7223
Published on মে 12, 2018প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে রোগীদের উন্নত চিকিৎসার দেয়ার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে রোগ নির্ণয়ের আধুনিক যন্ত্রপাতি পরিচালনার জন্য দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি নির্দেশ নিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘একটা বিষয় আমরা দেখি রোগ নির্ণয়ের (ডায়াগনসিস) ব্যাপারে কেন যেন কোথায় একটা বিরাট ভুল হয়ে যায়। যদিও যন্ত্রপাতি এখন অনেক উন্নত। তবে, সেগুলো পরিচালনার জন্য দক্ষ লোকের অভাব রয়েছে।’
প্রধানমন্ত্রী শনিবার সকালে রাজধানীর মুগদায় ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব অ্যাডভান্সড নার্সিং এডুকেশন এন্ড রিসার্চ (এনআইএএনইআর)-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে এ কথা বলেন।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘অনেক মডার্ন মেশিন এখন, সেগুলো চালানোর মত বা সেগুলি রিডিং করার মত বা সেগুলিকে দেখার মত সেই ধরনের স্কিলড মানুষ তৈরী করা প্রয়োজন।’
‘সেখানে কি করতে হবে, আমার মনে হয় আপনারা সেভাবেই ব্যবস্থা নেবেন। আপনারা উদ্যোগ নিয়ে কি করতে হবে বলেন, আমরা করে দেব। কোন অসুবিধা নাই,’ আশ্বস্ত করেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, এই বিষয়টার সুরাহা হওয়া দরকার নইলে আমাদের একজন কেউ রোগী হলেই দৌঁড়াতে হবে সিঙ্গাপুর দৌঁড়াতে হবে ব্যাংকক, থাইল্যান্ড, ইন্ডিয়া অমুক জায়গায়, কেন? আর তারা ভালভাবে যদি পারে, আমরা কেন পারবো না। এই প্রশ্নটাই বারবার আমার মনে হয়।
‘আমাদেরও পারতে হবে। সমমানের সমমর্যাদার চিকিৎসাসেবা আমরাও দিতে পারবো। সেই অভিজ্ঞতা, সেই শক্তিটা আমাদের অর্জন করতে হবে,’ বলেন তিনি।
স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী জাহিদ মালেক, কোইকা সহ-সভাপতি কিয়াংগুন সুল, কোইকার সাউথ এশিয়া এন্ড প্যাসিফিক অ্যাফেয়ার্স ব্যুরোর মহাপরিচালক ইয়ো ইয়ং কিং অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব মো. সিরাজুল হক খান স্বাগত বক্তৃতা করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, মানুষকে সেবা দেয়ার মনোভাবটাই হচ্ছে সব থেকে বড় কথা। কাজেই আমাদের নার্স, ডাক্তার এবং সংশ্লিষ্ট যারা তাদের মনে সবসময় এই কথাটাই থাকতে হবে- মানুষ যখন রোগী হয়ে আসে তখন ওষুধের থেকেও ডাক্তার নার্সদের ব্যবহার, তাদের কথাবার্তা এবং তাদের সহানুভূতিশীল মনোভাব থেকেই কিন্তু অর্ধেক রোগ ভাল হয়ে যেতে পারে। আর আন্তরিকতা ও দায়িত্ববোধটা এটাই সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ।
প্রধানমন্ত্রী এ সময় দেশে রোগীর তুলনায় ডাক্তার ও নার্সদের অপ্রতুলতার বাস্তবতা স্বীকার করে নিয়েই ডাক্তারদের একটু সংযত হবার পরামর্শ দেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এক্ষেত্রে আপনাদের একটু সংযত হতে হবে। দিনের বেলা সরকারি চাকরি করবেন। আর রাতে গিয়ে প্রাইভেট করবেন তারপরতো মেজাজ এমনিতেই খারাপ হবে, সেটা স্বাভাবিক। এক্ষেত্রে আমার মনে হয় আপনারা একটু হিসেব করে, যতটা ধারণ করতে পারেন ঠিক ততটাই করবেন।’
চিকিৎসা সেবা মানুষের দোরগোড়ায় নিয়ে যেতে সরকারি বেসরকারি উদ্যোগে সরকার হাসপাতাল করে দিচ্ছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী এসব হাসপাতালের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দিকে নজর দেয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট কতৃর্পক্ষের প্রতি নির্দেশ দেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘হাসপাতালগুলোর বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা থাকা উচিত। এটা কিন্তু এখনো আমাদের উন্নত হয় নাই। এদিকে বিশেষভাবে দৃষ্টি দিতে হবে। নইলে রোগতো ছড়াতেই থাকবে। এটা সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়বে।’
অনুষ্ঠানে মুগদায় নার্সিং ইনস্টিটিউট হওয়ার প্রেক্ষিতে সেখানে একটি মেডিকেল ইউনিভার্সিটি স্থাপনের জন্য স্থানীয় সংসদ সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরী দাবি তুললে প্রধানমন্ত্রী সাবের চৌধুরীকেই এখানে ব্যক্তিগত উদ্যোগে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের আহবান জানান।
বিভাগীয় শহরগুলোতে সরকারি উদ্যোগে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় করা হচ্ছে এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশের মত বাংলাদেশ ও এখন বেসরকারি খাতটাকেই উন্মুক্ত করা হচ্ছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী এখানে বেসরকারি উদ্যোগে বিশ্ববিদ্যালয় করা হলে সবরকম সহযোগিতা করবেন বলেও জানান।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, চিকিৎসা সেবায় নার্সিং একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই সেবা হওয়া উচিত বিশ্বমানের। এ দর্শন থেকেই ২০১০ সালে দক্ষিণ কোরিয়ায় রাষ্ট্রীয় সফরের সময় আমি কোরিয়ার প্রেসিডেন্টকে বাংলাদেশের নার্সিং শিক্ষা ও সার্ভিসের উন্নয়নে সহযোগিতার অনুরোধ জানাই। কোরিয়া সরকার কোইকা (কেওআইসিএ)-র মাধ্যমে বাংলাদেশে নার্সিং শিক্ষার মান উন্নয়নে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব অ্যাডভান্সড নার্সিং এডুকেশন এন্ড রিসার্চ’র (এনআইএএনইআর) নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করে।
তিনি বলেন, জানুয়ারি ২০১৬ থেকে মাস্টার্স ইন নার্সিং ও নার্সিং এর বিভিন্ন বিষয়ে রিসার্চ কোর্স চালু করা হয়। সেজন্য প্রধানমন্ত্রী কোরিয়া সরকার এবং কোইকা-কে আন্তরিক ধন্যবাদ জানান।
‘আমার বিশ্বাস, এই ইনস্টিটিউটের মাধ্যমে বাংলাদেশের নার্সিং শিক্ষা ও সেবার মান আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত হবে,’ -বলেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, তাঁর সরকার জাতির পিতার দর্শনকে ধারণ করে জনগণের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে গত ৯ বছরে স্বাস্থ্যখাতের উন্নয়নে ব্যাপক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা প্রণীত নার্স ও চিকিৎসকের অনুপাত ২:১ অর্জনের লক্ষ্য বাস্তবায়নের উদ্যোগ গৃহীত হয়েছে এবং ইতোমধ্যে নার্সদের পদ ২য় শ্রেণিতে উন্নীত করা হয়েছে।
বিদ্যমান ৭টি নার্সিং ইনস্টিটিউটকে কলেজে উন্নয়ন এবং নার্সিং পরিদপ্তরকে নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরে উন্নীত করা হয়েছে, বলেন প্রধানমন্ত্রী।
নার্স এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের কল্যাণে সরকারের নানা পদক্ষেপের উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকারি চাকুরিতে প্রবেশে সিনিয়র স্টাফ নার্স নিয়োগের বয়সসীমা ৩৬ বছর করা হয়েছে। ৩ বছর মেয়াদী ডিপ্লোমা ইন মিডওয়াইফারি কোর্সসহ ব্লেন্ডেড ওয়েব-বেইজড মাস্টার্স এবং পিএইচডি প্রোগ্রাম অন সেক্সুয়াল, রিপ্রোডাক্টিভ হেলথ এন্ড রাইটস কোর্স চালু করা হয়েছে এবং ২০ তলা বিশিষ্ট নার্সিং ও মিডওয়াইফারি ভবন নির্মাণ কাজ চলমান রয়েছে।
তিনি বলেন, আমরা এ পর্যন্ত মোট ১৫ হাজার ৪৪৫ জন সিনিয়র স্টাফ নার্স নিয়োগ প্রদান করেছি। আরও ৫ হাজার সিনিয়র স্টাফ নার্স এবং প্রায় ১ হাজার ২০০ জন মিডওয়াইফ নিয়োগের প্রক্রিয়া চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে।
স্বাস্থ্য সেবা বিস্তৃৃত করায় তাঁর সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকান্ডের উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ২ নম্বর ইউনিট, কুয়েত-মৈত্রী হাসপাতাল এবং জাতীয় নাক, কান, গলা ইনস্টিটিউটের কার্যক্রম চালু, গোপালগঞ্জে বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা মুজিব চক্ষু ইনস্টিটিউট, আগারগাঁওয়ে নিউরো সায়েন্স হাসপাতাল, বিভিন্ন মেডিকেল কলেজে বার্ন ইউনিট স্থাপন, হাসপাতালগুলোতে টেলিমেডিসিন সেবা সম্প্রসারণ এবং ট্রেনিং ইনস্টিটিউট এবং গাজীপুরে শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব মেমোরিয়াল বিশেষায়িত হাসপাতাল ও নার্সিং কলেজ স্থাপন করা হয়েছে।
চাঁনখারপুলে বিশেষায়িত ও অত্যাধুনিক ‘শেখ হাসিনা বার্ন ও প্লাষ্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট’ নির্মাণ কাজও শেষ পর্যায়ে বলেন তিনি।
তিনি বলেন, তাঁর সরকার গত ৯ বছরে নতুন ১৩ হাজার চিকিৎসক নিয়োগ দিয়েছে এবং আরও ১০ হাজার চিকিৎসক নিয়োগের লক্ষ্যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
সম্প্রতি বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের স্তরে উন্নীত হয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী ২০২১ সালে ক্ষুধা ও দারিদ্র মুক্ত মধ্যম আয়ের বাংলাদেশ এবং এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ গড়ে তোলায় তাঁর রাজনৈতিক অঙ্গীকারও ভাষণে পুনর্ব্যক্ত করেন।
প্রধানমন্ত্রী ১২ মে আধুনিক নার্সিং এর প্রবর্তক মহীয়সী নারী ফ্লোরেন্স নাইটিংগেলের জন্মদিন হওয়ায় তাঁকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন।
বক্তৃতার শুরুতেই প্রধানমন্ত্রী স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু-১ সফলভাবে মহাকাশে উৎক্ষেপণ হওয়ায় দেশবাসীকে অভিনন্দন জানান।
তিনি বলেন, ‘আজকে স্বাধীন জাতি হিসেবে আমরা মনে করি বিশ্ব দরবারে একটা উচ্চমর্যাদা পেয়েছি। স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু-১ এর মাধ্যমে পৃথিবীর ৫৭তম দেশ হিসেবে এখন আমরা অবস্থান করছি।’
শেখ হাসিনা বলেন, আজকে মহাকাশে আমাদের স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু-১ উৎক্ষেপণ করা হয়েছে অত্যন্ত সফলভাবে। বাংলাদেশ এখন মহাকাশে অবস্থান করছে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের জনগণ নৌকা মার্কায় ভোট দিয়ে এদেশের স্বাধীনতা অর্জন করেছে। আবার নৌকা মাকায় ভোট দিয়েছিল বলেই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করতে পেরেছে। আর সরকার গঠন করেই দেশের সার্বিক উন্নয়নে ব্যাপকভাবে কাজ করেছে। আর সেই কাজের ফলেই আমরা বাংলাদেশকে আজকে মহাকাশ পর্যন্ত নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছি। শুধু তাই নয়, আধুুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে বাংলাদেশ যাতে এগিয়ে যেতে পারে এবং এই স্যাটেলাইটের মাধ্যমে শুধু যে চিত্ত বিনোদন হবে তা নয়, এটা আমাদের সার্বিকভাবে কাজে লাগবে। এটাকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমরা ব্যবহার করতে পারবো।
স্যাটেলাইটের বিবিধ ব্যবহারের উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের শিক্ষা, বিনোদন, চিকিৎসা সেবা, আমাদেনর প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেতে শুরু করে বিভিন্ন ক্ষেত্রেই আমরা এখান থেকে তথ্য সংগ্রহ করতে পারবো। আর ডিজিটাল বাংলাদেশ যে আমরা গড়ে তুলেছি- সারা বাংলাদেশে সাবমেরিন কেবলের মাধ্যমে যে ইন্টারনেট সার্ভিস আমরা দিচ্ছি সেটা স্যাটেলাইটের মাধ্যমে আমাদের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে শুরু করে দ্বীপাঞ্চলে আমাদের এই সেবাটা পৌঁছে দিতে পারবো। এখন থেকে স্পেস অন্যান্য দেশগুলোকে ভাড়া দিয়ে আমরা বৈদেশিক মুদ্রাও অর্জন করতে পারবো। সেই সুযোগটাও আমাদের রয়েছে।