এসডিজি অর্জনে নারীর অবদানঃ আব্দুল লতিফ বকসী

3449

Published on এপ্রিল 23, 2018
  • Details Image

দেশের উন্নয়নে নারীর অংশগ্রহণ এবং অবদান এখন দৃশ্যমান। উন্নত বিশ্বের নারীদের মতো বাংলাদেশের নারীরাও শিক্ষা ও যোগ্যতা বলে নিজ নিজ অবস্থানে অবদান রেখে যাচ্ছেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও অফিস-আদালতে নজর দিলেই এর প্রমাণ মেলে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মেয়েদের সরব উপস্থিতি জানিয়ে দেয় বাংলাদেশের নারীরা এখন আর পিছিয়ে নেই। দেশের প্রতিটি কর্মক্ষেত্রেই নারীদের অংশগ্রহণ দেশের উন্নয়ন বেগবান করেছে। দেশের ব্যাপক উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে নিম্ন আয়ের দেশ থেকে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার সব শর্ত পূরণ করেছে। চলতি ২০১৮ সালের মার্চে নিম্নমধ্য আয়ের দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হবে বাংলাদেশ।

টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে অর্ধেক জনসংখ্যা নারীকে পেছনে রাখার সুযোগ নেই। নারীর ক্ষমতায়ন ও নারীর উন্নয়নে বর্তমান সরকারের অনেক অবদান রয়েছে। বাবা-মা এখন আর ছেলে-মেয়ের মধ্যে পার্থক্য খোঁজেন না। সমাজের মানুষের দৃষ্টিভিঙ্গও পরিবর্তন হতে শুরু করেছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কর্মস্থলে নারী-পুরুষের বৈষম্য কমেছে আগের তুলনায়। নারী-পুরুষ এখন সমান তালে কাজ করে যাচ্ছে। সবাই বিশ্বাস করতে শুরু করেছে নারী-পুরুষ কেউ কারো প্রতিপক্ষ নয়। একে অন্যকে সহযোগিতা করছে সব ক্ষেত্রে।

জাতিসংঘের ঘোষণা অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ সফলভাবে এসডিজি অর্জন করবে। সে পথেই দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। এর আগে বাংলাদেশ সফলভাবে এমডিজি অর্জন করে পুরস্কৃত হয়েছে। বাংলাদেশের উন্নয়ন বিশ^বাসীর কাছে রোল মডেল। বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হতে তিনটি শর্ত পূরণ করতে হয়েছে। প্রথমত, মাথাপিছু আয় ১ হাজার ২৪২ মার্কিন ডলার হতে হয়, বর্তমানে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ১ হাজার ৬১০ মার্কিন ডলার। দ্বিতীয়ত, মানবসম্পদের উন্নয়ন অর্থাৎ দেশের ৬৬ শতাংশ মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত হতে হয়, বর্তমানে বাংলাদেশের ৭০ শতাংশ মানুষের জীবনযাত্রার মানের উন্নতি হয়েছে। তৃতীয়ত, অর্থনৈতিকভাবে ভঙ্গুর না হওয়ার মাত্রা ৩০ শতাংশের নিচে হতে হয়, বাংলাদেশে এ মুহূর্তে তা ২৬ শতাংশ। বিশ্বের ইকোনমিক ও সোশ্যাল কাউন্সিল উল্লিখিত তিনটি বিষয় বিবেচনা করে কোনো দেশকে নিম্ন আয়ের থেকে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হওয়ার ঘোষণা দেয়। আগামী মার্চে এ কাউন্সিলের মূল্যায়ন কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হবে। সেখানে বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে ঘোষণার বিষয়টি আলোচিত হবে। আশা করা যায়, কাউন্সিল বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে ঘোষণা করবে। ফলে দেশ টেকসই উন্নয়নের পথে একধাপ এগিয়ে যাবে।

নারীর উন্নয়নে এবং সমাজে সর্বক্ষেত্রে পুরুষের সমান অবদান রাখতে সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন সংস্থাও কাজ করে যাচ্ছে। এ কারণেই অল্প সময়ের মধ্যে আমাদের দেশেও ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। একসময় নারীরা স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারত না, কর্মক্ষেত্রে কাজ করতে অনেক প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হতো। সামর্থ্য থাকার পরও আমাদের জনশক্তি কাজে লাগানোর সুযোগ ছিল না, অব্যবহৃত থাকত বিপুল জনশক্তি। শিক্ষার অভাবে আমাদের নারী সমাজ পিছিয়ে ছিল অনেক দূর। নারীদের অন্ধকার জগৎ থেকে আলোর জগতে আনার জন্য বেগম রোকেয়া আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছেন। কিন্তু তিনি তার প্রচেষ্টার সফলতা দেখে যেতে পারেননি। আজ নারীদের অবস্থার পরিবর্তন এসেছে। শিক্ষার হার বেড়েছে। দেশের সর্বক্ষেত্রে নারীর সরব উপস্থিতি সমাজ ও দেশের অর্থনীতিকে বদলে দিয়েছে। নারীরা এখন দেশের অর্থনীতির জন্য বোঝা নয়, সম্পদ। আজ দেশে এমন কোনো সেক্টর নেই, যেখানে নারীদের অবদান নেই। আমাদের জাতীয় সংসদের স্পিকার, সংসদ নেতা, বিরোধীদলীয় নেতা এবং সংসদ উপনেতা সবাই নারী। জাতীয় সংসদে শুধু সংরক্ষিত আসনেই নয়, পুরুষদের সঙ্গে সরাসরি ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে নির্বাচিত হয়ে জাতীয় সংসদে দক্ষতা ও যোগ্যতার সঙ্গে অবদান রাখছেন নারী।

দেশে বর্তমানে শিক্ষার হার ৬৩ দশমিক ৬ শতাংশ। মেধায় মেয়েরা ছেলেদের থেকে কোনো অংশেই কম নয়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে মেয়েরা ছেলেদের চেয়েও ভালো রেজাল্ট করছে। চাকরিক্ষেত্রে কোটার বাইরেও মেধার প্রতিযোগিতায় মেয়েরা পেছনে ফেলছে ছেলেদের। কর্মক্ষেত্রে নারীর কর্মনিষ্ঠা সবার কাছে প্রশংসিত। বাংলাদেশের রপ্তানির প্রধান খাত তৈরি পোশাক। উন্নত বিশ্বে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের বিপুল চাহিদা রয়েছে। এ শিল্পের প্রধান কারিগর নারী। প্রতিবছর বাংলাদেশ মোট ৩৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের পণ্য রপ্তানি করে থাকে। এর মধ্যে তৈরি পোশাক রপ্তানি করে ২৮ বিলিয়ন ডলারের বেশি। তৈরি পোশাকশিল্পে প্রায় ৪৫ লাখ শ্রমিক কাজ করেন, এর মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশ নারী। দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ এ শিল্পে নিয়োজিত। তারা ভাগ্য পরিবর্তনের পাশাপাশি দারিদ্র্য বিমোচনে ভূমিকা রাখছেন। গত আট বছরে দেশের দারিদ্র্যসীমা ৩৮ দশমিক ৪ থেকে কমে ২৩ দশমিক ২ শতাংশে নেমে এসেছে, ২০২১ সালে তা নেমে আসবে ১২ শতাংশে। মানুষের গড় আয়ু এখন প্রায় ৭১ বছর। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির হার এখন ৯৭ দশমিক ৯৪ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ঝড়ে পড়ার হার ৪০ দশমিক ২৯ থেকে কমে ২০ দশমিক ৪ শতাংশে নেমে এসেছে। মেয়েশিশুদের বিষয়ে আলাদা দৃষ্টি দেওয়ার কারণে স্কুলে তাদের ঝড়ে পড়ার সংখ্যা এখন খুবই সামান্য।

কর্মক্ষেত্রের সব পর্যায়েই নারীর অবদান সবার দৃষ্টি কেড়েছে। একসময় এনজিওতে নারীরা কাজ করলেও মানুষ বাঁকা চোখে তাকাত। আজ তারাই মেয়েদের কাজ করতে উৎসাহিত করছে। দক্ষতার সঙ্গে নারীরা সফলভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করে যাচ্ছেন। দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখছেন নারী। নারী উদ্যোক্তারা এখন ব্যবসা-বাণিজ্যে বিপ্লব ঘটিয়েছেন বাংলাদেশে। এসএমই লোনসহ নারী ব্যবসায়ীদের জন্য সরকার বিশেষ সুযোগ-সুবিধা অনেক ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেওয়ার কারণেই দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছেন নারী উদ্যোক্তারা। নারীদের ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প এখন দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশে বেশ জনপ্রিয়। দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনেও নারী ব্যবসায়ীদের অবদান অনেক। ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে উৎপাদিত পণ্য বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে রপ্তানি হচ্ছে। নারীঘন এ শিল্প এখন দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে নারীর কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে। বিপুলসংখ্যক গ্রামের নারী এখন জাতীয় উৎপাদনে অবদান রাখার সুযোগ পাচ্ছেন। আর্থসামাজিক উন্নতি হচ্ছে দ্রুতগতিতে।

বর্তমান সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর যুগান্তকারী উদ্যোগ ‘একটি বাড়ি, একটি খামার’ প্রকল্প দেশে নারী জাগরণে বিপ্লব ঘটিয়েছে। এর মাধ্যমে নারীরা সংসারের স্বাভাবিক কাজের মধ্যে নিজেদের উন্নয়নের মাধ্যমে জাতীয় উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রেখে চলেছেন। কাজের সুফল এখন দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের নারীরাও ভোগ করছেন। নারীদের আয় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়েছে, সচেতনতা বেড়েছে, দায়িত্বশীলতা বেড়েছে। গ্রামের নারীরাও এখন আর অবহেলিত বা নির্যাতিত নন, যা একটি জাতির উন্নয়নের জন্য খুবই জরুরি। একসময় নারীরা অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে ভয় পেতেন। আজ সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন এসেছে। নারীরা সুশিক্ষার কারণে ন্যায়-অন্যায় বুঝতে শিখেছেন, এখন আর কোনো নারী নীরবে অন্যায় সহ্য করেন না, প্রতিবাদ করেন।

নারীদের সুরক্ষায় সরকার প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন ও সামাজিক সুরক্ষার ব্যবস্থা করেছে। বাল্যবিয়ের হার কমেছে। কাজ করে কম মজুরি দেওয়া বা নারীদের ইচ্ছামতো ব্যবহার করার সুযোগ আর নেই। সঙ্গত কারণেই দেশে নারী নির্যাতনের ঘটনা কমেছে উল্লেখযোগ্য হারে। নারী নির্যাতন হলেও তার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিকার পাওয়ার কারণে প্রতিবাদের হার বেড়েছে। থানায় নারী ও শিশু ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। নারী ও শিশু নির্যাতনবিরোধী আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। ফলে এখন এ ধরনের অপরাধপ্রবণতা কমে এসেছে। কোনো ঘটনা ঘটলেই সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে অতি অল্প সময়ের মধ্যে তার বিচার হচ্ছে। এটি একটি সভ্য সমাজের জন্য খুবই জরুরি।

নারীরা এখন বিদেশে গিয়ে কাজ করে দেশে টাকা পাঠাচ্ছেন। পৃথিবীর অনেক দেশেই নারী কর্মীদের বিপুল চাহিদা রয়েছে। জনশক্তি রপ্তানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বে অন্যতম। এক কোটির বেশি জনশক্তি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কর্মরত। রেমিট্যান্স থেকে আয় এখন ১৪ বিলিয়নের বেশি। নারী কর্মীদের আগ্রহের কারণে বিদেশে যাওয়ার ক্ষেত্রে সরকার বিশেষ সুযোগ-সুবিধা প্রদান করছে। নারীরা যাতে প্রতারিত না হন, হয়রানির শিকার না হন সে জন্য তাদের সহায়তা ও বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে, আর্থিক সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণে বিদেশে বাংলাদেশে নারী কর্মীদের সংখ্যা বেড়েই চলছে। ১৯৯১ সালে ১৭৯ জন নারী কর্মীকে বিদেশে পাঠানোর মধ্য দিয়ে নারী জনশক্তি রপ্তানি শুরু হয়। গত বছরে বিদেশে নারী কর্মী গেছে প্রায় আট লাখ।

ইউনিয়ন পরিষদ থেকে মহান জাতীয় সংসদ সব জায়গায় নারীর প্রত্যাশিত অংশগ্রহণ নতুন যুগের সূচনা করেছে। বিশেষ করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নারীদের উপস্থিতি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে শক্তিশালী ও সমৃদ্ধ করেছে। সরকার নারী শিক্ষা প্রসারে বিশেষ সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। বিনামূল্যে লেখাপড়ার সুযোগের পাশাপাশি উপবৃত্তি দেওয়া হচ্ছে। ফলে নারী শিক্ষা উন্নয়নে বিপ্লব সৃষ্টি করেছে। দেশে-বিদেশে কর্মক্ষেত্রে নারী তাদের দক্ষতা, মেধা ও বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছেন। নারীর কাজের পরিবেশ, মূল্যায়ন ও উৎসাহ অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশের নারীরা অনেক এগিয়ে যাবেন। বাংলাদেশ টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে নারী-পুরুষ সম্মিলিতভাবে এগিয়ে যেতে হবে। আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে জাতিসংঘ ঘোষিত এসডিজির সফল বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ এগিয়ে যাওয়ার নতুন মাত্রা যুক্ত করবে। আর সে জন্য দেশের নারী-পুরুষকে কাজ করতে হবে একসঙ্গে।

সৌজন্যেঃ আমাদের সময়

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত