5643
Published on এপ্রিল 11, 2018দেশের রাজনীতির হালচাল বোঝা কঠিন। তবে এটা বুঝতে পারছি এখন আর বিএনপি সুবিধা করতে পারবে না। পারছে না এটা যেমন সত্য আর সহজে পারবে বলেও মনে হয় না। এর কারণ বোঝা কঠিন না। সাঁড়াশি আক্রমণের মুখে পড়ে দলটির বারোটা বেজেছে। এর জন্য তারা ওয়ান-ইলেভেন বা আওয়ামী লীগকে দায়ী করলেও মূলত এর কারণ তাদের দলের আদর্শহীনতা। বিএনপি শুরু থেকে এক ধরনের সুবিধা ভোগ করে আসছিল। সেই সুবিধা যে চিরকালীন না সেটাই তারা বোঝেনি।
বঙ্গবন্ধু হত্যার পর চার জাতীয় নেতার মর্মান্তিক মৃত্যুতে হতবিহ্বল বাংলাদেশ আর আজকের বাংলাদেশ এক নয়। যে প্রজন্ম বঙ্গবন্ধু বা তাঁর সহকর্মীদের হত্যা করে পাকিস্তান ফিরিয়ে আনা কিংবা ছায়া পাকিস্তান তৈরির চেষ্টা করেছিল তারা আজ বিগত। তাদের একজন মুক্তিযোদ্ধা বা পথহারা সেনানায়কের দরকার ছিল। সে দরকার আজ ফুরিয়েছে। আজকের বাংলাদেশে ভারত বিরোধিতা যত প্রকট হোক না কেন তার সঙ্গে তখনকার সময়ের মিল নেই। প্রতিশোধ নেয়ার রাজনীতি মুক্তিযুদ্ধকে ছাড় দেয়নি বটে আজ সেও নির্মম ঐতিহাসিক প্রতিশোধে মৃতপ্রায়। খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত যে ক্যারিশমা আর দলের যে রমরমা হাল তাও অস্তমিত।
তারা সব সময় বলেন সাইলেন্ট মেজরিটিতে তারা এগিয়ে। অস্বীকার করি না। কিন্তু সে মেজরিটিতে এক শতাংশও বুদ্ধিবৃত্তি নেই। কোনো দেশ বা দেশের সরকার কেবল সাধারণ নামে পরিচিত মানুষের ইচ্ছায় চলে না। চললে আগে বিএনপি যখন যেভাবে খুশি চলত তাও তারা পারত না। কারণ তখন আওয়ামী লীগের দিকে মানুষের সহানুভ‚তি বঙ্গবন্ধু ও ইতিহাসের ফিরে আসার জন্য মানুষের প্রাণ কাঁদলেও তারা গদিজুড়ে আরাম করেই বসেছিল। কারণ তখন সাধারণের বাইরে যে প্রশাসন, সামরিক-অসামরিক আমলাতন্ত্র সবাই তাদের চাইত। সে সময় আজ গত। ওয়ান-ইলেভেন এমনি এমনি তৈরি হয়নি। খালেদা জিয়ার বড় ছেলে আর তার সাগরেদদের যে অত্যাচার সেটা মানুষ ভোলেনি। মানুষ তো আমজনতা তারা প্রশাসন এমনকি সেনাবাহিনীকেও রাগিয়ে তুলেছিল। সে ক্রোধের নমুনা আমরা দেখেছি। মূলত তখন থেকেই তারেক জিয়া ও বিএনপির অধঃপতনের শুরু। বিএনপির বর্তমান নেতারা জানলেও মানেন না যে, মানুষ এখন আর সেসব সময়ে ফিরতে চায় না। অথচ বর্তমান সরকারের মন্ত্রী-আমলারা এমন কোনো শুভ কাজ বা ভালো কিছু করছেন না যাতে মানুষ তাদের মাথায় তুলে রাখবে। মূলত এরা সরকারের ভাবমূর্তি আর অর্জনকেই মাঝে মাঝে হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছেন। তারপরও মানুষ কেন বিএনপির জন্য মাঠে নামেনি?
এর উত্তর সে দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা খুব ভালো জানেন। মানুষের জীবনে এক আশ্চর্য পরিবর্তন এনে দিয়েছে সময়। অতীতের যাবতীয় ভুল আর ভ্রান্তি বহন করার পরও বাংলাদেশ আজ বিশাল এক শক্তির প্রতীকে পরিণত হতে চলেছে। আমরা যারা বিদেশে থাকি সবাই দেখছি কীভাবে বদলে যাচ্ছে আমাদের জাতি ও দেশের ইমেজ। শুধু বড় বড় কথা আর প্রতিবেশীদের সঙ্গে ঝগড়ার নামে তলে তলে দাসখত দিয়ে এগুনো যায় না। খালেদা জিয়ার সে বয়স বা দলের ভেতর সে উন্মাদনাও আর নেই। দায়সারা আবেগনির্ভর রাজনীতি থেকে মুক্ত সমাজের নেতা শেখ হাসিনা আজ তার দলকে ফেলে এগিয়ে গেছেন। তার উদ্যম, তার দেশবোধ, তার বর্তমান কনফিডেন্স একজন নেতার ভেতরও নেই। এটা তিনি একদিনে অর্জন করেননি। জীবন তাকে যে বেদনা ও দুঃখ উপহার দিয়েছে সে কষ্টগুলো তিনি মনে পুষে দুঃখী হওয়ার পরিবর্তে কাজে লাগিয়ে আজ এই জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছেন। যতই প্রগলভ বা বেশি কথার জন্য তাকে দায়ী করি না কেন তিনি না থাকলে বাংলাদেশের এই স্থিতাবস্থা ও অগ্রগতি সম্ভব হতো না। ফলে প্রশাসন সরকার দেশ-বিদেশের প্রতিষ্ঠান ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডল মিলে এখন যে জয়রথ তাতে বিএনপির ঠাঁই নেই। তারা ঠাঁই করে নেয়ার রাজনীতি করছেনও না। ফলে খালেদা জিয়ার কারাগার মুক্তির জন্য ছোট ছেলের বৌয়ের পারিবারিক উদ্যোগ তাদের দিক থেকে বেঠিক কিছু না।
কোথাকার পানি কোথায় গড়াচ্ছে? খবরে দেখলাম বিএনপি মহাসচিব হাসি হাসি মুখে বলছেন তারা আসন্ন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নেবেন। এটা গণতন্ত্রের জন্য সুসংবাদ বৈকি। কিন্তু খটকা থেকে যাচ্ছে। তাদের নেত্রী খালেদা জিয়া এখন কারাগারে। এমন বাস্তবতা হজম করা বিএনপির কথা ছিল না। এই দল কয়েকবার সরকারে থাকা এক শক্তিশালী দল। তৃণমূলে জনপ্রিয় নামে পরিচিত দলটির জন্ম সামরিক ছাউনিতে। একদা তাদের চ্যালেঞ্জ জানানোর মতো কেউই ছিল না প্রায়। সে জায়গা থেকে তাদের আপসহীন নামে পরিচিত নেত্রী খালেদা জিয়া আজ কারাগারে। তাকে মুক্ত করার আন্দোলন দূরে থাক সহানুভ‚তি জন্মানোর মতো কাজও দলটি করতে পারছে না। তাদের সাংগঠনিক ভিত্তি যে এতটা দুর্বল সেটা আগে বোঝা যায়নি। যারা এখন নেতৃত্বে তারা গদিনসীন ভদ্রলোক হলেও এদের মাঠে নামার অভ্যাস কম। তাই স্বভাবতই প্রশ্ন উঠছে কি হচ্ছে আসলে?
মির্জা ফখরুল যে নির্বাচনে যাওয়ার কথা বললেন সেই দৃশ্যে একটা বিষয় বেশ দেখার মতো। একেবারে শেষদিকে এসে দায়সারা গোছের বা বলতে হবে বলে বললেন, এটা নাকি আন্দোলনের কৌশল। বিষয়টা কৌতুকের মতো শুনিয়েছে। ইতোমধ্যে তিনি খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করতে ব্যর্থ হলেও প্রয়াত আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী এসে দেখা করে গিয়েছেন। তা ছাড়া সরকার বা প্রশাসনের যে দৃষ্টিভঙ্গি তাতে এটা বোঝা যায় খালেদা জিয়া এমন কোনোভাবে মুক্ত হতে পারবেন না যাতে তাকে ঘিরে জনমত গড়ে ওঠে কিংবা তিনি তা নিয়ে রাজনীতি করে সহানুভ‚তি কুড়োতে পারবেন। ফলে আরো অনেক বিষয় এখন বাজারে আছে। যার কিছু সত্য মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক।
আসলে কি হচ্ছে পর্দার অন্তরালে? জোর গুজব বিএনপির কিছু নেতা বেরিয়ে নতুন দল বা একই নামে নির্বাচনে যাবেন। কথাটা ফখরুল সাহেব প্রকারান্তরে সমর্থন করেছেন। খবরে দেখলাম তিনি বলেছেন, কিছু নেতা বেরিয়ে গেলেও কর্মীরা যাবেন না। এই আগাম কথায় কিসের ইঙ্গিত?
পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতিতে আমরা কি দেখছি এখন? খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতেও দল কিছু করতে পারছে না। রাজনীতি পারছে না কদম ওঠাতে। এটা ভারতেও হয়েছিল। সঞ্জয় গান্ধীর কথামতো চলতে গিয়ে বিপাকে পড়া ইন্দিরাজি শুধু গদি না দলও হারিয়েছিলেন প্রায়। এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল কংগ্রেসের দীর্ঘ সময়ের প্রতীক গরুবাছুর বাদ দিয়ে হাত মার্কা নিয়ে লড়তে হয়েছিল তাকে। সে সময় থেকে মানেকা গান্ধী আর বরুণ ছিটকে পড়তে পড়তে পরে এক সময় তারা দল ঘরবাড়ি পরিবার ছেড়ে একা হয়ে গেল। সামনে চলে এল বড় ছেলে রাজিব গান্ধী ও তার পরিবার। আজ অবধি সে রাহুল আর তার মা-ই হাল ধরে আছেন দলের। বিএনপি কি তবে তেমন কোনো জায়গায় যাচ্ছে? তারেক জিয়া ও তার স্ত্রী কি ছিটকে পড়বে দৃশ্যপটে আসবে কনিষ্ঠ পুত্রবধূ? তবে কি এটাই সত্য।
ক্লান্ত পরিশ্রান্ত খালেদা জিয়া আরো কিছু সরকারপ্রধানের মতো বিদেশ চলে যাচ্ছেন? এমন বাস্তবতা অস্বাভাবিক কিছু না। বিএনপি আন্দোলন জমাতে পারবে না। তাদের আদর্শ বা সংগঠন কোনোটাই এখন আর কাজ করছে না। শুধু সাইলেন্ট মেজরিটির ওপর ভর করে খালেদা জিয়ার মুক্তি অসম্ভব। ফলে নেতারা যদি এসব বুঝে দলকে নতুনভাবে পরিচালনা করে নিজেরা টিকে থাকার রাজনীতি করেন অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না। বিএনপি এ দেশ ও ইতিহাসের ধারা মানেনি। মানেনি শহীদ ও মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান। মানেনি বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর মতো করুণ বিষাদময় ঘটনা। তবে কি সেই পাপ আজ তাড়া করে ফিরছে তাদের?। বাকিটা সময়ের হাতে।