8400
Published on এপ্রিল 10, 2018কথায় আছে রাজনীতিবিদদের ক্ষেত্রে ক্ষমতা আর কারাগারের দূরত্ব কয়েক হাত। এই উপমহাদেশের ক্ষেত্রে কথা কয়টি বহুলাংশে সত্য। রাজনীতি করে ক্ষমতার শীর্ষে গেছেন, কিন্তু কখনো কারাদণ্ড ভোগ করেননি, তেমন ভাগ্যবান মানুষ সম্ভবত পুরো উপমহাদেশে দুজন আছেন। প্রথমজন পাকিস্তানের জন্মদাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, আর দ্বিতীয়জন বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা এবং বাংলাদেশের প্রথম সেনাশাসক জেনারেল জিয়া। ঐতিহাসিকরা একমত, ভারতকে দ্বিখণ্ডিত করার জন্য ব্রিটিশরা জিন্নাহকে সৃষ্টি করেছিল। এই কথার সত্যতা মেলে পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সাবেক প্রধান, বর্তমানে প্রয়াত খান আবদুল ওয়ালী খানের গবেষণাধর্মী বই ‘Facts are Facts’ পড়লে। ওয়ালী খান সীমান্ত গান্ধী বলে পরিচিত খান আবদুল গাফ্ফার খানের পুত্র। সীমান্ত গান্ধী আরো অনেক মুসলমান নেতার মতো ভারত ভাগের বিপক্ষে ছিলেন। ১৯৪৬ সালে ভারতজুড়ে যে সাধারণ নির্বাচন হয়, তাকে মনে করা হয় পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য অনানুষ্ঠানিক গণভোট। সেই গণভোটে বর্তমান পাকিস্তানের কোনো প্রদেশই পাকিস্তানের পক্ষে ভোট দেয়নি। একমাত্র অবিভক্ত বাংলা মুসলিম লীগের পক্ষে ভোট দিয়েছিল, বলেছিল আমরা পাকিস্তান চাই। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে হত্যা করার পর জিয়া ক্ষমতা দখল করে প্রথমে সামরিক শাসক ও পরে প্রেসিডেন্টের পদটি দখল করেছিলেন। রাজনীতির সঙ্গে তাঁর কোনো সম্পর্ক ছিল না। সরদার ফজলুল করিম ও অধ্যাপক নূরুল ইসলামকে দেওয়া উপপ্রধানমন্ত্রী মশিউর রহমান যাদু মিয়ার (একসময় ভাসানী ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন এবং তাঁর বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে রসদ সরবরাহের অভিযোগ আছে) বড় ভাই মোখলেসুর রহমানের (সিধু মিয়ার) সাক্ষাৎকারভিত্তিক রচনায় জিয়াউর রহমানের ‘রাজনীতিবিদ’ হয়ে ওঠার এক চমকপ্রদ বর্ণনা আছে (প্রতিচিন্তা, অক্টোবর-ডিসেম্বর, ২০১৪)। জিয়া একজন পেশাদার সৈনিক ছিলেন, তবে বাংলাদেশের ষড়যন্ত্রের রাজনীতিতে তাঁর সমতুল্য অতীতেও কেউ ছিলেন না, ভবিষ্যতেও কারো আবির্ভাব হবে তার সম্ভাবনা ক্ষীণ। এই দুই ব্যক্তি কারাগার কী জিনিস তা কখনো দেখেননি। রাজনৈতিক কারণে জেলে গিয়েছেন মিসরের জাতীয়তাবাদী প্রেসিডেন্ট জামাল আবদেল নাসের, স্বাধীন ইন্দোনেশিয়ার জাতির পিতা আহম্মেদ সুকর্ন, স্বাধীন আলজেরিয়ার জনক আহমেদ বেন বেল্লা, ভিয়েতনামের প্রবাদপুরুষ হো চি মিন (চীনে গুপ্তচরবৃত্তির দায়ে অভিযুক্ত)। দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা দীর্ঘ ২৭ বছর কারাদণ্ড ভোগ করেছেন। উপমহাদেশে মহাত্মা গান্ধী, জওয়াহেরলাল নেহরু, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী আর আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু বছরের পর বছর কারাদণ্ড ভোগ করেছেন। কেউ বিনা বিচারে আর কেউবা বিচারের নামে প্রহসনের শিকার হয়ে। তাঁদের প্রায় সবাই কারাজীবন নিয়ে অসামান্য সব স্মৃতিকথা লিখে রেখে গেছেন। বলা হয়, একজন রাজনৈতিক বন্দি লেখক না হয়েও কারাগারে গেলে বেশ বড় মাপের লেখক হয়ে উঠতে পারেন। কারাগারে থাকাকালে নেহরুর লেখা ‘The Discovery of India’ I ‘Letters from Father to Daughter’ দুটি অসামান্য গ্রন্থ, যদিও এই বই দুটি ঠিক কারাস্মৃতি নয়। কারাগারে বঙ্গবন্ধুর লেখা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ (নামকরণ বঙ্গবন্ধুর বড় কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা) আর ‘কারাগারের রোজনামচা’ (বঙ্গবন্ধু নামকরণ করেছিলেন ‘লোটা, বাটি, কম্বল, জেলখানার সম্বল’। বর্তমান নামটিও শেখ হাসিনার দেওয়া) বঙ্গবন্ধুর আত্মত্যাগ ও স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পেছনের করুণ ইতিহাস। এই রাজনৈতিক ব্যক্তিদের লেখা, তাঁদের রচনা পড়লে বোঝা যায় কারাজীবনের প্রতিদিনের একটি চিত্র। তাঁরা সবাই রাজনৈতিক কারণে কারাবরণ করেছেন কোনো দুর্নীতি বা ক্ষমতার অপব্যবহারের দায়ে বা ফৌজদারি মামলায় দণ্ডিত হয়ে নয়, যেমনটি হয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম জিয়া। তবে সম্প্রতি দক্ষিণ কোরিয়ার ক্ষমতাচ্যুত রাষ্ট্রপতি পার্ক গিউন হাই ক্ষমতার অপব্যবহারের দায়ে ২৪ বছরের সাজাপ্রাপ্ত হয়ে জেলে গেছেন। দুর্নীতির দায়ে ১২ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছেন ব্রাজিলের সাবেক জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট লুই ইনাসিও লুলা। ক্ষমতার অপব্যবহারের দায়ে সাজাপ্রাপ্ত হয়ে ভারতের কিংবদন্তিতুল্য প্রধানমন্ত্রী কারাগারে গিয়েছিলেন। একই অপরাধে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো শুধু কারাগারেই যাননি, ফাঁসিতেও ঝুলতে হয়েছে তাঁকে। ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব তাঁর দুই কন্যাকে নিয়ে গৃহবন্দি ছিলেন। ২৭ জুলাই ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের একটি স্যাঁতসেঁতে কেবিনে সজীব ওয়াজেদ জয়ের জন্ম হয়। বাইরে পাকিস্তানি সেনা প্রহরা। বেগম মুজিবের তাঁর কন্যাকে দেখতে যাওয়ার অনুমতি ছিল না। অনেক বাগিবতণ্ডা করে বেগম সুফিয়া কামাল ও মিসেস নার্গিস জাফর মাঝেমধ্যে শেখ হাসিনা ও নবজাতককে দেখতে যেতেন। বর্তমান প্রজন্ম এসব ইতিহাস কখনো জানতে পারে না।
গত ৮ ফেব্রুয়ারি বিচারিক আদালত বেগম জিয়াকে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় দুর্নীতির দায়ে পাঁচ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেছেন। যদিও আদালতের এখতিয়ার ছিল আরো বেশি দণ্ড দেওয়ার, বেগম জিয়ার শারীরিক অবস্থা ও বয়স বিবেচনা করে অন্য দণ্ডিতদের তুলনায় কম দণ্ড দিয়েছেন। বেগম জিয়া বর্তমানে নাজিমুদ্দীন রোডের পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারে বিশেষ সেলে আছেন। বেগম জিয়ার কারাদণ্ড নিয়ে দেশে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিদেশেও বেশ রাজনীতি আর অপরাজনীতি হচ্ছে। এসব কর্মকাণ্ডে যেমন জড়িত আছেন বিএনপির নেতারা, তেমনি জড়িত আছেন দেশের ‘সুশীল’ নামধারী কিছু ব্যক্তি, আর এক শ্রেণির মিডিয়া। বেগম জিয়ার কারাদণ্ডে দণ্ডিত হওয়াকে কেন্দ্র করে লন্ডনে বাংলাদেশ দূতাবাসে বিএনপির কর্মী নামধারী কিছু দুর্বৃত্ত কিছুদিন আগে জোরপূর্বক প্রবেশ করে ভাঙচুর করেছে, বঙ্গবন্ধুর ছবির অপমান করেছে। আর দুঃখের বিষয় হচ্ছে, ব্রিটিশ পুলিশ দূতাবাসের নিরাপত্তা দিতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। এমন ঘটনা বাংলাদেশে ঘটলে ব্রিটিশ সরকার একটা তুলকালাম কাণ্ড ঘটিয়ে দিত। বিএনপি তাদের চেয়ারপারসনের দণ্ড নিয়ে রাজনীতি বা অপরাজনীতি করবে তা স্বাভাবিক। তবে প্রতিদিন দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রুহুল কবীর রিজভী সংবাদ সম্মেলনের নামে যা করেন আর বলেন, তাতে তিনি তাঁর রাজনৈতিক অতীতকে চরমভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলেছেন। তিনি বুঝতে পারেন না, তাঁর কোনো বক্তব্যই কেউ আর গুরুত্ব দিয়ে নেন না। বাংলাদেশের রাজনীতি এমন পর্যায়ে গেছে যে কয়েকটি প্রিন্ট মিডিয়া ও একদল ‘সুশীল’ ব্যক্তি পারলে ছলে-বলে-কৌশলে এখনই শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করে বেগম জিয়াকে ক্ষমতায় বসান। এরাই মূলত এক-এগারোর আগে তথাকথিত মাইনাস টু, যা বাস্তবে ছিল মাইনাস ওয়ান (শেখ হাসিনা) ফর্মুলার জনক। বেগম জিয়া বেশ ভাগ্যবান, কারণ তাঁর স্বামী ও তাঁর মেয়াদকালে যাঁরা কারাগারে নিক্ষিপ্ত হয়েছিলেন, তাঁরা কেউ তাঁর মতো ভাগ্যবান ছিলেন না। জিয়া ক্ষমতা দখল করে যাঁদের প্রথমেই গ্রেপ্তার করে জেলে পোরেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বোস প্রফেসর ড. আবদুল মতিন চৌধুরী। তাঁর অপরাধ, তিনি ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংবর্ধনা দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। এই স্বনামধন্য বিজ্ঞানী ১৭ মাস বিনা বিচারে কারাভোগ করেছেন। একইভাবে কারাগারে পুরেছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মাজহারুল ইসলামকে। বেগম জিয়ার শাসনকালে বোমা ফুটল ময়মনসিংহে। বোমাবাজির দায়ে ঢাকায় গ্রেপ্তার হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ ড. মুনতাসীর মামুন, ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির। ড. মামুনকে নিয়ে যাওয়া হলো দিনাজপুর জেলে। তখন শীতকাল। দিনাজপুরের ঠাণ্ডা শীতকালে ৪ ডিগ্রি পর্যন্ত নেমে আসে। দিনাজপুর কারাগারে কোনো ডিভিশন দেওয়ার ব্যবস্থা নেই। ড. মামুন কারা কর্তৃপক্ষকে জানালেন, তাঁর শারীরিক সমস্যা আছে। কারা কর্তৃপক্ষ নিরুপায়, কারণ কারা ফটকের ওপর কোনো পর্দা বা আবরণ দেওয়ার নিয়ম নেই। ঠাণ্ডা বাতাস প্রবেশে কোনো বাধা নেই। আওয়ামী লীগ নেতা সাবের হোসেন চৌধুরীকে ফেরি থেকে ১০টি প্লেট চুরির অপরাধে কারাগারে নিক্ষেপ করা হলো। সাবেক বিমানবাহিনীর প্রধান জামাল উদ্দিনকে ঘড়ি চুরির অপরাধে অভিযুক্ত করা হলো। সাংবাদিক এনামুল হক চৌধুরীকে (বর্তমানে ডেইলি সানের সম্পাদক) মিথ্যা সংবাদ পরিবেশনের দায়ে গ্রেপ্তার করে কারাগারে নিক্ষেপই শুধু করা হয়নি, তাঁর ওপর যে নির্যাতন চালানো হয়েছিল তার ফলে তিনি অনেক দিন স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারেননি। তাঁদের কারো সামাজিক অবস্থান বেগম জিয়ার চেয়ে কোনো অবস্থায়ই নিচে নয়। বেগম জিয়া শুধু একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান ও দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তাঁরা কেউ রায়ে দণ্ডিত হননি। উদ্দেশ্যমূলকভাবে তাঁদের আটক করা হয়েছিল। আদালতের আদেশে ছাড়া পেয়েছিলেন। জেনারেল জিয়া বা তাঁর স্ত্রীর শাসনামলে বর্তমানে সরব ‘সুশীল’দের টুঁ শব্দ করতে দেখা যায়নি।
অনেক ‘সুশীল’ প্রশ্ন করেন, এক-এগারোর পর বেগম জিয়া গ্রেপ্তার হলে তিনি যদি ব্যক্তিগত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়ার সুযোগ পান, এখন পাবেন না কেন? এই ‘সুশীল’রা বুঝতে পারেন না অভিযুক্ত হওয়া এক জিনিস আর দণ্ডিত হওয়া অন্য জিনিস। একবার দণ্ডিত হলে যেকোনো আসামিকে কারা বিধি অনুযায়ী চলতে হয়। এক-এগারোর পর বেগম জিয়া ও শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তার করে বিচারের প্রহসন মঞ্চস্থ হয়েছিল, কোনো রায় হয়নি। বেগম জিয়ার বিজ্ঞ আইনজীবীরা বলেন, বেগম জিয়াকে আসন্ন নির্বাচন থেকে দূরে রাখতে বিচারকাজ তড়িঘড়ি করে করা হয়েছে। কী অসত্য তথ্য। ১০ বছর কোনো ফৌজদারি মামলা চলে, তা যেকোনো বিচারেই নজিরবিহীন। নানা অজুহাতে তখন বেগম জিয়া আদালতে হাজির হননি। ক্ষতি হয়েছে তাঁর। এখন ঠিক একই কৌশলের আশ্রয় নিয়েছেন বেগম জিয়া ও তাঁর আইনজীবীরা। এতেও ক্ষতি তাঁর। বেগম জিয়া তাঁর সার্বক্ষণিক গৃহপরিচারিকা ফাতেমাকে সঙ্গে রাখার সুযোগ পেয়েছেন। সার্বক্ষণিক চিকিৎসক আর নার্স আছেন। যত দূর জানা গেছে, তাঁর সেলটি ফুল ফারনিশড, টিভি আর এসিও আছে। তবে তিনি যে কোটি টাকার আসবাবপত্র ব্যবহারে অভ্যস্ত তা থেকে হয়তো তিনি বঞ্চিত। তবে এটা তো মেনে নিতে হবে, কারাগার কোনো ফাইভ স্টার হোটেল নয়। তাঁর দলের নেতারা দাবি করেছেন, বেগম জিয়া অসুস্থ, যা এই বয়সে স্বাভাবিক। আর তিনি যে আগে থেকেই কিছু শারীরিক সমস্যায় ভুগছেন তা দেশের মানুষ জানে। সরকার একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন মেডিক্যাল টিম পাঠিয়েছে তাঁর স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য। চিকিৎসক দল তাঁকে কিছু ওষুধ দিয়েছে, কিন্তু তিনি তা সেবন করতে অস্বীকার করেছেন। বলেছেন, তিনি তাঁর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ছাড়া কারো কোনো পরামর্শে ওষুধ সেবন করবেন না। এমনও নাকি তিনি বলেছেন, তিনি তাঁর পুত্রবধূ ডা. জোবাইদা রহমানের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ সেবন করবেন। এর জন্য হয় ডা. জোবাইদা রহমানকে লন্ডন থেকে দেশে আসতে হবে, অথবা বেগম জিয়াকে প্যারলে মুক্ত হয়ে লন্ডন যেতে হবে। তাঁকে এই সুযোগ দেওয়া হবে কি না তা নির্ধারণ করবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, কারা কর্তৃপক্ষ অথবা উচ্চ আদালত।
যেকোনো দেশে ‘সুশীল’ গোষ্ঠী থাকাটা ভালো। তবে তাঁরা ন্যায়ের পক্ষে কথা বলবেন তা-ই প্রত্যাশিত। বাংলাদেশের ‘সুশীল’ সমাজ এর কিছুটা ব্যতিক্রম। তাদের একটি বড় অংশের কর্মকাণ্ড ঠিক ‘সুশীল’ নয়, আপত্তিকর। বেগম জিয়া এই বয়সে জেলে থাকুক তা কাম্য ছিল না। তাঁর এবং তাঁর পুত্রের কর্মফলই তাঁকে এই পরিস্থিতিতে ঠেলে দিয়েছে। এখান থেকে দ্রুত তিনি বের হতে পারবেন কি না তা নিয়ে সন্দেহ আছে। কারণ তাঁকে আরো বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মামলা মোকাবেলা করতে হবে। বিএনপির নেতারা যতই বলুন বেগম জিয়া ছাড়া তাঁরা নির্বাচনে যাবেন না, তা শেষ পর্যন্ত ঠিক থাকবে না। নির্বাচনে তাঁরা ঠিকই যাবেন। কারণ সিদ্ধান্ত আসবে লন্ডন থেকে। আর তারেক রহমানের অনেক টাকার প্রয়োজন। একবার তিনি বাংলাদেশের বিল গেটস হতে চেয়েছিলেন। মনোনয়ন বাণিজ্য বিনা পুঁজিতে বেশ লাভজনক বাণিজ্য।
কথায় আছে রাজনীতিবিদদের ক্ষেত্রে ক্ষমতা আর কারাগারের দূরত্ব কয়েক হাত। এই উপমহাদেশের ক্ষেত্রে কথা কয়টি বহুলাংশে সত্য। রাজনীতি করে ক্ষমতার শীর্ষে গেছেন, কিন্তু কখনো কারাদণ্ড ভোগ করেননি, তেমন ভাগ্যবান মানুষ সম্ভবত পুরো উপমহাদেশে দুজন আছেন। প্রথমজন পাকিস্তানের জন্মদাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, আর দ্বিতীয়জন বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা এবং বাংলাদেশের প্রথম সেনাশাসক জেনারেল জিয়া। ঐতিহাসিকরা একমত, ভারতকে দ্বিখণ্ডিত করার জন্য ব্রিটিশরা জিন্নাহকে সৃষ্টি করেছিল। এই কথার সত্যতা মেলে পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সাবেক প্রধান, বর্তমানে প্রয়াত খান আবদুল ওয়ালী খানের গবেষণাধর্মী বই ‘Facts are Facts’ পড়লে। ওয়ালী খান সীমান্ত গান্ধী বলে পরিচিত খান আবদুল গাফ্ফার খানের পুত্র। সীমান্ত গান্ধী আরো অনেক মুসলমান নেতার মতো ভারত ভাগের বিপক্ষে ছিলেন। ১৯৪৬ সালে ভারতজুড়ে যে সাধারণ নির্বাচন হয়, তাকে মনে করা হয় পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য অনানুষ্ঠানিক গণভোট। সেই গণভোটে বর্তমান পাকিস্তানের কোনো প্রদেশই পাকিস্তানের পক্ষে ভোট দেয়নি। একমাত্র অবিভক্ত বাংলা মুসলিম লীগের পক্ষে ভোট দিয়েছিল, বলেছিল আমরা পাকিস্তান চাই। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে হত্যা করার পর জিয়া ক্ষমতা দখল করে প্রথমে সামরিক শাসক ও পরে প্রেসিডেন্টের পদটি দখল করেছিলেন। রাজনীতির সঙ্গে তাঁর কোনো সম্পর্ক ছিল না। সরদার ফজলুল করিম ও অধ্যাপক নূরুল ইসলামকে দেওয়া উপপ্রধানমন্ত্রী মশিউর রহমান যাদু মিয়ার (একসময় ভাসানী ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন এবং তাঁর বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে রসদ সরবরাহের অভিযোগ আছে) বড় ভাই মোখলেসুর রহমানের (সিধু মিয়ার) সাক্ষাৎকারভিত্তিক রচনায় জিয়াউর রহমানের ‘রাজনীতিবিদ’ হয়ে ওঠার এক চমকপ্রদ বর্ণনা আছে (প্রতিচিন্তা, অক্টোবর-ডিসেম্বর, ২০১৪)। জিয়া একজন পেশাদার সৈনিক ছিলেন, তবে বাংলাদেশের ষড়যন্ত্রের রাজনীতিতে তাঁর সমতুল্য অতীতেও কেউ ছিলেন না, ভবিষ্যতেও কারো আবির্ভাব হবে তার সম্ভাবনা ক্ষীণ। এই দুই ব্যক্তি কারাগার কী জিনিস তা কখনো দেখেননি। রাজনৈতিক কারণে জেলে গিয়েছেন মিসরের জাতীয়তাবাদী প্রেসিডেন্ট জামাল আবদেল নাসের, স্বাধীন ইন্দোনেশিয়ার জাতির পিতা আহম্মেদ সুকর্ন, স্বাধীন আলজেরিয়ার জনক আহমেদ বেন বেল্লা, ভিয়েতনামের প্রবাদপুরুষ হো চি মিন (চীনে গুপ্তচরবৃত্তির দায়ে অভিযুক্ত)। দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা দীর্ঘ ২৭ বছর কারাদণ্ড ভোগ করেছেন। উপমহাদেশে মহাত্মা গান্ধী, জওয়াহেরলাল নেহরু, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী আর আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু বছরের পর বছর কারাদণ্ড ভোগ করেছেন। কেউ বিনা বিচারে আর কেউবা বিচারের নামে প্রহসনের শিকার হয়ে। তাঁদের প্রায় সবাই কারাজীবন নিয়ে অসামান্য সব স্মৃতিকথা লিখে রেখে গেছেন। বলা হয়, একজন রাজনৈতিক বন্দি লেখক না হয়েও কারাগারে গেলে বেশ বড় মাপের লেখক হয়ে উঠতে পারেন। কারাগারে থাকাকালে নেহরুর লেখা ‘The Discovery of India’ I ‘Letters from Father to Daughter’ দুটি অসামান্য গ্রন্থ, যদিও এই বই দুটি ঠিক কারাস্মৃতি নয়। কারাগারে বঙ্গবন্ধুর লেখা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ (নামকরণ বঙ্গবন্ধুর বড় কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা) আর ‘কারাগারের রোজনামচা’ (বঙ্গবন্ধু নামকরণ করেছিলেন ‘লোটা, বাটি, কম্বল, জেলখানার সম্বল’। বর্তমান নামটিও শেখ হাসিনার দেওয়া) বঙ্গবন্ধুর আত্মত্যাগ ও স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পেছনের করুণ ইতিহাস। এই রাজনৈতিক ব্যক্তিদের লেখা, তাঁদের রচনা পড়লে বোঝা যায় কারাজীবনের প্রতিদিনের একটি চিত্র। তাঁরা সবাই রাজনৈতিক কারণে কারাবরণ করেছেন কোনো দুর্নীতি বা ক্ষমতার অপব্যবহারের দায়ে বা ফৌজদারি মামলায় দণ্ডিত হয়ে নয়, যেমনটি হয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম জিয়া। তবে সম্প্রতি দক্ষিণ কোরিয়ার ক্ষমতাচ্যুত রাষ্ট্রপতি পার্ক গিউন হাই ক্ষমতার অপব্যবহারের দায়ে ২৪ বছরের সাজাপ্রাপ্ত হয়ে জেলে গেছেন। দুর্নীতির দায়ে ১২ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছেন ব্রাজিলের সাবেক জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট লুই ইনাসিও লুলা। ক্ষমতার অপব্যবহারের দায়ে সাজাপ্রাপ্ত হয়ে ভারতের কিংবদন্তিতুল্য প্রধানমন্ত্রী কারাগারে গিয়েছিলেন। একই অপরাধে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো শুধু কারাগারেই যাননি, ফাঁসিতেও ঝুলতে হয়েছে তাঁকে। ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব তাঁর দুই কন্যাকে নিয়ে গৃহবন্দি ছিলেন। ২৭ জুলাই ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের একটি স্যাঁতসেঁতে কেবিনে সজীব ওয়াজেদ জয়ের জন্ম হয়। বাইরে পাকিস্তানি সেনা প্রহরা। বেগম মুজিবের তাঁর কন্যাকে দেখতে যাওয়ার অনুমতি ছিল না। অনেক বাগিবতণ্ডা করে বেগম সুফিয়া কামাল ও মিসেস নার্গিস জাফর মাঝেমধ্যে শেখ হাসিনা ও নবজাতককে দেখতে যেতেন। বর্তমান প্রজন্ম এসব ইতিহাস কখনো জানতে পারে না।
গত ৮ ফেব্রুয়ারি বিচারিক আদালত বেগম জিয়াকে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় দুর্নীতির দায়ে পাঁচ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেছেন। যদিও আদালতের এখতিয়ার ছিল আরো বেশি দণ্ড দেওয়ার, বেগম জিয়ার শারীরিক অবস্থা ও বয়স বিবেচনা করে অন্য দণ্ডিতদের তুলনায় কম দণ্ড দিয়েছেন। বেগম জিয়া বর্তমানে নাজিমুদ্দীন রোডের পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারে বিশেষ সেলে আছেন। বেগম জিয়ার কারাদণ্ড নিয়ে দেশে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিদেশেও বেশ রাজনীতি আর অপরাজনীতি হচ্ছে। এসব কর্মকাণ্ডে যেমন জড়িত আছেন বিএনপির নেতারা, তেমনি জড়িত আছেন দেশের ‘সুশীল’ নামধারী কিছু ব্যক্তি, আর এক শ্রেণির মিডিয়া। বেগম জিয়ার কারাদণ্ডে দণ্ডিত হওয়াকে কেন্দ্র করে লন্ডনে বাংলাদেশ দূতাবাসে বিএনপির কর্মী নামধারী কিছু দুর্বৃত্ত কিছুদিন আগে জোরপূর্বক প্রবেশ করে ভাঙচুর করেছে, বঙ্গবন্ধুর ছবির অপমান করেছে। আর দুঃখের বিষয় হচ্ছে, ব্রিটিশ পুলিশ দূতাবাসের নিরাপত্তা দিতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। এমন ঘটনা বাংলাদেশে ঘটলে ব্রিটিশ সরকার একটা তুলকালাম কাণ্ড ঘটিয়ে দিত। বিএনপি তাদের চেয়ারপারসনের দণ্ড নিয়ে রাজনীতি বা অপরাজনীতি করবে তা স্বাভাবিক। তবে প্রতিদিন দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রুহুল কবীর রিজভী সংবাদ সম্মেলনের নামে যা করেন আর বলেন, তাতে তিনি তাঁর রাজনৈতিক অতীতকে চরমভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলেছেন। তিনি বুঝতে পারেন না, তাঁর কোনো বক্তব্যই কেউ আর গুরুত্ব দিয়ে নেন না। বাংলাদেশের রাজনীতি এমন পর্যায়ে গেছে যে কয়েকটি প্রিন্ট মিডিয়া ও একদল ‘সুশীল’ ব্যক্তি পারলে ছলে-বলে-কৌশলে এখনই শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করে বেগম জিয়াকে ক্ষমতায় বসান। এরাই মূলত এক-এগারোর আগে তথাকথিত মাইনাস টু, যা বাস্তবে ছিল মাইনাস ওয়ান (শেখ হাসিনা) ফর্মুলার জনক। বেগম জিয়া বেশ ভাগ্যবান, কারণ তাঁর স্বামী ও তাঁর মেয়াদকালে যাঁরা কারাগারে নিক্ষিপ্ত হয়েছিলেন, তাঁরা কেউ তাঁর মতো ভাগ্যবান ছিলেন না। জিয়া ক্ষমতা দখল করে যাঁদের প্রথমেই গ্রেপ্তার করে জেলে পোরেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বোস প্রফেসর ড. আবদুল মতিন চৌধুরী। তাঁর অপরাধ, তিনি ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংবর্ধনা দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। এই স্বনামধন্য বিজ্ঞানী ১৭ মাস বিনা বিচারে কারাভোগ করেছেন। একইভাবে কারাগারে পুরেছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মাজহারুল ইসলামকে। বেগম জিয়ার শাসনকালে বোমা ফুটল ময়মনসিংহে। বোমাবাজির দায়ে ঢাকায় গ্রেপ্তার হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ ড. মুনতাসীর মামুন, ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির। ড. মামুনকে নিয়ে যাওয়া হলো দিনাজপুর জেলে। তখন শীতকাল। দিনাজপুরের ঠাণ্ডা শীতকালে ৪ ডিগ্রি পর্যন্ত নেমে আসে। দিনাজপুর কারাগারে কোনো ডিভিশন দেওয়ার ব্যবস্থা নেই। ড. মামুন কারা কর্তৃপক্ষকে জানালেন, তাঁর শারীরিক সমস্যা আছে। কারা কর্তৃপক্ষ নিরুপায়, কারণ কারা ফটকের ওপর কোনো পর্দা বা আবরণ দেওয়ার নিয়ম নেই। ঠাণ্ডা বাতাস প্রবেশে কোনো বাধা নেই। আওয়ামী লীগ নেতা সাবের হোসেন চৌধুরীকে ফেরি থেকে ১০টি প্লেট চুরির অপরাধে কারাগারে নিক্ষেপ করা হলো। সাবেক বিমানবাহিনীর প্রধান জামাল উদ্দিনকে ঘড়ি চুরির অপরাধে অভিযুক্ত করা হলো। সাংবাদিক এনামুল হক চৌধুরীকে (বর্তমানে ডেইলি সানের সম্পাদক) মিথ্যা সংবাদ পরিবেশনের দায়ে গ্রেপ্তার করে কারাগারে নিক্ষেপই শুধু করা হয়নি, তাঁর ওপর যে নির্যাতন চালানো হয়েছিল তার ফলে তিনি অনেক দিন স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারেননি। তাঁদের কারো সামাজিক অবস্থান বেগম জিয়ার চেয়ে কোনো অবস্থায়ই নিচে নয়। বেগম জিয়া শুধু একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান ও দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তাঁরা কেউ রায়ে দণ্ডিত হননি। উদ্দেশ্যমূলকভাবে তাঁদের আটক করা হয়েছিল। আদালতের আদেশে ছাড়া পেয়েছিলেন। জেনারেল জিয়া বা তাঁর স্ত্রীর শাসনামলে বর্তমানে সরব ‘সুশীল’দের টুঁ শব্দ করতে দেখা যায়নি।
অনেক ‘সুশীল’ প্রশ্ন করেন, এক-এগারোর পর বেগম জিয়া গ্রেপ্তার হলে তিনি যদি ব্যক্তিগত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়ার সুযোগ পান, এখন পাবেন না কেন? এই ‘সুশীল’রা বুঝতে পারেন না অভিযুক্ত হওয়া এক জিনিস আর দণ্ডিত হওয়া অন্য জিনিস। একবার দণ্ডিত হলে যেকোনো আসামিকে কারা বিধি অনুযায়ী চলতে হয়। এক-এগারোর পর বেগম জিয়া ও শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তার করে বিচারের প্রহসন মঞ্চস্থ হয়েছিল, কোনো রায় হয়নি। বেগম জিয়ার বিজ্ঞ আইনজীবীরা বলেন, বেগম জিয়াকে আসন্ন নির্বাচন থেকে দূরে রাখতে বিচারকাজ তড়িঘড়ি করে করা হয়েছে। কী অসত্য তথ্য। ১০ বছর কোনো ফৌজদারি মামলা চলে, তা যেকোনো বিচারেই নজিরবিহীন। নানা অজুহাতে তখন বেগম জিয়া আদালতে হাজির হননি। ক্ষতি হয়েছে তাঁর। এখন ঠিক একই কৌশলের আশ্রয় নিয়েছেন বেগম জিয়া ও তাঁর আইনজীবীরা। এতেও ক্ষতি তাঁর। বেগম জিয়া তাঁর সার্বক্ষণিক গৃহপরিচারিকা ফাতেমাকে সঙ্গে রাখার সুযোগ পেয়েছেন। সার্বক্ষণিক চিকিৎসক আর নার্স আছেন। যত দূর জানা গেছে, তাঁর সেলটি ফুল ফারনিশড, টিভি আর এসিও আছে। তবে তিনি যে কোটি টাকার আসবাবপত্র ব্যবহারে অভ্যস্ত তা থেকে হয়তো তিনি বঞ্চিত। তবে এটা তো মেনে নিতে হবে, কারাগার কোনো ফাইভ স্টার হোটেল নয়। তাঁর দলের নেতারা দাবি করেছেন, বেগম জিয়া অসুস্থ, যা এই বয়সে স্বাভাবিক। আর তিনি যে আগে থেকেই কিছু শারীরিক সমস্যায় ভুগছেন তা দেশের মানুষ জানে। সরকার একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন মেডিক্যাল টিম পাঠিয়েছে তাঁর স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য। চিকিৎসক দল তাঁকে কিছু ওষুধ দিয়েছে, কিন্তু তিনি তা সেবন করতে অস্বীকার করেছেন। বলেছেন, তিনি তাঁর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ছাড়া কারো কোনো পরামর্শে ওষুধ সেবন করবেন না। এমনও নাকি তিনি বলেছেন, তিনি তাঁর পুত্রবধূ ডা. জোবাইদা রহমানের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ সেবন করবেন। এর জন্য হয় ডা. জোবাইদা রহমানকে লন্ডন থেকে দেশে আসতে হবে, অথবা বেগম জিয়াকে প্যারলে মুক্ত হয়ে লন্ডন যেতে হবে। তাঁকে এই সুযোগ দেওয়া হবে কি না তা নির্ধারণ করবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, কারা কর্তৃপক্ষ অথবা উচ্চ আদালত।
যেকোনো দেশে ‘সুশীল’ গোষ্ঠী থাকাটা ভালো। তবে তাঁরা ন্যায়ের পক্ষে কথা বলবেন তা-ই প্রত্যাশিত। বাংলাদেশের ‘সুশীল’ সমাজ এর কিছুটা ব্যতিক্রম। তাদের একটি বড় অংশের কর্মকাণ্ড ঠিক ‘সুশীল’ নয়, আপত্তিকর। বেগম জিয়া এই বয়সে জেলে থাকুক তা কাম্য ছিল না। তাঁর এবং তাঁর পুত্রের কর্মফলই তাঁকে এই পরিস্থিতিতে ঠেলে দিয়েছে। এখান থেকে দ্রুত তিনি বের হতে পারবেন কি না তা নিয়ে সন্দেহ আছে। কারণ তাঁকে আরো বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মামলা মোকাবেলা করতে হবে। বিএনপির নেতারা যতই বলুন বেগম জিয়া ছাড়া তাঁরা নির্বাচনে যাবেন না, তা শেষ পর্যন্ত ঠিক থাকবে না। নির্বাচনে তাঁরা ঠিকই যাবেন। কারণ সিদ্ধান্ত আসবে লন্ডন থেকে। আর তারেক রহমানের অনেক টাকার প্রয়োজন। একবার তিনি বাংলাদেশের বিল গেটস হতে চেয়েছিলেন। মনোনয়ন বাণিজ্য বিনা পুঁজিতে বেশ লাভজনক বাণিজ্য।