4070
Published on মার্চ 25, 2018১৯৭১-এর ২৫ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাঙালির স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা অঙ্কুরে বিনাশ করতে চেয়েছে নজিরবিহীন গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞে। গণহত্যা ঢাকা থেকে ছড়িয়ে পরবর্তী নয় মাসে সমগ্র বাংলাদেশে অব্যাহত ছিল। মহান মুক্তিযুদ্ধে নিহতের সংখ্যা ৩০ লাখ কিংবা আরো বেশি। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এ পর্যন্ত পাঁচ হাজারের অধিক বধ্যভূমির সন্ধান পাওয়া গেছে। এর মধ্যে এক হাজার বধ্যভূমি চিহ্নিত। আফসোসের বিষয় স্বাধীনতার ৪৭ বছরে এই বধ্যভূমিগুলো অরক্ষিত রয়ে গেছে। অরক্ষিত উল্লেখযোগ্য বধ্যভূমিগুলো নিয়ে এই ধারাবাহিক রচনা।
পাকিস্তান আমলে রেলওয়ে জংশন শহর পার্বতীপুর এলাকাটি ছিল অবাঙালি অধ্যুষিত। পাকিস্তান সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় অবাঙালিরা ব্যবসা-বাণিজ্য বিশেষ করে রেলওয়েতে চাকরি করে অর্থনৈতিকভাবে বাঙালিদের চেয়ে উন্নতি লাভ করে। পার্বতীপুর শহরে বসবাসকারী প্রায় ৬৫ হাজার মানুষের মধ্যে প্রায় ৯০% ছিল অবাঙালি। ফলে অবাঙালিদের বিদ্বেষপূর্ণ আচরণের কারণে বাঙালি পরিবারের ছেলেমেয়েরা পৃথক পৃথক বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করত। বাঙালি ছেলেমেয়েরা বাংলা বিদ্যালয় হিসেবে পরিচিত জ্ঞানাঙ্কুর উচ্চ বিদ্যালয়ে আর অবাঙালিদের সন্তানরা উর্দু বিদ্যালয় হিসেবে পরিচিত জিন্নাহ উচ্চ বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করত। এই দুটি স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে খেলাধুলা নিয়ে কখনো দ্ব›েদ্বর সৃষ্টি হলে তা বাঙালি-অবাঙালি দাঙ্গায় পরিণত হয়ে নিমিষেই সারা শহরে ছড়িয়ে পড়ত। অবাঙালিদের প্রতি পাকিস্তান সরকারের সহানুভূতি ও পক্ষপাতিত্বের কারণে তৎকালীন বিভিন্ন আন্দোলনে তারা সব সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পক্ষাবলম্বন করত।
দিনাজপুর জেলার পার্বতীপুরে মুক্তিযুদ্ধকালীন স্থানীয় আলবদর, রাজাকার ও অবাঙালিদের সহযোগিতায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী যে গণহত্যা সংঘটিত করে তা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে নজিরবিহীন ঘটনা।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাত্রিতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঢাকাসহ দেশের বড় বড় শহরে গণহত্যা শুরু করলে পার্বতীপুরের অবাঙালিরা বেপরোয়া হয়ে ওঠে। তারা পার্বতীপুরে বেশ কয়েকজন বাঙালিকে হত্যা করে। এই খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে শহর ও আশপাশের গ্রাম থেকে ৪ এপ্রিল হাজার হাজার বাঙালি দেশীয় অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে পার্বতীপুর ঘেরাও করেন। কিন্তু অবাঙালিদের সাহায্য করতে সৈয়দপুর সেনানিবাস থেকে পাকিস্তানি সৈন্যরা এসে গুলিবর্ষণ শুরু করলে জনগণ ছত্রভঙ্গ হয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন।
মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে মুক্তিবাহিনী সংগঠিত হওয়ার আগেই বিদ্রোহ করে অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে সেনানিবাস থেকে বেরিয়ে ৩ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর, পুলিশ ও আনসার বাহিনীর বাঙালি সদস্যরা মিলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন এবং পার্বতীপুর শহর দখল করে নেন।
৪ এপ্রিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী পার্বতীপুর দখল করার পর মুক্তিযোদ্ধাদের চোরাগোপ্তা হামলার আশঙ্কায় অবাঙালি কামরুজ্জামান, শোয়েব, বাচ্চু খান, ইকবাল, ওয়াদুদ খান প্রমুখের সহযোগিতায় পার্বতীপুর শহরের চারদিকে প্রায় ৫ কিলোমিটার এলাকার জনপদে বাঙালিদের বাড়িঘরে ও ব্যবসা-বাণিজ্যের স্থানগুলোতে অগ্নিসংযোগ করে। তারপর থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের এদেশীয় অবাঙালি দোসররা পার্বতীপুরের আশপাশের বিভিন্ন গ্রামে আক্রমণ করে মুক্তিকামী নিরীহ জনগণ হত্যা, নারী নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট শুরু করে।
এপ্রিল মাসে পার্বতীপুরের প্রায় ৩ শতাধিক নারী, পুরুষ ও শিশু নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে বারাই সীমান্ত দিয়ে ভারতে যাওয়ার সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের অবাঙালি দোসররা সবাইকে গুলি করে হত্যা করে। তা ছাড়াও অবাঙালিরা এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে পার্বতীপুর শহরের পুরাতন বাজারে আটকেপড়া উপেন্দ্র শীল ও তার বড় ছেলে সুবাসচন্দ্র শীল, পাশের বাড়ির বালিয়া বাবু, তার স্ত্রী, তাদের চার ছেলে, দুই মেয়ে ও আত্মীয়স্বজনসহ মোট ১৪ জনকে জবাই করে হত্যার পর লাশগুলো একটি পরিত্যক্ত কুয়ায় নিক্ষেপ করে। শহরের অবাঙালি কাল্লু কসাই শত শত বাঙালিকে জবাই করে হত্যার পর লাশগুলো যত্রতত্র ফেলে রাখত, যা শিয়াল আর কুকুরের খাদ্যে পরিণত হতো। অনেক লাশ সামান্য মাটি খুঁড়ে চাপা দিয়ে রাখত।
পার্বতীপুর শহর থেকে ১০ কিলোমিটার দক্ষিণে রেল স্টেশন-সংলগ্ন ভবানীপুর গ্রামটি আয়তনে বেশ বড়। পাকিস্তানি সৈন্যরা ভবানীপুর, কামারপাড়া ও শেরপুরসহ আশপাশের গ্রামে নিয়মিত টহল দিত। ১৯৭১ সালের ১১ এপ্রিল দিনাজপুর কুঠিবাড়িতে অবস্থানরত বাঙালি সৈন্যদের সঙ্গে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তুমুল যুদ্ধ সংঘটিত হয়। বাঙালি সৈন্যদের প্রচণ্ড আক্রমণে পাকিস্তানি সৈন্যরা টিকতে না পেরে সৈয়দপুর সেনানিবাসে ফিরে যেতে বাধ্য হয়। এই যুদ্ধে ৭ জন ইপিআর সদস্য ও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এলোপাথাড়ি গুলিবর্ষণে ভবানীপুর ও শেরপুর গ্রামের বেশ কয়েকজন নিরীহ মানুষ শহীদ হন। যুদ্ধ শেষে বাঙালি সৈন্যরা ভবানীপুরের হাবড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের মিল এলাকায় অস্থায়ী ছাউনি স্থাপন করেন।
৯ মে পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাদের এদেশীয় দোসর ও প্রায় ১০০ জন অবাঙালির সহযোগিতায় ভবানীপুর গ্রামটি ঘেরাও করে। তারা অনেক নিরীহ গ্রামবাসীকে হত্যা করে এবং অনেককে ধরে পার্বতীপুরে অবাঙালি রাজাকার কামরুজ্জামানের বাড়িতে নিয়ে যায়। বন্দি গ্রামবাসীদের বাড়ির পাশের একটি বড় আমগাছের ডালে দড়ি দিয়ে উল্টো করে বেঁধে ঝুলিয়ে নির্যাতন করা হয়। ৩/৪ দিন পর্যন্ত অকথ্য নির্যাতন শেষে তাদের গুলি করে হত্যা করা হয়। অনেককে জীবন্ত অবস্থায় রেলস্টেশনে কয়লার ইঞ্জিনের জ্বলন্ত বয়লারে নিক্ষেপ করে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
তা ছাড়াও মুক্তিযুদ্ধকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় তাদের এদেশীয় অবাঙালি দোসররা পার্বতীপুর শহরের আশপাশের গ্রামের কত নিরীহ বাঙালিকে হত্যা করেছে আর কত মা-বোনকে পাশবিক নির্যাতন করেছে তার সঠিক সংখ্যা সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি।
পার্বতীপুর রেলস্টেশনে কয়লার ইঞ্জিনচালিত একটি রেলগাড়ি সব সময় প্রস্তুত রাখা হতো। প্রতিদিন সকাল ৮-৯টার সময় এই রেলগাড়িতে করে পাকিস্তানি সৈন্যরা প্রায় ২০০ জন অবাঙালি ও রাজাকারসহ পার্বতীপুর এলাকার বিভিন্ন গ্রামে গিয়ে অগ্নিসংযোগসহ হত্যা, নির্যাতন ও লুটপাট করত। এসব এলাকা থেকে অনেক নারী ও পুরুষকে ধরে এনে শহরের শোয়েব ভবনে আটকিয়ে রাখত। সেখানে তাদের ৩-৪ দিন অমানুষিক নির্যাতনের পর হত্যা করা হতো। এভাবে হত্যা করা হয়েছে ক্যাপ্টেন ডা. আবুল হোসেন, পার্বতীপুর রেলওয়ে হাসপাতালের ডা. আবদুল গফুর প্রমুখকে। তা ছাড়াও চণ্ডীপুর গ্রামের হাজি চান মাহমুদ ও বাজারপাড়া গ্রামের মোস্ত হাজিকে ধরে এনে জ্বলন্ত বয়লারে নিক্ষেপ করে হত্যা করা হয়।
জানা যায় যে, মুক্তিযুদ্ধকালীন বিভিন্ন সময়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসর অবাঙালিরা পার্বতীপুর শহর, ভবানীপুর গ্রামসহ আশপাশের বিভিন্ন গ্রামের প্রায় ৭০০ জন বাঙালিকে হত্যা করেছে।
ভবানীপুর ও এর আশপাশের গ্রাম থেকে ধরে এনে যাদের অমানুষিক নির্যাতনের পর হত্যা করে পার্বতীপুরের যেখানে মাটিচাপা দেয়া হয়েছিল সেই স্থানটি শনাক্ত করে স্থানীয়ভাবে গণকবর হিসেবে সংরক্ষণ করা হয়েছে। কিন্তু যাদের জ্বলন্ত বয়লারে নিক্ষেপ করে হত্যা করা হয়েছে তাদের জন্য কোনো গণকবর তৈরি করা সম্ভব হয়নি। তা ছাড়াও ভবানীপুর গ্রামের পাশে একটি শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণসহ শহীদদের নামের তালিকা সংগ্রহপূর্বক স্মৃতিস্তম্ভে স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।