5199
Published on মার্চ 24, 2019১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ বাংলার বুকে যে গণহত্যা হয়েছিল, তা বিশ্ব ইতিহাসে নজিরবিহীন। তখনো তো বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষিত হয়নি। তার আগে পর্যন্ত বলা চলে পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তান একই দেশ ছিল। সেই হিসেবে নিজ দেশের বেসামরিক ঘুমন্ত নগরবাসীর ওপর সেনাবাহিনীর এভাবে নির্বিচারে এত ব্যাপক গণহত্যা চালানোর নজির আর কোনো দেশে নেই।
ইয়াহিয়া ও পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক জান্তা এবং জুলফিকার আলি ভুট্টো ও তার দলবল যে কত ধূর্ত ও নির্মম, তা বোঝা যায় ২৪ মার্চ পর্যন্ত তাদের হাসিমুখে বাঙালিদের সঙ্গে আলোচনা বৈঠকে অংশ নেওয়ার ধরন দেখে।
২৪ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং জেনারেল ইয়াহিয়ার উপদেষ্টারা এক বৈঠকে মিলিত হন। দেশের চলমান রাজনৈতিক সংকট নিরসন ছিল তাদের উদ্দেশ্য। যদিও বৈঠকটি ব্যর্থ হয়। ইয়াহিয়া এক বেতার ভাষণে বলেন, ২৫ মার্চ তিনি রাজনৈতিক সংকট মীমাংসা ও ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন।
অথচ এর আড়ালে ইয়াহিয়া ২৫ মার্চের গণহত্যার পুরো প্রস্তুতি সম্পন্ন করেন। ভুট্টোও এই চক্রান্তের অন্যতম অংশীদার ছিলেন। এদিনই পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন সেনা ইউনিটে মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী ও খাদিম হোসেন রাজা কর্তৃক বাঙালি হত্যাযজ্ঞের পরিকল্পনা হস্তান্তর করা হয়। রাও ফরমান আলী আর খাদিম হোসেন রাজা ছিলেন ২৫ মার্চের গণহত্যার দুই প্রধান রূপকার। শুধু ২৫ মার্চ নয়, পুরো ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধেই যে গণহত্যা ও গণধর্ষণের তা-ব চলে, তারও প্রধান কুশীলব এরাই। তাদের সঙ্গে ছিলেন জেনারেল নিয়াজি। ডিসেম্বরের ১০-১৫ তারিখে বুদ্ধিজীবী হত্যাও হয়েছিল রাও ফরমান আলীর হিংস্র পরিকল্পনায়। ইয়াহিয়া খান, টিক্কা খান, রাও ফরমান আলী, খাদিম রাজা, নিয়াজিÑ এসব জল্লাদের হিংস্রতা এবং তাদের দেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর, আলশামসের অপরাধ কখনো বাঙালি ক্ষমা করতে পারবে না, করা উচিতও নয়। এদের ক্ষমা করা হলো শহীদদের রক্তের সঙ্গে বেইমানি।
২৪ মার্চ চট্টগ্রাম অঞ্চলের সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব থেকে বাঙালি ব্রিগেডিয়ার মজুমদারকে অপসারণ করা হয়। তার জায়গায় পাঞ্জাবি ব্রিগেডিয়ার আনসারীকে ওই পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। এটা ছিল চট্টগ্রামে বাঙালি সেনা অফিসার ও সৈনিকদের হত্যা করার চূ’ড়ান্ত পরিকল্পনার অংশ।
২৪ মার্চ জুলফিকার আলি ভুট্টো ছাড়া তার দলের অন্য সদস্যরা এবং পশ্চিম পাকিস্তানের অন্য নেতারা ঢাকা ত্যাগ করে চলে যান। বাঙালির চোখে ধুলো দিতে ভাঁওতাবাজি করে ভুট্টো দেহরক্ষীদের নিয়ে হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালে রয়ে যান।
২৫ মার্চের দিনেও চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাসে শ্রমিক জনতা বাধা দিলে সামরিক বাহিনীর গুলিতে ১১০ জন নিহত হন। বঙ্গবন্ধু এই ঘটনার প্রতিবাদে ২৭ মার্চ সমগ্র পূর্ব বাংলায় হরতাল পালনের ডাক দেন এবং বলেনÑ ‘আমার আশঙ্কা হচ্ছে, আলোচনা ও রাজনৈতিক মীমাংসার নামে কালক্ষেপণ করে বাঙালিদের দমন করার জন্য গোপনে পূর্ণ সামরিক প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।’ বঙ্গবন্ধুর এই আশঙ্কা ২৫ মার্চের রাতেই সত্যে পরিণত হয়। ২৫ মার্চেও সারা দিন ঢাকা শহরে চলে প্রতিবাদ মিছিল। রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড সৃষ্টি করে ছাত্র জনতা। এই ব্যারিকেডের কারণে ২৫ মার্চ অনেকের প্রাণ রক্ষা হয়। ঢাকায় বিভিন্ন স্থানে মুক্তিপাগল বাঙালির সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাদের সংঘর্ষ চলে। সচেতন মানুষদের মনে অজানা আতঙ্ক ছেয়ে থাকে। অনেকেই বুঝতে পারছিলেন, ক্র্যাকডাউন আসন্ন। কিন্তু সেটা যে এমন ব্যাপক হবে, তা অবশ্য কেউ ধারণা করতে পারেননি। অনেক রাজনীতিসচেতন ব্যক্তি ও ছাত্রনেতা সেই রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে না থাকায় বেঁচে যান।
২৫ মার্চ সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে গোপনে কুচক্রী প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ঢাকা ত্যাগ করেন। সোনার বাংলাকে শ্মশানে পরিণত করার নির্দেশ দিয়ে কাপুরুষ ইয়াহিয়া খান ঢাকা ত্যাগ করে চলে যান পশ্চিম পাকিস্তানে। আর পূর্ব বাংলাকে মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত করার জন্য শ্বাপদের হিংস্রতায় প্রস্তুত হন টিক্কা খান, রাও ফরমান আলী, খাদিম হোসেন রাজা গং।