4180
Published on মার্চ 24, 2018১৯৭১-এর ২৫ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাঙালির স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা অঙ্কুরে বিনাশ করতে চেয়েছে নজিরবিহীন গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞে। গণহত্যা ঢাকা থেকে ছড়িয়ে পরবর্তী নয় মাসে সমগ্র বাংলাদেশে অব্যাহত ছিল। মহান মুক্তিযুদ্ধে নিহতের সংখ্যা ৩০ লাখ কিংবা আরো বেশি। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এ পর্যন্ত পাঁচ হাজারের অধিক বধ্যভূমির সন্ধান পাওয়া গেছে। এর মধ্যে এক হাজার বধ্যভূমি চিহ্নিত। আফসোসের বিষয় স্বাধীনতার ৪৭ বছরে এই বধ্যভূমিগুলো অরক্ষিত রয়ে গেছে। অরক্ষিত উল্লেখযোগ্য বধ্যভূমিগুলো নিয়ে এই ধারাবাহিক রচনা।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাত্রিতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঢাকার রাজারবাগ পুলিশ লাইনে, পিলখানায় ইপিআর সদর দপ্তরে বাঙালি সদস্যদের হত্যাসহ ঢাকা শহরে নির্মম গণহত্যা সংঘটিত করে। পরদিন এই খবর জানার পর দেশের অন্যান্য স্থানের মতো চাঁপাইনবাবগঞ্জের দেশপ্রেমিক জনগণও বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। স্থানীয় ছাত্রনেতা, আওয়ামী লীগের নেতারা ও মুক্তিকামী জনগণ বাঙালি পুলিশ, ইপিআর, আনসার ও মুজাহিদ বাহিনীর সদস্যদের সহযোগিতায় প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করেন।
ইপিআর ৬ নম্বর উইংয়ের সদর দপ্তর ছিল চাঁপাইনবাবগঞ্জে, যেখানে উচ্চপদস্থ অধিকাংশ অফিসার ছিল অবাঙালি এবং তারা ছিল বাঙালি বিদ্বেষী। তারা ঢাকা পিলখানার মতো এখানেও বাঙালি ইপিআর সদস্যদের হত্যার কয়েকটি পরিকল্পনা গ্রহণ করলেও পূর্ব থেকে প্রস্তুত থাকা বাঙালি ইপিআর সদস্যরা সেগুলো ব্যর্থ করতে সমর্থ হন। অবস্থা বেগতিক দেখে অবাঙালি অফিসার ও সৈনিকরা ২৭ মার্চ চাঁপাইনবাবগঞ্জ ত্যাগ করে রাজশাহী যাওয়ার প্রস্তুতি গ্রহণ করে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ ত্যাগের প্রাক্কালে অবাঙালি ইপিআর সদস্যরা বাঙালি ইপিআর সদস্যদের ওপর হামলা করলে বাঙালি ইপিআর সদস্যরাও পালটা আক্রমণ করেন। প্রায় দুই ঘণ্টা গুলি বিনিময়ে অনেক হতাহতের পর অবাঙালি অফিসাররা পালাতে সক্ষম হলেও ইপিআর সদস্যরা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। এই আক্রমণের খবর ছড়িয়ে পড়লে এলাকায় বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে পড়ে। পরবর্তী সময়ে বাঙালি ইপিআর সদস্য, আনসার, মুজাহিদ, পুলিশ, ছাত্র ও জনতার সমন¦য়ে গঠিত বাহিনী চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহর রক্ষার জন্য বিভিন্ন স্থানে প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করেন।
একই দিন অবাঙালি ইপিআর সদস্যরা জাতীয় পরিষদের নির্বাচিত সদস্য আলহাজ রইসউদ্দিন এমএনএর সন্তান এডভোকেট আবদুর রশিদ ও যুবনেতা গৌতম সিনহাসহ অসংখ্য দেশপ্রেমিক বাঙালিকে বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করে ছাউনিতে নিয়ে যায় এবং সেখানকার একটি গোপন কক্ষে আটক রেখে তাদের ওপর নির্যাতন চালানো হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিভিন্ন অপকীর্তির খবর ছড়িয়ে পড়লে গ্রামগঞ্জ থেকে হাজার হাজার সাধারণ মানুষ লাঠিসোটা ও দেশীয় অস্ত্র নিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহর অভিমুখে অগ্রসর হতে থাকেন। প্রায় ১০ হাজার মানুষ পাগলা ও মহানন্দা নদী অতিক্রম করে শহর দখল করে নেন এবং উত্তেজিত জনতা শহর থেকে সব অবাঙালি ও পাকিস্তানপন্থিদের বিতাড়িত করে দেন।
মধ্য এপ্রিল পর্যন্ত চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরটি মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে ছিল। ১২ই এপ্রিল ঢাকা থেকে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের জন্য প্রেরিত পাকিস্তানি সৈন্য বিনা বাধায় নগরবাড়ী পৌঁছায়। সেখান হতে তারা পাবনা-নাটোর হয়ে রাজশাহীতে প্রবেশ করে। পথিমধ্যে তারা বিভিন্ন বাজার, মন্দির ও ঘরবাড়ি ভাঙচুর করে। ১৭ এপ্রিল চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরে পাকিস্তানি জঙ্গি বিমান থেকে বোমা বর্ষণ করা হয়। ১৯ এপ্রিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আর্টিলারি বহরসহ মোট ১০৬টি যানবাহন শহরে প্রবেশ করে আক্রমণ চালায়। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণের ফলে মুক্তিযোদ্ধারা চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহর ত্যাগ করতে বাধ্য হন। এতে সাধারণ মানুষের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে এবং তারা নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে এলাকা ত্যাগ করতে থাকেন।
২০ এপ্রিল পর্যন্ত পাকিস্তান সেনাবাহিনী গোদাগাড়িতে মুক্তিবাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থানের ওপরে একাধিকবার আক্রমণ চালালে মুক্তিবাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়ে। উপায়ান্তর না দেখে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটতে বাধ্য হন এবং পদ্মা নদীর চর এলাকায় নিরাপদ আশ্রয় গ্রহণ করেন। ইপিআর ছাউনি পুনর্দখলের মাধ্যমে নিজেদের আধিপত্যকে সুসংহত করার জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনী শহরে কারফিউ জারি করে। পাশাপাশি তাদের এদেশীয় দোসরদের সহায়তায় তারা শহর ও আশপাশের এলাকায় অবাধে বিভিন্ন অপকর্ম চালাতে থাকে। ইতোমধ্যে পাকিস্তানি সৈন্যরা চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরে প্রবেশ করলে স্থানীয় মুসলিম লীগ নেতা ডা. মমতাজ হোসেন রাস্তায় নেমে তাদের অভ্যর্থনা জানাতে গেলে পাকিস্তানি সৈন্যরা ভুলবশত তাকে গুলি করে হত্যা করে। অতঃপর তারা স্থানীয় সংগ্রাম কমিটির অফিসে অগ্নিসংযোগ করে।
স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব প্রদানকারী চাঁপাইনবাবগঞ্জের অনেক নেতাকর্মীদের ধরে এনে হত্যা করতে থাকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী। তারা জেলাপরিষদ ডাকবাংলো, শহীদ সাটু হল (সাবেক বিডি হল), চাঁপাইনবাবগঞ্জ কলেজ প্রভৃতি স্থানে তাদের নির্যাতন কেন্দ্র স্থাপন করে। শহরের উপকণ্ঠে শ্মশানঘাট, খালঘাট (বর্তমানে ইদগাহ ময়দান) ও খালঘাট গোরস্থানের ইপিআর ছাউনির পশ্চিম পার্শ্বে মহানন্দা নদীতীর ঘেঁষে দীর্ঘ ৫ মাইল এলাকায় মরিচা ও বাংকার তৈরি করে। স্থানীয় দোসরদের সহায়তায় পাকিস্তানি সৈন্যরা আশপাশের এলাকা থেকে সাধারণ মানুষদের ধরে এসব মরিচা ও বাংকারে এনে হত্যা করত এবং মৃতদেহগুলো মহানন্দা নদীতে ভাসিয়ে দিত। নারীলোলুপ পাকিস্তানি সৈন্যরা যুবতীদের ধরে এনে পাশবিক নির্যাতনের পর তাদেরও হত্যা করত এবং তাদের মৃতদেহগুলো নদীতে ভাসিয়ে দিত অথবা মাটি চাপা দিয়ে রাখত।
বহু বছর আগে নবাবগঞ্জে আমিরাবাজার নামক একটি প্রসিদ্ধ ব্যাবসা কেন্দ্র ছিল, যা বর্তমান হুজরাপুরের অন্তর্গত। এখানে একটি নদীবন্দর ছিল, যা তৎকালীন ব্যবসাবাণিজ্য ও যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম ছিল। হুজরাপুরের এক পাশে ঘন জঙ্গল ও এর আশপাশের এলাকায় শ্মশানঘাট, আবাদি জমি ও বিভিন্ন স্থাপনার পাশাপাশি বিরাট অংশ পতিত ছিল বলে উপযুক্ত স্থান বিবেচনায় মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনী এখানে ছাউনি স্থাপন করে এবং পরবর্তীকালে স্থানীয় দোসরদের সহায়তায় গণহত্যা, লুটতরাজ, নারী নির্যাতন, অগ্নিসংযোগসহ বিভিন্ন অপকর্ম চালায়।
মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে হুজরাপুরেই অধিক সংখ্যক গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায় যে, স্থানীয় নারীরাই সেখানে বেশি নির্যাতিত হয়েছেন এবং নারী-পুরুষ মিলিয়ে প্রায় ৬-৭ হাজার মানুষ এখানে নির্মম গণহত্যার শিকার হন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অত্যাচারের মাত্রা এতই ভয়াবহ ছিল যে, এক দিন ৩০০ জন নিরীহ মানুষকে ধরে নিয়ে যায়। যাদের মধ্যে দুজন পালাতে সক্ষম হন আর বাদবাকি সবাইকে হত্যা করা হয়।
এদেশীয় দোসরদের সহায়তায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী বিভিন্ন এলাকা থেকে নিরীহ মানুষদের জোরপূর্বক ট্রাকে উঠিয়ে হুজরাপুর ছাউনিতে নিয়ে আসত। এখানে এনে পুরুষদেরকে বেয়নেট চার্জ করে এবং নারীদের শ্লীলতাহানি শেষে হত্যা করে লাশ নদীতে ফেলে দিত তারা। তাছাড়া তারা ডা. মমতাজ হোসেনের পরিবারের সদস্যদেরও গুলি করে হত্যা করে। তবে তার ১২ বছরের কন্যা মাহমুদা খাতুন আহত অবস্থায় দৈবক্রমে বেঁচে যান। মুক্তিযুদ্ধকালীন এভাবেই হুজরাপুর এলাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী নারকীয় গণহত্যা সংঘটিত করে।
পাকিস্তানি সেনাছাউনির নিকটবর্তী খালঘাট এলাকায় নদীর পানির গভীরতা অনেক বেশি ছিল বলে পানির ঘূর্ণিপাকে নদীতে নিক্ষিপ্ত মৃতদেহগুলো ঘুরপাক খেয়ে উপরে উঠে আসত। মৃতদেহগুলো যেন সবার দৃষ্টির অগোচরে থাকে এ জন্য পাকিস্তানি সৈন্যরা ডিনামাইট বিস্ফোরণের মাধ্যমে দেহগুলো ছিন্নভিন্ন করে ফেলত। তা ছাড়াও পার্শ¦বর্তী বিভিন্ন গ্রাম থেকে সাধারণ মানুষদের ধরে এনে কয়েকটি দলে বিভক্ত করে বিভিন্ন অমানুষিক নির্যাতন করে তাদেরকে হত্যা করা হতো। এক দলকে দিয়ে মাটি খোঁড়ানো হতো, পরবর্তী সময়ে তাদের গুলি করে হত্যার পর সেই গর্তে ফেলে দেয়া হতো এবং অপর দলকে দিয়ে সেই গর্ত ভরাট করানো হতো। এভাবে পালাক্রমে তারা কয়েক হাজার নিরীহ মানুষকে হত্যা করে।
হুজরাপুরের পাকিস্তানি সেনাছাউনির নেতৃত্বে ছিল দুশ্চরিত্র মেজর শেরোয়ানি ও নিরাপত্তা কর্মকর্তা ক্যাপটেন ইকবাল। চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের কয়েকটি পরিবারের ওপর তাদের কড়া নজরদারি ছিল। এসব পরিবারের নারীদের তারা তাদের লালসার শিকারে পরিণত করে এবং দিনের পর দিন নির্যাতন চালায়। তাদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে বটকৃষ্ট দাসের দুই কন্যা বাসন্তী ও মিনতি তাদের ভাই সনদকে নিয়ে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যান। পরবর্তীকালে তাদের আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। তাদের পরিত্যক্ত বাড়িটি বর্তমানে সরকারের জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের অফিস হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। পাকিস্তানি সৈন্যরা হুজরাপুরের ঠাকুরবাড়ি লুটপাটের পর বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। তা ছাড়া এখানে পিতলের তৈরি প্রাচীন কালের বৃহদাকারের একটি রথ ছিল, এটাও ভাঙচুর ও লুট করা হয়।
১৯৭১ সালের মধ্য এপ্রিল থেকে ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এই নির্মম নির্যাতন ও গণহত্যা চলতে থাকে। সেই সময়ে হুজরাপুরের বহু মানুষ গণহত্যার শিকার হন।
সৌজন্যেঃ ভোরের কাগজ