প্রতিরোধে উত্তাল অবিস্মরণীয় ২৩ মার্চঃ বাহালুল মজনুন চুন্নূ

1749

Published on মার্চ 24, 2018
  • Details Image
২৩ মার্চ। বাঙালির জীবনে স্মরণীয় একটি দিন। একাত্তরের এই দিনে বাংলার ঘরে ঘরে বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত জাতীয় পতাকা উড়েছিল। প্রতিরোধ দিবস পালন উপলক্ষে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করার মধ্যে দিয়ে পাকিস্তানি শাসকদের কেবল বৃদ্ধাঙ্গুলিই দেখায়নি বাঙালি, তারা যে স্বাধীন সার্বভৌম মাতৃভূমি প্রতিষ্ঠা করতে বদ্ধপরিকর সেটার বহিঃপ্রকাশও ঘটিয়েছিল। মার্চ ছিল উত্তাল এক মাস। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশভাবে জয়লাভের পরেও ক্ষমতা হস্তান্তরে ইয়াহিয়ার টালবাহানা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন, পল্টনে স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ, সাতই মার্চের ভাষণ, অসহযোগ আন্দোলনে সর্বত্রই উত্তপ্ত পরিস্থিতি, সর্বত্রই অস্থিরতা। পাকিস্তানি আইন ও প্রশাসন পুরোপুরি অকার্যকর হয়ে পড়েছিল। দেশ চলছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে। পাকিস্তানিদের দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে, অন্যায়-অন্যায্য কর্মের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর প্রতীক হিসেবে ২৩ মার্চের পাকিস্তানের প্রজাতন্ত্র দিবসকে বাঙালি বেছে নিয়েছিল প্রতিরোধ দিবস হিসেবে। এই দিন রাষ্ট্রপতি ও গভর্নর পাকিস্তানের পতাকাখচিত মঞ্চে দাঁড়িয়ে সামরিক অভিবাদন গ্রহণ করতেন। সর্বত্র উড়ত পাকিস্তানি পতাকা। কিন্তু একাত্তরের ২৩ মার্চ পাকিস্তানি পতাকার পরিবর্তে বাংলাদেশের সর্বত্র বাংলাদেশের নতুন পতাকা উত্তোলন করা হয়েছিল।
 
প্রতিরোধ দিবসে ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোডের বাসভবনের শীর্ষে নিজের হাতে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন স্বাধীনতা আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। রাজধানী ঢাকাসহ সারা বাংলার স্বাধীনতাপাগল বাঙালিরা এদিন ঘরে ঘরে, অফিস-আদালতে, সর্বত্র সগৌরবে উত্তোলন করেছিল স্বাধীন বাংলার সবুজ জমিনের ওপর লাল সূর্য এবং সোনালি রঙের বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত নতুন পতাকা। ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাধীন বাংলার পতাকা তোলার পর প্রভাতফেরি বের করা হয়। তারপর আজিমপুর কবরস্থানে স্বাধিকার আন্দোলনের বীর শহিদদের মাজার জিয়ারত শেষে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে পুষ্পমাল্য অর্পণ করা হয়। এরপর আনুষ্ঠানিকভাবে পল্টন ময়দানে হাজার হাজার মানুষের সামনে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃ-চতুষ্টয় (নূরে আলম সিদ্দিকী, আব্দুল কুদ্দুস মাখন, আসম আব্দুর রব, শাহজাহান সিরাজ)। সেই সময় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটি গাওয়া হয়। সামরিক কায়দায় জাতীয় পতাকার প্রতি অভিবাদন জানানো হয়। কুচকাওয়াজ করা হয়। তারপর তারা জনতাকে সঙ্গে নিয়ে মিছিল করে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর হাতে জাতীয় পতাকা তুলে দেন। বঙ্গবন্ধু পতাকাটি গ্রহণ করেন। তিনি পতাকাটি উঁচু করে তুলে ধরে জনতাকে সেটি দেখান এবং হ্যান্ডমাইক হাতে নিয়ে জনতার উদ্দেশে বলেন, যতদিন বাঙালির মুক্তি ও স্বাধীনতা অর্জিত না হবে— ততদিন আমাদের অসহযোগ আন্দোলন চলবে। জনগণকে বৃহত্তর আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বঙ্গবন্ধু নিজেই আবার স্লোগান তোলেন— ‘তোমার দেশ আমার দেশ—বাংলাদেশ বাংলাদেশ’, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো/বাংলাদেশ স্বাধীন করো’, ‘জাগো জাগো বাঙালি জাগো, সংগ্রাম সংগ্রাম চলছে চলবে’। লাখো জনতা বাঙালির শার্দুলের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়েছিল সেদিন।

বাঙালিদের প্রতিরোধ দিবসে প্রেসিডেন্ট হাউজ, ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট এবং গভর্নর হাউজ ছাড়া আর কোথাও পাকিস্তানের পতাকা দেখা যায়নি। গভর্নর হাউজের  মেইন গেটের বাইরেও সংগ্রামী বাঙালিরা স্বাধীন বাংলার একটি পতাকা স্থাপন করে রাখে। এমনকি হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে স্বাধীন বাংলার পতাকা তোলার সময় সেনাবাহিনীর সদস্যরা বাধা দিলে ছাত্র-জনতা তা উপেক্ষা করে পতাকা তোলেন। ঢাকাস্থ ব্রিটিশ হাইকমিশন, সোভিয়েত কনস্যুলেট, চীন, ইরান, নেপাল ও ইন্দোনেশিয়ার দূতাবাসে স্বাধীন বাংলার পতাকা তোলা হয়। জনতার হাতে হাতে স্বাধীন বাংলার পতাকা। ঢাকা শহরসহ পুরো পূর্ববাংলা হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকাময়। চারিদিকে উচ্ছ্বাস। চারিদিকে ‘জয়বাংলা’ স্লোগান। লাখো জনতার কণ্ঠ হতে জয় বাংলা স্লোগানটি ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়ে ইথারে ভাসতে ভাসতে যেন সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল।

তেইশে মার্চ নিয়ে ইয়াহিয়ার উপদেষ্টা জি ডব্লিউ চৌধুরী তার দি লাস্ট ডে’জ অব ইউনাইটেড পাকিস্তান গ্রন্থে লিখেছেন, ‘পাকিস্তান সৃষ্টির পর ২৩ মার্চকে জাতীয় দিবস ঘোষণা করা হয় এবং দিনটিকে যথাযথ মর্যাদার সঙ্গে পালন করা হচ্ছিল। কিন্তু ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ ঢাকায় দিনটিকে প্রতিরোধ দিবস হিসেবে পালন করা হয়। কোথাও কোনো পাকিস্তানি পতাকা উত্তোলনের অনুমতি দেওয়া হয়নি। কোনো সরকারি ভবনে নয়, এমনকি বেসরকারি ভবনেও নয়। কেবল নিঃসঙ্গভাবে দুটি স্থানে ওড়ে এই পতাকা। প্রেসিডেন্ট হাউস, যেখানে সে সময়ে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান অবস্থান করছিলেন এবং প্রাদেশিক সরকারের ভবন। পাকিস্তানি পতাকা কেবল ওড়ানো বন্ধ করা হয়নি, সর্বত্র এই পতাকা পোড়ানো হয় এবং অপমানিত করা হয়। পাশাপাশি সর্বত্র ওড়ানো হয় বাংলাদেশের পতাকা।’ বাঙালির স্বাধীনতা অর্জনের পথে এই দিনটির মাহাত্ম্য অনেক। সারাদেশে বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত নতুন পতাকাটি ওড়ানোর মধ্যে দিয়ে বাঙালিরা স্বাধীনতা সংগ্রামে উদীপ্ত হয়েছিল। যে উদ্দীপনার ধারাবাহিকতায় লাখো শহিদের রক্তের বিনিময়ে বিশ্বের মানচিত্রে জায়গা করে নিয়েছিল স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।

 
সৌজন্যেঃ ইত্তেফাক  

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত