3640
Published on মার্চ 23, 2018১৯৭১-এর ২৫ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাঙালির স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা অঙ্কুরে বিনাশ করতে চেয়েছে নজিরবিহীন গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞে। গণহত্যা ঢাকা থেকে ছড়িয়ে পরবর্তী নয় মাসে সমগ্র বাংলাদেশে অব্যাহত ছিল। মহান মুক্তিযুদ্ধে নিহতের সংখ্যা ৩০ লাখ কিংবা আরো বেশি। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এ পর্যন্ত পাঁচ হাজারের অধিক বধ্যভূমির সন্ধান পাওয়া গেছে। এর মধ্যে এক হাজার বধ্যভূমি চিহ্নিত। আফসোসের বিষয় স্বাধীনতার ৪৭ বছরে এই বধ্যভূমিগুলো অরক্ষিত রয়ে গেছে। অরক্ষিত উল্লেখযোগ্য বধ্যভূমিগুলো নিয়ে এই ধারাবাহিক রচনা।
বাঙালি জাতির ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেছে অসংখ্য সফল আন্দোলন ও সংগ্রাম। এগুলো যেমন জাতির ঐতিহ্য ও গর্বের প্রতীক, তেমনি কষ্ট ও বেদনার অনুষঙ্গ। বাংলাদেশের অন্যতম উর্বর ভূমি ময়মনসিংহ জেলা যুগে যুগে এসব সফল আন্দোলন ও সংগ্রামের সাক্ষী।
১৯৭১ সালে ময়মনসিংহ জেলার ভালুকা থানার ৫ নম্বর বিরুনিয়া ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ড বিরুনিয়া, কংশেরকুল ও কাইচান গ্রাম নিয়ে গঠিত ছিল। ভালুকা-গফরগাঁওয়ের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষাকারী আধাপাকা সড়কটি সামরিক যানবাহন চলাচলের অনুপযোগী ছিল। তা ছাড়াও খালবিল ও উঁচু-নিচু ভূমিতে এলাকা পরিপূর্ণ ছিল। ময়মনসিংহ থেকে একটি রেললাইন গফরগাঁও হয়ে ঢাকা পর্যন্ত বিদ্যমান। তখন ঢাকা-ময়মনসিংহ পর্যন্ত সরাসরি কোনো সড়ক পথ না থাকায় টাঙ্গাইল হয়ে যোগাযোগ রক্ষা করা হতো। ফলে এলাকাটি মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বিশেষ করে ভালুকায় অবস্থানরত আফসার বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নিরাপদ ছিল।
ভালুকা থানার অন্তর্গত পোনাশাইল, রাজৈ, বিরুনিয়া, মল্লিকবাড়ি, বয়রার ট্যাঁক, উথুরা নয়নপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় আফসার বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে বেশ কয়েকবার সংঘর্ষে পাকিস্তানি সৈন্যরা পিছু হটতে বাধ্য হয়। পরবর্তীকালে জিঘাংসার বশবর্তী হয়ে পাকিস্তানি সৈন্যরা তাদের এদেশীয় দোসরদের সহযোগিতায় এসব গ্রামের জনগণের ওপর অকথ্য নির্যাতন চালাতে থাকে এবং এলাকার ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। সেইসঙ্গে চলতে থাকে নারী নির্যাতন।
১৭ নভেম্বর বুধবার আনুমানিক সকাল ১০টায় বিরুনিয়া, কংশেরকুল ও কাইচান গ্রামে পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাদের স্থানীয় দোসরদের সহায়তায় নির্মম গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। নারী নির্যাতন ও লুটপাটের পর পাকিস্তানি সৈন্যরা শতাধিক ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে।
ইতোপূর্বে জুন মাসের শেষ দিকে বিরুনিয়া ইউনিয়নের ভাওয়ালিয়া বাজুতে আফসার বাহিনীর সঙ্গে সংঘটিত যুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হয়। তাই প্রথম থেকেই বিরুনিয়া তাদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। বিরুনিয়া আক্রমণের অন্যতম কয়েকটি কারণ ছিল-
১. বিরুনিয়া গ্রামের ঠাকুরবাড়িতে মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায় হতে বিভিন্ন সময়ে কয়েকজন অধিনায়কের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা শিবির স্থাপন করে যুদ্ধ পরিচালনা করতেন।
২. ঠাকুরবাড়ির বিনোদ বিহারী চক্রবর্তী ও তার দুই পুত্র (বাদল বিহারী চক্রবর্তী ও দিলীপ চক্রবর্তী) মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য আশ্রয় ও থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করতেন।
৩. হিন্দু অধ্যুষিত এই এলাকায় হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি বজায় ছিল।
৪. বিরুনিয়া, কংশেরকুল ও কাইচান গ্রামের কেউ রাজাকার বাহিনীতে যোগদান করেননি।
৫. স্বদেশি আন্দোলনের অন্যতম নেতা মধুসূদন ভৌমিকের বাড়ি বিরুনিয়া গ্রামে।
৬. এই এলাকায় আওয়ামী লীগের সমর্থক বেশি ছিল।
৭. সর্বোপরি ভালুকা থানাতেই আফসার বাহিনীর সরব উপস্থিতি বিদ্যমান ছিল।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর স্থানীয় দোসররা বিভিন্ন উৎস থেকে তথ্যসংগ্রহ করে সেনাছাউনিতে সরবরাহ করত। ভালুকায় অবস্থানরত পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাদের এদেশীয় দোসরদের মাধ্যমে উপরোক্ত বিষয়াদি জানতে পেরে বিরুনিয়া গ্রামে আক্রমণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ভালুকা থানার সুতিয়া নদীর পাড় ধরে ধীতপুর, বিরুনিয়া ও রাজৈ ইউনিয়নের বিশাল এলাকাজুড়ে হিন্দু অধ্যুষিত শিক্ষিত, সংস্কৃতিমনা ও রাজনীতি সচেতন মানুষের বসবাস। তাদের অন্যতম বিনোদ বিহারী চক্রবর্তী স্থানীয় গণবাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে বিরুনিয়া, কংশেরকুল ও কাইচান গ্রামের বাসিন্দাদের পাকিস্তান বিরোধী মানসিকতায় উদ্বুদ্ধ করেন।
মুক্তিযুদ্ধকালীন ১১ নম্বর সেক্টরের আওতাধীন এই অঞ্চলে দুর্গম যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর উল্লেখযোগ্য শক্ত অবস্থান ছিল না। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৩৩ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট ও ৭০ উইং রেঞ্জার্সের অপারেশনাল আওতায় ছিল ভালুকা থানা। টাঙ্গাইল ও রাজেন্দ্রপুরে অবস্থান করছিল ৩১ বালুচ রেজিমেন্ট।
১৭ নভেম্বর ভালুকা ও গফরগাঁও থানায় অবস্থিত পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরদের একটি দল দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে বিরুনিয়াকেন্দ্রিক ৩ নম্বর ওয়ার্ডকে ঘিরে ফেলে। এক ভাগ মশাখালি ও মুখী হয়ে বিরুনিয়া ও কংশেরকুল গ্রামে এবং আরেক ভাগ গয়েসপুর হয়ে রাজৈ এলাকা দিয়ে বিরুনিয়া ও রাজৈ ইউনিয়নের গ্রামগুলোতে গণহত্যা ও অগ্নিসংযোগ শুরু করে। গ্রামের নিরীহ জনগণ ভয়ে চিৎকার করতে করতে প্রাণ বাঁচানোর জন্য দিগি¦দিকে পালাতে থাকেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আক্রমণের খবর পেয়ে এলাকায় অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধারাও পাল্টা আক্রমণ করতে থাকেন। তবে গ্রামগুলোতে পর্যাপ্ত সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা না থাকায় তাদের আক্রমণও ছিল দুর্বল। পাকিস্তানি সৈন্যরা ইতোমধ্যে অধ্যক্ষ অনিল ভৌমিকের বাড়ি পৌঁছে যায়। গোলাগুলির মধ্যে কয়েকজন প্রতিবেশীর সঙ্গে বিনোদ বিহারী চক্রবর্তী তার স্ত্রী ও দুই ছেলেকে (বাদল বিহারী চক্রবর্তী ও দিলীপ চক্রবর্তী) নিয়ে অনিল ভৌমিকের বাড়ির পেছনের ডোবায় আশ্রয় গ্রহণ করেন। পাকিস্তানি সৈন্যরা অনিল ভৌমিকের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে এবং দুপুর প্রায় ১২টার দিকে ডোবায় আত্মগোপনকারীদের সন্ধান পেয়ে তাদের পাড়ে তুলে গুলি করে। গুলিবিদ্ধ হয়ে ৫ জন শহীদ হন এবং আহত অবস্থায় বাদল বিহারী চক্রবর্তী মৃতের ভান করে পড়ে থাকায় বেঁচে যান।
সেদিনের আক্রমণে বিরুনিয়া, কংশেরকুল, কাইচান ও আশপাশের গ্রামগুলোতে প্রায় ১৫০ জন শহীদ হন। যারা মৃত্যুর হাত থেকে সেদিন বাঁচতে সক্ষম হয়েছিলেন তারা কোনো রকমে ৩টি গ্রামের শহীদদের লাশ দাফনের চেষ্টা করেন। অতি সন্তর্পণে কবর খুঁড়ে একই কবরে ২-৩টি করে লাশ দাফন করেন। অনেক মৃতদেহ নদীর পানিতে ভেসে যায়, অনেক লাশ শিয়াল আর কুকুরের খাদ্যে পরিণত হয়। গুরুতর আহত অনেক মানুষ বিনা চিকিৎসায় পরবর্তীকালে মৃত্যুবরণ করেন। পাকিস্তানি সৈন্যদের গুলিবর্ষণে ভীত হয়ে ২ জন কিশোর (নুরু ও দুলাল) প্রাণরক্ষার জন্য পানিতে নামার চেষ্টা করেন কিন্তু পাকিস্তানি সৈন্যরা তাদের হাত ধরে জোরপূর্বক টেনে ওপরে তুলে। তারা প্রাণভিক্ষা চেয়েছিলেন কিন্তু নিরপরাধ দুই কিশোরকে মশাখালির সেনাছাউনিতে নিয়ে যায় পাকিস্তানি সৈন্যরা। পরবর্তীকালে তাদের আর কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি।
সৌজন্যেঃ ভোরের কাগজ