ডেনড্রোবিয়াম শেখ হাসিনা এবং এলডিসি থেকে উত্তরণঃ প্রফেসর ড. অরুণ কুমার গোস্বামী

4847

Published on মার্চ 21, 2018
  • Details Image

সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সিঙ্গাপুর সফরের সময় সেখানকার একটি অর্কিড ফুলের নামকরণ করা হয়েছে ‘ডেনড্রোবিয়াম শেখ হাসিনা’। এই প্রাপ্তিটি বাংলাদেশের জনগণকে প্রধানমন্ত্রী উৎসর্গ করেছেন। উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী উন্নত ও সমৃদ্ধ নগররাষ্ট্র সিঙ্গাপুরের কাছ থেকে এরূপ উপহার বাংলাদেশের জাতীয় গৌরবের একটি বিষয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আমাদের প্রাণপ্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের জাতি-রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতার ৪৭তম দিবসের মুহূর্ত, অন্যান্য অনেক কিছুর পাশাপাশি মূলত তিনটি উপাদান দ্বারা পরিবেষ্টিত। এই তিনটি উপাদানের দুটি হচ্ছে বর্তমানের মর্যাদাকর অবস্থান, আর তৃতীয়টি হচ্ছে মর্যাদার এই অবস্থান ধরে রাখা এবং ভবিষ্যতে এর ধারাবাহিকতা অনুযায়ী আরো এগিয়ে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা। বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ও প্রয়োজনীয় বিষয় হচ্ছে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদায় বাংলাদেশের উন্নীত হওয়া এবং বলা বাহুল্য, এসব অর্জনের ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলেই কেবল দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এযাবৎকালের সব স্মরণীয়-বরণীয় মর্যাদা প্রাপ্তি আমাদের জাতীয় ইতিহাসের পাতায় গৌরবের বার্তা হয়ে থাকবে। আর এভাবেই বাংলাদেশ এক সময় উন্নত দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে।

এ বছরের অর্থাৎ ২০১৮-এর ডিসেম্বরে নির্বাচন। নির্বাচনকে সামনে রেখে এই তৃতীয় উপাদানটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দিয়েছে। এই সঙ্গে প্রথমটি অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সিঙ্গাপুর সফর, একটি প্রত্যয় আমাদের সামনে এনে দিয়েছে, তা হলো, লি কুয়ান ইউয়ের নেতৃত্বে সিঙ্গাপুরের উন্নয়ন কৌশলগুলো লক্ষ করা। কিংবা এ ক্ষেত্রে সিঙ্গাপুরের প্রতিবেশী মাহাথির মোহাম্মদের মালয়েশিয়ার উন্নয়ন কৌশলগুলো লক্ষ করা। দারিদ্র্যপীড়িত তৃতীয় বিশ্বের দেশ থেকে উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার গৌরবোজ্জ্বল কাহিনী লি কুয়ান ইউয়ের নেতৃত্বে সিঙ্গাপুরের আছে। এ কাহিনী মালয়েশিয়ারও আছে, মাহাথির মোহাম্মদের নেতৃত্বে। উল্লেখ্য, লি কুয়ান ইউয়ের ছেলে লি সিয়েন লোং সিঙ্গাপুরের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী। লি কুয়ান ইউ যাঁকে সাধারণভাবে এলকেওয়াই হিসেবেই চিহ্নিত করা হয়। তিনি অর্থাৎ লিকুয়ান ইউ হচ্ছেন সিঙ্গাপুরের মহান স্থপতি। তিনি ছিলেন সিঙ্গাপুরের প্রথম প্রধানমন্ত্রী। একনাগাড়ে তিন দশক তিনি শাসন করে সিঙ্গাপুরকে তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশ থেকে প্রথম বিশ্বের পর্যায়ে পৌঁছে দিয়েছেন।

সিঙ্গাপুর এবং মালয়েশিয়ার অনেকের কাছেও যথাক্রমে লি কুয়ান ইউ এবং মাহাথির মোহাম্মদের অনুসৃত পথ পছন্দ হয়নি। যেমনটি বাংলাদেশেও দেখা যায়। কিন্তু সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ার এই দুজন নেতা স্ব স্ব দেশের উন্নয়নের স্বার্থে সেইসব বিরুদ্ধ ও ক্ষতিকারক পথ সত্ত্বেও তাদের দেশকে এগিয়ে নিতে পেরেছেন।

মাহাথিরকে বলা হয় আধুনিক মালয়েশিয়ার প্রতিষ্ঠাতা। দরিদ্র, জীর্ণ এক মালয়েশিয়াকে তিনি ঈর্ষণীয় উন্নতির সোনালি বন্দরে নিয়ে গিয়েছেন। ১৯৮১ সাল থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত মাহথির মোহাম্মদ মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। এই সময়কেই বলা হয় মালয়েশিয়ার স্বর্ণযুগ। দেশে বিপুল জনপ্রিয় মাহাথির মোহাম্মদের সঙ্গে বিশ্বব্যাংকসহ পাশ্চাত্যের দ্ব›দ্ব ছিল তার পুরো শাসনামল জুড়েই। বিশ্বব্যাংকের সহায়তা নিতে তিনি অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। বাংলাদেশের কয়েকটি সংবাদ মাধ্যমে প্রচারিত প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদের মিল তুলে ধরেছেন অস্ট্রেলিয়ার সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘গভর্নমেন্ট এন্ড ইন্টারন্যাশনাল পলিটিক্স’-এর অধ্যাপক জন কীয়েন।

অপরদিকে, মালয়েশিয়ার কলামিস্ট এবং বিশ্লেষক পি গুনাসেগারম তার ‘কম্পেয়ারিং লি কুয়ান ইউ এন্ড মাহাথির’ শীর্ষক একটি লেখায় লি কুয়ান ইউ এবং মাহাথির মোহাম্মদের তুলনা করেছেন। গুনাসেগারম বলেছেন, লি কুয়ান ইউ এবং মাহাথির মোহাম্মদ উভয়েই দৃঢ়ভাবে ক্ষমতায় থেকেছেন, তাঁরা উভয়েই বিচার বিভাগকে ব্যবহার করেছেন বিরুদ্ধ মতকে দমন করার জন্য তারা উভয়েই শক্ত হাতে দেশ শাসন করেছেন, তারা উভয়েই তাদের পরবর্তী উত্তরাধিকারের ব্যাপারে সতর্ক ছিলেন, তারা কেউই তাদের রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার করেননি। তবে তাঁরা উভয়েই তাদের জাতিগত পরিচিতির ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করেছেন, মাহাথির মালয় বা মালয়েশিয়ার ‘ভূমিপুত্র’ এবং লি কুয়ান ইউ সিঙ্গাপুরের চীনাদের প্রাধান্য টিকিয়ে রাখতে চেয়েছেন।

এর পাশাপাশি গুনাসেগারম লি কুয়ান ইউ এবং মাহাথির মোহাম্মদের মধ্যে কিছু বৈসাদৃশ্য লক্ষ করেছেন। তিনি বলছেন, মাহাথির দুর্নীতিকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছেন কিন্তু লি দুর্নীতি নির্মূল করেছেন, মাহাথির অদক্ষতাকে এগিয়ে নিতে সাহায্য করেছেন কিন্তু লি কুয়ান ইউ দক্ষতাকে এগিয়ে নিয়েছেন, মাহাথির সিভিল সার্ভিসকে হীনবীর্য করেছেন অপরদিকে লি কুয়ান ইউ সিভিল সার্ভিসকে অত্যুৎকৃষ্ট সুদক্ষ করে গড়ে তুলেছেন, মাহাথির শিল্প রক্ষা করেছেন, যেসব শিল্প টিকে থাকতে পারছিল না অর্থাৎ দুর্বল শিল্পগুলোকে লি কুয়ান ইউ পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছেন, মাহাথির শিক্ষার পচন শুরু করেছিলেন কিন্তু লি কুয়ান ইউ শিক্ষার গুণগত মান তথা উৎকর্ষতাকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছেন।

সিঙ্গাপুরে এমনিতে ঘুরে আসা হয়তো স্বাভাবিক কোনো ঘটনা কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ১১ মার্চের এই সফর ব্যক্তি শেখ হাসিনা এবং বাংলাদেশের এক বড় অনন্য মর্যাদা প্রাপ্তির দিন। সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী লি সিয়েন লোংয়ের আমন্ত্রণে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এই সফর করেন। এ সময় দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পাশাপাশি সিঙ্গাপুরের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং সে দেশের ব্যবসায়ীদের সঙ্গেও আলোচনায় বসেন। উল্লেখ্য, কাঠমান্ডুতে বাংলাদেশের ব্যক্তিমালিকানাধীন বিমান সংস্থা ‘ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স’-এর মর্মান্তিক বিমান দুর্ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী সফররত অবস্থায় তার শোক প্রকাশ করেন, নেপালের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেন, দুর্ঘটনার জন্য সব ধরনের সহযোগিতা করার প্রতিশ্রæতির কথা বলেন এবং সিঙ্গাপুর সফর সংক্ষিপ্ত করে দেশে ফিরে আসেন।

সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রথম সফরটি স্মরণীয় করে রাখতে সিঙ্গাপুর জাতীয় উদ্যানে সে দেশের জাতীয় ফুল অর্কিডের একটি প্রজাতির নামকরণ করা হয়েছে ‘ডেনড্রোবিয়াম শেখ হাসিনা’। সিঙ্গাপুরের বোটানিক্যাল গার্ডেনের কর্মকর্তারা ‘সানপ্লাজা পার্ক’ এবং ‘সোলেটার চকোলেট’ প্রজাতির শংকরায়ণের মাধ্যমে ‘ডেনড্রোবিয়াম শেখ হাসিনা’ অর্কিডের উদ্ভাবন করেছেন। সিঙ্গাপুর জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানের পরিচালক ড. নাইজেল টেইলর সি হর্ট একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ‘ডেনড্রোবিয়াম শেখ হাসিনা’ অর্কিডটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে তুলে দেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রীর ছোট বোন শেখ রেহানার ছেলে রেদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি, তার স্ত্রী পেপী সিদ্দিক ও তাদের দুই সন্তান প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন। এ ছাড়া পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদসহ প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গীরা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। নতুন অর্কিডটির শংকরায়ণের সঙ্গে সম্পৃক্ত এবং বাগানের ব্যবস্থাপক ডেভিড লিম বলেন, ‘ডেনড্রোবিয়াম শেখ হাসিনা’ অর্কিডটির শংকরায়ণ এবং পত্র-পল্লবে বিকশিত হতে সাড়ে চার বছর সময় লেগেছে। এই হাইব্রিড অর্কিড ২৫ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। প্রতিটি গাছেরই ১৫টি ফুলের থোকা হয়। প্রতিটি প্রস্থে ৫ সে.মি. হয়। প্যাঁচানো প্রতিটি ফুলের গোড়া গাঢ় পিঙ্গল রঙের এবং ফুলের মাঝখানে হালকা বাদামি ও ধবধবে সাদা প্রান্ত থাকে। সিঙ্গাপুরের রীতি অনুযায়ী ১৯৫৭ সাল থেকে দেশটিতে সফরকারী বিভিন্ন দেশের প্রায় আড়াইশো রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানের নামে স্থানীয় অর্কিডের নামকরণ করা হয়েছে বলেও ডেভিড লিম জানান। তাদের সফরকে স্মরণীয় করে রাখতেই এটা করা হয়। ‘ডেনড্রোবিয়াম শেখ হাসিনা’ অর্কিডটি এখন থেকে গার্ডেনের ভিআইপি গ্যালারির শোকেসে শোভা পাবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পুরো অর্কিড বাগানের বিভিন্ন অংশ ঘুরে দেখেন এবং বাগানের সৌন্দর্য উপভোগ করেন। বাগানটিতে ১ হাজার প্রজাতি এবং ২ হাজার শংকরায়ণকৃত উদ্ভিদ রয়েছে। সিঙ্গাপুরের এই বোটানিক্যাল গার্ডেনটি জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো ঘোষিত একটি বিশ্ব ঐতিহ্য।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বলা হয় আধুনিক বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা। দারিদ্র্য ও ক্ষুধা-পীড়িত এক বাংলাদেশকে তিনি দিয়েছেন নতুন পরিচয়। বাংলাদেশকে আজ বলা হয় উন্নয়নের রোল মডেল। নিজ অর্থায়নে পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের মতো মেগা উন্নয়ন প্রকল্পের উৎসব চলছে আজ সমগ্র বাংলাদেশ জুড়ে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানির কাছে গ্যাস বিক্রি করতে রাজি না হওয়ায় ২০০১-এ তাকে ক্ষমতা হারাতে হয়েছিল, এমন অভিযোগ তিনি প্রকাশ্যেই করেন। বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে তিনি প্রকাশ্যে দ্ব›েদ্ব জড়িয়েছিলেন। দুর্নীতির অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে বিশ্বব্যাংককে তিনি দুর্নীতি প্রমাণের আহ্বান জানিয়েছিলেন। পরে বিশ্বব্যাংকের টাকা ছাড়াই নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের কাজ শুরু করেছেন। এখন পদ্মা সেতু দৃশ্যমান। আধুনিক বাংলাদেশের রূপকার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ অদূর ভবিষ্যতে সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ার মতো একটি উন্নত সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে বিশ্বের বুকে মাথা উঁঁচু করে দাঁড়াবে, আগামী ডিসেম্বরের নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশবাসী এই আশা পোষণ করে।

লেখক : চেয়ারম্যান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

সৌজন্যেঃ দৈনিক ভোরের কাগজ

প্রকাশকালঃ ১৯ মার্চ, ২০১৮

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত