3683
Published on মার্চ 21, 2018বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের কাতারে যাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছে। আমাদের সবার জন্যই এটা অত্যন্ত আনন্দের বিষয়। কারণ আমরা স্বাধীনতা অর্জনই করেছিলাম উন্নতি করার জন্য। বিশ্বের দরবারে দেখিয়ে দেওয়ার জন্য যে বাংলাদেশ বহুদিন নির্যাতিত ছিল; কিন্তু এরা মেধাবী এবং কর্মক্ষম জাতি। কাজেই সেটা যে আমরা কাজে প্রমাণিত করতে পেরেছি, এটাই এখন সবচেয়ে বড় আনন্দের।
এই ছোট্ট ভূখণ্ডের মধ্যে ১৬ কোটি মানুষের বাস, এটা একটা মস্ত বড় চ্যালেঞ্জ। কিন্তু এই চ্যালেঞ্জ আমরা অত্যন্ত কঠোরতার সঙ্গে মোকাবেলা করে এসেছি। যেমন—১৯৭১ সালে যখন আমাদের সাড়ে সাত কোটি জনগণ ছিল, তখন আমাদের এখানে ৬০ শতাংশ মানুষের খাবার উৎপন্ন হতো, বাকিটা আমদানি করা লাগত। আজ ১৬ কোটি মানুষের দেশে আমরা খাদ্য নিজেরাই উৎপাদন করছি। এই সক্ষমতা অর্জন—এটা তো বাইরের দেশের কেউ আমাদের করে দেয়নি, আমরা নিজেরাই করেছি। এটা সম্ভব হয়েছে স্বাধীনতার পরে আমাদের উদ্দীপনা, আমাদের বেঁচে থাকার স্বপ্ন ও সর্বোপরি আমাদের নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা থেকে। এখানেই আমাদের সম্ভাবনা। আমরা যখন চলতে শুরু করেছি, স্বাধীনতার পর ৪০ বছর পার হয়ে গেছে, এত দিন যখন আমরা অগ্রগতি সাধন করেছি, ভবিষ্যতেও পারব সেই দৃঢ় বিশ্বাস আমাদের গড়ে উঠেছে। তবে একটি কথা কিন্তু বলতেই হয়, এই অগ্রগতির পথের যাত্রাটা মসৃণ ছিল না। আমরা ১৯৭৫ সালে হোঁচট খেয়েছিলাম এবং উল্টো যাত্রা শুরু হয়েছিল। সেখান থেকে অনেক চড়াই-উতরাই পার হয়ে আজকের অবস্থানে আসতে হয়েছে। বর্তমানে যারা ক্ষমতায় আছে—মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের জোট আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে, এদের অফুরন্ত প্রচেষ্টায় আমরা ২০০৯ অথবা ২০১০ থেকে আমরা উন্নতির দিকে যাত্রা শুরু করি। আস্তে আস্তে এই অর্জন সামনের দিকে এগোচ্ছে। প্রথম কয়েক বছর তো আমরা ছয় ভাগ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছি, গত বছর আমরা সাত ভাগ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছি এই সরকারের আমলে। এর আগে কিন্তু হয়নি। আমি আশাবাদী, কারণ জাতি হিসেবে বাঙালি অত্যন্ত মেধাবী, কর্মক্ষম ও সৃজনশীল।
সম্ভাবনার পাশাপাশি এখানে কিছু সমস্যাও দেখছি। সমস্যাগুলোকে আমি এভাবে ব্যাখ্যা করতে চাই—এখানে রাজনৈতিক সমস্যা কিছু আছে, আবার স্বাভাবিকভাবেই অর্থনৈতিক ব্যাপার তো আছেই। রাজনৈতিক ব্যাপারগুলো হচ্ছে, আমরা কিন্তু নেগোশিয়েট করে বা আলোচনার মাধ্যমে স্বাধীনতা পাইনি। আমরা যুদ্ধ করে স্বাধীনতা পেয়েছি এবং যারা পরাজিত হয়েছিল, তারা আমাদের কাছে অস্ত্র সমর্পণ করেছিল। এ রকম একটি অবস্থার মধ্যে বঙ্গবন্ধুকে এবং যাঁরা নাকি মুক্তিযুদ্ধের সরকার পরিচালনা করেছিলেন, চারজন মন্ত্রীসহ প্রধানমন্ত্রীকে হত্যা করা হলো; আমি মনে করি, এটা ছিল পাকিস্তানিচক্রের ষড়যন্ত্র ও কিছু কিছু দেশের সমর্থনপুষ্ট। ১৬ ডিসেম্বর তো আমাদের বিজয় দিবস। তখনো কিন্তু আমাদের দেশটি পাকিস্তানি আর্মির হাতেই ছিল, যদিও এটা অনেকে মানতে চান না এবং তারা আমাদের বাঙালিদের মধ্যে তাদের কিছু রাজনৈতিক বীজ রোপণ করে গেছে। সেটা কী রকম? রাজনীতিতে যাদেরকে আমরা মুসলিম লীগ বলি বা জামায়াতে ইসলামী—মুসলিম লীগ কিন্তু তাদের নাম পরিবর্তন করেছে, পোশাকও পরিবর্তন করেছে। যেমন—মুসলিম লীগ হয়েছে কিন্তু বিএনপি। সে জন্য দেখবেন, প্রথম দিকে যারা বিএনপি গঠন করল তারা কিন্তু মুসলিম লীগেরই নেতা। সে জন্য বলছি যে যারা আমাদের সঙ্গে পরাজিত হয়েছিল সম্মুখসমরে, পরে এই পরাজিত শক্তিই অস্ত্রের জোরে আমাদের একটি দুর্বল সময়ে আমাদের স্বাধীনতাকে হরণ করতে চেয়েছিল। তাদের উদ্দেশ্যই ছিল পাকিস্তানের সঙ্গে এটাকে মিলিয়ে কনফেডারেশন বা কিছু একটা করার। এটা হয়তো তারা পারেনি ভূখণ্ডের কারণে। বাংলাদেশের চতুর্দিকে ভারত দ্বারা বেষ্টিত বলে তারা সেটা করতে পারেনি। কিন্তু তারা তাদের আদর্শ অনুযায়ী দেশটাকে দখলের জন্য অনেকটা অগ্রসর হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় বঙ্গবন্ধুর ডাকে অল্প কিছু রাজাকার ছাড়া সমগ্র বাঙালি জাতি এক হয়েছিল। ১৯৭৫ সালে তারা আবার জাতিকে বিভক্ত করতে চেয়েছিল—নানা প্রলোভন দিয়ে, ব্যবসা-বাণিজ্য দিয়ে। এই বিভক্তিই আমাদের জন্য বড় সর্বনাশ এবং জাতির সামনে এটাই সবচেয়ে বড় সমস্যা। এ ছাড়া আমি আর কোনো সমস্যা দেখছি না। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এই বিভক্তি এড়ানোর জন্য কাজ হচ্ছে। আমাদের কেউ আর আটকে রাখতে পারবে না। এটা শুরু হয়েছে। আশা করি, দেশ অনেক দূর এগিয়ে যাবে।
সামাজিকভাবে বা প্রতিদিনের জীবনপ্রবাহে এই উন্নয়ন কোনো চাপ তৈরি করবে কি না এটাই এখন একটি বড় প্রশ্ন। উন্নয়নশীল দেশের চাপটা অনুন্নত দেশের চাপের চেয়ে আলাদা। অনুন্নত দেশে তো নানা সমস্যা থাকে—সেখানে দুর্ভিক্ষ লেগে থাকে, দারিদ্র্যের হার বেশি, পোশাকের অভাব থাকে। এটা এক ধরনের চাপ। আর উন্নয়নশীল দেশের চাপ—যেটা আমরা এখন হতে চলেছি—মোটামুটি দারিদ্র্যমুক্ত; আমাদের চাপটা অন্য রকম—আমরা আরো বড় হব কী করে। আগে না খেয়ে মরে যেতাম, এখন মরি না। খেতে পাই। আমাদের এখন চিন্তা আরেকটু ভালো কি খেতে পারি, আরেকটু ভালো বাড়িতে কি থাকতে পারি। যার ভালো বাড়ি আছে, সে ভাবছে আর একটু ওপরে কি উঠতে পারি। বিশ্বের অন্য দেশের সঙ্গে কি আমি কমপিট করতে পারি—এটা হচ্ছে সমস্যা। এটাকে আমি ইতিবাচক সমস্যা হিসেবে দেখি। এই সমস্যার মধ্যেই বর্তমানে আমরা রয়েছি। সে জন্যই আমি বলব, জাতিকে যদি আমরা একত্রীকরণ করতে পারি, আমরা যদি সমস্বরে কথা বলতে পারি, তাহলে আমি মনে করি, দ্বিতীয় যে সমস্যার কারণটি সেটা আমাদের সামনে সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দেবে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরেই আমরা যেমন মাথা তুলে দাঁড়ানোর সুযোগ পেয়েছি, আমাদের জাতীয় প্রবৃদ্ধিও বাড়তে শুরু করেছে। আপনি পাকিস্তানের দিকে তাকালে দেখবেন, তারা অনেক দিন ধরেই তিন থেকে চারের মধ্যে আছে এলডিসিতে। আমরা যখন ছয়ে ছিলাম তখনো তারা আমাদের নিচে ছিল। আমরা এখন সাতে এসেছি, তারা আগের জায়গায়ই রয়ে গেছে। কাজেই মুক্তিযুদ্ধের পরে আমরা সত্যিকার অর্থে নিজেদের স্বাবলম্বী করার ব্যাপারে কতটা অ্যাসার্ট করতে পেরেছি, এটা দেখেও অনুমান করা যায়। এবং করেছিও।
এই উন্নয়নশীলতার পেছনে রাজনৈতিক সম্পর্ক আছে। কারণ যাঁরা স্বাধীনতায় বিশ্বাস করেন, তাঁরাই তো স্বাধীনতার লক্ষ্য অর্জনের চেষ্টা করবেন। যাঁরা স্বাধীনতায় বিশ্বাস করেন না বা বিশ্বাস করেননি, তাঁরা তো এই উন্নয়নের যাত্রায় বিশ্বাস করবেন না। এগিয়েও আসবেন না। স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তিগুলোই তো এখন নানা নামে ও দলে বিভক্ত হয়ে সমাজে বিচরণ করছে। ইসলামের নামে তারা অনগ্রসরতার ভাবনা-চিন্তাই সামনে আনতে চাইবে। কারণ তারা তো এই বাংলাদেশের উন্নয়ন চায়নি। তাদের উদ্দেশ্যই হচ্ছে পাকিস্তানের সঙ্গে মিলেমিশে থাকা এবং দেশকে পিছিয়ে রাখা। তারা তো কোনো দিনই উন্নয়ন চায় না। তারা স্বাধীনতাও চায়নি। কাজেই রাজনৈতিকভাবে এই উন্নয়নশীলতার একটি বড় সম্পর্ক আছে বলে আমি মনে করি। স্বাধীনতার পক্ষের দলের পক্ষেই শুধু এই উন্নয়নে ভূমিকা রাখা সম্ভব। আমি বলি না যে সেটা আওয়ামী লীগই হবে—সেটা যে কেউ হোক না কেন, সেটা যদি স্বাধীনতার পক্ষের দল হয়, তাদের যদি চলমানতা থাকে, তাহলে আমাদের এই উন্নতির চলমানতা থাকবে। কিন্তু যদি আমরা কখনো ভুল করে ফেলি, তাহলে আমাদের পশ্চাদ্গমন শুরু হবে। সে জন্য আমাদের সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।
আমাদের জন্য কেউ কিছু করে দেয়নি, আমরা নিজেরাই আমাদের কাজ করেছি। নিজেরাই আমরা দারিদ্র্য মুক্তির সংগ্রামে এগিয়ে গিয়েছি, এখনো সেই সংগ্রাম শেষ হয়নি। আমাদের যে জীবনমান—গ্রামে আগে অনেক মানুষের শার্টও ছিল না, তিন বেলা ঠিকমতো খেতে পেত না; এখন কিন্তু একটা লুঙ্গি ও একটা শার্ট সবার আছে। মানুষ খেতে পায়। এখন আরো ভালো পোশাক পরার চেষ্টা আছে। আমাদের সন্তানরা দেশের বাইরে যারা কাজ করছে, তারা টাকা পাঠাচ্ছে—সেই টাকায় মানুষ টিনের বাড়ি বা মাটির ঘর সরিয়ে পাকা বাড়ি দিচ্ছে। এসবই কিন্তু উন্নয়নের একটা ছবি তৈরি করে। এখন কুঁড়েঘর তেমন একটা দেখাই যায় না। এই যে আমাদের উন্নতি এবং পার্থিবভাবে আমরা ভালো থাকছি, এটিই আমাদের উদ্দীপনা ও প্রেরণা দেবে সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য। এই প্রেরণা থেকেই আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সূচনা। আজকে আমরা যে পর্যায়ে পৌঁছাতে পেরেছি, সেটা আমাদের স্বাধীনতা অর্জন না হলে কিন্তু হতো না। সে জন্যই অর্থনৈতিক শক্তিকে যারা চলমান রাখেন, তাঁদের হাত ধরে আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় দেশ আরো এগিয়ে যাবে—এটাই আমার প্রত্যাশা। এটা আমার কাছে এখন সবচেয়ে আনন্দের বিষয়।
লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর
সৌজন্যেঃ কালের কণ্ঠ