নতুন উচ্চতায় বাংলাদেশঃ ড. মিল্টন বিশ্বাস

7241

Published on মার্চ 14, 2018
  • Details Image
গত ২৫ ফেব্রুয়ারি  প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, মার্চে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পাচ্ছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ে তোলার মধ্যদিয়ে স্বল্প আয়ের দেশকে যে পর্যায়ে রেখে যান, সেখান থেকে এখন বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশে গ্রাজুয়েশন লাভ করতে যাচ্ছে। গৌরবের মার্চ মাস চলছে। এ মাসে ১৯৭১ সালে বাঙালি জাতির জীবনে একাধিক ঘটনা ঘটেছে। যার ভেতর আমাদের অধিকার আদায়ের লড়াই ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণই পথ দেখিয়ে দিয়েছিল বাংলাদেশের মুক্তিকামী জনতাকে। আর ওই ভাষণে অর্থনৈতিক মুক্তির কথাও ছিল। এজন্য প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য গভীর তাত্পর্যবহ।

এ দেশ অর্থনৈতিক এবং সামাজিকভাবে কতটা অগ্রগতি লাভ করেছে সেটি মূল্যায়ন করে জাতিসংঘের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক পরিষদের উন্নয়ন নীতি বিষয়ক কমিটি বা সিডিপি ঘোষণা দেবে আমরা উন্নয়নশীল দেশ। স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের জন্য তিনটি সূচক বিবেচনা করা হয়। তিন বছরের গড় মাথাপিছু জাতীয় আয়, মানবসম্পদ সূচক যা পুষ্টি, স্বাস্থ্য, স্কুলে ভর্তি ও শিক্ষার হারের সমন্বয়ে তৈরি হয় এবং অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচক যেটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বাণিজ্য তথা অর্থনৈতিক আঘাত, জনসংখ্যার পরিমাণ ও বিশ্ববাজার থেকে একটি দেশের দূরত্বের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়। এর প্রতিটিতে বাংলাদেশ অগ্রগতি লাভ করেছে। জাতিসংঘের এ কমিটি প্রতি তিন বছর পর-পর বৈঠকে বসে। একটি বিশেষজ্ঞ টেকনিক্যাল কমিটির মাধ্যমে উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি পাবার পর যেকোনো দেশের মূল্যায়ন হয়। ২০২১ সালে এ বিষয়ে প্রথম রিভিউ হবে, বাংলাদেশ সব ক্ষেত্রে তা অর্জনকে কতটা সুদৃঢ় করেছে, এরপর ২০২৪ সালে আরেকটি মূল্যায়ন হবে। এই দুটি পর্যালোচনায় পার হলে ২০২৪ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে তখন প্রস্তাব করা হবে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে স্থায়ী স্বীকৃতি দেবার জন্য।

১৯৭৪ সালে মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাস্তবতায় ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামলে আমেরিকার তত্কালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে মন্তব্য করেছিলেন। এ ধরনের মন্তব্য করেই ক্ষান্ত হননি তিনি, বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার প্রতি বাংলাদেশকে কোনো প্রকার সাহায্য-সহযোগিতা না করার পরামর্শ দেন। তাদের বিরোধিতা ও ষড়যন্ত্রের পরও বাংলাদেশ আজ বিশেষ অবস্থানে পৌঁছেছে। এ কারণে শেখ হাসিনার শাসনামলেই কিসিঞ্জারের পরবর্তী নেতৃবর্গ ভিন্ন সুরে কথা বলছেন। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ওবামা এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন বাংলাদেশকে বিশ্বের মডেল এবং বাংলাদেশস্থ সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডাব্লিউ মাজেনা ‘এশিয়ার টাইগার’ বলে মন্তব্য করেছেন। তাঁরা উভয়ে এ ধরনের মন্তব্য করতে বাধ্য হয়েছেন বাংলাদেশের নানামুখী সাফল্য ও উন্নয়নের জন্য। আজকে বাংলাদেশ যে অবস্থানে দাঁড়িয়েছে এটা হিলারি ও ওবামার পূর্ব-পুুরুষরা কোনোদিন স্বপ্নেও ভাবেননি। ২০১২ সালের ১৯ জুলাই মার্কিন কংগ্রেসের শুনানিতে সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী রবার্ট ব্লেক বলেছেন, বাংলাদেশ এশিয়ার একটি মডেল হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ শুনানিতে ডেমোক্র্যাটিক কংগ্রেসম্যান জো. ক্রাউলি ২০০৮ সালে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য বাংলাদেশের প্রশংসা করেন। ২০১২ সালের ২০ জুলাই রাজধানীর এক অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রদূত মাজেনা বলেন- বাংলাদেশের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। এদেশ হবে বিশ্বের অন্যতম রফতানিকারক দেশ, বিশেষ করে ওষুধ শিল্প, তৈরি পোশাক, তথ্যপ্রযুক্তি, হিমায়িত মাছ রফতানির মাধ্যমে বাংলাদেশ হবে এশিয়ার টাইগার। তিনি আরো বলেন, কৃষি এবং শিক্ষা খাতে বাংলাদেশে বিপ্লব হবে। এসব অর্জন সম্ভব হয়েছে জনগণের প্রতি সরকারের অঙ্গীকারদীপ্ত নেতৃত্বের জন্য। 
 
বাংলাদেশে তৃণমূলে তথ্যপ্রযুক্তির প্রসার, সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থার প্রবর্তন, সর্বসাধারণের কাছে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়া, সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনির মাধ্যমে সমাজে অবহেলিত মানুষের জীবনধারার মানোন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচনে অগ্রগতি এবং সীমিত সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করে বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রাকে বিশ্বদরবারে রোল মডেল হিসেবে উপস্থাপন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, পরিবেশ এবং প্রযুক্তিগতভাবে দক্ষিণের দেশগুলোর সামগ্রিক উন্নয়ন চিত্রে বাংলাদেশ এখন অনন্য। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফেরার পর থেকে দারিদ্র্যের হার দ্রুত কমে এসেছে। সামাজিক সুরক্ষামূলক কর্মসূচির আওতায় বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, স্বামী পরিত্যক্তা ও দুঃস্থ ভাতা, পঙ্গু, প্রতিবন্ধী ও অসহায়দের জন্য ভাতা, মাতৃত্বকালীন ভাতা, অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, ভর্তুকি মূল্যে খোলাবাজারে খাদ্যপণ্য বিক্রি, ভিজিডি, ভিজিএফ, টেস্ট রিলিফ, কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচির আওতায় খাদ্য সহায়তা, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি ইত্যাদি কর্মসূচি বাস্তবায়িত হয়েছে। 

গ্রামীণ জীবনের ব্যাপক রূপান্তরের ঘটনা অতুলনীয়। ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠার প্রভাব পড়েছে সর্বত্র। দেশের প্রতিটি ইউনিয়নে তথ্য ও সেবাকেন্দ্র চালু রয়েছে। এসব তথ্য কেন্দ্র থেকে গ্রামীণ জনগোষ্ঠী বিভিন্ন সরকারি ফরম, নোটিস, পাসপোর্ট ও ভিসা সংক্রান্ত তথ্য, কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও বিভিন্ন সেবা বিষয়ক তথ্য, চাকরির খবর, নাগরিকত্ব সনদপত্র, পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল, বিদেশে চাকরি প্রাপ্তির লক্ষ্যে রেজিস্ট্রেশনসহ ২২০টি সেবা গ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। উপরন্তু মোবাইল ব্যাংকিং, জীবন বীমা, মাটি পরীক্ষা ও সারের সুপারিশ, বিদ্যুত্ বিল পরিশোধ এবং জমির পর্চাসহ অন্যান্য সেবা পাওয়ার সুযোগ রয়েছে। প্রায় চার হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার ল্যাব স্থাপন সম্পন্ন হয়েছে। উপজেলা ও জেলা হাসপাতালগুলোতে মোবাইল স্বাস্থ্যসেবা টেলিমেডিসিন সিস্টেমসহ চলছে। মোবাইল টেলিফোন সিমের সংখ্যা ১৫ কোটিতে উন্নীত হয়েছে আর থ্রি-জি-এর পর ফোর-জি প্রযুক্তি জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে ব্যাপকভাবে। এসবই উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার সোপান।

বস্তুত স্বাধীনতার পর ৪৭ বছর পেরিয়ে গেছে উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি পেতে। তবে বিষয়টি এ দেশের জন্য গৌরবের। জাতি হিসেবে আমরা চাই নিজেদের মর্যাদা ও গৌরব প্রতিষ্ঠিত করতে। এই স্বীকৃতি বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সম্মানিত করবে। বর্তমানে স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ রপ্তানিসহ বিভিন্ন খাতে অর্থনৈতিক সুবিধা পায়। যেমন তৈরি পোশাক রপ্তানির ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা পায় বাংলাদেশ, যেটি বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি আয়ের সংস্থান করে। নতুন স্বীকৃতির ফলে স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে পাওয়া সেসব সুবিধা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তবে চিন্তা করার কোনো কারণ নেই সরকারের নেতৃত্ব পুনরায় আমাদের সামনে এগোতে উত্সাহিত করবে। আমরা উন্নত দেশের মর্যাদায় অভিষিক্ত হবো ২০৪১ সালে।

লেখক : অধ্যাপক , জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

সৌজন্যেঃ দৈনিক ইত্তেফাক

প্রকাশঃ ১৩ মার্চ ২০১৮

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত