4647
Published on মার্চ 8, 2018কন্যা সন্তানকে স্বাবলম্বী করে তুলতে সহায়তা করতে অভিভাবকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
৮ই মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস ২০১৮ উদযাপনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমিও সকলের কাছে আহ্বান জানাব যে, বিয়ে দিলেই মেয়ের ওপর থেকে দায়িত্ব চলে যায় না। বরং দায়িত্ব আরও বাড়ে। মেয়েকে যদি লেখা পড়া শিখিয়ে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যেতে পারে; সেটাই সমাজের জন্য সব থেকে ভালো.. পরিবারের জন্যও সেটা একটা সুরক্ষা সুষ্টি করতে পারে।”
বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে এই অনুষ্ঠানে নারী উন্নয়নে সরকারের উদ্যোগের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, “সমাজে যদি নারী পড়ে থাকে; তাহলে এই সমাজ মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। নারীদের অধিকার সুরক্ষিত করে তাদের অধিকার সৃষ্টি করে দেওয়া এবং সর্বক্ষেত্রে তাদের বিচরণ যেন নিশ্চিত হয়; সেটাই আমাদের লক্ষ্যে। আর সেই কাজটাই করে আমরা অনেকদূর এগিয়ে নিয়ে গেছি।
“বাংলাদেশের মেয়েরা পিছিয়ে নেই। যে বাধা ছিল; তা অতিক্রম করে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি।”
রাজনীতি, প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী থেকে শুরু করে সশস্ত্র বাহিনী, বিচার বিভাগ, ব্যবস্থা ও ক্রীড়াঙ্গনে নারীদের পদচারণার কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, “সকল জায়গায় মেয়েরা কিন্তু তাদের স্থান করে নিয়েছে। একটু সাহসের সাথে এগিয়ে গেলেই কিন্তু স্থান করা যায়। মেয়েরা যখন কাজ করে; আমি মনে করি খুব ভালোভাবেই কাজ করে। তাদের দক্ষতা অনেক বেশি; কোনো সন্দেহ নাই।”
নারী শিক্ষার ওপর জোর দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “বাবা-মাও যখন দেখে যে, আমার মেয়ে লেখাপড়া শিখে সে যখন অর্থ উপার্জন করতে পারে, সংসারে সহযোগিতা করতে পারে; তখন আর বিয়ে দেওয়ার জন্য তাড়াহুড়া করবে না।”
নারীদের নিজের পরিবারের প্রতি দায়িত্ব যথাযথ পালনের কথাও মনে করিয়ে দেন প্রধানমন্ত্রী।
চারটা বিভাগে মহিলা পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠার কথা মনে করিয়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “পর্যায়ক্রমিকভাবে আমরা প্রতিটি বিভাগে এই পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট করবো। প্রতিটি বিভাগে আমরা মহিলা মহিলা কারিগরি স্কুল ও কলেজ আমরা প্রতিষ্ঠা করে দেব। সে ব্যবস্থাও আমরা নিয়েছি।”
প্রতিটি উপজেলায় সরকারি ট্রেনিং সেন্টার চালুর কথাও বলেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, “৭০টি সরকারি ট্রেনিং সেন্টার-টিটিসি চালু হয়েছে। প্রতিটি উপজেলায় আমরা টিটিসি চালু করবো। এখানে ছেলে-মেয়ে উভয়েই পড়াশোনার সুযোগ পাবে।”
সব উপজেলায় কর্মজীবী মহিলাদের জন্য হোস্টেল তৈরিতে ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলে শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, “স্বল্প ব্যয়ে কর্মজীবী মহিলাদের জন্য ঢাকাসহ অন্যান্য জেলা শহরে ৮টি হোস্টেল পরিচালনা করা হচ্ছে। পর্যায়ক্রমিকভাবে প্রতিটি জেলায় আমরা কর্মজীবী মহিলাদের জন্য এই হোস্টেল করে দেব। উপজেলা পর্যন্ত যেন হয়; সে ব্যবস্থা আমরা নেব।”
নারীদের উন্নয়ন ছাড়া উন্নত সমাজ প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয় বলে মন্তব্য করে শেখ হাসিনা বলেন, “একটা সমাজ উন্নত হবে কীভাবে? সমাজকে উন্নত করতে হলে নারী-পুরুষ সবাইকে সমানভাবে সুযোগ করে দিতে হবে। সেভাবেই নারীদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও করতে হবে। কর্মক্ষেত্রে তাদের শক্তি ও মেধা যেনো কাজে লাগে; তার ব্যবস্থাটাও করতে হবে।
“মেয়েদের আমরা সুযোগ না দিলে কোনো কাজই হবে না”
সরকারের উদ্যোগে পাশাপাশি নারীদের এগিয়ে আসার তাগিদ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “একটু সাহস করে এগিয়ে যাওয়া সেটাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় বিষয়।”
নারীর অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতার ওপর জোর দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “অর্থনৈতিক স্বাধীনতাটা এখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মেয়েদের বসে থাকলে চলবে না। নিজেদেরও কাজ করতে হবে, লেখাপড়া শিখতে হবে এবং নিজেদের পায়ে দাড়াতে হবে।”
মেয়েদের উচ্চশিক্ষায় বৃত্তি দেওয়ার কথা মনে করিয়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট ফান্ড থেকে উচ্চ শিক্ষায় বৃত্তি দিচ্ছি। উচ্চ শিক্ষা বৃত্তির ৭৫ ভাগই মেয়েরা পায়।”
মহিলাদের আত্ম-কর্মসংস্থানের জন্য দেশব্যাপী ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম চলমান থাকার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “মেয়েরা যেন নিজেরা ব্যবসা-বাণিজ্য গড়ে তুলতে পারে; সেই সুযোগটা আমরা করে দিয়েছি।”
সারাদেশে ৭৪টি ডে-কেয়ার সেন্টার স্থাপন করা হলেও প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে এর প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “মা তখনই কাজে মনোযোগ দিতে পারবে; যখন তার সন্তানটা সুরক্ষিত থাকবে। প্রতিটি জায়গায় ডে-কেয়ার সেন্টার করা প্রয়োজন।”
প্রশিক্ষণের ওপর জোর দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, “মেয়েদের প্রতিটি উপজেলায় বিনা পয়সায় ১৮টা ট্রেডে ট্রেনিং দেওয়া হচ্ছে। গাড়ি চালনা থেকে শুরু করে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ প্রতিটি ক্ষেত্রেই ট্রেনিং দেওয়া হচ্ছে। প্রশিক্ষণকালীন সময়ে মেয়েরা কিছু ভাতা পাচ্ছে।”
বর্তমান সরকারের সময়ে ৩৯টি সরকারি পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “এখানে তিনটা আছে; বিশেষ ভাবে মহিলাদের জন্য। ৬৬টি টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ চালু আছে। যেখানে ছেলে-মেয়ে উভয়েই ট্রেনিং নিতে পারে।”
প্রধানমন্ত্রী বলেন, “প্রতিটি উপজেলায় আমরা একটা করে টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজ প্রতিষ্ঠা করে দিচ্ছি। একশটার কাজ ইতিমধ্যে চালু হয়ে গেছে। সেখানে ছেলে-মেয়ে উভয়েই পড়তে পারবে।”
“তার জন্য যা যা করার আমরা করে যাচ্ছি, আমরা চেষ্টা করছি; কাজ করবার সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে।”
প্রধানমন্ত্রী বলেন, “রাষ্ট্রীয় কাজে মহিলারা যেন মূল স্রোতে চলে আসতে পারে; আমরা সে পদক্ষেপ নিয়েছি।”
নারীদের উন্নয়নে সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, ‘জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১’ প্রনয়ণ ও বাস্তবায়নের জন্য ‘জাতীয় কর্মপরিকল্পনা ২০১৩’ গ্রহণ করা হয়েছে।
নারী নেতৃত্ব গড়ে তোলার ওপর জোর দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “স্থানীয় সরকারের প্রতিটি স্তরে আমরা কোটা সিস্টেম করে দিয়েছি। নেতৃত্বটা তৃণমূল থেকে আস্তে আস্তে উঠে আসুক; সেটাই আমরা চাই।”
প্রধানমন্ত্রী হাসতে হাসতে বলেন, “জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত মহিলা আসন ৩০ থেকে ৫০-এ উন্নীত। আর ২২ জন সরাসরি নির্বাচিত। স্পিকার একজন মহিলা, সংসদ নেতা হিসাবে আমি আছি, বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ, সাজেদা চৌধুরী উপনেতা: জাতীয় সংসদের চারটি উচু পদ; সবই মহিলারা দখল করে আছে।”
নারী ও শিশু রক্ষায় সকল ধরনের নির্যাতন বন্ধে সরকারের কঠোর অবস্থানের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০০, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০৩ (সংশোধিত), বাল্য বিবাহ নিরোধ আইন-২০১৭, পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন ২০১০ এবং ডিএনএ আইন-২০১৪ প্রণয়ন করার কথা মনে করিয়ে দেন।
তিনি বলেন, যৌতুক নিরোধ আইন-২০১৮ ও শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র স্থাপন আইন-২০১৮ প্রণয়ন চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে।
তিনি বলেন, “আমরা শিক্ষানীতিতে নারী শিক্ষার উপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছি। দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত নারী শিক্ষার্থীদের শিক্ষা অবৈতনিক করা হয়েছে। কন্যা শিশুদের জন্য উপবৃত্তি দেওয়া হচ্ছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ৬০ ভাগ নারী।”
প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যের শুরুতেই তার মা ফজিলাতুন নেসা মুজিব ও বেগম রোকেয়াকে স্মরণ করেন।
মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকীর সভাপতিত্বে এই অনুষ্ঠানে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক মিয়া সেপ্পো এবং মহিলা ও নারী মন্ত্রণালয়ের সচিব নাছিমা বেগম বক্তব্য রাখেন।
প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানে বিশেষ অবদান রাখার জন্য পাঁচজন নারীর হাতে জয়িতা সম্মাননা তুলে দেন।
অনুষ্ঠানের শুরুতেই প্রধানমন্ত্রীকে উত্তরীয় পরিয়ে দেন মেহের আফরোজ চুমকী।
ছবিঃ ইয়াসিন কবির জয়