খালেদা জিয়ার দুঃসময় ও অমোঘ নিয়তিঃ অজয় দাশগুপ্ত

6189

Published on ফেব্রুয়ারি 19, 2018
  • Details Image

মানুষের জীবনে সুসময়-দুঃসময় দুটোই স্বাভাবিক। এমন কোন মানুষ নেই যাকে এর মুখোমুখি হতে হয় না। এটাই জীবন। কিছু মানুষ একে শিক্ষা হিসেবে নেয় আর কেউ মনে করে এটা তার প্রাপ্য ছিল না। জোর করে কেউ কাউকে আসলে কোন কিছু দিলেও টেকে না। যা আসে তা প্রকৃতিজাত আর কিছু মানুষ ভোগ করে তার অতীত কাজের ফল হিসেবে। আমি যখন এ লেখা লিখছি সারাদেশ ভাসছে ভালবাসা দিবসের বন্যায়। আগের দিন ছিল ফাল্গুনের প্রথম দিন। সেদিনও বাংলাদেশের মানুষের জীবন ছিল আনন্দমুখর। আমাদের বয়সে যৌবনে যা ছিল না তা এখন জনসাধারণের চোখের সামনে হাজির। আমরা ফাল্গুন দিন পালন করতাম না এমন নয়। করতাম ছোট পরিসরে। নিজেদের ভেতর। এখন ঢাকা চট্টগ্রামসহ দেশের সব জায়গায় মেলা হয়। জমে ওঠে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এই যে এতগুলো আয়োজন কোথাও কি কিছু ঘটেছে? না ঘটার কারণ দেশের অপরাজনীতিকে শক্ত হাতে দমন করা হয়েছে। যারা গণতন্ত্র গণতন্ত্র বলে মুখে ফেণা তোলেন তারা একবারের জন্যও বলেন না যে, একশ্রেণীর মানুষ যারা দেশের সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ম ও লোকাচারের বিরুদ্ধে তারা গণতন্ত্র বোঝে না। তারা কিছুই বোঝে না। তাদের আক্রমণের কারণ একটাই আর বাহানা অনেকগুলো। তারা যেনতেন প্রকারে দেশ শাসনে থাকতে চায়। এ দেশের মূল ইতিহাস আর সংস্কৃতি তাদের প্রধান বৈরী। এরপর তাদের জন্মগত আক্রোশের কারণও আমাদের জানা আছে। সে অপচক্র আজ নিষ্ক্রিয় অথবা দমে আছে বলেই মানুষ মনের আনন্দে তাদের জীবন ও সংস্কৃতি নিয়ে বাঁচতে পারছে।

বলছিলাম মানুষের এই আনন্দ অবগাহনের কালে জেলখানায় থাকা খালেদা জিয়ার কথা। তাকে কেউ কোন দিন কি বলবেন কেন তিনি আজ এই পরিণতি বরণ করতে বাধ্য হলেন? খালেদা জিয়ার আমল কি আসলেই ধোয়া তুলসীপাতার আমল ছিল? বার বার ঘু ঘু ধান খাবার দিন যে শেষ এটা বিএনপি বুঝে উঠতে পারেনি। একটা সময় ছিল যখন তারা ধরে নিয়েছিল তাদের কোন বিকল্প নেই। আমরা খুব ভালভাবে জানতাম বিএনপি শেষ অবধি পারবে না। না পারার একশ’ একটি কারণের ভেতর বড় কারণ সংস্কৃতি ও ইতিহাসের সঙ্গে মীরজাফরী। কে না জানে বঙ্গবন্ধুর অঙ্গুলি হেলন স্বাধীন এই দেশ। এ দেশের মুক্তির পেছনে ছিল তাজউদ্দীন এবং সৈয়দ নজরুলের মতো নেতারা। আওয়ামী লীগ ইতিহাস ভাগ করতে না চাইলেও সবাই জানেন বামদের ভূমিকাও সেদিন ছিল প্রেরণার। তাছাড়া জিয়াউর রহমান একজন সেক্টর কমান্ডার ব্যতীত আর কিছুই ছিলেন না। সেই মানুষকে জাতির কাঁধে চাপিয়ে দেয়ার পাপ কি ছেড়ে কথা বলবে? এগুলো অনৈতিক বিষয়। চোখে দেখার বিষয়গুলোও মানেনি বিএনপি। একদিন এ দেশে জাসদেরও রমরমা ডাক নাম ছিল। পঁচাত্তরের আগে তাদের জনসভা মানে মানুষের ঢল। বৈজ্ঞানিক নামের আজগুবি সমাজতন্ত্রের নাম শুনলে লেনিন মার্কস বা মাও সেতুংও মূর্ছা যাওয়ার কথা। অথচ কি তাদের শানশওকত। মনে হতো তারাই লেনিন বা মার্কস। যখন জামায়াতী আর স্বাধীনতাবিরোধীরা তাদের কাম হাসিল করে ফেলল, তাদের হাতের মুঠোয় বেঈমান সেনানায়ক আর গদি জাসদও শেষ। জনসভায় আর মানুষের ঢল নামে না।

বিএনপির বর্তমান অবস্থার জন্য আসলে কি কি ফ্যাক্টর দাবি সেটা কি তারা বোঝে? তাদের পেছনে সমবেত একদা মুসলিম লীগ করা বয়স্ক ভদ্রজনরা হয় মৃত, নয় নিষ্ক্রিয়। সরে গেছে জামায়াতের ছায়া। জামায়াতকে সাইজ করার পর বিএনপি যে আসলে আন্দোলন করতে পারবে না এটা তারাও জানে। কোথায় তাদের ছাত্রদল? কোথায় যুব দল? গদিতে থাকলে পার্টি আছে না থাকলে খালি বেগম জিয়া ভরসা এটা কি কোন কাজের কথা? বিলেতে থাকা যুবরাজ তাদের কতটা সর্বনাশ করেছে বা করছে সেটা বুঝতে না পারলে ঘুরে দঁাঁড়াবার সময় বা সুযোগ পাবে না বিএনপি। এর একটা কারণ দেশের চলমান পারিবারিক রাজনীতি। উত্তরাধিকারের রাজনীতি সব সময় ঠিক নয়। তবে তা যদি হয় মেধা ও যোগ্যতার তাহলে কি হয় বা হতে পারে তা ইন্দিরা গান্ধী, বেনজীর এবং শেখ হাসিনাতেই দৃশ্যমান। বঙ্গবন্ধুর উত্তরাধিকারেরা দেশ বিদেশে পড়াশোনা করে নিজেদের প্রস্তুত না করলে টিউলিপ ব্রিটিশ পার্লামেন্টে এমপি হতে পারতেন? এই ঘটনা আমাদের মনে করিয়ে দেয় তারা যোগ্যতার পথে হাঁটছেন। বিএনপির দুর্ভাগ্য, তাদের ধারণা দেশ কোন তালুক। তালুক দেশের মানুষ ঘাস খায় না। তাদের মনে ভারত বিরোধিতা বা আওয়ামী বিরোধিতা থাকলেও তারা অবিবেচক কারও হাতে দেশ ছেড়ে দেবে না। এই কারণে আমার কেন জানি মনে হয় বিএনপি নামের ট্রেন এক গাড়ি যাত্রী আর নেতা নিয়ে রওনা হয়ে আজ যখন আখেরি স্টেশনের কাছে বগিতে বেগম জিয়া ছাড়া সবাই নেমে গেছে যার যার জায়গায়। এখন তিনি একা ও নিঃসঙ্গ।

বিএনপির দাপটের সময় আমরা ভরা যৌবনে। মনে আছে আমরা কেমন ভয়ার্ত থাকতাম। একদিকে সেনাবাহিনীর সমর্থন আরেকদিকে প্রশাসনের অত্যাচার। এমনও ঘটেছে রোকেয়া হলের ছাত্রীদের ওড়না কেড়ে উৎসব করা ছাত্রদলকে আবারও জেতাতে হয়েছে মান বাঁচানোর স্বার্থে। মানুষ কিছু ভুলে যায় না। আজ যারা দেশ শাসনে তাদের অপকর্মও সময় ছেড়ে কথা বলবে না। পার্থক্য এই তাদের আমলে উন্নয়ন ও ব্যক্তিগত বা সামাজিকভাবে ভাল থাকার কারণে মানুষ অনেক কিছু ছাড় দিচ্ছে। কারণ, তারা বোঝে শেখ হাসিনার বিকল্প নেই। যেভাবে হোক তিনি এই দেশ ও জাতিকে মর্যাদার আসনে নিয়ে গেছেন। বিএনপির কড়া সমর্থকরা একবারও ভাবে না তাদের বর্তমান ভারপ্রাপ্ত নেতার আমলে দেশে কি ঘটেছিল? ঢাকার রাজপথে আপনি গ্রেনেড মারবেন, আপনারা ট্রাকে করে অস্ত্র আনবেন, দেশকে জঙ্গীর আখড়া করবেন আর সাম্প্রদায়িকতার নামে পার পেয়ে যাবেন? ধানের শীষের জোয়ার ভোটের বাক্সে আছে কি নেই জানি না তবে মনে নেই। না থাকার প্রমাণ খালেদা জিয়া আজ হাতে হাতে পাচ্ছেন। 

বদলে যাওয়া জীবনে মানুষের হাতে সময় কম। তারা রাস্তায় নেমে আন্দোলন করবে না। তাদের কাছে তেমন কোন কারণও নেই। রাজনীতিতে জেল-জুলুম আর সাজা খাটা স্বাভাবিক বিষয়। অস্বাভাবিক এই কয়েক দফার প্রধানমন্ত্রী ও তার দলের লোকেরা নাকি পুলিশের ভয়ে কিছু করতে পারছেন না। সত্য স্বীকার আর বাস্তবতা মানলে তাদের মতো মানুষ নিশ্চয়ই গ্রহণ করত। তাদের উচিত সত্যের কাছে ফিরে যাওয়া। মেনে নেয়া। খালেদা জিয়া যে পাপের শাস্তি ভোগ করছেন তার পেছনে দল ও দলের যেসব নেতা দায়ী তাদের কথা বলতে হবে। তা না হলে আজ মিডিয়ায় দেখলাম খালেদা তারেকহীন বিএনপির কথা ভাবা হচ্ছে। সেটাও দেখে যেতে হতে পারে আমাদের।

বিএনপির মতো বড় একটি দলের সান্ত¡না কেবল জনগণে আছি রাস্তায় নেই? এটা ভাবতেও কেমন জানি লাগছে। সময় আসলে কাউকে ছেড়ে কথা বলে না। এটাই নিয়তি। আর একটা কথা বিদেশে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করে বা দেশকে বিপাকে ফেলে যারা তাঁকে মুক্ত করার বাসনা পোষণ করছেন তাদের আসল উদ্দেশ্য কি বোঝা মুশকিল। তবে এদের কারণে আরও এক ধাপ পিছিয়ে যাবে বিএনপির আগামী যাত্রা। এটা নিশ্চিত।

সৌজন্যেঃ দৈনিক জনকণ্ঠ

প্রকাশকালঃ ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত