7637
Published on ফেব্রুয়ারি 4, 2018নির্বাচন এলে বিএনপি অংশ নেয় না, গণতন্ত্রের কথা বলে। নির্বাচন প্রতিরোধ করতে আগুন সন্ত্রাসী রাজপথে নামায়।
পেট্রোলবোমা মেরে বাস-ট্রেনযাত্রী, রিক্সা-ভ্যানযাত্রী হত্যা করে, কর্তব্যরত পুলিশ হত্যা করে, প্রিসাইডিং অফিসার হত্যা করে, নির্বাচন ঠেকানোর নামে শত শত প্রাথমিক বিদ্যালয় জ্বালিয়ে ছাই করে। পেট্রোলবোমা মেরে গরু পুড়িয়ে ছাই করে।
সংখ্যালঘুরা যাতে ভোট না দেয়, দেশত্যাগ করে, সে জন্য তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়। দেশ অচল করার টার্গেট নিয়ে গাছ কেটে, রাস্তা কেটে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। মানুষ যাতে ভোটকেন্দ্রে না যায়, ভোটদানে বিরত থাকে সে লক্ষ্যে ভয়ভীতি প্রচার-প্রচারণা চালায়। শাপলা চত্বরে বিরাট সমাবেশ ঘটিয়ে গোটা মতিঝিল, বায়তুল মোকাররম, বিজয়নগর, জিরো পয়েন্ট, বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউ জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছাই করে। এমনকি বায়তুল মোকাররম বই মার্কেট (বেশিরভাগই ধর্মীয় গ্রন্থাদি) পুড়িয়ে দেয়া হয়।
স্বপ্ন ছিল বঙ্গভবন দখলের উদ্দেশ্যে রাতভর শাপলা চত্বরে রাত কাটিয়ে কাকডাকা ভোরে অভিযান শুরু করবে।
‘একই মায়ের পেটের দুই সহোদর ‘ছাত্রদল-ছাত্রশিবির’ নামিয়ে উল্লিখিত নাশকতা চালানো হয়। খালেদা জিয়া রাজপথে না নামলেও জঙ্গিগোষ্ঠী ছাত্রদল-শিবিরের ছদ্মবেশে নাশকতা চালায়।
বিদেশী কূটনীতিকদের ডেকে এনে কান্নাকাটি করে। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জাতীয় প্রেসক্লাবে কাঁথা-বালিশ নিয়ে এসে সাধারণ সম্পাদকের (শিবির) কক্ষে আস্তানা গাড়ার চেষ্টা করে। প্রেসক্লাব চত্বরে গণতন্ত্র মঞ্চ স্থাপন করে সরকার উৎখাতের চক্রান্ত করে। এগুলো যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হওয়ার পর থেকে ২০১২-১৩ এবং ২০১৪-এর ৫ জানুয়ারির নির্বাচন পরবর্তী ৯০ দিনের ঘটনাবলী, যাতে একজন প্রিসাইডিং অফিসার, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, ঘুমন্ত বাস হেলপারসহ দেড় শতাধিক নাগরিককে হত্যা করা হয়। এর আগে ২০০৪ সালে ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউতে দেশরতœ শেখ হাসিনার সমাবেশে লাগাতার গ্রেনেড-গুলি হামলা চালিয়ে শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের গোটা নেতৃত্বকে নিশ্চিহ্ন করার চক্রান্ত করে। এই হামলায় শেখ হাসিনা আল্লাহর রহমতে বেঁচে গেলেও তাঁর এক কানের শ্রবণশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং কেন্দ্রীয় নেত্রী আইভী রহমানসহ ২৪ জন নেতা-কর্মী ঘটনাস্থলে নিহত হন। কেন্দ্রীয় নেতা ঢাকার প্রথম নির্বাচিত মেয়র মোহাম্মদ হানিফ, কেন্দ্রীয় নেতা আবদুর রাজ্জাক, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত গ্রেনেডের স্পিøøন্টার নিয়ে মারা যান। সেদিন বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউর আওয়ামী লীগ অফিস চত্বর ছিল রক্তের বন্যা। যাদের শরীর থেকে রক্ত ঝরেছিল এবং যারা এখনও কি যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে আছেন সে কেবল তারাই জানেন। তখন ক্ষমতায় ছিল খালেদা জিয়া। বিচার করা তো দূরের কথা, বরং পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে বলেছেন ‘শেখ হাসিনা ভ্যানিটি ব্যাগে করে গ্রেনেড নিয়ে বিস্ফোরণ ঘটনা’ (?)
২০০১-এর নির্বাচনে কারচুপি করে নির্বাচনী বৈতরণী পার হয়ে দেশব্যাপী অত্যাচার-নির্যাতন এমন মাত্রায় চালিয়েছিল যে, সংখ্যালঘুদের ওপর তো বটেই, নৌকায় ভোট দেয়ায় আওয়ামী লীগ সমর্থকদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া, পুকুরের মাছ, গোয়ালের গরু, বনের গাছ-গাছালি লুট, নারী নির্যাতন, কী অত্যাচার না করেছিল। যা বর্ণনারও অতীত। চোখ তুলে ফেলা হয়েছে, হাতের কব্জি কেটে ফেলা হয়েছে, কী ভয়ঙ্কর ছিল সেগুলো। যা পাকিস্তানী বর্বরতাকে মনে করিয়ে দেয়।
বাংলার মানুষকে রাজপথে নামাতে পারেনি খালেদা জিয়া। বরং শেখ হাসিনার টার্গেট অনুযায়ী ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচন হয়েছে এবং গত ৪ বছরের অধিককাল শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী তথা জাতি-রাষ্ট্রের নেতা হিসেবে এমন এক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করে চলেছেন, যা বিশ্বব্যাপী ঈর্ষণীয় এবং রোল মডেল।
সেদিন নির্বাচন হয়েছিল বলে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু হচ্ছে। এখন দিনের ২৪ ঘণ্টায় বড় জোর ২-৩ বারে আধ ঘণ্টা লোডশেডিং হয়, সব দিন হয়ও না। দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ, রফতানিও হচ্ছে। মঙ্গা, দুর্ভিক্ষ, কাহাত, আকাল ইত্যাদি শব্দ এখন ডিকশনারিতে উঠে গ্যাছে, জীবনে নেই। জাতীয় প্রবৃদ্ধির হার ৭-এর ওপরে। মাথাপিছু আয় ১৬১০ মার্কিন ডলার বা ১,২৮,০০০ টাকা। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। শিক্ষার হার ৭২%। গড় আয়ু ৭১ বছর।
মৎস্য উৎপাদনে বিশ্বে ৪র্থ, এবার ৩য় হবে। আগামী মার্চ মাসে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ। তারপরই মধ্যম আয়ের দেশ, তারপর উন্নত বাংলাদেশ। ভারতের সঙ্গে সীমান্ত সঙ্কট সমাধান। সমুদ্র সীমানা নির্ধারণ। রোহিঙ্গা সঙ্কটের মানবিক ও কূটনৈতিক মোকাবেলা বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত। শেখ হাসিনা এখন বিশ্বের ৫ জন সৎ রাষ্ট্রনেতার মধ্যে তৃতীয় । শেখ হাসিনার মতো প্রধানমন্ত্রী যুগে যুগে জন্মায় না। শেখ হাসিনা বিশ্বের ১০ জন ক্ষমতাধর রাষ্ট্রনেতার অন্যতম। শেখ হাসিনা বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, নারী শিক্ষার অগ্রদূত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত, সর্বজনশ্রদ্ধেয় কবি বেগম সুফিয়া কামালের উত্তরসূরি হিসেবে এক এবং অদ্বিতীয়। কেবল যে মেধাবী তা নয়, এখনও রাত জেগে পড়েন। আমি মাঝে-মধ্যে শ্রীলঙ্কার কলম্বো থেকে প্রকাশিত অনলাইন পত্রিকা এশিয়ান ট্রিবিউনে লিখি। অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব ও লেখক গবেষক রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী আমাকে ওই অনলাইনে লিখতে উদ্বুদ্ধ করেন। সম্ভবত ২০০১ সালের নির্বাচনে পর বিএনপি-জামায়াত জোটের হত্যা, নির্যাতন, নারী ধর্ষণ, হিন্দুদের ওপর অত্যাচারের ওপর একটি কলাম লিখি এবং কলামের শিরোনাম ছিল ঐরহফঁং ধৎব ঃযব ংড়হং ড়ভ ইধহমষধফবংয ংড়রষ (হিন্দুজ আর দ্য সন্স অব বাংলাদেশ সয়েল)। এশিয়ান ট্রিবিউন এটিকে লিড আইটেম হিসেবে দিয়ে প্রকাশ করে। শেখ হাসিনা তখন বিরোধীদলীয় নেত্রী। সারাজীবন বাংলায় সাংবাদিকতা (ইত্তেফাক) করেছি, এশিয়ান ট্রিবিউনে ইংরেজীতে কলাম লিখলাম, যার একটা প্রিন্ট আউট হাতে ছিল। ওটা নিয়ে নেত্রীর সঙ্গে দেখা করলাম। তাকে লেখাটা দেখালাম। তিনি হেডিং দেখেই বলে দিলেন ‘ওটা তো পড়ে ফেলেছি।’ শেখ হাসিনা কতখানি সিরিয়াস পাঠক! পোশাক-আশাকে, কথাবার্তায়, আচার-আচরণে, ধর্মাচারে একেবারেই বঙ্গনারী, ধার্মিক সেকুলার মুসলিম।
শেখ হাসিনাকে প্রতিপক্ষ দাঁড় করানোর প্রচেষ্টা বিএনপির অলীক কল্পনা ছাড়া কিছু নয়। লেখাপড়া ছাড়া ব্যবসা করা যায়, তাও আধুনিক ব্যবসা নয়। আধুনিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়তে হলে অবশ্যই আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত জ্ঞান থাকতে হবে। যে কারণে দেখা যায় খালেদা জিয়ার পরিবার ব্যবসা করতে গিয়ে এখন আদালতের সম্মুখীন হচ্ছে। লেখাপড়া জানলে তিনি তিনবারের প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে অন্তত একটা হলেও মনে রাখার মতো উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারতেন। কথাবার্তা বলতেও সাবধান হতে পারতেন। বস্তুত ভদ্রমহিলা জ্ঞানের দীনতার কারণেই অনেক সময় অসংলগ্ন কথা বলে ফেলেন, যেমন ২০০১-এর ইলেকশনের আগে বললেন : আওয়ামী লীগকে ভোট দিলে বাংলাদেশ ভারত হয়ে যাবে। আওয়ামী লীগকে ভোট দিলে মসজিদে আজান হবে না, উলুধ্বনি হবে। আওয়ামী লীগকে ভোট দিলে মসজিদে তালা ঝুলবে। আওয়ামী লীগকে ভোট দিলে টুপি মাথায় দেয়া যাবে না।
খালেদা জিয়া আগে যেমন বহুবার আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন, মানুষকে রাজপথে নামাতে পারেননি। এবারও পারবেন না। হ্যাঁ, তবে একটা ব্যাপার ভালই পারেন। এই তো ক’দিন আগে হাইকোর্টের পাশে প্রিজনভ্যান থেকে তাদের তিনজন আটক নেতা-কর্মীকে ছিনিয়ে নিয়ে গেল তাদের জঙ্গী কর্মীরা। যেভাবে ২০১৩-১৪ সালে পুলিশের ওপর আক্রমণ করেছিল এবারও দেখলাম একইভাবে ফ্লায়িং কিক মারতে। তবে কি তিনি জঙ্গীদের আবার মাঠে নামালেন? কিন্তু ২০১৩ আর ২০১৮ এক নয়। এরই মধ্যে জামায়াত-শিবির-জঙ্গী ও জঙ্গী সঙ্গীদের শক্তি অনেক কমেছে। গত ৪-৫ বছরে প্রশাসন-আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ক্ষমতা অনেক অনেক বেশি বেড়েছে।
সে সময় আমি প্রশ্ন করেছিলাম ১৯৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিল, শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী। তখন কি বাংলাদেশ ভারত হয়েছিল? তখন কি মসজিদে আজান হয়নি? তখন কি মসজিদে উলুধ্বনি হয়েছে? তারপরও এমন কথা বলা মূর্খ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা নয় কি? পাকিস্তান আমলে অর্থাৎ ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনের সময় মুসলিম লীগ ফতোয়া দিয়েছিল আওয়ামী লীগকে ভোট দিলে বিবি তালাক হয়ে যাবে। মুসলিম লীগ ভেবেছিল এটি বললে মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগবে এবং মুসলিম লীগ মেজরিটি আসন পেয়ে যাবে ও তরতর করে ক্ষমতায় চলে যাবে। কিন্তু হয়েছে উল্টোটাই, মুসলিম লীগের ভরাডুবি হয়েছে। এবার খালেদা জিয়া যা বললেন তাতে পাগলেও হেসে কুটিকুটি হবে। বললেন : জোড়াতালি দিয়ে পদ্মা সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে, কেউ উঠবেন না, রিস্ক আছে।
কিন্তু তিনি জানেন না নির্মাণশৈলীই হলো মেগা প্রজেক্টগুলো জোড়া দিয়েই হয়। একটা পার্টের সঙ্গে আরেকটা পার্ট। কিন্তু তালি আসল কিভাবে? এটা হাস্যকর নয় কি? তবে পদ্মা সেতু দিয়ে চলাচল না করার তার আহ্বানের একটা পজিটিভ দিক আছে এবং তা হলো পদ্মা সেতু নির্মাণ কাজ শেষ হতে হতে বিএনপি নামক দলটির মৃত্যু ঘটবে। তখন খালেদা জিয়া ‘নৌকা’য় চড়বেন এবং পদ্মা পার হবেন।
সম্প্রতি তিনি আরেকটি কথা বলছেন, ‘শেখ হাসিনা দেশের অর্থ খরচ করে দুটি সাবমেরিন কিনে এনেছেন। উদ্বোধনের পর দুটিই ডুবে গেছে। এর অর্থ তিনি জানেনই না যে, সাবমেরিন পানির নিচ দিয়ে চলে। কিন্তু বেগম খালেদা জিয়ার ‘সন্দেহ’ হয় না। ইংরেজী পত্রিকার এক রিপোর্টারের রিপোর্ট পড়তে পড়তে নিউজ এডিটর সংশ্লিষ্ট রিপোর্টারকে ডাকলেন। কয়েকটি ভুল চিহ্নিত করে বললেন, তোমার যখন সন্দেহ হবে তখন ডিকশনারি কনসাল করবে। রিপোর্টার উত্তর দিলেন, ‘আমার সন্দেহ হয় না।’
সৌজন্যেঃ জনকণ্ঠ
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও সভাপতি, জাতীয় প্রেসক্লাব