28921
Published on ফেব্রুয়ারি 4, 2018বিএনপিতে অনেক সিনিয়র আইনজীবী আছেন। তাদের অনেকেই জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় বেগম জিয়ার পক্ষে বক্তব্য রাখেন। যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য বর্তমান সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি জয়নুল আবেদীন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার প্রমুখ। এ ছাড়াও যিনি দীর্ঘদিন মামলাটি পরিচালনা করেছেন, আবদুর রেজ্জাক খান, তিনিও বিজ্ঞ আইনজীবী। বিএনপির বর্তমান আচরণ দেখে মনে হচ্ছে, এই বিজ্ঞ আইনজীবীরাই মামলার মেরিট দেখে বুঝতে পেরেছেন, এ মামলায় বেগম জিয়ার সাজা হওয়াটাই স্বাভাবিক।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় বেগম জিয়ার এই বিজ্ঞ আইনজীবীগণ খালেদার পক্ষে যে কোন ভাল গ্রাউন্ড পাননি তার প্রমাণ মিলেছে ৭১ টেলিভিশনের একটি নিউজে। তরুণ প্রজন্মের শক্তিশালী রিপোর্টার ফারজানা রূপার এই রিপোর্টটিই বিজ্ঞ আইনজীবীদের অসহায়ত্ব প্রকাশ করে দিয়েছে। ফারজানা রূপা বিএনপির যুগ্ম-সম্পাদক, সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও খুবই ভাল আইনজীবী হিসেবে পরিচিত মাহবুব উদ্দিন খোকনের কাছে জানতে চান, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের ঠিকানা কোথায়? জনাব মাহবুব অত্যন্ত সদালাপী ও খুবই উৎফুল্ল মানুষ হিসেবে কোর্ট প্রাঙ্গণে পরিচিত ও জনপ্রিয়। তিনি ফারজানা রূপার এ প্রশ্নে বিব্রত হয়ে অনেকটা সঙ্কুুচিত মুখে বলেন, এ বিষয়ে আমাদের লার্নেড সিনিয়রদের একটি প্যানেল আছে, তারা বলতে পারবেন। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদকে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, এতিমখানা তো হয়নি। ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকারকে প্রশ্ন করলে তিনি অত্যন্ত রাগত স্বরে বলেন, ঠিকানার জন্য এত ওয়ারিড হচ্ছেন কেন? আর বিএনপি নেতা আবদুল্লা আল নোমান একেবারে অসহায় মুখে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে তার পরে কাঁপা কাঁপা গলায় বলেন, ঠিকানাটা আমার জানা নেই।
যে সকল বিজ্ঞ আইনজীবীর সঙ্গে ফারজানা রূপা কথা বলেছেন, এই বিজ্ঞ আইনজীবীরা কোনরূপ গ্রাউন্ডওয়ার্ক না করে মামলা করবেন তা কখনও হতে পারে না। তবে এই সব মামলার রিপোর্ট এডিট করতে বসে আমাদের মতো আইনের বাইরের লোকদের সামনেও দুটো বিষয় পরিষ্কার হয়। এক. কোন আইনজীবী খুবই কোর লিগ্যাল পয়েন্টে বক্তব্য রাখছেন। দুই. কোন আইনজীবী পল্টনের ময়দানের বক্তব্য রেখে যাচ্ছেন বা প্রতিপক্ষের যুক্তি খ-ন না করে তথাকথিত রাজনৈতিক বক্তব্য রেখে যাচ্ছেন। যেমন, যখন ষোড়শ সংশোধনীর মামলা চলছিল তখন খুবই ডিটেলইস রিপোর্ট করা হয় জনকণ্ঠে। রিপোর্টার আরাফাত মুন্নাকে নির্দেশই দিয়ে রেখেছিলাম তুমি সবার বক্তব্য টেপ করে হুবহু লিখবে। তারপরে কতটুকু ছাপা হবে সেটা পরের বিষয়। ওই ডিটেইলস রিপোর্ট পড়তে পড়তে অনেক সময় জনকণ্ঠের উপদেষ্টা সম্পাদক প্রবীণ সাংবাদিক তোয়াব খান ভাইকে বলেছি, কেন যেন মনে হচ্ছে আমাদের বিজ্ঞ এ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্য পল্টনের রাজনৈতিক বক্তব্য হচ্ছে। তিনি প্রতিপক্ষের হাল্কা যুক্তিগুলোও খ-ন করছেন না। ঠিক তেমনিভাবে এখানে মওদুদ আহমদসহ বিজ্ঞ আইনজীবীদের বক্তব্যগুলো যখন এডিট করেছি, তখন পড়তে পড়তে সেগুলোকে আইনী বক্তব্যের থেকে রাজনৈতিক বক্তব্য মনে হয়েছে বেশি- যা তাঁরা প্রেসক্লাবের সামনে মানব বন্ধনে বলেন। বিশেষ করে মওদুদ আহমদের বক্তব্যকে তো শতভাগ রাজনৈতিক বক্তব্যই মনে হয়। বিএনপির অন্য সিনিয়র আইনজীবীদেরও বক্তব্যের মূল বিষয় ছিল এটা রাজনৈতিক প্রতিহিংসার মামলা। দুর্নীতির বিষয়টি খ-নের চেষ্টা থেকে তাঁরা বেশি জোর দিয়েছিলেন রাজনৈতিক বিষয়ে। কেন তাঁরা এমনটি করেন সেটা তাঁরাই ভাল বলতে পারবেন। তবে এখন বিএনপি নেতাদের আচরণ দেখে মনে হচ্ছে, তাঁদের সকল বিজ্ঞ আইনজীবী মামলার মেরিট দেখেই বুঝতে পেরেছিলেন- এখানে প্রকৃত অর্থে দুর্নীতি করা হয়েছে। তাই রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করা ছাড়া দ্বিতীয় কোন পথ নেই। এ কারণেই তাঁরা অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে কোর্ট থেকেই রাজনীতিটা শুরু করেন।
এখন তারা মামলার রায় প্রভাবিত করার জন্য ইতোমধ্যে দুটো কাজ করেছেন। এক, তারা নানান বক্তব্য ও বিবৃতিতে বলছেন, মামলার রায় তাদের বিপক্ষে গেলে তারা রাজপথে নামবেন। এমনকি তাদের অঙ্গ সংগঠন নিয়ে তারা সেভাবে মিটিংও করছেন। সেই মিটিংয়ের ঘোষণাপত্র পত্রিকায় আসছে। অর্থাৎ, তারা বিচার বিভাগকে রাজপথের হুমকি দেখাচ্ছেন। ষোড়শ সংশোধনী মামলায় তৎকালীন প্রধান বিচারপতি অবাঞ্ছিত, জাতীয় চেতনা ও স্বাধীনতাবিরোধী কথা লিখলে তা নিয়ে যখন পার্লামেন্টে আলোচনা হয়, তখন তারা বলেছিলেন, এই আলোচনা বিচার বিভাগের ওপর হস্তক্ষেপ। পার্লামেন্ট সার্বভৌম। পার্লামেন্টই আইন তৈরি করে। পার্লামেন্টই বিচার বিভাগের কাঠামো দেয়। তার পরেও তাঁরা সেদিন এ কথা বলেছিলেন। অন্যদিকে এখন তারা একটি দুর্নীতি মামলার রায় ঘোষণা হওয়ার আগেই কেমন রায় হলে তারা মানবেন, কেমন রায় হলে মানবেন না- এ ধরনের বক্তব্য দিচ্ছেন। এগুলো কি বিচার বিভাগতে প্রভাবিত করা নয়? সর্বোপরি, বিচারকে প্রভাবিত করার জন্য তাদের পার্টির থেকে সর্বোচ্চ চাপ প্রয়োগ করা হয়েছে। তাদের পার্টির নেতা নজরুল ইসলাম খান নির্বাচন কমিশনকে জানিয়ে এসেছেন, বেগম জিয়ার সাজা হলে তারা নির্বাচনে যাবেন না। নির্বাচন কমিশনের ওপর চাপ প্রয়োগ পক্ষান্তরে বিচার বিভাগের ওপর চাপ প্রয়োগ। নির্বাচন কমিশনকে এই কথা বলার পরে এখন তারা বিদেশী কূটনীতিকদের বলবেন, বেগম জিয়ার সাজা হলে তারা নির্বাচনে যাবেন না।
শুধু এখানেই শেষ নয়, বিএনপির বিজ্ঞ আইনজীবীরা বিএনপিকে বেগম জিয়ার সাজার বিষয়ে এতটাই নিশ্চিত করেছেন যে, তারা তাদের দলীয় গঠনতন্ত্রের ৭ নম্বর ধারা ইতোমধ্যে বদল করেছেন যা ইতোমধ্যে মিডিয়ায় এসেছে। যেখানে বলা আছে, ‘নিম্নোক্ত ব্যক্তিরা জাতীয় কাউন্সিল, জাতীয় নির্বাহী কমিটি, জাতীয় স্থায়ী কমিটি বা যে কোন পর্যায়ের যে কোন নির্বাহী কমিটির সদস্য পদের কিংবা জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলের প্রার্থী পদে অযোগ্য বলে বিবেচিত হবেন। তারা হলেন : (ক) ১৯৭২ সালের রাষ্ট্রপতির আদেশ নম্বর ৮ এর বলে দ-িত ব্যক্তি, (খ) দেউলিয়া, (গ) উন্মাদ বলে প্রমাণিত ব্যক্তি, (ঘ) সমাজে দুর্নীতিপরায়ণ ও কুখ্যাত বলে পরিচিত ব্যক্তি।’ এই ধারা বাদ দিয়ে গত ২৮ তারিখ তাদের স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খানের নেতৃত্বে তিন সদস্যের প্রতিনিধি দল প্রধান নির্বাচন কমিশনার কেএম নুরুল হুদার কাছে সংশোধিত গঠনতন্ত্র জমা দেন। অবশ্য একটি সূত্র থেকে সর্বশেষ যে সংবাদ পেয়েছি- সেখানে দেখা যাচ্ছে বিএনপি ভিন্ন কিছু পরিবর্তন করেছে। তবে সেটাও দুর্নীতি ও চাঁদাবাজির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।
যা হোক, তাদের এই দলের গঠনতন্ত্র বদলের বিষয়ে দলীয় যুগ্ম সম্পাদক রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, এ সিদ্ধান্ত তাদের দুই বছর আগে হয়েছিল। তবে অন্য কয়েক নেতা টেলিভিশনে বলেছেন, সরকার তাদের দল ভাঙ্গার চেষ্টা করছে বলে তারা এ কাজটি করেছে। অন্যদিকে জামায়াত-বিএনপি সমর্থিত দৈনিক প্রথম আলোর রিপোর্টে বলা হয়েছে- ‘বিএনপি দল ভাঙ্গার চেষ্টায় হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার হতে পারে- এই আশঙ্কায় গঠনতন্ত্রের একটি ধারা বাদ দিয়েছে বিএনপি।... বিএনপির উচ্চ পর্যায়ের একাধিক নেতা জানান, তাদের কাছে তথ্য আছে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপিকে ভাঙতে সরকারের একটি মহল থেকে চেষ্টা ও তৎপরতা চালানো হবে। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার রায়ের পর এই তৎপরতা গতি পেতে পারে। এই মামলায় বিএনপির চেয়ারপার্সনের সাজা হলে ‘দুর্নীতিপরায়ণ’ ব্যক্তি দলের সদস্যপদের অযোগ্য হবেন বলে যে কথাটি গঠনতন্ত্রে আছে, তা সামনে এনে একটি মহল বিএনপিতে বিভক্তি সৃষ্টির জন্য দলের একটা অংশকে ব্যবহার করতে পারে।’
রায়ের আগেই বিএনপির এই গঠনতন্ত্র পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে এটা স্পষ্ট যে, বিএনপির বিজ্ঞ আইনজীবীরা তাদের নিশ্চিত করেছেন, এই মামলায় বেগম জিয়ার দুর্নীতি স্পষ্ট। এখানে সাজা হবেই। আর তাদের আইনজীবীদের কাছ থেকে বিএনপি এতটাই নিশ্চিত হয়েছে যে, তারা দলের গঠনতন্ত্র বেগম জিয়ার সাজা হওয়ার আগেই পরিবর্তন করলেন। যার ফলে বেগম জিয়ার সাজা হওয়ার আগেই তারা প্রমাণ করলেন, বেগম জিয়া দুর্নীতিপরায়ণ ব্যক্তি। যিনি সমাজে কুখ্যাত হিসেবে পরিচিত। তাই মামলার রায়ের পরে যে কথা বিএনপির প্রতিপক্ষ বিএনপিকে বলত সে কথা তারা নিজেরাই তাদের নেত্রীকে কাজের মাধ্যমে বললেন এবং এমনভাবে উপস্থিত করলেন যে, বেগম জিয়াকে তারা নিজেরাই দুর্নীতিপরায়ণ মনে করে। অবশ্য এটা বিএনপির জন্য একটা শুভ লক্ষণ। কারণ, সত্যকে উপলব্ধি না করলে সঠিক রাজনীতি করা যায় না। বেগম জিয়া হাওয়া ভবনের মাধমে দেশে যেভাবে দুর্নীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছিলেন, তা বাংলাদেশের কোন নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী কখনই করেননি। বাংলাদেশের প্রথম নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ সরকার থেকে পদত্যাগ করে বাসে চড়ে কোর্টে যেতেন আইন পেশা চালানোর জন্য। দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর সততা, তাঁর ইতিহাস পৃথিবীজোড়া। এ নিয়ে কোন কিছু লেখারও নেই, মন্তব্য করলে তাঁকে বরং ছোট করা হয়। এর পরের প্রধানমন্ত্রী মনসুর আলী। তাঁর সততা ও নিষ্ঠা ইতিহাসের একটি উদাহরণ। এর পরের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। তার পরে শেখ হাসিনা। আন্তর্জাতিক জরিপে শেখ হাসিনা বিশ্বের পাঁচজন সৎ নেতার ভেতর তৃতীয় অবস্থানে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের একমাত্র নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াই দুর্নীতিপরায়ণ। একটা সরকারের প্রধান যখন দুর্নীতিপরায়ণ হয় তখন ওই দেশে কোন ভাল কিছু আশা করা যায় না। তাই দলীয়ভাবে বিএনপি তাকে দুর্নীতিপরায়ণ চিহ্নিত করে শুধু তাদের দল ভাঙ্গা ঠেকাতে যে পথ নিয়েছে অর্থাৎ এখন থেকে যে কোন দুর্নীতিপরায়ণ ও সামাজিকভাবে কুখ্যাত ব্যক্তি বিএনপির সদস্য হতে পারবে। এর ভেতর দিয়েও একটা প্রকৃত সত্য বেরিয়ে এলো, বাস্তবে সামাজিকভাবে অনেক কুখ্যাতরা এখন বিএনপিতে- নইলে পেট্রোলবোমা মেরে তারা মায়ের পেটের শিশুকেও হত্যা করে কীভাবে? আর ভবিষ্যতে বিএনপি একটি দুর্নীতিবাজ ও কুখ্যাত ব্যক্তিদের ক্লাবে পরিণত হবে।
-স্বদেশ রায়
সৌজন্যেঃ জনকণ্ঠ