দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে মেগা প্রকল্পঃ আলাউদ্দিন চৌধুরী

6652

Published on জানুয়ারি 20, 2018
  • Details Image
অবকাঠামোর উন্নয়নে নেওয়া সাহসী পদক্ষেপের কারণে আজ মেগা প্রকল্পগুলো আলোর মুখ দেখতে শুরু করেছে। পদ্মাসেতু আজ স্বপ্ন নয়, বাস্তবে রূপ নিয়েছে। নানা প্রতিকূলতার মাঝেও মেট্রোরেল, পারমানবিক বিদ্যুেকন্দ্রের মতো মেগা প্রকল্পগুলো দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে। বর্তমান সরকারের অন্যতম লক্ষ্য হলো- ‘রূপকল্প ২০২১’ বাস্তবায়নের মাধ্যমে তথ্যপ্রযুক্তিসমৃদ্ধ, উন্নত ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ বিনির্মাণ এবং বাংলাদেশকে একটি মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করা। রূপকল্প ২০২১ বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে পরিকল্পিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়নের মাধ্যমে জাতীয় প্রবৃদ্ধি ৮ থেকে ১০ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্য নিয়ে বর্তমান সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করেছিল। ২০০৯-১০ সালের বাজেটে মহাজোট সরকারের নির্বাচনী ওয়াদার প্রথম বিষয়টি ছিল বিশ্ব মন্দার মোকাবেলা, দ্রব্যমূল্যের হ্রাসকরণ এবং দেশজ উত্পাদন বাড়িয়ে বা যথাসময়ে আমদানি করে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের স্থিতিশীলতা বজায় রাখা। আরেকটি অঙ্গীকার ছিল জ্বালানি ও বিদ্যুত্ সংকটের সমাধান এবং সেই লক্ষ্যে একটি জরুরি কার্যক্রম বাস্তবায়ন। ২০০৭-০৮ অর্থবছরে ২২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা থেকে আজ উন্নয়ন বাজেটের আকার দেড় লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। দেশ এখন পারমানবিক বিদ্যুত্ প্রকল্প, স্যাটেলাইট প্রকল্পের মতো সাহসী পদক্ষেপ নিতে পেরেছে।

জনগুরুত্ব বিবেচনায় সরকার দশটি বৃহত্ প্রকল্পকে মেগা প্রজেক্ট হিসেবে অগ্রাধিকার দিয়েছে। এগুলো হলো—পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণ প্রকল্প, পদ্মা রেল সেতু সংযোগ প্রকল্প, চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু থেকে গুনদুম পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প, ঢাকা মাস র্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রকল্প (এমআরটি), পায়রা বন্দর নির্মাণ প্রকল্প, গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ প্রকল্প, মাতারবাড়ি আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল কোল ফায়ার্ড পাওয়ার প্রকল্প, মৈত্রী সুপার থার্মাল পাওয়ার প্রকল্প বা রামপাল বিদ্যুত্ প্রকল্প, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুেকন্দ্র স্থাপন প্রকল্প এবং এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্প।

২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর জাজিরা প্রান্তে ৩৭ ও ৩৮ নম্বর খুঁটির ওপর প্রথম স্প্যানটি বসানোর মাধ্যমে দৃশ্যমান হলো পদ্মা সেতুর অবয়ব। ১৫০ মিটার দীর্ঘ এই স্প্যান স্থাপনের মধ্য দিয়ে পদ্মা সেতুর অগ্রগতি আরেক ধাপ এগিয়ে গেল। ২০১৫ সালের মধ্যে এই সেতু দিয়ে দক্ষিণবঙ্গে যাতায়াতের লক্ষ্য ছিল। কিন্তু কথিত দুর্নীতির অভিযোগ তুলে অর্থায়ন থেকে সরে দাঁড়ায় উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা বিশ্বব্যাংক। সরকার নিজস্ব উদ্যোগে নির্মাণ শুরু করায় জনমনেও স্বস্তি বিরাজ করে। এই সেতু নির্মাণ নিঃসন্দেহে চ্যালেঞ্জের ছিল। পদ্মা সেতু আজ স্বপ্ন নয়, বাস্তবের পথে। আগামী কয়েক মাসের মধ্যে দৃশ্যমান হবে মেট্রোরেল। মেগা প্রকল্পগুলো যেমন আশা জাগিয়েছে, তেমনি এর বাস্তবায়ন নিয়েও রয়েছে চ্যালেঞ্জ। এ চ্যালেঞ্জ বাস্তবায়নে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে গঠিত হয়েছে ফাস্ট ট্র্যাক প্রজেক্ট মনিটরিং কমিটি। এসব প্রকল্পে নিবিড় তদারকির মাধ্যমে দ্রুত বাস্তবায়ন করতে চাচ্ছে সরকার। ফাস্ট ট্র্যাকের অগ্রগতি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়—

পদ্মা সেতু

পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পে জারিজার প্রান্তে ও মাওয়া প্রান্তে অ্যাপ্রোচ সড়কের কাজ এবং সার্ভিস এরিয়া ২-এর কাজ শতভাগ শেষ হয়েছে। মূল সেতুর কাজ হয়েছে ৫১ ভাগ। মূল সেতু ও নদীশাসনের কাজের অগ্রগতি ৩৫ শতাংশ।

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র

বর্তমান সরকারের আরেকটি ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্প পাবনার রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুেকন্দ্র। বিদ্যুতের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে সরকার রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুেকন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা হাতে নেয়। ২০১৩ সালের অক্টোবরে এর ভিত্তি স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর ২০১৫ সালের আগস্ট মাসে পারমাণবিক বিদ্যুেকন্দ্র পরিচালনায় কোম্পানি গঠন করতে সংসদে বিল পাস হয়। ৫০ বছর ধরে বিদ্যুত্ উত্পাদনের সক্ষমতাসম্পন্ন এই প্রকল্প নির্মাণের লক্ষে এরমধ্যেই রাশিয়ান প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করেছে বাংলাদেশ। এখানে ১২০০ করে মোট ২৪০০ মেগাওয়াটের দুটি বিদ্যুেকন্দ্র তৈরি করা হবে। পাঁচ স্তরের নিরাপত্তাব্যবস্থা সম্বলিত ‘সর্বাধুনিক তৃতীয় প্রজন্মের প্রযুক্তি’ দিয়ে রূপপুরে এই বিদ্যুেকন্দ্র নির্মাণ করা হবে। রাশিয়ান ফেডারেশনের সঙ্গে স্বাক্ষরিত দুইটি চুক্তির আওতায় রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র স্থাপন প্রকল্পের কার্যক্রম চলমান রয়েছে।

মেট্রোরেল

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মহানগরীগুলোয় দ্রুত চলাচল সুবিধার জন্য মেট্রোরেলের মতো গণপরিবহন ব্যবস্থা আগেই চালু হয়েছে। আমাদের দেশে এই প্রথমবারের মতো ঢাকার উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ২০.১০ কিলোমিটার মেট্রোরেল স্থাপন করা হচ্ছে। পুরো কাজ শেষ হবে ২০২০ সালের জুনের মধ্যে। তবে এর আগে ২০১৯ সালের মধ্যে উত্তরা থেকে ফার্মগেট অংশ চালুর পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে। ঢাকা মাস র্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পের (মেট্রো রেল) আওতায় প্রথম পর্যায়ে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত লাইন স্থাপন করা হবে। পরবর্তী পর্যায়ে এটি মতিঝিল পর্যন্ত স্থাপন করা হবে। আগামী কয়েকমাসের মধ্যে মেট্রোরেলের কাজ দৃশ্যমান হবে। এর কাজ পুরোদমে এগিয়ে চলছে। তবে জনদুর্ভোগ যাতে কম হয়, সে বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া নির্মাণ সামগ্রী ও অন্যান্য আবর্জনা রাস্তা থেকে যথাসময়ে অপসারণ করার বিষয়েও নির্দেশনা রয়েছে। ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর-কুড়িল-বনানী-মহাখালী-তেজগাঁও-মগবাজার-কমলাপুর-সায়েদাবাদ-যাত্রাবাড়ী-ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক (কুতুবখালী) পর্যন্ত যাবে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। প্রথমেই বিমানবন্দর থেকে বনানী পর্যন্ত সুপার স্ট্রাকচারের কাজ হবে।
 
এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্প

দেশে গ্যাসের মজুত কমে আসায় ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার কক্সবাজারের মহেশখালীতে লিকুইফাইড ন্যাচারাল গ্যাস (এলএনজি) টার্মিনাল তৈরির উদ্যোগ নেয়। ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে আওয়ামী লীগ টানা দ্বিতীয় মেয়াদে সরকার গঠনের পর অগ্রাধিকার প্রকল্পগুলোর মধ্যে এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণও অন্তর্ভুক্ত করা হয়। শিল্প ও বিদ্যুতের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছাতে হলে দৈনিক ৩ হাজার ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের প্রয়োজন হবে। এই চাহিদা মেটাতে সরকার শুধু মহেশখালীর এই ভাসমান টার্মিনাল ছাড়াও ভূমিতে আরও ৪টি এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। মহেশখালী-আনোয়ারা, আনোয়ারা-ফৌজদারহাট এবং চট্টগ্রাম-ফেনী-বাখরাবাদ গ্যাস পাইপলাইন স্থাপনের জন্য আগামী এক বছরের মধ্যে ভূমি অধিগ্রহণের পরিকল্পনা রয়েছে। এলএনজি টার্মিনাল স্থাপনের জন্য সময়ভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।

পায়রা সমুদ্র বন্দর

পায়রা বন্দর নির্মাণকে সামনে রেখে বদলে যেতে শুরু করেছে পটুয়াখালীর পাশাপাশি দক্ষিণাঞ্চলের চিত্র। পায়রা গভীর সমুদ্র বন্দর কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ১ হাজার ১২৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০১৫ সালের জুলাই থেকে ২০১৮ সালের জুন পর্যন্ত মেয়াদে বাস্তবায়নের জন্য একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। এর আওতায় জমি অধিগ্রহণ, ওয়ার হাউস নির্মাণ, সার্ভে বোট, পাইলট ভেসেল প্রভৃতি ক্রয় করা হবে বলে জানা গেছে। এই বন্দর পূর্ণাঙ্গ চালু হলে এখানে সার কারখানা, জাহাজ নির্মাণ ও জাহাজ ভাঙা কারখানাসহ বিভিন্ন শিল্প-কারখানা গড়ে উঠবে। এ ছাড়া পটুয়াখালী হয়ে কুয়াকাটা সৈকত পর্যন্ত চার লেন বিশিষ্ট সড়ক যোগাযোগ বসানোর কাজ শুরু হয়েছে। ফলে পায়রা বন্দরের সঙ্গে সুগম হবে দেশের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ। পদ্মা সেতু নির্মাণ শেষ হলে রেলপথের মাধ্যমে রাজধানী ঢাকা ও অন্যান্য জেলার সঙ্গে যুক্ত হবে পায়রা বন্দর।

পদ্মা সেতু রেল সংযোগ

এ প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণ কাজ চলমান রয়েছে। এনজিওর মাধ্যমে রিসেটেলমেন্ট কার্যক্রম সম্পাদন করা হবে বলে জানানো হয়েছে। তবে এ প্রকল্পে এখনো চুক্তি স্বাক্ষর হয়নি। প্রকল্পের ভৌত অগ্রগতি মাত্র সাড়ে ৮ ভাগ। পরবর্তীতে পায়রা বন্দর থেকে পদ্মা সেতু পর্যন্ত রেল লাইন স্থাপনের বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানা যায়।

দোহাজারী থেকে ঘুনধুম পর্যন্ত রেল লাইন নির্মাণ প্রকল্প

দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার হয়ে মিয়ানমারের কাছে ঘুনধুম পর্যন্ত সিঙ্গেল লাইন ডুয়েলগেল রেল পথ নির্মাণ প্রকল্পের জন্য কক্সবাজার এলাকায় জমি পাওয়া গেছে। ভৌত নির্মাণ কাজ, অস্থায়ী পিলার, সুপারভিশন ও ম্যানেজমেন্টের জন্য পরামর্শক নিয়োগ প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। তবে এ প্রকল্পে আর্থিক অগ্রগতি মাত্র ১২ দশমিক ৭০ ভাগ। প্রকল্পের জন্য ভূমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া আরও দ্রুত হওয়া প্রয়োজন।

রামপাল বিদ্যুতকেন্দ্র

রামপালে মৈত্রী সুপার থার্মাল পাওয়ার প্রজেক্টের নিয়োগকৃত পরামর্শকরা কাজ শুরু করেছে। প্রকল্প স্থানে মাটি ভরাট কাজ শতভাগ সম্পন্ন হয়েছে।

মাতারবাড়ি বিদ্যুৎ প্রকল্প

এ প্রকল্পের জন্য ১৫শ একর জমি অধিগ্রহণের কাজ সম্পন্ন হয়েছে এবং প্রকল্পের পরামর্শক নিয়োগ করা হয়েছে। পুনর্বাসন কার্যক্রমের জন্য এনজিও নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। মাতারবাড়ি ও মহেশখালি বিদ্যুত্, জ্বালানি, অর্থনৈতিক অঞ্চলসহ বন্দর উন্নয়ন সংক্রান্ত বেশ কিছু অবকাঠামো নির্মাণের কাজ চালু হতে যাচ্ছে। এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ ও গ্যাস পাইপলাইন স্থাপন প্রকল্প একসঙ্গে ফাস্ট ট্র্যাকে তদারকি করা হবে বলে জানা যায়।
 
সৌজন্যেঃ ইত্তেফাক

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত