527
Published on ডিসেম্বর 22, 2016প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আসলে যারা ধর্ম পালনের নামে ধর্ম পালনের একটা ভান করে তারাই ধর্মে ধর্মে সংঘাত সৃষ্টি করে।’
তিনি বলেন, ধর্মের ওপর যাদের বিশ্বাস ও আস্থা আছে তারা কিন্তু কোন অন্যায় পদক্ষেপ নিতে পারে না। এটা হলো বাস্তবতা।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘ধর্মকে যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করলে আসলে ধর্মকেই প্রকৃতপক্ষে খাটো করা হয়, মানুষের কাছে ছোট করা হয়, হেয় করা হয়। কিন্তু আমাদের দায়িত্ব যার যার ধর্মকে একটা সম্মানজনক অবস্থানে নিয়ে যাওয়া। যেন কেউ কখনও কোন ধর্ম সম্পর্কে অঙ্গুলি নির্দেশ করতে না পারে বা যেন হেয় করতে না পারে।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৃহস্পতিবার বিকেলে খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের শুভ বড়দিন উদযাপন এবং আর্চ বিশপ প্যাট্রিক ডি রোজারিও’র কার্ডিনাল পদে উন্নীত হওয়া উপলক্ষে আয়োজিত নাগরিক সংবর্ধনায় প্রধান অতিথির ভাষণে এ কথা বলেন। ফার্মগেটের বাংলাদেশ কৃষিবিদ মিলনায়তনে এই সংবর্ধনা অনুষ্ঠিত হয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ধর্মের সম্মান বজায় রাখা স্ব স্ব ধর্মের যারা তাদের প্রত্যেকেরই দায়িত্ব এবং আমি একজন মুসলমান হিসেবে আমার ধর্ম পালন করি। তাই এই ধর্মের প্রতি আমার বিশ্বাস ও আস্থা আছে। অন্যরাও যেন বাংলাদেশে তার ধর্মটা যথাযথভাবে পালন করতে পারে সেই পরিবেশ বজায় রাখতে চাই।
অনুষ্ঠানে আর্চ বিশপ প্যাট্রিক ডি রোজারিও, ধর্মমন্ত্রী অধ্যক্ষ মতিউর রহমান, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি বক্তৃতা করেন। ফ্রান্সিস সরোদ গোমেজ অনুষ্ঠানে সভাপতিত্বে করেন এবং বাংলাদেশ খ্রিস্টান এসোসিয়েশনের সভাপতি নির্মল রোজারিও স্বাগত বক্তৃতা করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আপনার জানেন যে- বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ গড়ে তুলতে জাতির পিতা আত্মনিয়োগ করেছিলেন। অত্যন্ত দুঃখের বিষয় পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। আমি ও আমার বোন রেহানা বিদেশে থাকায় প্রাণে বেঁচে যাই। কিন্তু স্বজন হারানোর ব্যথাটা আমি বুঝি। আমরা আমাদের বাবা-মা-ভাই আপনজন হারিয়েছিলাম। কিন্তু বাংলাদেশ কি হারিয়েছিল? বাংলাদেশতো তার সকল সম্ভাবনা হারিয়েছিল ।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সেই সময়ে (বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে) এই বাংলাদেশ যেখানে একটা সুন্দর পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল। সকল ধর্মের মানুষের জন্য একটা শান্তিপূর্ণ বসবাসের জায়গা হয়েছিল। সেখানে সাম্প্রদায়িকতা উস্কে দিয়ে একটি সংঘাত লাগানোর চেষ্টা সেই পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের পর থেকেই শুরু হয়েছিল, এটাই হচ্ছে দুর্ভাগ্যজনক।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, সেই চেতনায় বাংলাদেশ আবার জেগে উঠেছে। আমাদের দেশের সঠিক ইতিহাস এদেশের মানুষ জানতে পারছে এবং আজকে যেন আত্মবিশ্বাসটা নিয়ে দেশ আবার এগিয়ে যাচ্ছে।
শেখ হাসিনা বলেন, আপনারা নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছিলেন যে একটা সময়ে হঠাৎ একজন খ্রিস্টানকে, একজন বুদ্ধিষ্ট, একজন হিন্দু এমনকি মুসলমান কোরআন শরিফ পড়ছে মসজিদে বসে তাকেও হত্যা করা হলো এবং শুরু হলো ব্যাপক প্রচার। অর্থাৎ বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে নষ্ট করার জন্যই যেন এ ধরনের ঘটনা ঘটাতে শুরু করলো। মানুষকে পুড়িয়ে পুড়িয়ে হত্যা করা হল। কোন মানুষ জীবন্ত মানুষকে পুড়িয়ে মারতে পারে রাজনৈতিক উচ্চাভিলাস চরিতার্থ করার জন্য, এটা আসলে বিশ্বাস করা যায় না। কিন্তু আমরা সেই বিভৎস ভয়াবহ অবস্থাও দেখেছি এই বাংলাদেশে। ২০১৫ সালের সেই জানুয়ারি থেকে মার্চ মাসের কথা একটু চিন্তা করে দেখেন। কি জঘন্য ঘটনা এই বাংলাদেশে বিএনপি-জামায়াত জোট ঘটিয়েছিল। জীবন্ত মানুষকে পুড়িয়ে মারা হচ্ছে আর বলা হচ্ছে ওটাই নাকি আন্দোলন। সেই আন্দোলন করে নাকি আবার সরকার উৎখাত করবে। ভোট দিয়ে জনগণ আমাদের নির্বাচিত করেছে। জনগণ ক্ষমতা দিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, খ্রিস্টান ধর্মের প্রবক্তা যীশুখ্রীষ্ট সবসময় আর্ত-পীড়িতকে সাহায্য করতেন, তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়াতেন। আমরা যদি সকল ধর্মের মর্মবাণীর দিকে তাকাই তাহলে কিন্তু সাদৃশ্য দেখতে পাব। প্রত্যেক ধর্মেই কিন্তু শান্তির কথা বলা হয়েছে। সহশীলতার ও মানবতার কথা বলা হয়েছে। অনাহার ক্লিষ্ট, রোগাক্রান্ত অবহেলিত জনগোষ্ঠীকে সাহায্যের কথা বলা হয়েছে। কাজেই আমরা এই বাংলাদেশে সবসময় এটাই বিশ্বাস করি- এখানে সকল ধর্মের সমান অধিকার থাকবে। এটাই হচ্ছে আমাদের মূল নীতি। আমাদের সংবিধানেই এই স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের ধর্ম ইসলাম ধর্ম। আমি যেহেতু নিজের ধর্ম পালন করি তাই অন্যের ধর্মের প্রতিও আমি শ্রদ্ধা জানাই। আমি যদি বিশ্বাস করি এই পৃথিবী আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের সৃষ্ট, তাহলে সবকিছুইতো তিনি সৃষ্টি করেছেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, কাজেই তিনি (আল্লাহ) যেভাবেই যাকে সৃষ্টি করেছেন না কেন সে সেইভাবেই চলবে এটাইতো স্বাভাবিক। কাজেই সেখানে কোন সংঘাত, দ্বন্দ্ব, সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ কোনকিছুরই স্থান নেই। এখানে মানবতাটাই হচ্ছে সবচেয়ে বড়। কাজেই মানবতাকেই আমরা সবচেয়ে গুরুত্ব দেই। আমাদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থের ‘সুরা কাফেরুন’-এ স্পষ্ট বলা আছে- ‘লাকুম দিনুকুম ওয়ালিয়াদিন।’ যার যার ধর্ম সে সে পালন করবে। তোমার ধর্ম তোমার। আমরা সেই নীতিতেই বিশ্বাস করি। আর জাতির পিতার নেতৃত্বে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। এখানে সকল ধর্ম, বর্ণের মানুষইতো এক হয়ে বুকের রক্ত দিয়ে এদেশের স্বাধীনতা এনেছে। কাজেই এ মাটিতে প্রত্যেকটি মানুষ তাঁর অধিকার নিয়েই বসবাস করবে। সেটাই আমরা বিশ্বাস করি।
তিনি বলেন, আমরা চাই এই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ বাংলাদেশে সকলে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নিয়েই বসবাস করবেন। তাছাড়া আমরা এটাই বিশ্বাস করি ধর্ম যার যার কিন্তু উৎসব সবার এবং বাংলাদেশের জনগণের কিন্তু সেই উদারতা আছে। সবাই মিলেই কিন্তু আমরা উৎসব পালন করে থাকি। কাজেই আমাদের সেই সুন্দর পরিবেশটা বজায় রাখতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী কার্ডিনাল মনোনীত হওয়া আর্চ বিশপ প্যাট্রিক ডি রোজরিওকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, বিশ্বে খ্রিস্টানদের ধর্মগুরু পোপ ফ্রান্সিস আর্চ বিশপ প্যাট্রিক ডি রোজারিও সিএসসিকে কার্ডিনাল পদে উন্নীত করেছেন। এই প্রথম আমরা এই পদে একজন বাঙালিকে পেলাম। যেটা আমরা আগে কখনও চিন্তাও করতে পারিনি। সারাবিশ্বে মাত্র ১২১ জন কার্ডিনাল যারা পোপ হিসেবে প্রার্থী হতে পারবেন আবার পোপ নির্বাচনের জন্য ভোট দিতে পারবেন। সেই ভোটদানের অধিকারটা আজকে একজন বাঙালি পেয়েছেন। কাজেই আজকে আমরা খুবই আনন্দিত এই আনন্দটা শুধু খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের নয়, সমগ্র বাঙালি জাতির। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে আজকে সকলেই আনন্দিত বলে আমি মনে করি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশকে আমরা একটি উন্নত দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চাই। যেটা জাতির পিতার স্বপ্ন ছিল। একটি ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলাদেশ গড়ে তুলতে চাচ্ছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতা এই সোনার বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য যে বাণী আমাদের দিয়েছেন এবং আমাদের সংবিধানেও স্পষ্ট উল্লেখ আছে যে, ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়, অনেকেই এর ভুল ব্যাখ্যা করে ধর্মনিরপেক্ষতাকে ধর্মহীনতায় নিয়ে আসে। আর আমরাওতো ধর্মহীনতায় বিশ্বাস করি না। যার যার ধর্ম সে সে পূর্ণ অধিকার নিয়ে পরিপূর্ণভাবে পালন করতে পারবে। সেই পরিপূর্ণভাবে নিজ নিজ ধর্ম পালন করতে পারাটাই ধর্ম নিরপেক্ষতা। ধর্মকে বাদ দিয়ে নয়।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ভাষণ উদ্বৃত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তিনি বলেছিলেন- ‘ধর্ম নিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। মুসলমানরা তাদের ধর্ম পালন করবে তাদের বাধা দেয়ার ক্ষমতা এই রাষ্ট্রের কারো নেই। হিন্দুরা তাদের ধর্ম পালন করবে কারো বাধা দেয়ার ক্ষমতা নেই। বৌদ্ধরা তাদের ধর্ম পালন করবে খ্রিস্টানরা তাদের ধর্ম পালন করবে। তাদের কেউ বাধা দিতে পারবে না। আমাদের শুধু আপত্তি এই যে, ধর্মকে কেউ রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে না।’
তিনি আরো বলেন, ‘ধর্ম অতি পবিত্র বিষয়। পবিত্র ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা চলবে না।’এটাই হচ্ছে জাতির পিতার মূল কথা।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ক্ষমতা দেয়ার মালিক আর নেয়ার মালিক তো আল্লাহ রাব্বুল আলামিন। এ সম্পর্কে আমাদের কোরআন শরিফেও বলা আছে তিনিই সম্মান দেন আবার তিনিই সম্মান কেড়ে নিতে পারেন এবং আমি তাই বিশ্বাস করি। নইলে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের পর সব হারিয়ে একেবারে রিফিউজি হিসেবে যখন বিদেশে ছয়টি বছর কাটাতে হয়েছে। তারপর দেশে ফিরতে পেরেছি। দেশে ফিরে এসে আজকে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছি, প্রধানমন্ত্রী হয়েছি। এটা যদি আল্লাহ না দিতেন বা বাংলার জনগণের আস্থা, ভালবাসা, বিশ্বাস,সম্মান না পেতাম তাহলে কখনই এই দায়িত্ব পেতাম না।
নিজেকে জনগণের সেবক আখ্যায়িত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আমি মনে করি আমি জনগণের সেবক। জনগণের সেবা ও কল্যাণে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। কাজেই এই জনগণের জন্যই আমি কাজ করে যাচ্ছি। যেখানে সকল ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে এদেশের যারা নাগরিক তাদের প্রত্যেকের কল্যাণের জন্যই আমরা কাজ করে যাচ্ছি এবং এই কাজই আমরা করে যাব।
প্রধানমন্ত্রী দেশবাসীর পক্ষ থেকে সমগ্র খ্রিস্টান সম্প্রদায়কে বড়দিনের শুভেচ্ছা জানান।
প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানে বড় দিনের একটি কেক কাটেন এবং একটি সরণিকার মোড়কও উন্মোচন করেন।
ছবিঃ সাইফুল ইসলাম কল্লোল