সারাদেশে উদযাপিত হলো ৪৬তম বিজয় দিবস

632

Published on ডিসেম্বর 17, 2016
  • Details Image

দিবসটি উপলক্ষে সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে শুক্রবার কৃতজ্ঞ জাতি তাদের এই আন্তরিক শ্রদ্ধা জানানোর জন্য সমবেত হয়। শোক আর রক্তের ঋণ শোধ করার গর্ব নিয়ে উজ্জ্বীবিত জাতি দিবসটি উদযাপন করে অন্যরকম অনুভূতি নিয়ে।

ভোরে শীতের কুয়াশা ও ঠান্ডা বাতাস উপেক্ষা করে স্বাধীনতা বিরোধীদের বিচারের রায় কার্যকর হচ্ছে এই স্বস্তি নিয়ে সর্বস্তরের মানুষ ভোর থেকেই সাভারের স্মৃতি স্মৃতিসৌধের বাইরে ও আশেপাশের মহাসড়ক এলাকা এবং ধানমন্ডিস্থ বঙ্গবন্ধু ভবনের সামনে সমবেত হতে থাকে।

সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধ থেকে লাখো মানুষের দৃপ্তকণ্ঠে আওয়াজ উঠে যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষ নেয়ায় পাকিস্তানের সঙ্গে সকল সম্পর্ক ছিন্ন, জামায়াতকে নিষিদ্ধ এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দ্রুত শেষ করার।

ভোরের সূর্য ওঠার আগেই হাতে ফুল, মাথায় মহান বিজয় দিবস লেখা ব্যান্ড, মুখে একাত্তরের ঘাতকদের বিচার দাবির স্লোগানে স্মৃতিসৌধে নেমেছিল জনতার এই ঢল। বিনম্র শ্রদ্ধাবনত চিত্তে সমগ্র জাতি ত্রিশ লাখ শহীদকে আরও একবার জানিয়ে দিল ‘আমরা তোমাদের ভুলব না।’

দিবসটি উপলক্ষে সরকারি-বেসরকারিভাবে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে ভোরে ৩১ বার তোপধ্বনির মধ্য দিয়ে বিজয় দিবসের কর্মসূচি শুরু হয়। সশস্ত্র বাহিনীর কুচকাওয়াজ পরিদর্শন ও সালাম গ্রহণ করেন রাষ্ট্রপতি মো: আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

ভোর ৬টা ৩৪ মিনিটে সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে স্মৃতিস্তম্ভের বেদিতে রাষ্ট্রপতি মো: আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পুষ্পস্তবক অর্পণের মধ্য দিয়ে শুরু হয় শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন। এ সময় শহীদদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। বিউগলে বেজে ওঠে করুণ সুর। পরে শেখ হাসিনা দলীয় প্রধান হিসাবে দলের নেতাকর্মীদের নিয়ে স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।

এসময় অন্যান্যের মধ্যে জাতীয় সংসদের বিরোধী দলের নেতা রওশন এরশাদ, ডেপুটি স্পিকার এডভোকেট ফজলে রাব্বি মিয়া, মন্ত্রীপরিষদের সদস্যবৃন্দ, প্রতিমন্ত্রীবৃন্দ, তিন বাহিনীর প্রধানগণ, সংসদ সদস্যবৃন্দ, মুক্তিযোদ্ধা, কূটনীতিক, বিভিন্ন উন্নয়ন অংশীদারদের প্রতিনিধি এবং উচ্চপর্যায়ের সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী স্মৃতিসৌধস্থল ত্যাগ করার পর সর্ব সাধারণের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য খুলে দিলে সাধারণ মানুষের ঢল নামে।

একদিকে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা ও অন্যদিকে বিজয় উল্লাসে শুক্রবার জাতীয় স্মৃতিসৌধ চত্বর মুখর ছিল বিভিন্ন বয়সী মানুষের পদচারণায়। স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির ধ্বংসাত্মক, নৈরাজ্যকর কর্মকান্ড প্রতিহত করতে নানা স্লোগান, দেশাত্মবোধক গান চলছিল বিরামহীনভাবে। জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানাতে আসা জনতার এই ঢল অব্যাহত থাকে দুপুর ১টা পর্যন্ত।

একে একে বেদীতে শ্রদ্ধা জানায় কেন্দ্রীয় ১৪ দল, শহীদ পরিবারের সন্তান ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধারা। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ সভাপতি ও তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর নেতৃত্বে জাসদ, উপাচার্য ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রী রাশেদ খান মেননের নেতৃত্বে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, সভাপতি শাখাওয়াত হোসেন বাদশা ও মুরসালিন নোমানীর নেতৃত্বে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি জাতীয় স্মৃতিসৌধে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানায়।

এ ছাড়া বাংলাদেশে কমিউনিস্ট পার্টি, আওয়ামী যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, ছাত্রলীগ, কৃষক লীগ, যুব মহিলা লীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি (জেপি), ছাত্র ইউনিয়ন, যুব ইউনিয়ন, উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী, বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলা একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমি, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম-মুক্তিযুদ্ধ-’৭১, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, মুক্তিযোদ্ধা যুব কমান্ড, বঙ্গবন্ধু পরিষদ, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন মঞ্চ ও প্রজন্ম মঞ্চ, জাকের পার্টি, মুক্তিযোদ্ধা সংহতি পরিষদ সহ বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও বিভিন্ন হলের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাও স্মৃতিসৌধে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানায়।

পরে মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ধানমন্ডিন্থ ৩২ নম্বরের বঙ্গবন্ধু ভবনের সামনে রক্ষিত জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এরপর দলীয় নেতাদের নিয়ে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে তিনি জাতির পিতার প্রতি শ্রদ্ধা জানান। দলের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা এসময় বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।

এদিকে মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে রাজধানীর শাহবাগে কণ্ঠে জাতীয় সংগীত ও শপথ বাক্য পাঠ অনুষ্ঠিত হয়েছে। বিকেল ৪টা ৩১ মিনিটে জাতীয় সংগীত শুরু হয়। এ সময় লাখো মানুষ অংশ নেন। এছাড়াও বিজয় দিবস পালন সংক্রান্ত জাতীয় কমিটির উদ্যোগে বিজয় উৎসব দিনব্যাপী নানা কর্মসূচি পালিত হয়। কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত সকালে অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন।

এছাড়াও মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে জাতীয় প্রেসক্লাব ও ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন পৃথক আলোচনা সভার আয়োজন করে।

বিকেলে রাজধানীতে লাখো মানুষের অংশগ্রহণে মহান বিজয় দিবসে রাজধানীতে শোভাযাত্রা বের করে আওয়ামী লীগ। ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্দ্যান থেকে ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বঙ্গবন্ধু ভবনস্থ এই দীর্ঘ সাড়ে তিন কিলোমিটার সড়কজুড়েই মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দলটির বর্ণাঢ্য মনোলভা বিজয় র্যানলিতে মানুষের ঢল নামে ।

এর আগে সকালে ‘ঐক্য গড়ো বাংলাদেশ, সাম্প্রদায়িকতার হবে শেষ’ শীর্ষক সাম্প্রদায়িকতাকে রুখে দেওয়ার ডাক দিয়ে মহান বিজয় দিবসে শোভাযাত্রা বের করে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট। সকাল ১১টার দিকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে শোভাযাত্রাটি দোয়েল চত্বর হয়ে মৎস্য ভবন ও শাহবাগ মোড় ঘুরে টিএসসিতে গিয়ে শেষ হয়। শোভাযাত্রায় সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের কর্মীসহ সর্বস্তরের মানুষ অংশ নেন।

এদিকে মহান বিজয় দিবস উদযাপন উপলক্ষে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের দক্ষিণ সাহানে কোরআনখানি, মিলাদ ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়।এ সময় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে শহীদ তাঁর পরিবারের সদস্য এবং মুক্তিযুদ্ধে শাহাদাত বরণকারী সকল শহীদের রূহের মাগফেরাত কামনা করে বিশেষ দোয়া ও মোনাজাত করা হয়। এ সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা এবং দেশ ও জাতির সুখ, শান্তি, সমৃদ্ধি ও কল্যাণের জন্য মোনাজাত করা হয়।

মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটি ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরে এক বিশেষ প্রার্থনা সভার আয়োজন করে। প্রার্থনা সভায় জাতির শান্তি, সমৃদ্ধি, অগ্রগতি এবং শহীদদের আত্মার সদগতি কামনা করা হয়।

দিনটি উপলক্ষে সকল সরকারি-আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি ভবনে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ভবন ও স্থাপনায় আলোকসজ্জার ব্যবস্থা হয়েছে। রাজধানী ঢাকা ও দেশের বিভিন্ন শহরের প্রধান সড়ক ও সড়ক দ্বীপগুলো জাতীয় পতাকা ও রঙ-বেরঙের পতাকায় সাজানো হয়।

এদিকে জাতির শান্তি, সমৃদ্ধি ও অগ্রগতি কামনা করে মসজিদ, মন্দির, গির্জা, প্যাগোডাসহ সব ধর্মীয় উপাসনালয়ে বিশেষ মোনাজাত ও প্রার্থনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। হাসপাতাল, জেলখানা, বৃদ্ধাশ্রম, এতিমখানা, শিশু পরিবার ও ভবঘুরে প্রতিষ্ঠানগুলোয় উন্নতমানের খাবার সরবরাহ করা হয়।

TAGS:

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত