510
Published on এপ্রিল 28, 2016প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে তাঁর সরকার আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করছে।
তিনি বলেন, ‘অনেকে বিচার পায় না। অতীতে আইনগত সহায়তার কোন ব্যবস্থা ছিল না। মানুষের সব মৌলিক অধিকারের পাশাপাশি বিচার পাওয়ার অধিকারও প্রতিষ্ঠিত করতে আমরা কাজ করছি।’
শেখ হাসিনা নিজেকে একজন বিচার বঞ্চিত ভুক্তভোগী আখ্যায়িত করে বলেন, ‘সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে আমাদেরকে বিচার পাওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত, এমনকি খুনিদের বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরী প্রদান, জনপ্রতিনিধি বানিয়ে পুরস্কৃত করা হয়েছিল।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আওয়ামী লীগ ‘৯৬ সালে সরকার গঠনের পর বিচার বিভাগের উন্নয়ন এবং সেইসাথে বিচারক নিয়োগ থেকে শুরু করে প্রতিটি ক্ষেত্রে আধুনিকায়নের নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। হাইকোর্টে অ্যানেক্স ভবন নির্মান ছাড়াও জেলা পর্যায়ে আদালতগুলোকে নতুনভাবে গড়ে তোলা এবং আইনগত সহায়তার সুযোগ বৃদ্ধি সহ বহুকাজ আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে সম্পন্ন হয়েছে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভালো কাজ হচ্ছে আইনগত সহায়তা প্রদানের সিদ্ধান্ত এবং সেটাকে আইনে পরিণত এবং বাস্তবায়ন করা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৃহস্পতিবার সকালে রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে জাতীয় আইনগত সুবিধা প্রদান দিবসের অনুষ্ঠানমালার উদ্বোধোনকালে প্রধান অতিথির ভাষণে এ কথা বলেন।
আইন মন্ত্রণালয় এবং জাতীয় সংসদের আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক বিভাগ অনুষ্ঠানটির আয়োজন করে।
প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানে লিগ্যাল এইড কল সেন্টার জাতীয় হেল্পলাইনের উদ্বোধন করেন। এ হেল্পলাইনে (১৬৪৩০) ফোন করে জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদানকারী সংস্থার মাধ্যমে বিনামূল্যে আইনি সহায়তা পাবেন দেশের স্বল্প আয়ের ও অসহায় বিচারপ্রার্থী নাগরিকরা।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব আবু সালেহ শেখ মোহাম্মদ জহিরুল হক। লিগ্যাল এইড সার্ভিসেসের পরিচালক মালিক আবদুল্লাহ আল আমিন অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তৃতা করেন।
অনুষ্ঠানে লিগ্যাল এইড সার্ভিসের সুবিধাপ্রাপ্ত দুজন ভুক্তভোগী নরসিংদীর শিউলী আক্তার এবং গার্মেন্টস কর্মী রঞ্জিত কুমার রায় নন্দী তাঁদের অনুভূতি ব্যক্ত করেন।
অনুষ্ঠানে লিগ্যাল এইড সার্ভিসেসের ওপর একটি তথ্য চিত্রও পরিবেশিত হয়।
পরে প্রধানমন্ত্রী সুইচ টিপে এবং কল সেন্টারের হেলপ লাইনে ফোন করে একজন ভুক্তভোগী হিসেবে আইনগত সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রগুলো অবগত হবার মাধ্যমে এই আইনগত সুবিধা প্রদানের হেলপ লাইনটির উদ্বোধন করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা স্বাধীন জাতি। বঙ্গবন্ধু আমাদের স্বাধীনতা দিয়ে গেছেন। স্বাধীন দেশে তিনি একটি সংবিধান দিয়ে গেছেন। যেখানে মানুষের সব মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। আমরা বঙ্গবন্ধুর সেই সংবিধানের পদাঙ্ক অনুসরণ করে চলছি।
পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ের কথা স্মরণ করে শেখ হাসিনা বলেন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধুসহ তার পরিবারের ১৮ জন সদস্যকে হত্যা করা হলো। এরপর যেন এ হত্যাকান্ডের কোনো বিচার না হয়, সেজন্য একটি অধ্যাদেশ জারি করা হলো। আমাদের বিচার চাওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হলো। তবে, জনগণের রায়ে ২১ বছর পর ক্ষমতায় এসে আমরা সেই অধ্যাদেশ বাতিল করে ওই বর্বর হত্যাকান্ডের বিচার করেছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিচার চাওয়ার অধিকার সকলেরই রয়েছে। সমাজের সবাই বিচার চাওয়ার অধিকার পেলে অবহেলিত-নিম্নবিত্ত মানুষরা কেন পাবে না?
তিনি অন্ন-বস্ত্র-স্বাস্থ্য-শিক্ষাসহ বিভিন্ন খাতে সরকারের নানা উন্নয়নমুখী পদক্ষেপের কথা তুলে ধরে বলেন, দেশের মাথাপিছু আয় ১৪শ’৬৬ ডলারে উন্নীত হয়েছে। আগামী বাজেটে এ বিষয়ে আরো সুখবর আসতে পারে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে জাতিকে একটি অনন্য সাধারণ সংবিধান উপহার দিয়ে গেছেন। গণতন্ত্র, মানবাধিকার, সাম্য ও ন্যায়বিচারের এক অনন্য দলিল আমাদের সংবিধান। এই সংবিধানে সুবিচার ও সাম্যের বাণীকে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। পাশাপাশি সকল নাগরিকের মৌলিক অধিকারের রক্ষাকবচ হিসেবে এতে যথাযথ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।
তিনি উল্লেখ করেন, আমাদের পবিত্র সংবিধানের ২৭নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে: ‘আইনের দৃষ্টিতে সকলেই সমান এবং সকলেই আইনের সমান আশ্রয়লাভের অধিকারী’। সংবিধানের ১৯নং অনুচ্ছেদে স্পষ্ট ভাষায় বলা হয়েছে: ‘সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করিতে রাষ্ট্র সচেষ্ট হইবে’।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট কালরাতে জাতির পিতাকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করার মধ্য দিয়ে স্তব্ধ করে দেওয়া হয় এদেশের জনগণের মৌলিক অধিকার ও মানবাধিকার।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বহু চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে এবং দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে আমরা বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচারের আওতায় নিয়ে এসে জাতিকে কিছুটা হলেও কলঙ্কমুক্ত করেছি।
শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, অবকাঠামোসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের রোল মডেল উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁর সরকার জনগণের ভোট ও ভাতের অধিকার নিশ্চিত করার পাশাপাশি জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ।
তিনি বলেন, আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল, অসহায়, স¤¦লহীন এবং নানাবিধ আর্থ-সামাজিক কারণে বিচার পেতে অসমর্থ বিচারপ্রার্থী মানুষকে আইনগত সহায়তা প্রদানের লক্ষ্যে আমরা আইনগত সহায়তা প্রদান আইন, ২০০০ প্রণয়ন করি। কিন্তু, ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর আইনগত সহায়তা প্রদান আইন, ২০০০ কে বাস্তবে অকার্যকর করে রাখে। ২০০৯ সালে পুনরায় দায়িত্ব গ্রহণের পর আমরা এই আইনকে গতিশীল করি। এ সংক্রান্ত আরও আইন ও বিধি প্রণয়ন করা হয়েছে। ফলে দুঃস্থ, অসহায় ও দরিদ্র বিচারপ্রার্থী জনগণ আইনের সুফল ভোগ করছেন।
প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন, ২০০৯ সাল থেকে ২০১৪ পর্যন্ত মোট ১ লাখ ১৮ হাজার ১৮৮ জন গরিব ও অস্বচ্ছল ব্যক্তিকে আইনগত সহায়তা প্রদান করা হয়েছে।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আইনের শাসন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় আমরা দৃঢ় অঙ্গীকারবদ্ধ। এজন্য ‘জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা’ প্রতিষ্ঠা ছাড়াও জাতীয় মানবাধিকার কমিশন প্রতিষ্ঠা করেছি। এ দুটি প্রতিষ্ঠানই আইনের শাসন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় সমাজে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে চলেছে।’
তিনি বলেন, ২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর পরই জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনে ‘দি কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউর (এমেন্ডমেন্ট) অ্যাক্ট, ২০০৯ পাশের মাধ্যমে আমরা বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের কাজটিকে স্থায়ীরূপ দান করেছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর পরই অধঃস্তন আদালতের জন্য বিচারক নিয়োগ, নতুন নতুন আদালত ও ট্রাইব্যুনাল স্থাপনসহ প্রয়োজনীয় পদ সৃষ্টি করেছি। উচ্চ আদালতেও বিচারকের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে।
তিনি বলেন, বিচার বিভাগের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে বিচারকদের কাজের গতিশীলতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে আমরা তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার বিচার বিভাগের সর্বত্র ছড়িয়ে দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছি। প্রশাসনিক উদ্যোগের পাশাপাশি আইনী সংস্কারমূলক কার্যক্রম হাতে নিয়েছি। আদালতে বিচারাধীন মামলাসমূহ বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি ব্যবস্থার ক্ষেত্র ও পরিধি সম্প্রসারণ করা হয়েছে। এ লক্ষ্যে ১৯০৮ সালের দেওয়ানী কার্যবিধি ইতোমধ্যে সংশোধন করা হয়েছে।
সরকারি আইনী সহায়তা কার্যক্রমকে তৃণমূল পর্যায়ে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে দেশের সকল জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে লিগ্যাল এইড কমিটি গঠন করা হয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সুবিধাবঞ্চিত মানুষের জন্য দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থিত চৌকি আদালতগুলোতে এবং শ্রমিকদের কল্যাণে শ্রম আদালতসমূহে আইনগত সহায়তা প্রদানের লক্ষ্যে গঠিত কমিটি কাজ করে যাচ্ছে।
এছাড়া, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টেও দুঃস্থ, অসহায়, দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত বিচারপ্রার্থীদের জন্য সরকারি আইনী সেবা প্রদান করা হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, আইনী সহায়তা কার্যক্রমকে আরও কার্যকর, গতিশীল ও সেবাবান্ধব করার লক্ষ্যে প্রত্যেক জেলায় একটি করে স্থায়ী ‘লিগ্যাল এইড অফিস’ স্থাপন করা হয়েছে। এসব অফিস পরিচালনার জন্য ৬৪টি জেলা লিগ্যাল এইড অফিসারের পদ সৃষ্টি করা হয়েছে এবং বিচারকগণকে এসব পদে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জেলা লিগ্যাল এইড অফিসকে শুধু আইনী সহায়তা প্রদানের কেন্দ্র হিসেবে সীমাবদ্ধ রাখা হচ্ছে না। অসহায় দরিদ্র বিচারপ্রার্থীসহ জনগণের কল্যাণে মামলা জট কমানোর লক্ষ্যে সরকার এ অফিসকে ‘এডিআর কর্ণার’ বা ‘বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির কেন্দ্রস্থল’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সরকারি আইনী সেবার মানোন্নয়নে সহায়তা প্রদান’ প্রকল্পের আওতায় সম্পূর্ণ সরকারি অর্থায়নে সরকারি আইনী সহায়তায় জাতীয় হেল্প লাইন কল সেন্টার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এ কল সেন্টারের মাধ্যমে ২৪ ঘন্টা দেশের যেকোন স্থান থেকে যে কেউ বিনামূল্যে কল করে আইনগত সেবা নিতে পারবেন। এর মাধ্যমে তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত সরকারি আইনী সেবা আরও বিস্তৃত ও সহজলভ্য হবে। আইনগত সহায়তা প্রদানের জন্য সরকার সকল ব্যয় বহন করছে।
প্রধানমন্ত্রী সমৃদ্ধ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করে বলেন, আমাদের লক্ষ্য ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি সুখী, অসাম্প্রদায়িক মধ্যম আয়ের এবং ২০৪১ সালের মধ্যে সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে বিশ্ব মানচিত্রে প্রতিষ্ঠিত করা। আমরা প্রত্যেকেই আমাদের নিজ নিজ অবস্থান হতে সর্বোচ্চ শক্তি ও সামর্থ্য দিয়ে একটি সমৃদ্ধশালী ও সুখী বাংলাদেশ গড়ে তুলতে সক্ষম হব, ইনশাআল্লাহ্।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ইতোধ্যেই প্রায় ৫ কোটি লোক নিম্নবিত্ত থেকে নিম্ন মধ্যবিত্ত পর্যায়ে উঠে এসেছে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব স্বাধীন বাঙালি জাতি কখনও নিম্নে থাকতে পারে না ।
তিনি বলেন, তাঁর সরকার সামাজিক অসঙ্গতি ও বৈষম্য দূর করে ধনী-দরিদ্র সকলকে এক কাতারে আনতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তৃণমূল পর্যায়ে সরকারি আইন সহায়তা কার্যক্রমের বিস্তার ঘটিয়ে এটিকে একটি স্থায়ী প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি দেশী-বিদেশী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, দাতা গোষ্ঠী, আইনজীবী, বিচারকসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে এগিয়ে আসারও উদাত্ত আহ্বান জানান।