কেরানীগঞ্জে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

592

Published on এপ্রিল 10, 2016
  • Details Image

রাজধানীর বাইরে দেশের সর্ববৃহৎ ও সবচেয়ে সুরক্ষিত সর্বাধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত কারাগার উদ্বোধন করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা মানুষকে মানুষ হিসেবেই দেখি। জাতির পিতা আমাদের সেই শিক্ষাই দিয়েছেন। আমাদের লক্ষ্য এই কারাগার যেন একটি সংশোধনাগার হিসেবে বন্দিসেবা দিতে পারে। যারা জঘন্য অপরাধী তাদের কথা আমি বলব না, যাদের মানুষ হবার সুযোগ রয়েছে তাদের যেন সংশোধনের সুযোগটা করে দিতে পারি।

প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন, অপরাধীদের অপরাধ করার মানসিকতা দূর করে তাদেরকে কর্মমুখী জীবনের মূল ধারাতে ফিরিয়ে আনা সরকার ও রাষ্ট্রের অন্যতম দায়িত্ব।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রবিবার সকালে কেরাণীগঞ্জে নবনির্মিত ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার উদ্বোধনকালে প্রধান অতিথির ভাষণে এ কথা বলেন।

অনুষ্ঠানে আরো বক্তৃতা করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মো. মোজাম্মেল হক খান এবং কারা মহাপরিদর্শক সৈয়দ ইফতেখার উদ্দীন আহমেদ।

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট নসরুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব আবুল কালাম আজাদ, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব সুরাইয়া বেগম অনুষ্ঠানে মন্ত্রিপরিষদ সদস্য, সংসদ সদস্যবৃন্দ, সরকারি, বেসরকারকারি ও স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানের উর্ধ্বতন কর্মকর্তবৃন্দ, উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাবৃন্দ এবং কূটনৈতিক মিশনের সদস্যবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘মানুষ অপরাধ করলে তাদেরকে গ্রেফতার ও বন্দি করা হয়। অপরাধ প্রবণতা থেকে অপরাধীদের সরিয়ে আনার উপায় সম্পর্কে আমাদের চিন্তা করতে হবে।

তিনি অপরাধ সংঘটনের কারণ সম্পর্কে বলেন, অনেকের অভাবে স্বভাব নষ্ট হয়। এছাড়া, এখন নতুন নতুন অপরাধ দেখা দিচ্ছে। সময়ের বিবর্তনে বিশ্ব এগিয়ে যাচ্ছে, প্রযুক্তির উদ্ভাবন হচ্ছে আর অপরাধ প্রবণতাতেও ভিন্নতা আসছে। অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এসব বিবেচনায় রেখে পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন।

তিনি বলেন, ‘আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে অপরাধীদেরকে তার অপরাধ প্রবনতা থেকে সরিয়ে এনে সংশোধন করা। সংশোধন করে তার জীবনটা কর্মমুখী করার ব্যবস্থা করতে হবে।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, কারাগার শুধু বন্দিখানা নয়, সেখানে অপরাধীদের সংশোধন করার পদক্ষেপটা নিতে হবে। সেদিকে আমরা বিশেষভাবে গুরুত্ব দিচ্ছি।

তিনি বলেন, ছিঁচকে চুরির অপরাধে কেউ জেলখানায় আসার পর যাতে পাকা বড় চোর হওয়ার ট্রেনিং না পায় সে লক্ষ্যে পদক্ষেপ নিতে হবে। আমরা তাদের জন্য প্রয়োজনীয় নানা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করবো।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, কারাগারেই অনেক জিনিষের প্রয়োজন হয় সেটা কারাগারেই তারা তৈরি করতে পারবে, উৎপাদন করতে পারবে। এগুলো বাজারজাত করার ফলে যে আয় হবে তা থেকে উৎপাদনকারী কয়েদীদের মজুরি দেয়া হবে। এই মজুরি তাদের জন্য জমা থাকবে। প্রয়োজনে কয়েদিরা তাদের পরিবারকেও এর কিছুটা অংশ যেন পাঠাতে পারে তার ব্যবস্থাটাও করে দিতে হবে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, কয়েদীদের মাসে একবার পাবলিক টেলিফোনের মাধ্যমে পরিবারের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ করে দিলে তাদের সংশোধনে বিশেষ সহায়ক হতে পারে ।

শেখ হাসিনা বলেন, ‘দীর্ঘদিন কারাভোগের পর জমানো কিছু সঞ্চয় নিয়ে কয়েদিরা মুক্তি পেলে বাকী জীবনটা সে কিছু করে খেতে পারবে। আর অপরাধের পথে পা বাড়াবে না।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, একজন অপরাধ করে। কিন্তু কষ্ট পায় তার গোটা পরিবার।

তিনি দেশের মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামের কারণে জাতির জনকের বারংবার কারাগারে থাকার স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘কেউ কারাগারে থাকলে, আসল ভুক্তভোগী হয় তার পরিবার। আমার মত এই কষ্টটা হাড়ে হাড়ে আর কেউ বুঝবে না।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, কারাবন্দিদের মানবেতর পরিবেশে বসবাস করতে হয়। কারণ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার মুঘল আমলে দুর্গের আদলে তৈরি। যেখানে ঘোড়াশাল থেকে শুরু করে অনেক কিছু ছিল। এটিকে ব্রিটিশ আমলে কারাগারে রূপান্তরিত করা হয়। এরপর পাকিস্তান আমলে এটা পূর্ব পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় কারাগারে রূপান্তরিত করা হয়। কাজেই এটা কারাগারের আদলে তৈরি হয়নি। যেখানে মাত্র আড়াই হাজার লোকের ধারণ ক্ষমতা সেখানে হাজার হাজার বন্দি অত্যন্ত মানবেতরভাবে জীবন যাপন করতো।

নতুন জেলখানায় প্রচুর জায়গা রয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী কয়েদীদের নানা উৎপাদনমুখী কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত করার জন্য জেল কতৃর্পক্ষকে নির্দেশনা দেন।

একইসঙ্গে তিনি কারারক্ষীদের এবং কয়েদীদের প্রশিক্ষণের ওপর গুরুত্বারোপ করে বর্তমান নাজিমউদ্দিন রোডের জেলের ফাঁকা জায়গার পরিবর্তে এই কেরানীগঞ্জেই জেলখানার পাশে কারাবন্দি এবং কারারক্ষীদের প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট নির্মাণের ঘোষণা দেন।

প্রধানমন্ত্রী কারাগারের জন্য বিদ্যুৎ ব্যবস্থা নিরবচ্ছিন্ন করার বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ নিয়ে সৃষ্ট ঘটনাকে দুঃখজনক বলে অভিহিত করেন।

তিনি বলেন, বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্প গ্রহণ করতে গেলেই এক শ্রেণীর লোক পরিবেশ রক্ষার জন্য তৎপর হয়। তারা কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র করতে দেবে না। প্রথমবার যখন আমি ’৯৬ সালে ক্ষমতায় ছিলাম, তখনই দিনাজপুরে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের ভিত্তিপ্রস্থর স্থাপন করি। সেখানে দুটো বিদ্যুৎ কেন্দ্র আছে, তৃতীয়টার কাজ চলছে। এলাকার কোন ক্ষতি হয়নি বরং জমির উর্বরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ধান-পান হচ্ছে, গাছপালা হচ্ছে-সব হচ্ছে। মানুষ বসবাস করছে।

তিনি বলেন, কয়লার একটা কার্গো ডুবে যাওয়ার পর অনৈকে বললো যে, পানি নাকি দূষিত হয়ে গেছে।

তিনি উল্লেখ করেন, ফিল্টারে পানি পরিশোধণে কয়লা ব্যবহার হয়। অন্যদিকে, কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ছাই সিমেন্ট কারখানায় ব্যবহার করা হয়। সিমেন্ট কারখানাগুলো এই ছাই নিয়ে যাচ্ছে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, পৃথিবীর সবদেশে, অক্সফোর্ড থেকে শুরু করে সারাবিশ্বে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে। অথচ এখানে উদ্ভট কথা বলে অযথা কতজন মানুষের জীবন পর্যন্ত নিয়ে নেয়া হলো। এটা দুঃখজনক।

তিনি বলেন, আমরা দ্রুত বিদ্যুৎ উৎপাদন করে মানুষকে একট স্বস্তি দিয়েছি। এখন সেই উৎপাদনে বাধা দেয়ার চেষ্টা হচ্ছে, অথচ আমাদের উন্নয়নের জন্যই এটা দরকার।

কেরানীগঞ্জ এক সময় অবহেলিত জনপদ ছিল উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সেখানে দ্বিতীয় বুড়িগঙ্গা সেতু এবং মাওয়া পর্যন্ত রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে। এমনকি পদ্মাসেতুর যে রেললাইন হচ্ছে তা কেরানীগঞ্জ হয়ে যাচ্ছে। এটিকে একটি আধুনিক এলাকা হিসেবে গড়ে তোলা হচ্ছে।

এক সময় ঢাকা থেকে কেরানীগঞ্জে লঞ্চে যাতায়াত করার বিষয়টি স্মৃতিচারণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজ আর কেরানীগঞ্জ খুব দূরে নয়। খুব দ্রুতই এখানে আসা-যাওয়া করা যায়, আধা ঘন্টাতেই পৌঁছানো যায়। এখানে যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রভুত উন্নয়ন হয়েছে আর পদ্মা সেতু হবার পর এখানকার জমির দাম বহুগুণে বেড়ে যাবে তাতে কোন সন্দেহ নাই।

কারাগারে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে প্রতিটি কারাভবনে সোলার প্যানেল করে দেয়া হবে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কারাাগারে বিদ্যুৎ থাকার দরকার বিধায় আমরা নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থা করে দেব।

তিনি কারা হাসপাতালটি ১৬ শয্যা থেকে বাড়িয়ে কারাগার সংশ্লিষ্ট এবং জনগণের সুবিধার্থে দুইশ’ থেকে আড়াইশো’ শয্যার করে নির্মাণের পাশাপাশি কারারক্ষীদের সন্তানদের লেখাপড়ার জন্য প্রয়োজনে নতুন বিদ্যালয় নির্মাণ এবং যাতায়াতে বাস সুবিধা দেয়ার ঘোষণা দেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা দেশের প্রতিটি সেক্টরে কোথায় কি সমস্যা তা চিহ্নিত করেই উন্নয়নের উদ্যোগ নিয়েছি তাই দেশের প্রতিটি ক্ষেত্রেই আজ উন্নয়ন হচ্ছে। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে।

বক্তৃতার শুরুতেই প্রধানমন্ত্রী জাতির জনকের দীর্ঘ কারাজীবনের কথা স্মরণ করে বলেন, ১৫ দিনে মাত্র একবার দেখা করতে দিত। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে বারবারই কারাগারে এসেছি বাবার সঙ্গে দেখা করতে। এরমধ্যে ১৯৬৮ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সময় বঙ্গবন্ধুকে কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে গেলে প্রায় ৬ মাস তিনি বেঁচে আছেন কিনা জানতে পারেননি।

তিনি আরো উল্লেখ করেন, তাছাড়া, একাত্তরের ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণার পরে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তান নিয়ে যাবার পর ৭২ সালের ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু মুক্তি পেয়ে লন্ডন যাবার আগ পর্যন্ত তাঁর পরিবারের সদস্যরা জানতে পারেননি, তিনি বেঁচে আছেন কিনা।

তিনি এ প্রসঙ্গে এরশাদ সরকারের সময় হাউজ অ্যারেষ্ট এবং সাবজেলে থাকাসহ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় জাতীয় সংসদ ভবনের পাশে সাবজেলে থাকার স্মৃতিচারণ করেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, অপরাধীদের অপরাধ কর্ম থেকে সরিয়ে আনতে সমাজের সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে। এই সংস্কার করতে গেলে মন মানসিকতার একটু পরিবর্তন ঘটাতে হবে।

তিনি বলেন, আমরা বাংলাদেশে শিক্ষাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছি, কারণ একটি শিক্ষিত জাতিই পারে দারিদ্র্য দূর করতে। শিক্ষা ছাড়া আমরা এগিয়ে যেতে পারব না। সুতরাং সেদিকে লক্ষ্য রেখেই আমরা পদক্ষেপ নিয়েছি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, চিকিৎসা সেবায় আমরা পদক্ষেপ নিয়েছি বলে আজ চিকিৎসাসেবা মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছে। আমরা খাদ্য উৎপাদনে এখন উদ্বৃত্ত দেশ। অতি দরিদ্রদের আমরা বিনা পয়সায়ও খাদ্য নিয়ে থাকি। এদেশকে এ সময় অন্যের কাছে ভিক্ষা চাইতে হত। আজকে আল্লাহর রহমতে আর ভিক্ষা চাইতে হয় না। সেই সাথে সাথে দেশকে আমরা আরও উন্নত করতে চাই।

তিনি ২০২১ সালের মধ্যে দেশকে মধ্যম আয়ের দেশে এবং ২০৪১ সাল নাগাদ উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশে পরিণত করার লক্ষ্য অর্জন করতে সকলের সহযোগিতা কামনা করেন।

প্রধানমন্ত্রী কারাগার প্রাঙ্গণে একটি গাছের চারাও রোপন করেন।

TAGS:

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত