নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে, আত্মবিশ্বাস নিয়ে চলতে হবেঃ নারীদের প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

1304

Published on মার্চ 8, 2016
  • Details Image

প্রধানমন্ত্রী বলেন,‘আমাদের কারো মুখাপেক্ষী হলে চলবে না। নিজেদের ভাগ্য নিজেদেরই গড়তে হবে, নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে, আত্মবিশ্বাস নিয়ে চলতে হবে। তবেই মর্যাদা পাওয়া যাবে। কেঁদে কেঁদে ফিরলে মর্যাদা কেউ হাতে তুলে দিবে না। বরং করুনা করবে। আর করুনা নিয়ে মেয়েরা বাঁচতে পারে না।’

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মঙ্গলবার সকালে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আন্তর্জাতিক নারী দিবস-২০১৬ এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে এ কথা বলেন।

‘আমরা সরকার পরিচালনা করে বিগত বছরগুলোতে নারীদের ক্ষমতায়নে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নয়ন করেছি এবং তাদের কর্মের সুযোগ সৃষ্টি করেছি। কাজেই নিজের মর্যাদাটা নিজের কর্মের মধ্য দিয়ে এবং আত্মবিশ্বাসের মাধ্যমে নিজেকেই অর্জন করতে হবে,’ বলেও প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন।

ইসলামে নারীর ক্ষমতায়নের গৌরবের ইতিহাস রয়েছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘কাজেই কূপমন্ডুকতার নামে নারীকে পেছনে ঠেলে রাখা চলবে না।’

তিনি এ প্রসঙ্গে বিবি খাদিজা (রা:) দৃষ্টান্ত উল্লেখ করে বলেন, আল্লাহর রাসুল মুহাম্মদ (সা:) এর কাছে প্রথম ইসলাম গ্রহণকারী ও একজন নারী।

তিনি ব্যবসা করতেন এবং ব্যবসার জন্য দেশ বিদেশে ভ্রমন করেছেন,এমনকি রাসুল মুহাম্মদ (সা:) এর সাথে জিহাদের ময়দানেও গিয়েছেন।

জিহাদে নারী শহীদ সুমাইয়ার নাম উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন,কাজেই আমাদের ঘাবড়ালে চলবে না।

নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকির সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন-ইউএন ওমেন ইন বাংলাদেশ’র দেশীয় প্রতিনিধি ক্রিষ্টিন হান্টার।

নারী ও শিশু মন্ত্রণালয়ের সচিব নাসিমা বেগম অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তৃতা করেন।

অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব ড. সুরাইয়া বেগম’সহ মন্ত্রিপরিষদ সদস্যবৃন্দ, সংসদ সদস্যবৃন্দ, সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, দপ্তর এবং অধিদপ্তরের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাগণ, বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত, কূটনৈতিক মিশনের সদস্য, আন্তর্জাতিক সহযোগী সংগঠনের কর্মকর্তাগণ উপস্থিত ছিলেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় তো বটেই, বিশ্বের অনেক উন্নত দেশের থেকেও এগিয়ে আছে। এ প্রসঙ্গে তিনি যুক্তরাষ্টের দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, অনেক পরাশক্তি যারা সারাবিশ্বে মোড়লগিরি করে বেড়ায় তারাও এখন পর্যন্ত কোন নারী সরকার প্রধান নির্বাচন করেনি, এমনটি নারীদের ভোটাধিকারও দেয় অনেক দেরিতে।

নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ পাশ্ববর্তী ভারত-পকিস্তানের চেয়েও এগিয়ে বলে প্রধানমন্ত্রী মন্তব্য করেন।

স্বাধীনতার পরেই সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এদেশে নারীর ক্ষমতায়নের সূচনা করেন উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধু নারী-পুরুষের সমান অধিকারে বিশ্বাস করতেন। জাতীয় জীবনের সকলক্ষেত্রে নারীর সমানাধিকারের বিষয়টি তিনি সংবিধানের ১৯ এবং ২৮ অনুচ্ছেদে নিশ্চিত করেছেন। জাতির পিতা মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিত মা-বোনদের ‘বীরঙ্গনা’ খেতাব এবং রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদান স্বাধীনতা যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত নারীদের পুনর্বাসন ও ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে ১৯৭২ সালে ‘নারী পুনর্বাসন বোর্ড’ গঠন করেছিলেন।

প্রধানমন্ত্রী এ সময় মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিতা মা-বোনদের কথা স্মরণ করে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের পরে মা-বোনেরা বিভিন্ন রোগ অসুখে ভুগছিলো। বিদেশ থেকে ডাক্তার এনে তাদের বঙ্গবন্ধু তাদের চিকিৎসা করান।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমার মা একাত্তরের সে সব নারীদের পরিচর্যা করেছিলেন। তারা সুস্থ হওয়ার পর পরিচয় দিতে চাইতো না। তাদের অনেককেই পরিবারে আর গ্রহণ করা হয়নি। বিয়ের সময় বাবার নামের সমস্যা হতো-‘জাতির পিতা বলেছিলেন, লিখে দাও বাবার নাম শেখ মুজিবুর রহমান। বাড়ি ৩২ নম্বর, ধানমন্ডি।’

সবক্ষেত্রে নারীরা সুচারুভাবে কাজ করে যাচ্ছে। এমনকি ক্ষেত্র বিশেষে তারা পুরুষের চেয়েও এগিয়ে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সবচেয়ে বড়ো বিষয় নারীরা দুর্নীতিতে যুক্ত নেই।’

তিনি বলেন, ইতোমধ্যে আমরা নারীদের উন্নয়নে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছি উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী সরকারি চাকুরীতে মহিলাদের জন্য ১০ শতাংশ কোটা সংরক্ষণ, পুরুষ উদ্যোক্তাদের চেয়ে নারী উদ্যোক্তাদের ৫-৬ শতাংশ কম সুদে ঋণ সুবিধা প্রদান, ল্যাকটেটিং মাদার ও গর্ভবতী মায়েদের জন্য ভাতা চালু, বিধবা ও স্বামী পরিত্যক্তা ভাতা প্রদান,সচিবালয়সহ বিভিন্ন জায়গায় ডে’কেয়ার সেন্টার চালু, স্বামী পরিত্যক্তা, নির্যাতিতা নারীদের জন্য ভাতার ব্যবস্থা, নারীদের জন্য নীতিমালা প্রণয়ন, নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে যৌতুক নিরোধ আইন সংশোধন করে যুগপোযোগী করা, বিভাগীয় পর্যায়ে ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার স্থাপন, নারীদের আইনী সুবিধা প্রদানের উদ্যোগ, পৃথক ডায়বেটিস হাসপাতাল নির্মাণ, হিজড়াদের তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, সারাদেশে ৫ হাজার ২৭৫টি ডিজিটাল সেন্টার চালু করা হয়েছে। সেখানে ব্যবস্থা করা হয়েছে নারীদের কর্মসংস্থানের। উদ্যোক্তা হিসবে একজন পুরুষ এবং একজন নারী রাখার বিধান করা হয়েছে।

শেখ হাসিনা বলেন, চাকরির ক্ষেত্রে নারীদের ১০ শতাংশ কোটা বঙ্গবন্ধু চালু করে গেছেন। নারীদের অবৈতনিক শিক্ষার ব্যবস্থা করে গেছেন। ক্ষমতায় আসার পর আমরা তৃণমূল পর্যায় থেকে স্থানীয় সরকার প্রক্রিয়া শক্তিশালী করার উদ্যোগ নেই। আমাদের উদ্যোগের ফলেই বাংলাদেশে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীর অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।

তিনি বলেন,বর্তমানে বাংলাদেশের সংসদ নেতা, বিরোধীদলীয় নেতা, সংসদের উপনেতা নারী এবং স্পীকারও নারী। এরকম দৃষ্টান্ত পৃথিবীতে নজিরবিহীন।

তিনি বলেন,বর্তমান সংসদে সরাসরি ভোটে নির্বাচিত ২০ জন নারী সংসদ সদস্য রয়েছেন। সংরক্ষিত নারী আসনের সংখ্যা ৩০ থেকে ৫০ জনে উন্নীত করা হয়েছে। তৃণমূল পর্যায়ে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের জন্য স্থানীয় সরকারের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে- যেমন ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা, সিটি কর্পোরেশনে ৩০ শতাংশ আসন নারীর জন্য সংরক্ষিত রাখা হয়েছে। উপজেলা পরিষদে নির্বাচিত মহিলা ভাইস-চেয়ারম্যানের পদ সৃষ্টি, ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত আসনে নির্বাচিত পাঁচ জন নারী সদস্যকে উপজেলা পরিষদে অন্তর্ভুক্তকরণ এবং বিভিন্ন কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে তাদের দায়িত্ব পালনের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে।

এ সময় প্রধানমন্ত্রী তিন বাহিনীতে নারীদের নিয়োগ, বিমানের পাইলট পদে নারীর দায়িত্ব পালন, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে কন্টিজেন্ট প্রধান হিসেবে নারী সদস্যের দায়িত্ব পালনের বিষয়টি উল্লেখ করেন। পাশাপাশি আদালতে নারী জজ, এসপি,ডিসি প্রভৃতি পদে বর্তমান সরকারের নারীদের পদায়ন করাসহ বাংলাদেশের জন্য সাফ গেমস সাঁতার ও ভারোত্তলনে দুই নারীর স্বর্ণ জয়ের প্রসঙ্গও উত্থাপন করেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন,আমরা মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী জাতি। পরমুখাপেক্ষী হয়ে আমরা বাঁচতে চাই না। আমাদের ভাগ্য আমরা নিজেরাই গড়ে তুলব। এজন্য প্রয়োজন নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা।

তিনি বলেন, নারীকে জাতীয় উন্নয়নের মূলধারাতে অন্তর্ভুক্ত করতে পারলেই আমরা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের ‘সোনার বাংলা’ গড়ে তুলতে পারব। বাংলাদেশ হবে বিশ্বের বুকে একটি সমৃদ্ধশালী, শান্তিপূর্ণ দেশ।

তিনি বলেন,আমরা দেশকে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত বাংলাদেশ গঠনের যে কর্মকান্ড বাস্তবায়ন করছি-এ সব কাজে পুরুষের পাশপাশি নারী সমাজও সমানতালে দায়িত্ব পালন করছেন। ধর্মের দোহাই দিয়ে এবং নানা অজুহাত দেখিয়ে নারীদের আর পেছনে ফেলে রাখা যাবে না।

শেখ হাসিনা বলেন,বর্তমান বিশ্বে ৭০ ভাগ মানুষ হচ্ছেন মহিলা ও নারীশিশু। অনেক দেশেই নারীরা পুরুষের সমান কঠিন কাজ ও দূর্যোগপূর্ণ কাজে অংশ নিচ্ছেন,কিন্তু তারা উপযুক্ত মজুরী পান না। আমরা আমাদের নারী সমাজের কাজের মূল্যায়ন করছি এবং প্রকৃত মজুরী প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি।

ছবিঃ সাইফুল ইসলাম কল্লোল

TAGS:

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত