580
Published on ফেব্রুয়ারি 14, 2016তিনি বলেন, ‘যারা বিত্তবান বা সমাজে একটু প্রতিষ্ঠিত তারা নিজ নিজ স্কুলে অন্তত, যে স্কুলে আপনারা লেখাপড়া করেছেন সেখানে একটা মল্টিমিডিয়া ক্লাশ রুম বা রুমের সামগ্রী উপহার দেবেন। সমগ্র জাতীয় মাধ্যমে আপমাদের কাছে আমি অনুরোধ জানাচ্ছি... সরকার করবে তবু নিজেরাও চাইলে অবদান রাখতে পারেন।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ সকালে তাঁর তেজগাঁওস্থ কার্যালয়ে প্রাথমিক শিক্ষা কন্টেন্ট ইন্টার অ্যাকটিভ মাল্টিমিডিয়া ডিজিটাল ভার্সনে রূপান্তর শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় প্রস্তুতকৃত ডিজিটাল শিক্ষা কন্টেন্ট’র উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে এ কথা বলেন। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্ত বিভাগ এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে শুভেচ্ছা বক্তৃতা করেন- প্রাথমিক ও গণশিক্ষা বিষয়ক মন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক, ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারপার্সন স্যার ফজলে হাসান আবেদ, সেভ দ্যা চিলড্রেন’র আঞ্চলিক পরিচালক মাইকেল ম্যাকগ্রা এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব হুমায়ুন খালিদ। স্বাগত বক্তৃতা করেন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সচিব শ্যাম সুন্দর শিকদার।
অনুষ্ঠানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষয়েত্রী ১ম থেকে ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত বিভিন্ন ক্লাশের পাঠ্যসূচি হিসেবে শব্দ, ছবি এবং এনিমেশন সমন্বয়ে তৈরি ডিজিটাল কন্টেন্টের সঙ্গে সকলকে পরিচয় করিয়ে দেন। যার মধ্যে রয়েছে- বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় এবং বাংলাভাষা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের জাতির পিতা, ছড়া, ইংরেজী বিষয়ের ডিজিটাল কন্টেন্ট প্রভৃতি। এছাড়া, ডিজিটাল কন্টেন্ট’র উপর নির্মিত একটি প্রামাণ্য চিত্রও প্রদর্শিত হয়।
অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী ডিজিটাল সিডির মোড়ক উন্মোচন এবং ডিজিটাল কন্টেন্ট সম্বলিত ’ট্যাব’ এ আঙুলের চাপ দিয়ে ডিজিটাল প্রাইমারী শিক্ষার্থীদের জন্য ন্যাশনাল টেক্সট এন্ড কারিকুলাম বোর্ড (এনসিটিবি) সংযোজিত ডিজিটাল কন্টেন্ট শিক্ষা সামগ্রীর উদ্বোধন করেন। প্রধানমন্ত্রী এ সময় সংশ্লিষ্ট ওয়েবসাইটও উদ্বোধন করেন।
প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা, মন্ত্রিপরিষদ সদস্য, সংসদ সদস্যবৃন্দ, মন্ত্রণালয় এবং সরকারের বিভিন্ন দফতরের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা, সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা, বিদেশী কূটনীতিক এবং উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা এবং বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকা ও শিক্ষার্থীবৃন্দ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী তাঁর বক্তৃতায় কোমল মতি শিশুদের ভালো ফলাফলের আশায় পড়ার জন্য চাপ না দিয়ে পড়াশোনার প্রতি তাদের আগ্রহী করে তুলতে পরামর্শ দেন।
তিনি বলেন, ‘পড়াশোনার নামে মা-বাবা তথা অভিভাবকদেরর ভালো ফলাফলের জন্য নিজস্ব প্রতিযোগিতা বন্ধ করতে হবে। ভাল ফলের জন্য শিশু বয়সে চাপ দিলে আপাত ভাল হলেও পড়ে ভাল হয় না।’
তিনি ব্যক্তিগত জীবনের অভিজ্ঞতায় বলেন, ‘আমি বা রেহানা কখনও আমাদের বাচ্চাদের পড়ার জন্য চাপ দেইনি। পড়ার জন্য চাপাচাপি করতে হবে কেন, তারা নিজ আগ্রহেই পড়বে।’
আজকের শিশুদের বিশ্বমানের অভিহিত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের শিশুরা অনেক বেশী মেধাবী। তারা প্রযুত্তিনির্ভর আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত । তাদের কাছ থেকে অনেক কিছুই শেখার আছে।..আমার ছেলের কাছ থেকে থেকে এখনও আমি শিখছি,শিক্ষায় কোন লজ্জা নেই।
আগামী দিনের শিক্ষক বাচ্চাদের কাছ থেকে ভালো শেখা যায়, তাদের কাছে বিশ্ব এখন উন্মুক্ত বলেও মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, ‘আজকের শিশুরাই কিন্তু আগামী দিনের শিক্ষক। কেননা আমাদের শিশুরা অনেক মেধাবী ও মননশীল। তাই তাদের সে সুযোগ করে দিতে প্রযুক্তি ব্যবহার সহজলভ্য করা হচ্ছে।
আনন্দের মাধ্যমে শিশুদের পড়ানোর আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, সবাই যে পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করবে তা কিন্তু নয়। তাই তাদের পড়ার জন্য বেশি চাপ দেয়া যাবে না। খেলা আর আনন্দের ছলে তাদের পড়াতে হবে। এতে পড়ালেখার-পাশাপাশি শিশুর মানসিক মনোবলও বাড়বে।
শিক্ষার্থীদের প্রযুক্তিনির্ভর করে গড়ে তুলতে ডিজিটাল ক্লাস রুম করে দেয়া হচ্ছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ৬৩ হাজার ৬০১টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রত্যেকটিতে অন্তত একটি করে হলেও আমরা মাল্টিমিডিয়া ক্লামরুম করে দেব।
তিনি বলেন, মনে আছে, আগে কম্পিউটার কিনতে অনেক টাকা লাগত। পার্টির জন্য একটা কম্পিউটার কিনেছিলাম, ধার করে ৩ লাখ টাকায়, অ্যাপল কম্পিউটার।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এসব আমরা সহজ করে দিয়েছি। এখন একটা ল্যাপটপ কিনতে বেশি টাকা লাগে না। আমরা সারাদেশে সব কিছু ডিজিটাল করে দিয়েছি। সবকিছু এখন সহজ হয়ে গেছে। তাই আপনারা যারা বিত্তশালী আছেন অন্তত নিজেরা যে বিদ্যালয়ে পড়েছেন সেগুলো সাজিয়ে তুলুন। আপনার স্কুলকে আপনিই দিন।
’৯৬ সালে সরকার গঠনের আগের কথা স্মরণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এখন ১৬ কোটি মানুষ ১৩ কোটি মোবাইল সীম ব্যবহার করে, অনেকে দুই-তিনটাও ব্যবহার করে। আর বিএনপি আমলে এক লাখ ৩০ লাখ টাকা ছিল মোবাইল ফোন। কল করলে বা ধরলেও মিনিটে দশ টাকা কেটে নেয়া হত। মোবাইল অপারেশনকে প্রাইভেট সেক্টরে দিয়ে দেয়ার জন্যই আজ হাতে হাতে মোবাইল ফোন বলে তিনি উল্লেখ করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এখন কৃষকেরা মোবাইলের মাধ্যমে চাষাবাদের তথ্য পাচ্ছে। মোবাইলের মাধ্যমে দেশের যে কোন জায়গা থেকে কেনা কাটা করা যায়। এজন্য আর কাউকে ঢাকা আসার দরকার নেই। কল সেন্টারের মাধ্যমে মানুষ ২ শতাধিক সেবা ঘরে বসেই পাচ্ছে। স্বাস্থ্য সেবাও মোবাইলের মাধ্যমে হচ্ছে।
মোবাইলে এস এম এস আদান-প্রদান ও অপারেটিং দক্ষতাও দেশকে নিরক্ষর মুক্ত করতে ভূমিকা রাখছে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা ক্ষমতায় আসার আগ পর্যন্ত দেশে কোন বৃত্তি দেয়ার ব্যবস্থা ছিল না। ‘আমরা ডিগ্রি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার জন্য বৃত্তির ব্যবস্থা করেছি। ১ কোটি ৩০ লাখ শিক্ষার্থীকে বৃত্তি-উপবৃত্তি প্রদান করা হচ্ছে।
বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাষ্ট করে তিনি এবং তাঁর বোন শেখ রেহানা ব্যক্তিগত উদ্যোগে দরিদ্রদের শিক্ষা কার্যক্রমে পৃষ্টপোষকতার অংশ হিসেবে বৃত্তি প্রদান করে যাচ্ছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রাথমিক থেকে ডিগ্রী পর্যন্ত ১৩ হাজার শিক্ষার্থীকে এই ট্রাস্ট বৃত্তি-উপবৃত্তি প্রদান করছে। সর্বনিম্ন ৫০০ টাকা থেকে ২০০০ টাকা পর্যন্ত এই বৃত্তি নিয়ে অনেক শিক্ষার্থীই পড়াশোনা করছে বলে তিনি জানান।
বর্তমান সরকার প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়নে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৯৬ সালে সরকারের আসার পরই প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নে সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিলেও নানা ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়ে ২০০১ সালে আমাদের ক্ষমতায় আসতে না দেয়ায় সাক্ষরতার হার আমাদের রেখে যাওয়া ৬৫ শতাংশ থেকে ৪৫ শতাংশে নেমে আসে, প্রাথমিকে ঝরে পড়ার হারও বেড়ে যায়। পরবর্তিতে আমাদের বিভিন্ন পদক্ষেপে এখন সাক্ষরতার হার ৭১ শতাংশে এসেছে। আমরা এই হার শতভাগে উন্নীত করতে চাই।
প্রধানমন্ত্রী দেশের উন্নয়নের খন্ডচিত্র তুলে ধরে বলেন, আমাদের প্রবৃদ্ধি এখন ৬ দশমিক ৫৫ ভাগ, বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ ২৭ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে, বাজেটের শতকরা ৯০ ভাগ এখন আমরা বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে ব্যয় করছি, বিএনপি আমলে থাকা দারিদ্র্যের হার প্রায় ৪৮ শতাংশ থেকে আমরা ২২ ভাগে নামিয়ে এনেছি ২০২১ সালের মধ্যে এটাকে আরো অন্তত ১০ ভাগ কমিয়ে আনার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী জাতি, আমরা পরাজিত হব না। এই কথা সব সময় চিন্তায় থাকতে হবে আমরা পারি, আমরা পারবো, আমরা করবো। আমরা পারবই পারবো। শিক্ষার্থীদের এই আত্মবিশ্বাস নিয়ে চলতে হবে।’
তিনি দেশবাসীর উদ্দেশ্যে বলেন, সবাই সেই আত্মবিশ্বাস নিয়ে চলবেন। আমাদের দেশকে আমরা ২০২১ সালে মধ্যম আয়ের দেশে এবং ২০৪১ সালে বাংলাদেশকে উন্নত দেশ হিসেবে গড়ে তুলে বিশ্বে বাংলাদেশের মর্যাদাকে যেন আরো বাড়াতে পারি। এই একটাই লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি।
বক্তৃতার শুরুতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর প্রাথমিক শিক্ষার সম্প্রসারণে বিভিন্ন পদক্ষেপ তুলে ধরেন।
তিনি এ সময় প্রাথমিক শিক্ষায় ডিজিটাল কন্টেন্ট সম্পর্কে বলেন, ‘এটা আমাদের নির্বাচনী ঘোষণা ছিল। অনেকে বিদ্রুপ করতো। তখন বিদ্যুতের সমস্যা ছিল। বিদ্যুৎ চলে গেলেই তারা কেউ কেউ ঠাট্টা তামাশা করতো-ডিজিটাল বিদ্যুৎ গেল।
এখন ডিজিটাল বাংলাদেশ নিয়ে আর কেউ উপহাস করে না।.. ডিজিটাল বাংলাদেশ এখন বাস্তব।’
যারা এক সময় সমালোচনা করতো তারাই এই ডিজিটালের সুফল বেশি করে ভোগ করছে বলেও প্রধানমন্ত্রী মন্তব্য করেন।
ছবিঃ সাইফুল ইসলাম কল্লোল