374
Published on অক্টোবর 13, 2015মঙ্গলবার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে এফবিসিসিআই এ সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ যখনই বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করে সামনে এগিয়ে যেতে চায়, বাংলার মানুষ যখনই মাথা উঁচু করে বাঁচতে চায়, তখনই দেশি-বিদেশী ষড়যন্ত্র মাথাচাড়া দিয়ে উঠে।
তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যে সময় আমাদের কাজকে স্বীকৃতি দিয়ে পুরস্কৃত করছে, ঠিক তখনই দুইজন বিদেশিকে হত্যা করা হল। এগুলো পরিকল্পিত হত্যাকা-।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, মানুষ যেন নিরাপদে থাকতে পারে, স্বাচ্ছন্দে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারে, এটাই তার সরকারের চাওয়া।
তিনি বলেন, আমি সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে বাংলার মাটিতে এসেছি। আমার পাওয়ার আর কিছু নেই। তবে যারা এ দেশের ক্ষতি করতে চায় তাদের কোন ছাড় দেয়া হবে না।
‘বাঙালী জাতিকে দাবায়ে রাখতে পারবা না’ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের এ উদ্বৃতি উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে এ দেশ স্বাধীন হয়েছে। তাই সকল ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে বাংলাদেশ তার মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রেখে মাথা উঁচু করে চলবে।
তিনি বলেন, দেশের উন্নয়নের জন্য তাঁর সরকার এমন কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, যার ফলে বাঙালী জাতি বিশ্বসভায় মাথা উচুঁ করে চলতে পারবে।
১৯৯৬ সালে তাঁর দল আওয়ামী লীগের সরকার গঠনের কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, তখন তাঁর সরকারের প্রথম লক্ষ্য ছিল জনগণের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন, কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা, আইন-শৃংখলার উন্নতিসহ দেশকে স্বাবলম্বি করা। ২০০১ সাল পর্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই দেশ এগিয়ে চলেছে। কিন্তু বিএনপি-জামায়াত জোট ২০০১ সালে ক্ষমতায় আসার পর তাদের নেয়া সব পদক্ষেপ হারিয়ে যায়।
তিনি বলেন, ২০০৯ সালে আবার তাঁর দল সরকার গঠন করে দেশকে উন্নয়নের ধারায় নিয়ে যেতে কাজ করতে থাকে। বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার লক্ষ্য নিয়েই তাঁর সরকার বর্তমানে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। যার সাফল্য সরূপ বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশকে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশের স্বীকৃতি দিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আওয়ামী লীগ মাঠ পর্যায়ের এমন একটি সংগঠন, তারা ক্ষমতার বাইরে থাকলেও দলের নীতিমালা অনুযায়ী বিষয়ভিত্তিক, যেমন-স্বাস্থ্য, বিজ্ঞান, পরিবেশ, কৃষি ইত্যাদি বিষয়ে প্রতিনিয়ত সভা-সেমিনার করে থাকে।
তিনি বলেন, তাই দলটি যখন ক্ষমতায় আসে, তখন ওই সভা-সেমিনার থেকে উঠে আসা মতামতের ভিত্তিতে দেশের কল্যাণের জন্য নানা উদ্যোগ গ্রহণ করে। ১৯৯৬ সালেও সে অনুযায়ী পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা গ্রহণ করে তাঁর সরকার কাজ শুরু করে। কিন্তু বিএনপি ক্ষমতায় এসে ওই পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা বাদ দিয়ে দেয়। এতে দেশের উন্নয়ন বাধাগ্রস্থ হয়।
২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে আবার পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা গ্রহণ করেন উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, এখন তাঁর সরকার দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। দেশের উন্নয়নে ২০২০ সাল পর্যন্ত কি কি করা হবে সে পরিকল্পনা গ্রহণ করেই এখন তাঁর সরকার কাজ করে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনের পরিকল্পনা গ্রহণ করায় সে সময় অনেকেই বিরূপ মন্তব্য করে বলেছিলেন এটা সম্ভব নয়। কিন্তু ২০০৯ সালে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার যে অঙ্গীকার নিয়ে তাঁর সরকার পথ চলা শুরু করেছিল, তার অনেকাংশই আজ পূরণ করতে পেরেছে। প্রত্যন্ত গ্রামে যেখানে এক সময় বিদ্যুৎ সংযোগ পাওয়াই ছিল স্বপ্ন, সেখানকার মানুষেরা আজ ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে দেশে-বিদেশে স্বজনদের সাথে ভিডিও কনফারেন্সিং-এ কথা বলছেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, মোবাইল ব্যাঙ্কিংয়ের মাধ্যমে আমাদের পোশাক শ্রমিক ভাইবোনেরা স্বজনদের কাছে দ্রুততম সময়ে টাকা পাঠাচ্ছেন। সারাদেশের ৫ হাজার ২৭৫টি ডিজিটাল কেন্দ্রের মাধ্যমে সরকার প্রায় ২০০টি সেবা মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়েছে।
তিনি বলেন, ১৬ কোটি মানুষের বাংলাদেশে মোবাইল সিমকার্ডের সংখ্যা প্রায় ১৩ কোটি। ইন্টারনেট ব্যবহারকারির সংখ্যা প্রায় ৫ কোটি ৭ লাখ। ২০১৭ সালের মধ্যে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট স্থাপন সম্পন্ন হবে। মোবাইল-ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে তখন আরও বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে।
বৈশ্বিক উষ্ণায়নে বাংলাদেশের তেমন কোন দায় নেই, তারপরও আমাদেরই সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখিন হতে হচ্ছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্ব আজ হুমকির সম্মুখীন। আমাদের এই ধরিত্রীর অতি উষ্ণায়ন এবং বর্তমান জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য মূলতঃ উন্নত দেশগুলোই দায়ী।
ঝড়, জলোচ্ছাস, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইত্যাদির মোকাবেলা আমাদেরই বেশি করতে হয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, যুগ যুগ ধরে আমাদের দেশের মানুষ প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করেই টিকে আছে। ৯১ সালের ঘূর্ণিঝড় ও ৯৮’র বন্যা থেকে শিক্ষা নিয়ে তাঁর সরকার এমন কিছু প্রশমন ব্যবস্থা গ্রহণ করছে যা বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিরোধে সহায়ক হিসেবে কাজ করছে।
শেখ হাসিনা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় কারো মুখের দিকে তাকিয়ে থাকিনি। সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে ক্লাইমেট চেঞ্জ ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করেছি। বিগত পাঁচ বছরে প্রায় ২ হাজার ৯০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় কিভাবে টিকে থাকতে হবে প্রতিরোধের সে পদক্ষেপ তাঁর সরকার গ্রহণ করেছে। এ জন্য উপকূলীয় অঞ্চলে বনায়নের মাধ্যমে সবুজ বেষ্টনী গড়ে তোলা হয়েছে। যার ফলে ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের সময় এই সবুজ বেষ্টনী প্রতিরোধ হিসেবে কাজ করছে।
পরিবেশ রক্ষায় ব্যবসায়ী এবং শিল্পপতি সম্প্রদায় সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু কন্যা বলেন, আপনারা শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার সময় পরিবেশ সংরক্ষণের বিষয়গুলো যথাযথভাবে পালন করলে সরকারের জন্য কাজটা সহজ হয়ে যায়।
তিনি শিল্প-কারখানার জন্য জমি কেনার সময় কৃষি জমি, জলাধার ও পরিবেশ যাতে নষ্ট না হয়, সেদিকে নজর দেয়ার অনুরোধ জানান।
হাসপাতালসহ বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানের বর্জ্য নদীর পানি দূষণ করছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এর ক্ষতির সম্মুখিন হচ্ছে নতুন প্রজন্ম।
কৃষি সম্পদ নষ্ট করা যাবে না, ব্যবসায়ীদের এ কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, ১৬ কোটি মানুষের খাদ্য এ মাটি থেকেই উৎপাদন করতে হয়। আগে ১২ মাসই সিম, ফুলকপি, লাউসহ নানা সবজি পাওয়া যেত না, এখন পাওয়া যায়। এটা এমনি এমনি হয়নি। এ জন্য আমাদের বিজ্ঞানীদের অনেক গবেষণা করতে হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের কৃষি বিজ্ঞানীরাই বন্যা, খরা এবং লবণাক্ততা সহিষ্ণু বেশ কয়েক প্রকারের ফসলের জাত উদ্ভাবন করতে সক্ষম হয়েছেন। যেগুলো বিরূপ পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে ফলন দিতে সক্ষম। তাই যেখানেই শিল্পায়ন গড়ে তুলবেন, জলাধার, প্রকৃতি ও পরিবেশের কথা মাথায় রেখে কাজ করবেন।
তিনি বলেন, আমাদের দ্রুত সবুজ অর্থনীতির দিকে অগ্রসর হতে হবে। এমনভাবে কলকারখানা নির্মাণ করতে হবে যেখানে ক্ষতিকারক বর্জ্য উৎপন্ন হয়ে পরিবেশ দূষণ করবে না।
এ দু’টো পুরস্কার নিঃসন্দেহে তাঁর এবং দেশবাসীর জন্য গর্বের বিষয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, পুরস্কারপ্রাপ্তি সমন্বিতভাবে টেকসই উন্নয়ন চর্চায় আমাদের দায়িত্বকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। আমাদের এমন কিছু করা চলবে না, যা আমাদের দেশের ক্ষতিসাধন করে। আমাদের নদীনালা, খালবিল, জলাভূমি এবং বাস্তুতন্ত্রকে সুরক্ষা দিতে হবে। আমাদের বনভূমি, জীববৈচিত্র এবং বন্য প্রাণীসম্পদকে ধ্বংস হতে দেয়া যাবে না।
দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার পথ তৈরি করা হয়েছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ভৌগলিক পরিবেশ মাথায় রেখে উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। ভারত, ভুটান, নেপালকে নিয়ে ৪ দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং চীনকে নিয়ে বানিজ্যিক অঞ্চল তৈরি করা হয়েছে।
দেশের মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমাদের কোন অঞ্চলে কোন পণ্য উৎপন্ন হয়, কোন কোন পণ্য বিশ্বে রপ্তানী করা যাবে তাঁর সরকার সে তালিকা তৈরি করে এগিয়ে যাচ্ছে। এতে পণ্য রপ্তানী সহজ হবে। দেশের মানুষের ক্রয় ক্ষমকা বৃদ্ধি পাবে। ব্যবসায়ীরাও লাভবান হবেন।
তাঁর সরকার দারিদ্রের হার হ্রাস করতে পেরেছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী ২০২১ সালের মধ্যে দারিদ্রতা নির্মূল করতে ব্যাসায়ীদের সহযোগিতা কামনা করেন। ব্যবসায়ীরা যাতে স্বাচ্ছন্দে ব্যবসা করতে পারে এ জন্য সরকার বেসরকারী খাতকে গুরুত্ব দিয়ে এ খাত উন্মুক্ত করে দিয়েছে। দেশে সুদের হার বেশি উল্লেখ করে তিনি ব্যবসায়ীদের টাকা নিজ দেশে রাখার প্রতিও গুরুত্বারোপ করেন।
আওয়ামী লীগ ব্যবসা বান্ধব সরকার উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, এ দল ব্যবসা করে না, তবে ব্যবসা করে দেয়ার পরিবেশ তৈরি করে দেয়। বর্তমার সরকার মূদ্রাস্ফীতি ৬এর ঘরে রেখেছে।
তাঁর সরকার যতদিন ক্ষমতায় আছে একটি মানুষও না খেয়ে থাকবে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমি নিস্ব হয়ে বাংলা মাটিতে এসেছি। আমার চাওয়া-পাওয়ার কিছু নেই। বাংলাদেশকে সমৃদ্ধ সোনার বাংলায় গড়ে তোলাই আমার একমাত্র চাওয়া।
২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নত দেশে পরিণত করা হবে এটাই তাঁর লক্ষ্য উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমার দেয়ার কিছু নেই, আছে শুধু ভালবাসা দিয়ে যাব তাই’।
সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ। স্বাগত বক্তৃতা দেন এফবিসিসিআইয়ের সদ্য নির্বাচিত সভাপতি মতলুব আহমেদ। এছাড়া আরো বক্তৃতা করেন সংগঠনটির সদ্য বিদায়ী সভাপতি কাজী আকরাম উদ্দিন আহমেদ, প্রথম সহ-সভাপতি মো: শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন ও সহ-সভাপতি মাহবুবুল আলম।