494
Published on সেপ্টেম্বর 27, 2014প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আসুন আমরা যুদ্ধ প্রত্যাখ্যান করে শান্তির জন্য কাজ করি।’ যুদ্ধ বন্ধে জাতিসংঘ মুখ্য ভূমিকা পালন করতে পারে একথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ লক্ষ্য অর্জনে বাংলাদেশ সবার সঙ্গে কাজ করতে অঙ্গীকারাবদ্ধ।
শেখ হাসিনা আজ জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্য পদ লাভের ৪০ বছর পূর্তি উপলক্ষে এখানে সংস্থাটির প্রধান কার্যালয়ে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে এ আবেদন জানান। জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি-মুন ও সদস্য রাষ্ট্রগুলো অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ ও জাতিসংঘের রয়েছে অভিন্ন লক্ষ্য। বাংলাদেশ তার জনগণের ক্ষমতায়ন ও বিশ্বকে আগামী প্রজন্মের জন্য নিরাপদ করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবে।
প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর আগে ভিশন-২০২১ বাস্তবায়ন এবং দেশকে জ্ঞানভিত্তিক মধ্যম আয়ের অর্থনৈতিক দেশে পরিণত করতে বাংলাদেশের সরকার ও জনগণের নিরলস কর্মপ্রচেষ্টায় জাতিসংঘ ও সদস্য দেশগুলোর সমর্থন সহায়তা কামনা করেন।
অনুষ্ঠানে তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং স্বাধীনতার জন্য ৩০ লাখ শহীদ ও সম্ভ্রম হারানো ২ লাখ নারীর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
১৯৭৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্য পদ প্রাপ্তিকে দেশের পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসেবে অভিহিত করে। শেখ হাসিনা বলেন, ওই সময় আন্তর্জাতিক এই সর্বোচ্চ সংস্থায় বাংলাদেশের অন্তভূক্তি সদ্য স্বাধীন দেশটির জনগণের কাছে অত্যুচ্চ বিজয় হিসেবে পরিগণিত হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী ভারত ও রাশিয়ান ফেডারেশন (তদানিস্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন), এই দুই বন্ধু দেশের সমর্থনের কথা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করে বলেন, এই উভয় দেশ ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে সর্বোতভাবে সহায়তা দিয়েছে এবং জাতিসংঘের ১৩৬তম সদস্য হিসেবে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তিতে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছে।
একই সঙ্গে তিনি ওই দুঃসময়ে যুক্তরাজ্য ও জার্মানীসহ বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ানো ইউরোপের অনেক দেশের কথাও কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করেন।
শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক সিনেটর প্রয়াত এ্যাডওয়ার্ড এম কেনেডি ও মার্কিন জনগণের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে বলেন, সিনেটর কেনেডী বাঙ্গালীদের উপর নৃশংসতা ও গণহত্যার বিরুদ্ধে কেবল মার্কিন সিনেটেই সোচ্চার ছিলেন না, সে সঙ্গে তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশও সফর করেছেন।
তিনি বলেন, জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের এশিয়া ও আফ্রিকার সব নেতৃবৃন্দ ও জনগণ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও স্বাধীনতা পরবর্তী জাতিসংঘ সদস্যপদ লাভে অত্যুষ্ণ সমর্থন দিয়েছে।
১৯৭৪ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধুর প্রথম ভাষণের উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, তখন থেকে জাতির পিতার ওই ভাষণে উল্লেখিত পররাষ্ট্র নীতির রূপরেখার আলোকে জাতিসংঘের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক নির্ধারিত হয়ে আসছে।
শেখ হাসিনা বলেন, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি তাঁর ভাষণে আন্তর্জাতিক সহযোগতিার মাধ্যমে জাতিসংঘ সনদ, শান্তি, সহিষ্ণুতা, গণতন্ত্র, মানবাধিকার, সামাজিক অগ্রগতি, ন্যায়বিচার এবং আইনের শাসন সমুন্নত রাখতে দ্ব্যর্থ অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। এসব আদর্শ জাতিসংঘ ও এর বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে সম্পর্ক নির্ধারণে বাংলাদেশের পরবর্তী সকল নেতৃত্ব ও কূটনৈতিক কর্মকা-ের প্রেরণা হয়ে আছে।
প্রধানমন্ত্রী ১৯৭২ সাল থেকে শান্তি, উন্নয়ন, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের জাতীয় আকাক্সক্ষার সমর্থনে এদেশের জনগণের পাশে দৃঢ়ভাবে দাঁড়ানোর জন্য জাতিসংঘের প্রশংসা করেন।
তিনি বলেন, অনেক আগেই বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্য হওয়ায় স্বাধীনতার পরপরই এদেশের পুনর্গঠনে ইউএনডিপি, ইউনিসেফ, ডব্লিউএফপি, এফএও, ইউএনএফপিএ, ইউএনআরডব্লিউএ ও ইউনেসেফের মতো সংস্থাগুলো এগিয়ে আসে ও সমর্থন দেয়।
এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘের তদানিস্তন মহাসচিব কুর্টওয়াল্ডহেইমের ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ সফর এবং বঙ্গবন্ধু সরকারের প্রতি তার সংহতির কথা স্মরণ করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৭৪ সালে একুশে সূচনা থেকে গত ৪০ বছরে জাতিসংঘের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক শক্তিশালী থেকে শক্তিশালী হয়ে কৌশলগত অংশীদারিত্বের উন্নীত হয়েছে। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা ও শান্তিপ্রতিষ্ঠা, গণতন্ত্র, মানবাধিকার, সাজাজিক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতিসহ বিশেষ করে এমডিজি এবং ২০১৫ উন্নয়ন পরবর্তী এজেন্ডার ক্ষেত্রে এই সম্পর্ক বিকশিত হয়েছে।
শেখ হাসিনা বিশ্ব সংস্থাটিতে বাংলাদেশের অবস্থান সুদৃঢ় করতে জাতিসংঘের পূর্ববর্তী মহাসচিবদের সমর্থনের জন্য তাদেরকে ধন্যবাদ দেয়ার পাশাপাশি বান কি-মুনকে উদার ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, বিগত ৪ দশক থেকে বাংলাদেশ বিশ্ব শান্তি ও উন্নয়নে জাতিসংঘ উদ্যোগের অগ্রভাগে থেকেছে। বিশ্বসংস্থাটির ৪১তম সাধারণ অধিবেশন এবং ২ বার নিরাপত্তা পরিষদে সভাপতিত্ব করেছে। এছাড়া ইউএনডিপি-ইউএনএফপিএ, ইউনিসেফ, ইউনেস্কো, ডাব্লিউএফএ, এফএও, ইউএন উইমেন, মানবাধিকার কাউন্সিল ও আরো অনেক ফোরামসহ ইকোসক-এ ৮ বার এবং গুরুত্বপূর্ণ জাতিসংঘে ফান্ড ও প্রোগ্রামে কয়েকবার দায়িত্ব পালন করেছে।
এ প্রসঙ্গে একজন সদস্য হিসেবে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের ঐতিহাসিক সম্মেলন এবং ২০০০ সালে মিলেনিয়াম সম্মেলনে তাঁর ভাষণ এবং শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিশনের উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে সভাপতির দায়িত্ব পালনের কথা স্মরণ করে শেখ হাসিনা বলেন, সবার প্রতি বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে শত্রুতাা নয়। বঙ্গবন্ধুর প্রবর্তিত এই টেকসই পররাষ্ট্র নীতি এখনো জাতিসংঘে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতির পটভূমি হিসেবে রয়ে গেছে। বঙ্গবন্ধুর এই শান্তিকেন্দ্রিক পররাষ্ট্র নীতি বাংলাদেশকে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কর্মসূচিতে নেতৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত করেছে।
বিশ্ব শান্তির জন্য বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের ১১৯ জন বীর সেনানীর আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বর্তমানে ৪ দেশে জাতিসংঘের ৫৪ মিশনে বাংলাদেশের ১ লাখ ২৮ হাজারেরও বেশি সদস্য নিয়োজিত রয়েছে।
এমডিজি অর্জন ও বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় সাফল্যের জন্য বাংলাদেশকে রোল মডেল সদস্য দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ায় জাতিসংঘ মহাসচিবকে ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘জাতিসংঘে সার্বভৌম ও গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে আমাদের উদীপ্ত সাফল্যগুলোর জন্য আমরা বিনম্র গর্ববোধ করছি।
অনুষ্ঠানে তিনি জাতিসংঘের সঙ্গে বাংলাদেশের আগামী দিনের কর্মকা-ের একটি রোডম্যাপ উপস্থাপন করেন।
শেখ হাসিনা বলেন, ভবিষ্যতেও বাংলাদেশ বিশ্ব শান্তি, নিরাপত্তা ও উন্নয়নের প্রতি দৃঢ়ভাবে অঙ্গীকারাবদ্ধ থাকবে।
এ সঙ্গে বাংলাদেশ সাধারণ নাগরিকদের নিরাপত্তার বিষয় অগ্রাধিকার দিতে জাতিসংঘের নেতৃস্থানীয় শান্তিরক্ষী হিসেবে দায়িত্ব পালন করে যাবে।
তিনি বলেন, যুদ্ধ, সংঘর্ষ ও সশস্ত্র সহিংসতা মোকাবেলায় জাতিসংঘের সক্ষমতা বাড়াতে বাংলাদেশ সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে একযোগে কাজ করবে।
শেখ হাসিনা বলেন, পিস বিল্ডিং কমিশনে বাংলাদেশ জাতি গঠনে অর্জিত অভিজ্ঞতা নিয়ে ভূমিকা রাখবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ পরমাণু, সমুদ্র সীমা, মহাকাশ ও সাইবার নিরাপত্তাসহ জাতিসংঘের নিরস্ত্রীকরণ কর্মসূচিতে দৃঢ়ভাবে অগ্রণী অবস্থানে থাকবে এবং সন্ত্রাসবাদ ও সহিংস চরমপন্থা এবং মানব, মাদক ও বণ্যপ্রাণীর পাচার রোধে বৈশ্বিক লড়াইয়ে সক্রিয়ভাবে ভূমিকা রাখবে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ অংশীদারিত্বমূলক উন্নয়নের জন্য শান্তির সংস্কৃতি ও জনগণের ক্ষমতায়নের পক্ষে প্রচারণা অব্যাহত রাখবে এবং অপরাধীর বিচার মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, যৌন নির্যাতন ও গণহত্যার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ভূমিকা রাখবে।
শেখ হাসিনা বৈশ্বিক মানবাধিকার কর্মসূচিতে মূলনীতি নির্ধারণে গঠনমূলক অবদান রাখতে এবং জাতীয় মানবাধিকার ও সুশাসন জোরদার এবং দুর্নীতি দমনে জাতিসংঘের সঙ্গে কাজ করার দৃঢ়সংকল্প ব্যক্ত করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ নারী নির্যাতন ও বাল্য বিবাহ রোধে বিশেষভাবে নজর দানের মাধ্যমে কন্যা শিশু ও নারীর ক্ষমতায়নে কাজ করে যাবে এবং অটিজমের মতো বিশেষ প্রয়োজন সম্পন্ন জনগোষ্ঠীসহ শিশু অধিকারে নিশ্চিত কর্মকা- আরও জোরদার করবে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ সহ¯্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্র(এমডিজি) অর্জনে তার অসাধারণ সাফল্যের মাধ্যমে দৃপ্ত পদক্ষেপে ২০১৫-উত্তর যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছে।
শেখ হাসিনা বলেন, আমরা আমাদের এমডিজি অর্জন তরান্বিত করব এবং ২০১৫-উত্তর উন্নয়ন কাঠামোর আওতায় কিছু পরিমাপযোগ্য ও অর্জনযোগ্য লক্ষ্য অর্জনে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠায় কাজ করে যাবো।
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা প্রসঙ্গে সোচ্চার কণ্ঠে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এটি আমাদের জাতীয় অগ্রাধিকার। বাংলাদেশ অভিবাসন, স্বল্পোন্নত দেশগুলো (এলডিসি)’র সামুদ্রিক সম্পদ ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের লভ্যাংশের টেকসই ব্যবহারের পক্ষে সোচ্চার হবে।
-বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস)