ভারতের সাথে সমুদ্রসীমার বিতর্কে বাংলাদেশের জয়লাভঃ জলসীমায় ১৯,৪৬৭ বর্গ কি.মি সংযোজন

615

Published on জুলাই 8, 2014
  • Details Image

দীর্ঘ চার বছর নয় মাস আইনি লড়াইয়ের পর এ চূড়ান্ত রায় হাতে পেল বাংলাদেশ। এ রায় আপিলযোগ্য নয়।

সোমবার বাংলাদেশ সময় দুপুর ২টায় দু’দেশের প্রতিনিধিদের হাতে এ রায় হস্তান্তর করেন পিসিএ’র সেক্রেটারি জেনারেল হুগো এইচ সিবলেজ। দু’দেশের পক্ষে এ রায়ের কপি গ্রহণ করেন নেদারল্যান্ডসে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত শেখ মোহাম্মদ বেলাল ও ভারতের রাষ্ট্রদূত রাজেশ নন্দন প্রসাদ।

সমুদ্রসীমা নিয়ে ভারতের সঙ্গে বিরোধের প্রধান বিষয় হলো দুই দেশের জলসীমা শুরুর স্থান নির্ধারণ। এছাড়া ভূমিরেখার মূলবিন্দু থেকে সমুদ্রে রেখা টানার পদ্ধতি নিয়েও মতবিরোধ দেখা দেয়। ভূমির মূল বিন্দু থেকে সমুদ্রের দিকে ১৮০ ডিগ্রির সোজা রেখা দাবি করে বাংলাদেশ। তবে ভারতের যুক্তি ছিল সমুদ্রতট বিবেচনায় এ রেখা হবে ১৬২ ডিগ্রি। সালিশি আদালতের রায়ে ভূমির মূল বিন্দু থেকে সমুদ্রের দিকে ১৭৭.৩ ডিগ্রি রেখা টানা হয়েছে। যা বাংলাদেশের দাবির খুব কাছাকাছি।

বিরোধ নিষ্পত্তির আগে বাংলাদেশ অংশের ১০টি তেল-গ্যাস ব্লক নিজেদের বলে দাবি ছিলো ভারতের। তবে রায়ের মধ্য দিয়ে এ দশটি ব্লকই বাংলাদেশ পেয়েছে। তবে ১০ ব্লকের ০১,০৫, ০৯, ১৪, ১৯ এবং ২৪ নম্বর ব্লকের অংশ বিশেষ পেয়েছে ভারত। এ রায়ের মাধ্যমে ২০০ নটিক্যাল মাইল একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং উপকূল থেকে ৩৫৪ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত মহীসোপানের তলদেশে অবস্থিত সব ধরনের প্রাণিজ ও খণিজ সম্পদের উপর সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্টা হয়েছে বাংলাদেশের।

দু’দেশের সমুদ্রসীমার বিষয়ে ভারতের যুক্তি ছিল সমদূরত্বের (ইকুইডিসট্যান্স) ভিত্তিতে রেখা টানতে হবে। বাংলাদেশ এর বিরোধিতা করে ইকুইটি বা ন্যায্যতার ভিত্তিতে রেখা টানার পক্ষে অবস্থান নেয়। এর পাশাপাশি জ্যামিতিক ‘অ্যাঙ্গেল বাই সেক্টর’ পদ্ধতিতে দাবি জানায় বাংলাদেশ।

আদালত তার নিজস্ব বিবেচনায় সমতার ভিত্তিতে এ রায় দেন। যেখানে দেখা যায়, বাংলাদেশের সিংহভাগ দাবিই পূরণ হয়েছে। আদালতের এই সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিক আইনে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। কারণ, এ ধরনের সাহসী সিদ্ধান্ত আজ পর্যন্ত কোন আদালত দেননি।

পিসিএ’র বিচারক ছিলেন পাঁচজন। এদের মধ্যে আদালতের প্রধান জার্মানির প্রফেসর ড. রুডিগার উলফ্রাম। অন্যরা হলেন, ফ্রান্সের জ্যাঁ-পিয়েরে কট, ঘানার থমাস এ ম্যানসা, ভারতের ড. প্রেমারাজ শ্রীনিবাস রাও, অস্ট্রেলিয়ার প্রফেসর আইভান শীয়ারার। প্রথা অনুযায়ী বাংলাদেশ ও ভারত একজন করে বিচারক মনোনীত করে থাকে। বাংলাদেশের মনোনীত বিচারক ছিলেন, ঘানার থমাস এ ম্যানসা।

মঙ্গলবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ রায়ের ফলাফল আনুষ্ঠানিককভাবে ঘোষণা করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলী। আরো উপস্থিত ছিলেন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্র সচিব মুস্তাফা কামাল, মেরিটাইম বিষয়ক সচিব রিয়ার অ্যাডমিরাল (অব.) খুরশিদ আলম ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, রায়ের ফলে বাংলাদেশ শেষ পর্যন্ত ১,১৮,৮১৩ বর্গ কিলোমিটারের বেশী টেরিটোরিয়াল সমুদ্র, ২০০ নটিক্যাল মাইল একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং চট্রগ্রাম উপকূল থেকে ৩৫৪ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত মহীসোপানের তলদেশে অবস্থিত সকল ধরনের প্রাণিজ ও অপ্রাণিজ সম্পদের উপর সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। ন্যায্যতা নিশ্চিত করার জন্য ট্রাইব্যুনাল বিরোধপূর্ণ আনুমানিক ২৫,৬০২ বর্গ কিলোমিটার সমুদ্র এলাকার মধ্যে ১৯,৪৬৭ বর্গ কিলোমিটার সমুদ্র এলাকা বাংলাদেশকে প্রদান করেছে।

তিনি বলেন, এই রায়ের স্বচ্ছতা ও আইনগত নিশ্চয়তার ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশের জনগণ গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্র সম্পদ ব্যবহার করে লাভবান হবে এবং দীর্ঘমেয়াদী টেকসই উন্নয়নের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে। বাংলাদেশে সমুদ্র ও সমুদ্র সম্পদের ব্যবহারে সচেতনতা বৃদ্ধি, এই সম্পদসমূহ ব্যবহারের ক্ষেত্রসমূহে সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে জনগণের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে কল্যাণমুখী পরিবর্তন আনার লক্ষ্যে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আগামী ১-২ সেপ্টেম্বর ২০১৪ তারিখে ব্লু-ইকোনমি শীর্ষক একটি আন্তর্জাতিক কর্মশালার আয়োজন করতে যাচ্ছে।

প্রতিবেশী দুইটি দেশের মধ্যে সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তির আলোচনা শুরু হওয়ার প্রায় আড়াই দশক দুই দেশের মধ্যে এ আলোচনা থেমে থাকে। দীর্ঘ বিরতিতে সমুদ্রসীমা বিরোধের আলোচনা শুরু হয় ২০০৮ সালের শুরুতে। কিন্তু আলোচনার পরেও অগ্রগতি না হওয়ায় সালিসি আদালতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ। ২০০৯ সালের ৮ অক্টোবর ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তিতে সালিসি আদালতে আবেদন করে বাংলাদেশ।

প্রতিবেশী দু’টি দেশের মধ্যে সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তির আলোচনা শুরু হয় ১৯৭৪ সালে। এর পর প্রায় আড়াই দশক দু’দেশের মধ্যে এ আলোচনা থেমে থাকে। দীর্ঘ বিরতিতে সমুদ্রসীমা বিরোধের আলোচনা শুরু হয় ২০০৮ সালের শুরুতে। কিন্তু আলোচনার পরেও অগ্রগতি না হওয়ায় সালিশি আদালতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ। বলা চলে, ভারতের অগোচরেই তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনির নির্দেশনায় মামলা করা হয়। ২০০৯ সালের ৮ অক্টোবর ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তিতে সালিশি আদালতে আবেদন করে বাংলাদেশ। ডা. দীপু মনিই এ মামলার বাদী।

বাংলাদেশের পক্ষে মামলায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সমুদ্রবিষয়ক ইউনিটের সচিব রিয়ার অ্যাডমিরাল (অব.) মো. খুরশেদ আলম ডেপুটি এজেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশের পক্ষে কৌঁসুলি হিসেবে ছিলেন লন্ডনের ম্যাট্রিক্স চেম্বার্সের প্রফেসর জেমস ক্রোফোর্ড এসসি, প্রফেসর ফিলিপ স্যান্ডস কিউসি, এসেক্স কোর্ট চেম্বার্সের প্রফেসর অ্যালান বয়েল, মন্ট্রিয়লের ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটির প্রফেসর পায়াম আকাভান, ওয়াশিংটন ডিসির ফলি হগ এলএলপির পল এস রিখলার ও লরেন্স মার্টিন।

অন্যদিকে মামলায় ভারতের পক্ষে এজেন্ট ছিলেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিবও আইনি উপদেষ্টা ড. নিরু চাধা এবং কো-এজেন্ট ছিলেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা। ভারতের কৌঁসুলিদলে ছিলেন আর কে পি শংকরদাশ, প্যারিস ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি নানতেরে-লা ডিফেন্সের প্রফেসর অ্যালিয়ান প্যালেট, লন্ডনের স্যার মাইকেল উড, ইয়েল ল স্কুলের প্রফেসর ডাব্লিউ মিশেল রেইসম্যান।

-বাংলানিউজ২৪.কম

TAGS:

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত