বিভেদ ভুলে সম্মিলিতভাবে শান্তি উন্নয়ন গণতন্ত্র, সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাওয়ার আহ্বান শেখ হাসিনার

718

Published on জানুয়ারি 3, 2014
  • Details Image


দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে আজ সন্ধ্যা ৭টায় জাতির উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশন ভাষণে তিনি বলেন, ‘আসুন, আমরা বিভেদ ভুলে সম্মিলিতভাবে শান্তি উন্নয়ন গণতন্ত্র ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাই। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তুলি। দেশ গড়ার এই সংগ্রামে জনগণের জয়- বাংলাদেশের জয় অনিবার্য।’
আগামী ৫ জানুয়ারি এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
জাতির উদ্দেশে দেয়া প্রায় ৩২ মিনিটের ভাষণে শেখ হাসিনা বলেন, ‘অতীতের মতো এবারও আমরা দেশবাসীর অকুণ্ঠ সমর্থন চাই। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু এবং ‘হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দী’র প্রতীক, স্বাধীনতা ও মুক্তির প্রতীক নৌকা। সেই নৌকা মার্কায় ভোট চাই।’
ভাষণে তাঁর সরকারের গত ৫ বছরের অভূতপূর্ভ উন্নয়ন কর্মকান্ডের সংক্ষিপ্ত বিবরণ তুলে ধরেন শেখ হাসিনা বলেন, ‘আপনাদের ভোটের মাধ্যমে সরকার গঠন করলে ইনশাল¬াহ ২০২১ সালের মধ্যে আমরা বাংলাদেশকে একটি মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত দেশে পরিণত করতে সক্ষম হবো।’
তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, গত পাঁচ বছরে অনুষ্ঠিত ৫,৮০৩ টি স্থানীয় সরকার ও উপ-নির্বাচনে আপনারা যেভাবে ভীতিমুক্ত পরিবেশে ভোট দিয়েছেন তেমনিভাবে আগামী ৫ জানুয়ারি একটি উৎসবমুখর পরিবেশে আপনারা ভোট দেবেন। পছন্দের জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করে গণতন্ত্রকে দৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করবেন।
প্রধানমন্ত্রী দৃঢ় আস্থা প্রকাশ করেন যে, এই নির্বচনের মাধ্যমে সমাজ থেকে হিংসা, হানাহানি ও সংঘাতের চির অবসান হবে। দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়নের ধারা থেকে বাংলাদেশ বেরিয়ে আসবে। গড়ে ওঠবে একটি সহিষ্ণু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা।
এ উপলক্ষে তিনি কষ্টসহিষ্ণু, সাহসী এবং প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা যুব সমাজকে বিশেষ ভাবে অভিনন্দন ও শুভাশিস জানিয়ে বলেন, ‘বিশেষ করে এবারের নির্বাচনে যে তরুণেরা প্রথমবারের মতো ভোট দিতে যাচ্ছে তাদের জন্য আমার শুভ কামনা। তরুণ ভোটাররা, তোমাদের উজ্জল ভবিষ্যতের জন্য আমরা আমাদের বর্তমানকে উৎসর্গ করছি।’
২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী অঙ্গীকার উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, সে সময় জাতিকে দেয়া সকল প্রতিশ্র“তি বাস্তবায়নের মাধ্যমে বর্তমান সরকার তার সততা ও বিশ্বাসযোগ্যতা প্রমাণ করেছে।
তিনি বলেন, জনগণের নিরঙ্কুশ সমর্থন ও সহযোগিতার ফলে গত পাঁচ বছরে এ সাফল্য অর্জন করা সম্ভব হয়েছে। জাতি গঠনে নতুন প্রজন্ম স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ এবং জনগণ নিরলস পরিশ্রম করেছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আপনারা প্রমাণ করেছেন ত্যাগ ও নিষ্ঠা ছাড়া মহৎ কিছু অর্জন করা সম্ভব নয়। আমরা পরিপূর্ণ আস্থার সঙ্গে বলতে চাই, বাংলাদেশ অতীতের অন্ধকার পেছনে ফেলে এখন আলোকিত ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আমরা এখন আলোকিত পথের যাত্রী।’
জনগণের ক্ষমতায়নকে গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত হিসেবে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, নিজেদের পছন্দের সরকার গঠনের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। তিনি আরো বলেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর জনগণের এই অধিকার হরণ করা হয়েছিল। কারচুপি, জবরদখল, অর্থ ও পেশীশক্তির অপব্যবহারে গত ৩৮ বছরে বিভিন্ন সময় নির্বাচন ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে।
শেখ হাসিনা বলেন, অসাংবিধানিকভাবে ক্ষমতা দখল আর জনগণের অধিকার নিয়ে ছিনিমিনি খেলার এই অসুস্থ ধারা চিরতরে বন্ধ করতে জাতীয় সংসদ বিশ্বের অন্যান্য সংসদীয় গণতান্ত্রিক দেশের মতোই একটি স্থায়ী নির্বাচনী ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। তিনি বলেন, একটি স্বাধীন ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশনের অধীনেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, কোন অনির্বাচিত ব্যক্তির অধীনে নয়।
নির্বাচনে বিএনপিকে আনতে সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টার কথা উল্লেখ করে আওয়ামী লীগ প্রধান বলেন, ‘আপনারা দেখেছেন, আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করেছি বিএনপিকে নির্বাচনে আনার জন্য। ২০১০ সাল থেকেই বার বার আমি আলোচনার মাধ্যমে একটি শান্তিপূর্ণ সমঝোতার পথে এগিয়ে আসতে বিএনপি নেত্রীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছি। নির্বাচনকালীন সর্বদলীয় সরকারে স্বরাষ্ট্রসহ যে কোন মন্ত্রণালয় দিতে আমি প্রস্তুত ছিলাম। আমি নিজে বিরোধীদলীয় নেত্রীকে টেলিফোন করে সংলাপের আহ্বান জানিয়েছি। তিনি সংলাপের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করে সংঘাতের পথ বেছে নিয়েছেন। বার বার আমাকে আল্টিমেটাম দিয়েছেন।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আপনাদেও ভোটে নির্বাচিত সরকার তার অঙ্গীকার পালন করেছে। কোন কোন ক্ষেত্রে আমরা আপনাদের কাছে দেয়া ওয়াদার চাইতেও বেশি কাজ করেছি।’
তিনি বলেন, আমরা ২০১৩ সালে ১০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা অর্জন করেছি । ইন্টারনেট সুবিধা গ্রাম পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছি। ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে পাঁচ বছরে ১২১ কোটি ৩৮ লাখ ৭১ হাজার ১৭২টি পাঠ্যবই বিনামূল্যে বিতরণ করেছি।
প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন, দেশে মাথাপিছু আয় এখন ১০৪৪ ডলার। দারিদ্র্যের হার ৪১ দশমিক ৫ থেকে কমে ২৬ শতাংশের নিচে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বাড়িয়েছি ৬০ থেকে ৭০ ভাগ। ২০ শতাংশ মহার্ঘভাতা দেয়া হয়েছে। শ্রমিকদের ন্যূনতম বেতন ৪১৭৫ টাকা করেছি। গার্মেন্টস শ্রমিকদের ন্যূনতম বেতন ৫৩০০ টাকায় বৃদ্ধি করা হয়েছে।
তিনি আরো উল্লেখ করেন, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অবসর গ্রহণের বয়স ৫৯ বছর করা হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের ৬০ বছর। রাষ্ট্র এবং সরকারের বিভিন্ন স্তরে প্রশাসন, সশস্ত্রবাহিনী, পুলিশ, আনসার, বিজিবি, শিক্ষক, প্রকৌশলী, নার্সসহ সকলের নতুন করে পদবিন্যাস ও পদমর্যাদা বৃদ্ধি করা হয়েছে। মাতৃত্বকালীন ছুটি চার মাস থেকে বাড়িয়ে ছয় মাসে উন্নীত করা হয়েছে। পাঁচ বছরে ১ কোটি মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমরা বিদেশে ২৫ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান এবং প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৬ লাখ কৃষককে বিনামূল্যে সার দেয়া হয়েছে। আমরা কৃষকদের জন্য দশ টাকায় ব্যাংক হিসাব খোলার ব্যবস্থা করেছি এবং ১৬ হাজার ২৯৯টি কমিউনিটি ক্লিনিক, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র স্থাপন করেছি। দেশে এখন মানুষের গড় আয়ু ৬৯ বছর। মাতৃমৃত্যু হার ও শিশু মৃত্যু হার আমরা কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছি। আমরা খাদ্যে ভেজাল প্রতিরোধে আইন করে তার কঠোর প্রয়োগ করেছি।
তিনি বলেন, আমরা ইতোমধ্যে সাক্ষরতার হার ৭১ ভাগে উন্নীত করেছি, ২৬ হাজার ২০০ প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করেছি। ১ লাখ ২০ হাজার শিক্ষকের চাকরি জাতীয়করণ ও ৫৬ হাজার শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। আমাদের সরকার ৬টি নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছে। প্রাথমিক স্তরে ৭৮ লাখ ৭০ হাজার ১২৯ জন ছাত্র-ছাত্রী উপবৃত্তি, মাধ্যমিক স্তরে ৪০ লাখ ছাত্র-ছাত্রী উপবৃত্তি পাচ্ছে। ডিগ্রি পর্যন্ত ১ লাখ ৩৩ হাজার ছাত্র-ছাত্রীকে বৃত্তি প্রদান করা হচ্ছে।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি ওয়াদা করেছিলাম ডিজিটাল বাংলাদেশ মানুষকে উপহার দিবো। এ লক্ষ্যে ৪ হাজার ৫১৬টি ইউনিয়ন তথ্য ও সেবাকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। সব জেলায় ই-সার্ভিস সেন্টার চালু হয়েছে। মোবাইল ব্যাংকিং, মোবাইল স্বাস্থ্যসেবা, ই-কমার্স চালু করেছি। মোবাইল ফোনে থ্রী-জি সেবা চালু করেছি। ৩ কোটি ৮৬ লাখ মানুষ এখন ইন্টারনেট ব্যবহার করছে। এখন দেশে ১১ কোটি মোবাইল সীম ব্যবহার করা হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আন্তর্জাতিক সমুদ্র ট্রাইব্যুনালে জিতে আমরা সমুদ্র জয় করেছি। ব্রিজ-কালভার্ট-সড়ক-মহাসড়কসহ যোগাযোগ অবকাঠামোতে ব্যাপক উন্নয়ন সাধন করেছি। শেখ হাসিনা বলেন, নির্বাচনী অঙ্গীকার অনুযায়ী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হয়েছে। ১০ জন যুদ্ধাপরাধীর বিচার সম্পন্ন হয়েছে। বিচারের রায়ও আল্লাহর রহমতে কার্যকর করা হচ্ছে।
জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আপনাদের সহযোগিতা, সমর্থন ও দোয়ায় এ দেশকে আমরা রাজনৈতিক-সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে একটি সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছি।’
তিনি বলেন, আমাদের দলের সাধারণ সম্পাদক বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের সাথে কয়েক দফা বৈঠক করেছেন। আমরা আশা করেছিলাম, জনগণের ওপর আস্থা রেখে প্রধান বিরোধীদল নির্বাচনে অংশ নিবে। কিন্তু আমাদের আন্তরিক চেষ্টা সত্ত্বেও বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে নাই।
শেখ হাসিনা বলেন, শুধু তাই নয়, তারা হরতাল ও অবরোধের নামে মানুষকে জিম্মি করে সন্ত্রাস ও নাশকতা সৃষ্টি করেছে। বায়তুল মোকাররম মসজিদে আগুন দিয়েছে; পবিত্র কোরআন শরীফ পুড়িয়েছে; মলোটভ ককটেল আর পেট্রোল বোমা দিয়ে পুড়িয়ে সাধারণ মানুষকে হত্যা করেছে। পুলিশ, বিজিবিসহ অনেককে হত্যার শিকার হতে হয়েছে। আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী ও সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরে তারা হামলা ও লুটতরাজ করেছে। রাস্তা কেটে, রেল লাইন উপড়ে ফেলে, গাছ কেটে জনগণকে ভোটের অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে তারা চেষ্টা করেছে।
তিনি বলেন, ‘একটি নির্বাচিত সরকার হিসেবে আমরা গণতন্ত্র সমুন্নত রাখার শপথ নিয়েছিলাম। তাই, সাংবিধানিকভাবেই আগামী ৫ জানুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।’
শেখ হাসিনা বলেন, আওয়ামী লীগের লক্ষ্য হচ্ছে জনগণের আর্থ-সামাজিক মুক্তি এবং ক্ষুধা, দারিদ্র ও নিরক্ষরতামুক্ত উন্নত-সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়ে তোলা। সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখেই গত নির্বাচনের আগে আমরা রূপকল্প-২০২১ ঘোষণা করেছিলাম। তারই ধারাবাহিকতায় আমরা নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করেছি। একটি দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন কৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে আমরা দেশকে অভিষ্ট গন্তব্যে নিয়ে যেতে চাই।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করা যেখানে মাথাপ্রতি গড় আয় বর্তমানের ১ হাজার ৪৪ ডলার থেকে বেড়ে ১ হাজার ৫শ’ ডলারে উন্নীত করা হবে। প্রবৃদ্ধির হার ৬.২ শতাংশ থেকে বেড়ে ১০ শতাংশ এবং দারিদ্র্যের হার বর্তমান ২৬ শতাংশ থেকে ১৩ শতাংশে নামিয়ে আনা হবে।
সমৃদ্ধি অর্জনের পথে নতুন পরিকল্পনার উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা এবার অগ্রাধিকার দিতে চাই সুশাসন প্রতিষ্ঠা, গণতন্ত্রায়ন ও ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের বিষয়ে। আমরা চাই, জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস ও সাম্প্রদায়িকতা দূর করে রাষ্ট্র ও সমাজ জীবনে শান্তি, শৃঙ্খলা ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা করতে। নাগরিকদের জীবনের নিরাপত্তা বিধান ও তাদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে।’
তিনি আরো বলেন, সুশাসন নিশ্চিত করতে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর সুপ্রতিষ্ঠিত করাই আমাদের লক্ষ্য। সংসদের ভেতরে এবং বাইরে সংসদ সদস্যদের সামষ্টিক ও ব্যক্তিগত কর্মকাণ্ডের জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতা এবং দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা হবে।
শেখ হাসিনা বলেন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও মর্যাদা সমুন্নত রাখা হবে। আইনের সমান প্রয়োগ, আইনের শাসন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা কার্যক্রম জোরদার করা হবে।
গণমুখী উন্নয়ন পরিকল্পনা সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী বলেন, রাষ্ট্র পরিচালনায় জনগণের অধিকতর অংশগ্রহণের লক্ষ্যে ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ করা হবে। জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ এবং ইউনিয়ন পরিষদের কাছে আরো বেশি ক্ষমতা ও দায়িত্ব দেয়া হবে। বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মসূচি স্থানীয় সরকারের হাতে ন্যস্ত করা হবে। প্রশাসনিক সংস্কার এবং সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দক্ষতা ও সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর প্রক্রিয়া চলমান থাকবে। আমাদের সরকার ই-গভর্নেন্স চালু করেছে যা আগামীতে প্রশাসনের সর্বস্তরে সম্প্রসারিত করবো।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, দুর্নীতি দমন কমিশনের ক্ষমতা, দক্ষতা ও কার্যকারিতা আরও বাড়ানো হবে।
আমাদের সরকার আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে শক্তিশালী করেছে। আধুনিক সাজ-রঞ্জামে সজ্জিত করা হয়েছে। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে তা আরও উন্নত করা হবে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি, আবাসন, শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে।
জনগণের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন করা হবে। খাদ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য জনগণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখা হবে।
অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে পরিকল্পনা সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী বলেন, শিল্পায়নের জন্য দেশি-বিদেশি এবং প্রবাসীদের বিনিয়োগে আকৃষ্ট করা হবে। অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা আমরা বৃদ্ধি করবো। প্রশাসনিক জটিলতা ও দীর্ঘসূত্রিতা নিরসন করা হবে। বাজার সম্প্রসারণ ও রফতানি বৃদ্ধির পদক্ষেপ নেয়া হবে।
দেশের সাত বিভাগে বিশেষ অর্থনৈতিক এলাকা ও শিল্পাঞ্চল প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং ইপিজেডগুলোতে শিল্পায়নের সুযোগ আরো বৃদ্ধি করা হবে। খাদ্য ও কৃষি প্রক্রিয়াজাত, পোশাক ও টেক্সটাইল খাতকে আরো শক্তিশালী ও নিরাপদ করা হবে। ক্ষুদ্র, মাঝারি ও কুটির শিল্পের জন্য স্বল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা এবং নারী উদ্যোক্তাদের বিশেষ ঋণের ব্যবস্থা দেয়া হবে।
জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধানের বিষয়ে তিনি বলেন, আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে বাংলাদেশের ঘরে ঘরে আমরা বিদ্যুৎ পৌছে দেবো। ২০১৬ সাল নাগাদ বিদ্যুৎ উৎপাদন ১৬ হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত হবে। ২০২১ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ২৪ হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত করা হয়েছে। সৌরবিদ্যুতের ব্যবহার আরো সহজলভ্য করা হবে।
রামপালে ১৩০০ মেগাওয়াটের কয়লাভিত্তিক কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র ও রূপপুরে ২০০০ মেগাওয়াটের পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নির্মাণকাজ নির্ধারিত সময়ে সম্পন্ন করবো। শেখ হাসিনা বলেন, গ্যাসের উত্তোলন ও ব্যবহার নিশ্চিত করা হবে। জাতীয় স্বার্থ সমুন্নত রেখে উপকূল ও গভীর সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনে অন্যান্য দেশ ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সহযোগিতার প্রচেষ্টা বৃদ্ধি করা হবে। দেশের উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোয় গ্যাস সরবরাহ করা হবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, দারিদ্র্যের লজ্জা ঘুচিয়ে একটি মানবিক সমাজ নির্মাণে জাতিসংঘের সহস্রাব্দ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাংলাদেশের সাফল্য আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত।
তিনি বলেন, গ্রামীণ হত-দরিদ্রদের জন্য নেয়া টেকসই নিরাপত্তা বেষ্টনি আমরা আরো জোরদার করবো। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অতি দরিদ্র ও দুস্থদের জন্য বিনামূল্যে খাদ্য বিতরণ, কাজের বিনিময়ে খাদ্য ও টেস্ট রিলিফ, বয়স্ক, প্রতিবন্ধী, বিধবা, স্বামী পরিত্যক্ত ও দুস্থ মহিলা ভাতা কর্মসূচিগুলো আমরা অব্যাহত রাখবো। '
শেখ হাসিনা বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের নেয়া একটি বাড়ি একটি খামার, আশ্রায়ণ, গৃহায়ন, আদর্শ গ্রাম, গুচ্ছ গ্রাম, ঘরে ফেরা কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে। পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক স্থাপনের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা হবে।
তিনি বলেন, নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য আমরা পেনশন স্কিম চালু করবো। জ্যেষ্ঠ নাগরিকদের জন্য সরকারি মালিকানাধীন পরিবহন, হাসপাতাল ও সেবায় বিশেষ ছাড় ও সুবিধা দেয়ার কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হবে।
মানবসম্পদ উন্নয়নের জন্য বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষা ব্যবস্থা ঢেলে সাজানো হবে। ‘ন্যাশনাল সার্ভিস’ কর্মসূচিকে পর্যায়ক্রমে সকল জেলায় সম্প্রসারিত করা হবে।
প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন, আওয়ামী লীগ সরকারই বাংলাদেশকে খাদ্য ঘাটতির দেশ থেকে উদ্বৃত্ত খাদ্যের দেশে পরিণত করেছে। সেই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশকে খাদ্য রফতানিকারক দেশে পরিণত করতে সার, বীজ, সেচসহ কৃষি উপকরণে ভর্তুকি প্রদান, কৃষিঋণ সরবরাহ এবং কৃষি ব্যাংকের মাধ্যমে বর্গাচাষীদের বিনা জামানতে কৃষিঋণ প্রদান অব্যাহত থাকবে। কৃষি পণ্যের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করা হবে।
তিনি বলেন, কৃষি গবেষণাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হবে। পাটের মতো অন্যান্য ফসলের জীবনরহস্য আবিষ্কারের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বিজ্ঞানসম্মত ভূমি ব্যবস্থাপনা নীতি গ্রহণ করা হবে। আগামী পাঁচ বছরে জমির রেকর্ড ডিজিটালাইজড ও পর্যায়ক্রমে হালনাগাদ করা হবে। জমির যুক্তিসঙ্গত ব্যবহার এবং প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষা করতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা হবে।
গ্রামাঞ্চলে কর্মসৃজন ও নাগরিক সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করে গ্রাম থেকে শহরে অভিবাসনের হার কমানো হবে। উপজেলা সদর ও শিল্প কেন্দ্রগুলোকে আধুনিক শহর ও উপশহর হিসেবে গড়ে তোলা হবে।
শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দিয়ে তিনি বলেন, শিক্ষানীতির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন আমরা করবো। প্রাথমিক শিক্ষার স্তর পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণিতে উন্নীত করা হবে এবং অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক করা হবে। প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট ফান্ড থেকে স্নাতক পর্যন্ত বৃত্তি প্রদান কার্যক্রম শুরু হয়েছে। বৃত্তি ও উপবৃত্তি প্রদান অব্যাহত থাকবে। নারী শিক্ষার প্রসার ঘটানো হবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ লক্ষ্যে তথ্যপ্রযুক্তি ও মাল্টিমিডিয়ার ব্যবহার সম্প্রসারিত করা হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা আরো বৃদ্ধি করা হবে। শিক্ষকদের জন্য পৃথক বেতন কমিশন গঠন করা হবে। স্কুল হতে ঝরে পড়া রোধের জন্য বিশেষ পদক্ষেপ আমরা নেবো।
তিনি আরো উল্লেখ করেন, প্রত্যেক উপজেলায় টেকনিক্যাল স্কুল প্রতিষ্ঠা ও ভোকেশনাল ট্রেনিং কোর্স চালু করা হবে। প্রত্যেক উপজেলায় একটি করে মডেল বিদ্যালয় স্থাপন করা হবে। মাদ্রাসা শিক্ষাকে যুগোপযোগী করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। প্রতিজেলায় একটি করে সরকারি স্কুল ও কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হবে।
প্রতি জেলায় একটি করে সরকারি অথবা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হবে। শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস, দলীয়করণ ও সেশনজট দূর করতে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রযুক্তি ও বৈজ্ঞানিক গবেষণায় রাষ্ট্র ও সরকার উৎসাহ যোগাবে। বিজ্ঞানী ও গবেষকদের বিশেষ মর্যাদা দান, চাকরির বয়সসীমা এবং সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও প্রণোদনা এমন পর্যায়ে আনা হবে যাতে তারা সাফল্যের সাথে গবেষণা শেষ করতে পারেন।
প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে আইটি শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হবে। দেশের বিভিন্ন স্থানে হাইটেক পার্ক, সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক, আইসিটি ইনকুবেটর এবং কম্পিউটার ভিলেজ স্থাপনের কাজ দ্রুত সম্পন্ন করা হবে। আউট সোর্সিং ও সফটওয়্যার রফতানিতে সহায়তা প্রদান অব্যাহত থাকবে।
যুগের চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, দেশজুড়ে দ্রুতগতির ইন্টারনেট সেবা এবং থ্রি-জি চালু হয়েছে। ফোর-জি ব্যবস্থাও চালু করা হবে। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে।
তিনি বলেন, স্বাস্থ্যনীতি ও কর্মপরিকল্পনাসমূহের বাস্তবায়ন অব্যাহত রাখা হবে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, জেলা হাসপাতাল ও অন্যান্য হাসপাতালের শয্যা সংখ্যা আরো বৃদ্ধি করা হবে।
মাঠপর্যায়ে স্বাস্থ্যকর্মীদের উপস্থিতি, সেবার মান এবং ওষুধের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা হবে। টেলিমেডিসিন ব্যবস্থা সম্প্রসারিত করা হবে। নার্সিং ও মেডিকেল টেকনোলজি শিক্ষার সম্প্রসারণ এবং উচ্চতর প্রশিক্ষণের সুযোগ-সুবিধা আমরা বৃদ্ধি করবো। শেখ হাসিনা আরো বলেন, আর্সেনিকমুক্ত নিরাপদ সুপেয় পানি, প্রতি বাড়িতে স্যানিটেশন এবং ক্ষতিকর রাসায়নিক ও ভেজালমুক্ত খাদ্য প্রাপ্তির ব্যবস্থা জোরদার করা হবে।
প্রতিবন্ধী কল্যাণে গৃহীত কার্যক্রম আরো জোরদার করার উলেÍখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, অটিস্টিক ও অন্যান্য প্রতিবন্ধীদের শিক্ষা, পুষ্টি, মানসিক ও শারীরিক বিকাশ, কর্মসংস্থান, চলাফেরা এবং সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় বিজ্ঞানসম্মত পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হবে।
নারী উন্নয়ন নীতি-২০১১ সূচারুভাবে অনুসরণ ও বাস্তবায়ন করার বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, নারীর প্রতি সহিংসতা, যৌন নিপীড়ন ও হয়রানি বন্ধ এবং নারী ও শিশু পাচার রোধে গৃহীত আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা হবে।
তিনি বলেন, এছাড়া, শিশু-কিশোরদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের লক্ষ্যে ক্রীড়া, বিনোদন ও সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের সুযোগ আমরা নিশ্চিত করবো। জাতিসংঘ শিশু অধিকার সংরক্ষণ সনদ অনুসরণ এবং জাতীয় শিশুনীতি হালনাগাদ করা হবে। শিশু-কিশোরদের মধ্যে ইতিহাস চেতনা ও বিজ্ঞানমনষ্কতা জাগিয়ে তুলতে এবং আনন্দময় শৈশব নিশ্চিত করতে বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। শিশুশ্রম, শিশু নির্যাতন বন্ধে কঠোরভাবে আইন প্রয়োগ করা হবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জনস্বার্থে ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, পণ্য পরিবহন এবং যাত্রী পরিবহনের জন্য বিদ্যমান সড়ক ও জনপথ মেরামত, সংরক্ষণ, মানোন্নয়ন, সম্প্রসারণ এবং লেন সংখ্যা বাড়ানো হবে।
শেখ হাসিনা বলেন, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে। নির্দিষ্ট সময়ে তা শেষ হবে। দ্বিতীয় পদ্মা, যমুনা, মেঘনা ও গোমতী সেতু নির্মাণ করা হবে। সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করা হবে।
তিনি অঙ্গীকার ঘোষণা করেন, আমরা রেলের যাত্রীসেবা আরো উন্নত করবো। দেশব্যাপী রেল যোগাযোগ সম্প্রসারণ করবো। বাংলাদেশ বিমানের যাত্রী পরিবহন ক্ষমতা বাড়ানো হবে। এবছরই ঢাকা-নিউইয়র্ক ফ্লাইট চালু করবো ইনশাল্লাহ। নৌপথ খনন ও পুনর্খননের কাজ আরো জোরদার করা হবে। সড়ক, রেল ও নৌ-পথে দুর্ঘটনা রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
মাদকাসক্তিকে সারাবিশ্বের একটি ভয়াবহ সমস্যা হিসেবে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তরুণ সমাজকে মাদকের থাবা থেকে রক্ষা করার লক্ষ্যে মাদক ব্যবসা, চোরাচালান এবং ব্যবহার কঠোরভাবে বন্ধ করা হবে।
তিনি বলেন, পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য গৃহীত উদ্যোগগুলো অব্যাহত থাকবে। নদী ভাঙন রোধ, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, লবণাক্ততা রোধ ও খরা মোকাবিলায় সমন্বিত পরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া আমরা জোরদার করবো।
তিনি আরো অঙ্গীকার করেন যে, জীবনধারণের ব্যয়ের সাথে সঙ্গতি রেখে শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ ও পুনর্নির্ধারণ প্রক্রিয়া চলমান থাকবে। কর্মপরিবেশ ও শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে। শিল্প শ্রমিকদের রেশনের সুবিধা দেয়া হবে।
প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক হতে নমনীয় শর্তে বিদেশে যাওয়ার এবং দেশে ফেরার পর কর্মসংস্থানের জন্য প্রয়োজনীয় ঋণ প্রদান করা হবে। ইউরোপ, আফ্রিকা এবং এশিয়ার বিভিন্ন দেশে শ্রম উইং খোলার কাজ দ্রুত সম্পন্ন করা হবে।
আবাসন প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আওয়ামী লীগ আগামীতে সারাদেশের জন্য একটি সমন্বিত জাতীয় নগরায়ন নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করবে।
তিনি বলেন, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং অবাধ-তথ্যপ্রবাহ নিশ্চিত করার নীতি অব্যাহত রাখা হবে। তথ্য অধিকার আইন এবং তথ্য কমিশনকে আরো কার্যকর করা হবে। অনলাইন মাধ্যম এবং সামাজিক গণমাধ্যমের দায়িত্বশীল ভূমিকা নিশ্চিত করতে নীতিমালা প্রণয়ন করা হবে।
সংবাদপত্রকে শিল্প হিসেবে ঘোষণা এবং প্রয়োজনীয় প্রণোদনা দেয়া হবে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে আরো অধিক সংখ্যক কমিউনিটি রেডিও’র লাইসেন্স দেয়া হবে। তিনি উল্লেখ করেন, সাংবাদিক ও সংবাদকর্মীদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে অষ্টম মজুরি বোর্ড গঠন করা হয়েছে। দায়িত্ব পালনকালে সংবাদকর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলা ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, চলচ্চিত্র এবং সৃজনশীল প্রকাশনাসহ শিল্পের সব শাখার জন্য রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা বাড়ানো হবে।
কোরআন ও সুন্নাহ পরিপন্থী কোনো আইন প্রণয়ন করা হবে না। প্রতি জেলা ও উপজেলায় একটি করে উন্নত মসজিদ নির্মাণ করা হবে। অন্যান্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো উন্নত করা হবে। সন্ত্রাসী সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদ নির্মূল করে সব ধর্মের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও সম্প্রীতিকে দৃঢ় করতে সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি আমরা করবো।
রাষ্ট্র ও সমাজ জীবনের সর্বক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও গৌরব সমুন্নত রাখা হবে। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি রক্ষায় গৃহীত কর্মসূচি ও প্রকল্পগুলো সম্পন্ন করা হবে। মুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও মর্যাদা সমুন্নত রাখা, অস্বচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা, চিকিৎসাসেবা, বার্ধক্যকালীন ভরণ-পোষণ, সন্তানদের চাকরি ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কোটা ব্যবস্থা অব্যাহত থাকবে। শেখ হাসিনা বলেন, আমরা সকল ধর্মের সমান অধিকার এবং ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-জাতিগোষ্ঠীর অধিকার ও মর্যাদার সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিয়েছি। ফলে তাদের জীবন, সম্পদ, উপাসনালয়, জীবনধারা ও সংস্কৃতির স্বাতন্ত্র্য দৃঢ়ভাবে সংরক্ষিত করা হবে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি বাস্তবায়িত করা হবে। এই অঞ্চলে পর্যটন শিল্প, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণসহ স্থানীয় কুটির শিল্প বিকাশের জন্য বিশেষ প্রকল্প গ্রহণ করা হবে এবং বাস্তবায়ন করা হবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সশস্ত্র বাহিনীর প্রতিরক্ষা সামর্থ্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে ১৯৭৪ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রণীত প্রতিরক্ষা নীতিমালার আলোকে আওয়ামী লীগ সরকার যে ফোর্সেস গোল-২০৩০ প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করেছে, তা অব্যাহত থাকবে।
সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীকে আরো শক্তিশালী, আধুনিক ও দক্ষ হিসেবে গড়ে তুলতে প্রয়োজনীয় সামরিক সাজ-সরঞ্জাম, যানবাহন সংগ্রহ করা হয়েছে। শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ যুগোপযোগী করা হয়েছে। এই কার্যক্রম আমরা অব্যাহত রাখবো। শেখ হাসিনা বলেন, সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের শিক্ষা, চিকিৎসা, আবাসন ও অবসরকালীন সুযোগ-সুবিধাসহ কল্যাণমূলক কর্মসূচি বাস্তবায়ন অব্যাহত থাকবে। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীতে অধিকতর অংশগ্রহণের সুযোগ বৃদ্ধি করার উদ্যোগ অব্যাহত থাকবে।
তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিভিন্ন ক্রীড়ায় খেলোয়াড়দের মানোন্নয়নকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হবে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত ‘সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে বৈরিতা নয়’- আওয়ামী লীগ সরকারের পররাষ্ট্রনীতি এই নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত। অন্য রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বকে সন্মান করা এবং অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করা এই নীতির অংশ।
বাংলাদেশের ভূ-খন্ডে জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস এবং বিচ্ছিন্নতাবাদী কোনো শক্তিকে প্রশ্রয় দেয়া হবে না। সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও বিচ্ছিন্নতাবাদ মোকাবিলায় দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি এবং এ সকল ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা অব্যাহত রাখা হবে।
প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যসহ সকল দেশের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় থাকবে। জাতিসংঘ, ওআইসি, কমনওয়েলথ, সার্ক, বিমসটেক, আসেমসহ সকল আন্তর্জাতিক সংস্থার সাথে সম্পর্ক আরো জোরদার করা হবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০০৮ সালের নির্বাচনে আমরা যেসব অঙ্গীকার করেছিলাম তা সততা ও বিশ্বস্ততার সঙ্গে পালন করেছি। দেশের সর্বস্তরের মানুষের অকুণ্ঠ সমর্থন, তাদের অক্লান্ত শ্রম-ঘাম, মেধা এবং দেশ গঠনে আমাদের তরুণ প্রজন্মের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের ফলেই বিগত পাঁচ বছরের সাফল্যগুলো অর্জন করা সম্ভব হয়েছে। আত্মত্যাগ ও উৎসর্গ ছাড়া মহৎ কিছু অর্জন করা যে সম্ভব নয়, আপনারা তা প্রমাণ করেছেন।
তিনি দৃপ্ত কণ্ঠে বলেন, ‘অতীতের অন্ধকার ঘুচিয়ে বাংলাদেশ এখন আলোকোজ্জ্বল সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। আমরা সবাই আলোর পথের যাত্রী।’
দেশবাসীর উদ্দেশ্যে শেখ হাসিনা বলেন, গত পাঁচ বছরে অনুষ্ঠিত ৫, ৮০৩ টি স্থানীয় সরকার ও উপ-নির্বাচনে আপনারা যেভাবে ভীতিমুক্ত পরিবেশে ভোট দিয়েছেন তেমনিভাবে আগামী ৫ জানুয়ারী উৎসবমুখর পরিবেশে আপনারা ভোট দেবেন। পছন্দের জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করে গণতন্ত্রকে দৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করবেন।
তিনি বলেন, এবার সমাজ থেকে হিংসা, হানাহানি ও সংঘাতের চির অবসান হবে। দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়নের ধারা থেকে বাংলাদেশ বেরিয়ে আসবে। গড়ে ওঠবে একটি সহিষ্ণু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা।
শেখ হাসিনা আশা প্রকাশ করেন, আপনাদের ভোটের মাধ্যমে এবার সরকার গঠন করলে ইনশাল্লাহ ২০২১ সালের মধ্যে আমরা বাংলাদেশকে একটি মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত দেশে পরিণত করতে সক্ষম হবো।
কষ্টসহিষ্ণু, সাহসী এবং প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা যুব সমাজের নতুন প্রজন্ম বিশেষ করে এবারের নির্বাচনে যে তরুণেরা প্রথমবারের মতো ভোট দিতে যাচ্ছে তাদের প্রতি প্রধানমন্ত্রী অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জানান।
তিনি বলেন, ‘তরুণ ভোটাররা, তোমাদের উজ্জল ভবিষ্যতের জন্য আমরা আমাদের বর্তমানকে উৎসর্গ করছি।’
শেখ হাসিনা অতীতের মতো এবারও দেশবাসীর অকুণ্ঠ সমর্থন কামনা করে বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু এবং ‘হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দী’র প্রতীক, স্বাধীনতা ও মুক্তির প্রতীক নৌকা। সেই নৌকা মার্কায় ভোট চাই। আসুন, আমরা বিভেদ ভুলে সম্মিলিতভাবে শান্তি উন্নয়ন গণতন্ত্র ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাই। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তুলি। দেশ গড়ার এই সংগ্রামে জনগণের জয়- বাংলাদেশের জয় অনিবার্য।

TAGS:

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত