4914
Published on ফেব্রুয়ারি 15, 2021অঞ্জন রায়:
চর্যাপদের কবিদের দ্রোহ থেকে কৈবর্ত্য বিদ্রোহ। ফকির বিদ্রোহ থেকে ফরায়েজী আন্দোলন। বাঁশের কেল্লা নিয়ে রুখে দাঁড়ানো তিতুমীর। কলের বোমা হাতে ক্ষুদিরাম বসু। চট্টলার সেনাপতি সূর্যসেন, প্রীতিলতা। ব্যারাকপুরে ব্রিটিশ শাসকের বিরুদ্ধে রুখে দাড়ানো মঙ্গল পান্ডে। বিনয়-বাদল-দিনেশ থেকে সুভাষ চন্দ্র বসু। রবি ঠাকুরের ছুঁড়ে ফেলা নাইট পদক আর নজরুলের দ্রোহ। সব সাহসের একত্রিত উচ্চারণবঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সঙ্গেই ভিন্ন পথচলা শুরু হয় সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের। মুখ থুবড়ে পড়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, প্রশাসন থেকে রাজনীতি। সব জায়গায় জেঁকে বসে পাকিস্তানি প্রেতাত্মাদের ভূত। জাতির জনককে হত্যার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বাংলাদেশ বেতার হয়ে গিয়েছিল রেডিও বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধে রণধ্বনী জয় বাংলা বদলে যায় বাংলাদেশ জিন্দাবাদে। বছর না ঘুরতে জেলখানা থেকে স্বদন্তে বেড়িয়ে আসে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে মানবতা বিরোধী অপরাধে জড়িত প্রায় ১১ হাজার যুদ্ধাপরাধী। যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন, যারা বিশ্বাস করতেন অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে তাদের জন্য শুরু হয় অন্ধকার কাল। ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের পর থেকেই একটানা চেষ্টা চলে বঙ্গবন্ধুকে ভুলিয়ে দেওয়ার। পাঠ্যপুস্তক থেকে মুছে ফেলা হয় বঙ্গবন্ধুর নাম। আওয়ামী লীগসহ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনৈতিক দলগুলোর ওপরে চলে ধারাবাহিক নির্যাতন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার সময়ে দেশের বাইরে ছিলেন তাঁর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। স্বামী-সন্তানসহ ছয় বছর বিদেশে কাটিয়ে ১৯৮১ সালের ১৯ মে দেশে ফিরতে সক্ষম হন তার বড় মেয়ে শেখ হাসিনা। দুই শিশু সন্তান সজীব ওয়াজেদ জয় এবং সায়মা ওয়াজেদ পুতুলকে লন্ডনে ছোট বোন শেখ রেহানার কাছে রেখে বাংলাদেশের গণতন্ত্র আর প্রগতিশীলতার রাজনীতি ফেরাতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশে ফেরেন তিনি।
দীর্ঘদিন পরে দেশে ফেরা শেখ হাসিনার জন্য যতটা না আনন্দের ছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি বেদনার। রাজনীতির ময়দানের মতোই ঝন্ঞাবিক্ষুব্ধ। স্কৃতিও যেন একাত্ম হয়ে গিয়েছিল শেখ হাসিনা আর বাঙালির আবেগের সঙ্গে। ১৯ মের সেই রবিবার সকাল থেকেই ছিল কালবৈশাখীর প্রবল ঝড়ো হাওয়া, বেগ ছিল ঘণ্টায় ৬৫ মাইল। ঝড়-বৃষ্টি মাথায় নিয়েই সেদিন বিমানবন্দরমুখী হয়েছিল লাখো মানুষ। মুষলধারার বৃষ্টি তাদের সরাতে পারেনি বিমানবন্দর থেকে। দীর্ঘ সাড়ে ছয় বছর পর দেশের মাটিতে পা রেখেই আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন শেখ হাসিনা। তাঁকে এক নজর দেখার জন্য কুর্মিটোলা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে শের-এ-বাংলা নগর পর্যন্ত সব রাস্তা সেদিন পরিণত হয়েছিল জনসমুদ্রে। আর দেশের মাটিতে পা দিয়েই শেখ হাসিনা বলেছিলেন, 'সব হারিয়ে আমি আপনাদের মাঝে এসেছি; বঙ্গবন্ধু নির্দেশিত পথে তার আদর্শ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে জাতির জনকের হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণে আমি জীবন উৎসর্গ করতে চাই।' তার আগমন উপলক্ষে স্বাধীনতার অজেয় ধ্বনি জয় বাংলা' আবারও লাখো কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছিল সেদিন। সেদিন সবার কণ্ঠে শ্লোগান ছিল হাসিনা তোমায় কথা দিলাম—পিতৃ হত্যার বদলা নেব।'
১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর প্রতিকূল পরিবেশে নির্বাসিত প্রবাস জীবন কাটাতে হয় আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। সেই অবস্থাতেই ১৯৮১ সালে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লিগের কাউন্সিলে সর্বসম্মতিক্রমে দলের নেতারা শেখ হাসিন সভাপতি নির্বাচিত করেন। দেশে ফেরার পর তিনি দায়িত্ব নেন মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের। দেশে ফেরার প্রথম দিনেই শেখ হাসিনা ছুটে গিয়েছিলেন ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িতে, যেখানে ঘাতকরা হত্যা করেছিল তার বাবা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মা ফজিলাতুন্নেসা মুজিব, ভাই শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রাসেল আর দুই ভাইয়ের স্ত্রীকে। তবে, তৎকালীন জিয়াউর রহমানের সরকার তাঁকে সেদিন ঢুকতে দেয়নি স্বজনের রক্তে ভেজা সেই বাড়িতে। বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে দোয়া পড়ে ফিরে যেতে হয়েছিল তাঁকে। সেদিন শেখ হাসিনার চোখের জল আর বৃষ্টির পানি একাকার হয়ে ডিজেছিলো বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার মাটি।
বঙ্গবন্ধু খুনীদের রক্ষায় বাংলাদেশের সংবিধানে যুক্ত করা হয়েছিল ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ। ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর এই কালো অধ্যাদেশটি জারি করা হয়। পরবর্তীতে ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ নেন। সে সময় বিচারপতি সায়েম রাষ্ট্রপতি ছিলেন। ১৯৭৬ সালের ২৯ এপ্রিল সায়েম জেনারেল জিয়াউর রহমানের কাছে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব হস্তান্তর করেন। ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল সায়েমকে পদত্যাগ করিয়ে রাষ্ট্রপতি হন জিয়াউর রহমান। ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি সামরিক আইনের অধীনে দেশে দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বিতর্কিত ওই নির্বাচনে জিয়াউর রহমানের দল বিএনপি দুই-তৃতীয়াংশ আসনে বিজয়ী হয়। সেই সংসদেই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল পর্যন্ত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ-সহ চার বছরে সামরিক আইনের আওতায় সব অধ্যাদেশ, ঘোষণাকে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে আইনি বৈধতা দেওয়া হয়।
এক ধরনের আইনি সুরক্ষা দিয়েই বঙ্গবন্ধুর খুনীদের বিচারের পথ যেমন বন্ধ করা হয়েছিল—একই সঙ্গে তাদের বিভিন্ন দূতাবাসে চাকুরি দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়। পরবর্তী কালে ১৯৯৬ সালে সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করে। বঙ্গবন্ধুর খুনীদের বিচারের হাতে ন্যস্ত করতে ১৯৯৬ সালের ১৪ নভেম্বর পার্লামেন্টে ইনডেমিনিটি আইন বাতিল করা হয়। সুগম হয় জাতির জনকের ঘাতকদের বিচারের পথ, নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করে বাঙালি। ১৯৯৬ সালের ২ অক্টোবর বঙ্গবন্ধুর আবাসিক একান্ত সহকারী (পিএ) এ এফ এম মোহিতুল ইসলাম ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সংঘটিত নারকীয় হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় থানায় একটি এফআইআর দায়ের করেন। ৩ অক্টোবর বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা সিআইডির কাছে হস্তান্তর করা হয় এবং তারা এ মামলার তদন্ত শুরু করে। ১৯৯৭ সালের ১৫ জানুয়ারি সিআইডি এই মামলায় ২০ জনকে অভিযুক্ত করে মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে চার্জশিট দাখিল করে। ১৯৯৭ সালের ১ মার্চ ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আইনগত আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করার পর বিচার কার্যের জন্য মামলাটি ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ আদালতে পাঠান। ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর মামলার রায়ে বিচারক কাজি গোলাম রসুল ১৫ জন সাবেক সেনা কর্মকর্তাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন। তবে, ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার গঠন করলে আবারও থমকে দাঁড়ায় বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার।
২০০৮ সালের নিরবাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার গঠন করলে, গতি ফেরে মামলার। উচ্চ আদালতে ২৯দিন শুনানির পর ২০০৯ সালের ১৯ নভেম্বর রায়ের তারিখ নির্ধারিত হয়। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের পাঁচ সদস্যের বেঞ্চে হাইকোর্টে দেওয়া রায় বহাল রেখে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ৫ আসামির দায়ের করা আপিল আবেদন খারিজ করে দেন। রায়ে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট সপরিবারে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা মামলায় ১২ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন উচ্চ আদালত। ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর ঘাতকদের মধ্যে সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, আর্টিলারি মুহিউদ্দিন আহমদ, বজলুল হুদা এবং ল্যান্সার এ কে এম মহিউদ্দিনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়।
অন্যদিকে দীর্ঘ দিনেও দেশে আনা সম্ভব হয়নি বঙ্গবন্ধুর পলাতক ৫ খুনিকে। বঙ্গবন্ধুর ঘাতকদের ৬ জন খুনীর মধ্যে ৫ জন এখনও বিদেশে পলাতক।কূটনৈতিক-সহ বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রে আছেন রাশেদ চৌধুরী এবং রিসালদার মোসলেমউদ্দিন। নূর চৌধুরী আছেন কানাডায়। অন্য ঘাতক খন্দকার আব্দুর রশিদ লিবিয়া অথবা কেনিয়ায়, শরিফুল হক ডালিম পাকিস্তান। আব্দুল মাজেদকে ভারত থেকে এনে বিচারের মুখোমুখী করা হয়। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম এই বিষয়ে আনন্দবাজার পত্রিকাকে বলেছেন—“খুনিদের ফিরিয়ে আনার বিষয়ে এখনও জটিলতা আছে সেটা অতিক্রম করার জোর চেষ্টা চলছে, আশা করছি তাদের আমরা ফিরিয়ে আনতে পারব। বঙ্গবন্ধুর পলাতক খুনিদের দেশে ফিরিয়ে আনতে সরকারের টাঙ্ক ফোর্স-এর উদ্যোগের কথা কিছুদিন আগে জানিয়েছিলেন বাংলাদেশের আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কিছুদিন আগে জানিয়েছিলেন, বঙ্গবন্ধুর খুনিদের গ্রেফতারে রেড অ্যালার্ট এখনো বহাল। খুনীদের অবস্থান নিশ্চিত করে দ্রুত তাদের দেশে আনা সম্ভব হবে। এই ফিরিয়ে আনার জোরদার চেষ্টা এখনো চলছে।
বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা দুবার পূর্ণ মেয়াদে দায়িত্ব পালন শেষে এবার তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি আইনের নিয়মিত প্রক্রিয়ায় বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করেছেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারও চালিয়ে যাচ্ছেন। মুক্তিযুদ্ধের যে শপথ ছিলো, সেই শপথের পথ থেকে মাঝে অনেকটাই বেপথ হয়েছিলো বাংলাদেশ। শেখ হাসিনার লড়াই সেই বেপথ বাংলাদেশকে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অসাম্প্রদায়িক মহাসড়কে তুলে দেওয়ার। তবে, সেই পথ যে মসৃন নয়, সেটা শেখ হাসিনাও জানেন ভালো করেই। ২০০৪ এর ২১ আগস্টসহ ২১ বারের বেশি তাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। তার পরেও শেখ হাসিনা আছেন—জারি আছে তার লড়াই। সেই লড়াইয়ের ফলাফলে বাংলাদেশ পথ হারায়নি। পথ হারায়নি মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা। এতকিছুর পরেও আগস্ট এলেই শোকাতুর হয় বাঙালি রক্তক্ষরণ হয় প্রতিটি হৃদয়ে। কেননা বাংলাদেশের আরেক নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।