মহান মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ ধাপে ধাপে চূড়ান্ত বিজয়ের পথে বাংলাদেশ
৯৭০ ৭ জুন রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন , আসন্ন নির্বাচন হবে ছয় দফার প্রশ্নে গণভোট ২৮ নভেম্বর ‘ঘূর্নিঝড়ে ১০ লাখ মারা গেছে , স্বাধিকার অর্জনের জন্য আরো দশ লাখ প্রাণ দেবে’ – সংবাদ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
৭ ডিসেম্বর সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামীলীগ ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে । পূর্ব পাকিস্তানের মোট ১৬৯ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ১৬৭ আসন লাভ করে । ১৭ ডিসেম্বর প্রাদেশিক ও জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে জয়লাভ করে
১৯৭১ ৩ জানুয়ারী রেসকোর্সে এক বিরাট সমাবেশে আওয়ামী লীগ দলীয় এম.সি.এ (কেন্দ্রীয় পরিষদের সদস্য) ও এম.পি.এ (প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য)-দের ছয় ও এগারো দফা রুপায়নের শপথ গ্রহন। সমাবেশে বঙ্গবন্ধু বলেন, ছয়দফা এখন আর পার্টির সম্পত্তি নয় – জনগনের সম্পত্তি । ছয়দফা ও এগারো দফার ভিত্তিতে প্রস্তাবিত সংবিধান প্রনীত হবে । এ ব্যাপারে কেউ আর প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারবে না।
১১ জানুয়ারী আওয়ামী লীগ একাই কেবলমাত্র কেন্দ্র ও পূর্ব বাংলার মন্ত্রীসভা গঠনে সক্ষম । ছয়দফার ভিত্তিতে কেবল সংবিধান প্রণয়নের মাধ্যমে জনতার দাবি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব – বঙ্গবন্ধু ১৭ ফেব্রুয়ারী বিশ্বের কোন শক্তিই আর বাঙ্গালীদের দাসত্ব – শৃঙ্খলে আটকে রাখতে পারবেনা । শহীদ দের রক্ত আমরা বৃথা যেতে দেবনা – বঙ্গবন্ধু
১ মার্চ পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বাতিল করাকে গভীর ষড়যন্ত্র হিসেবে উল্লেখ করে আন্দোলন-সংগ্রামের প্রস্তুতি নিতে জনগণকে আহ্বান জানান জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক বটতলায় বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করা হয়। ৩ মার্চ পল্টন ময়দানে ছাত্রলীগের জনসভায় ‘জাতীয় সংগীত’ হিসেবে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি নির্বাচন করা হয় ।
৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে লাখ লাখ জনতার সামনে ১৯ মিনিটের এক অলিখিত ভাষণ দিলেন; যেন বাংলার মানুষের বুকের কথাগুলোই বঙ্গবন্ধুর মুখ থেকে উচ্চারিত হলো । সবশেষে, তিনি উচ্চারণ করলেন সেই অমর বাণী- ‘তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ্। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম... জয় বাংলা।’
৯ মার্চ পল্টন ময়দানের জনসভায় বঙ্গবন্ধু পরিষ্কার ঘোষণা দিয়ে বলে দিলেন, পশ্চিম পাকিস্তানিরা যেন আলাদা করে তাদের শাসনতন্ত্র তৈরি করে, কারণ পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ একটি স্বাধীন দেশের জন্ম দিয়ে নিজেদের শাসনতন্ত্র নিজেরাই তৈরি করে নেবে। ১৫ মার্চ ইয়াহিয়া খান নিজে ঢাকায় এসে বঙ্গবন্ধুর সাথে আলোচনার ভান করতে থাকে, এর মাঝে প্রত্যেক দিন বিমানে করে ঢাকায় সৈন্য আনা হতে থাকে ।
১৯ মার্চ জয়দেবপুরে বাঙালি সেনারা বিদ্রোহ করে। ২১ মার্চ এইবার ষড়যন্ত্রে ভুট্টো যোগ দিল, সদলবলে ঢাকা পৌঁছে সে আলোচনার নাটক করতে থাকে। ২৩ মার্চ এইদিন ছিল পাকিস্তান দিবস, কিন্তু সেনাবাহিনীর ক্যান্টনমেন্ট আর গভর্নমেন্ট হাউজ ছাড়া সারা বাংলাদেশে কোথাও পাকিস্তানের পতাকা খুঁজে পাওয়া গেল না । ধানমন্ডিতে বঙ্গবন্ধুর বাসাতেও সেদিন ‘আমার সোনার বাংলা’ গানের সাথে সাথে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা তোলা হয় ।
২৫ মার্চ পৃথিবীর ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যার স্মৃতিবিজড়িত রাত ভয়াল ২৫ মার্চ । এই রাতের বীভৎসতা এতটাই নির্মম যে হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, ধ্বংসযজ্ঞের অতীত সব রেকর্ডকে ছাপিয়ে এটি হয়ে উঠেছে বিশ্বের ভয়ালতম গণহত্যার রাত । ইতিহাসের জঘন্যতম এই গণহত্যার রাতে, নিরস্ত্র বাঙালির রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে পাকবাহিনী মৃত্যুর মিছিলকে শত থেকে হাজার আর হাজার থেকে লাখে রূপান্তর করার পৈশাচিক আনন্দে মেতে উঠেছিল।
২৬ মার্চ বাঙালির শৃঙ্খল মুক্তির দিন । বিশ্বের বুকে লাল-সবুজের পতাকা ওড়ানোর দিন । এই দিন প্রথম প্রহরে ধানমন্ডির ঐতিহাসিক ৩২ নম্বরের বাড়ি থেকে পাক বাহিনীর গণহত্যার বিরুদ্ধে বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা ।
১০ই এপ্রিল মুক্তিযুদ্ধকে আরো বেগবান করতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি করে সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠন করা হয়। সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপরাষ্ট্রপতি এবং বঙ্গন্ধুর অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করা হয়। তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী, খন্দকার মোশতাক আহমেদ ও এ এইচ এম কামরুজ্জামানকে মন্ত্রিপরিষদের সদস্য নিয়োগ করা হয়।
১১ এপ্রিল টিক্কা খানের পরিবর্তে জেনারেল নিয়াজিকে বাংলাদেশে পাঠানো হয় সসস্ত্রবাহিনীর প্রধান করে। ১৭ই এপ্রিল বর্তমান মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে স্বাধীন বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার আনুষ্ঠানিক শপথ গ্রহন করে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। পতাকা উত্তোলনের সময় জাতীয় সংগীত 'আমার সোনার বাংলা' গানটি পরিবেশন করা হয়।
১১ জুলাই সংগঠিত বাহিনী হিসাবে মুক্তিবাহিনী যাত্রা শুরু করে। ১ আগস্ট নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ারে রবিশংকর, জর্জ হ্যারিসন সহ অসংখ্য শিল্পীকে নিয়ে স্মরণাতীত কালের বৃহত্তম একটি কনসার্ট সারা পৃথিবীর বিবেককে নাড়িয়ে দেয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কবি অ্যালেন গিনসবার্গ শরণার্থীদের কষ্ট নিয়ে ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ নামে যে অসাধারণ কবিতাটি রচনা করেন, সেটি এখনো মানুষের বুকে শিহরণের সৃষ্টি করে।
২৮ সেপ্টেম্বর ভারতের নাগাল্যান্ডের ডিমাপুর বিমানবন্দরে তিনটি বিমান ও নয়জন বৈমানিক নিয়ে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর প্রথম ইউনিট গঠিত হয়। ৬ অক্টোবর এদিন পাকিস্তানী বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর তীব্র সংঘর্ষ হয়। পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর ২২ জন অফিসার ও ৪০০০-এর বেশী সৈন্য, রাজাকার ও বদর বাহিনীর লোক নিহত হয়। বীর মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্ন রণাঙ্গণে প্রায় আড়াই হাজার কমান্ডো আক্রমণে উক্ত শত্রুসেনাদের নিহত করেছে।
৭ অক্টোবর ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম নয়াদিল্লিতে বলেন , বাংলাদেশ প্রশ্নে একটি রাজনৈতিক সমাধান বলতে একমাত্র ‘ স্বাধীনতা’ বুঝি । আমরা বিশ্বাস করি , বাঙ্গালিরা একদিন স্বাধীনতা লাভ করবে এবং বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্রের মর্যাদা ও স্বীকৃতি পাবে । কেননা , তারা ন্যায় ও সত্যের জন্য লড়াই করছে । ৯ নভেম্বর ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় উপহার পাওয়া মাত্র দু‘টি টহল জাহাজ "পদ্মা" ও "পলাশ" "পলাশ" নিয়ে শুরু হয় বাংলাদেশ নৌবাহিনীর যাত্রা। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ১০ নং সেক্টরের অধীনে যুদ্ধ পরিচালনা করে। খুলনা, নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রামে "অপারেশন জ্যাকপট" এই বাহিনীর পরিচালিত সফল অভিযানগুলোর অন্যতম।
নভেম্বর ২১ মুক্তিযুদ্ধের শেষধাপে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যময় দিন হলো ২১ নভেম্বর। এই দিনে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর আনুষ্ঠানিক অভ্যুদয় হয়। বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ বাহিনী গঠিত হয়, নাম দেয়া হয় মিত্রবাহিনী। ৬ ডিসেম্বর ভারতের কাছ থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম স্বীকৃতি লাভ। ৭ ডিসেম্বর দ্বিতীয় দেশ হিসেবে ভুটান বাংলাদেশেকে স্বাধীন দেশের স্বীকৃতি দেয়।
৮ ডিসেম্বর ভারতের সরকারী মুখপাত্রের ঘোষণা , পাকিস্তান যদি পূর্ব বাংলায় তাদের পরাজয় স্বীকার করে নেয় তবে সকল অঞ্চলেই এই যুদ্ধ বন্ধ হবে। ১৪ ডিসেম্বর ১৪ ডিসেম্বরের হত্যাকাণ্ড ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে এক জঘন্য বর্বর ঘটনা, যা বিশ্বব্যাপী শান্তিকামী মানুষকে স্তম্ভিত করেছিল। পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসররা দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের পৈশাচিকভাবে হত্যার পর ঢাকার মিরপুর, রায়েরবাজারসহ বিভিন্ন স্থানে লাশ ফেলে রেখে যায় । বুদ্ধিজীবীদের লাশ জুড়ে ছিল আঘাতের চিহ্ন, চোখ-হাত-পা ছিল বাঁধা, কারো কারো শরীরে একাধিক গুলি, অনেককে হত্যা করা হয়েছিল ধারালো অস্ত্র দিয়ে জবাই করে।
১৬ ডিসেম্বর বিকাল ৪ টা ৩১ মিনিটে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ৯০ হাজার পাকিস্তানী সৈন্যের যৌথবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পনের মধ্যদিয়ে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে আর্জিত হলো বাঙ্গালীর হাজার বছরের স্বপ্নসাধ-স্বাধীনতা।