114
Published on জুন 24, 2024বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ; মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দল। এই দলের সৃষ্টির সঙ্গে একটি নতুন রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের রাজনৈতিক ইতিহাস জড়িত। বাংলাদেশের ইতিহাস ঐতিহ্য ও উন্নয়নের স্বপ্নযাত্রার জন্মলগ্ন থেকেই সারথি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। শত সংকট, সংগ্রাম আর চরম জুলুম-নির্যাতন-নিপীড়ন অতিক্রম করে বীরদর্পে অদম্য গতিতে দলটি এগিয়ে চলছে প্রগতি আর উন্নয়নের অগ্রযাত্রায়।
যখন পশ্চিম পাকিস্তানের নির্যাতন ও একচেটিয়া সিদ্ধান্ত গ্রহণের কারণে কোণঠাসা ছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সব রাজনৈতিক কার্যক্রম, তখন সাধারণ মানুষের ম্যান্ডেট নিয়ে একমাত্র দল হিসেবে এগিয়ে আসে আওয়ামী লীগ। ফল হিসেবে তুমুল জনপ্রিয়তা নিয়ে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন দলটি।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বপ্ন দেখতেন: আওয়ামী লীগ হবে গণমানুষের দল। যে দল বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা তথা সব ধর্মের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ ও অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি এবং সমাজতন্ত্র বা শোষণমুক্ত সমাজ ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করবে।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আজকের অবস্থানে এসেছে আওয়ামী লীগ। প্রতিষ্ঠার পর থেকে নিয়মতান্ত্রিক পথে আন্দোলন-সংগ্রাম করে মানুষের অধিকার আদায় করেছে দলটি। এনে দিয়েছে এ দেশের স্বাধীনতা। তাই স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে ‘আওয়ামী লীগ’, ‘বঙ্গবন্ধু’ ও ‘বাংলাদেশ’ একটি আরেকটির সমার্থক।
আওয়ামী লীগের জন্ম ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন। সেদিন ঢাকার কে এম দাস লেন রোডের রোজ গার্ডেন প্যালেসে প্রতিষ্ঠিত হয় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ। এই ২৩ জুন পলাশীর আম্রকাননে বাংলার স্বাধীনতার লাল সূর্য অস্তমিত হয়েছিল। আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতারা দলের আত্মপ্রকাশের দিন হিসেবে ইতিহাস থেকে ২৩ জুন তারিখটি বেছে নিয়েছিলেন। কারণ, এটি ছিল এ দেশের মানুষের মুক্তির পথে যাত্রার প্রথম পদক্ষেপ।
১৯৫৫ সালে ধর্মনিরপেক্ষতার চর্চা এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সংগঠনটির নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দেয়া হয়, নাম রাখা হয়, ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ’। ১৯৪৭ সালের দেশভাগ হওয়ার পর থেকে পাকিস্তান সরকার বাঙালিদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা শুরু করে। এমন প্রেক্ষাপটে এ দেশের মানুষের অধিকার আদায়ে পাকিস্তান সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগে প্রয়োজন ছিল একটি রাজনৈতিক দলের। দেশভাগ হওয়ার পর পাকিস্তানে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা হলেও বাঙালিদের অধিকার আদায়ের জন্য যে দলটি সবসময় সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে সেটি আওয়ামী লীগ। এই দলটি পাকিস্তানি শাসকদের শোষণের বিরুদ্ধে কথা বলে এ দেশের মানুষের মুখপাত্র হয়ে ওঠে। বঙ্গবন্ধুর ডাকে এবং আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে হাতিয়ার তুলে নিয়ে প্রিয় মাতৃভূমির বীর সন্তানরা ৩০ লক্ষাধিক শহীদ আর ২ লক্ষাধিক মা-বোনের আত্মত্যাগে বাংলাদেশ স্বাধীন করে।
যুদ্ধোত্তর দেশে ব্যাপক পুনর্বাসন কর্মকাণ্ড হাতে নেন বঙ্গবন্ধু। এ জন্য সকল পর্যায়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিটি গঠন করা হয়। গৃহহীনদের আবাসন সুবিধা, জরুরি ভিত্তিতে নগদ টাকা, খাদ্য সহায়তা, শিক্ষা কার্যক্রম চালু করতে আর্থিক সহায়তা, মহকুমা সদরে অভিভাবকহীন নারীদের আশ্রয় প্রদান, বিশুদ্ধ পানির সুব্যবস্থা, ধ্বংসপ্রাপ্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা পুনরুদ্ধার, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেন। কৃষক, কামার, কুমার, তাঁতি, জেলে প্রভৃতি পেশার মানুষের জীবিকা নির্বাহে সহায়তা দেয়া হয়। যাতে তারা নিজ নিজ পেশা অব্যাহত রাখতে পারেন। মজার বিষয় হলো, সে সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে যেসব কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছিল বা গ্রহণ করা হবে বলে পরিকল্পনা করা হয়েছিল, তার ভিত্তিতেই এখনও দেশের উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা করছেন বঙ্গবন্ধুর যোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
আওয়ামী লীগ পনেরো বছরের বেশি টানা ক্ষমতায়। এরইমধ্যে ‘উন্নয়নের মহাসড়কে’ অবস্থান করছে দেশ। সরকার এবং আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, দেশের অগ্রযাত্রা আর থামানো যাবে না।
এরইমধ্যে দেশজুড়ে অবকাঠামোগত নানা উন্নয়ন হয়েছে। বন্দরনগরী চট্টগ্রাম ও রাজধানী ঢাকায়ও রাস্তাঘাটের উন্নয়নসহ অবকাঠামো নির্মাণের কর্মযজ্ঞ চলছে। এর মধ্যে মেট্রোরেল, বিআরটি উল্লেখযোগ্য। নির্মিত হয়েছে ৬.১৫ কিলোমিটারের স্বপ্নের পদ্মা সেতু।
এই সেতু বাস্তবায়নের পর শুধু দক্ষিণবঙ্গই নয়, পাল্টে গেছে পুরো দেশের অর্থনৈতিক চিত্র। এই সেতু দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার যোগাযোগ, বাণিজ্য, পর্যটনসহ নানা ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। ঢাকার আশপাশে নদ-নদী রক্ষা করে পরিবেশের সৌন্দর্য রক্ষায়ও চলছে নানাবিদ কর্মকাণ্ড।
নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণকাজ কোনো সহজ কাজ ছিল না। কিন্তু তা করে বিশ্বকে বঙ্গবন্ধুকন্যা দেখিয়ে দিচ্ছেন যে, বাংলাদেশ পারে।
‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ এখন বাস্তব। এগিয়ে চলেছে দেশ। ইন্টারনেট অব থিংসকে কাজে লাগিয়ে আসন্ন চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রস্তুতি নিতে এরইমধ্যে কাজ শুরু হয়েছে। ডিজিটাল বাংলাদেশের সুবিধা কাজে লাগিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্লাস অনলাইনে নেয়া হচ্ছে। অনেক প্রয়োজনীয় কাজ করা হচ্ছে ভার্চুয়ালি। গড়ে উঠছে হাই-টেক পার্ক। শিল্পসমৃদ্ধ দেশ গড়ে তুলতে জোর দেয়া হচ্ছে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে।
মূলত আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরই দেশে জনকল্যাণমুখী নানা উদ্যোগ নেয়া হয়। এসব উদ্যোগ বাস্তবায়নের ফলে সারা বিশ্বের কাছে এরইমধ্যে প্রাকৃতিক দুর্যোগের নিবিড় সমন্বিত ব্যবস্থাপনা, ক্ষুদ্রঋণের ব্যবহার এবং দারিদ্র্য দূরীকরণে এর ভূমিকা, জনবহুল দেশে নির্বাচন পরিচালনায় স্বচ্ছ ও সুষ্ঠুতা আনা, বৃক্ষরোপণ, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সূচকের ইতিবাচক পরিবর্তনের প্রভৃতি ক্ষেত্রে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ।
৩০ লাখ শহীদের প্রাণ, লক্ষ-লক্ষ মা-বোনের অশ্রু, সম্ভ্রম ও রক্তের বিনিময়ে জন্ম নেয়া এই বাংলাদেশকে আজকের অবস্থানে আসতে অতিক্রম করতে হয়েছে হাজারো প্রতিবন্ধকতা। যুদ্ধবিধ্বস্ত, প্রায় সর্বক্ষেত্রে অবকাঠামোবিহীন সেদিনের সেই সদ্যোজাত জাতির অর্জনের পরিসংখ্যানও অপ্রতুল নয়।
সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এমডিজি) ৮টি লক্ষ্যের মধ্যে শিক্ষা, শিশুমৃত্যু হার কমানো এবং দারিদ্র্য হ্রাসের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য উন্নতি প্রদর্শন করতে সক্ষম হয়েছে বয়সে পঞ্চাশ পেরোনো দেশটি। যার অবদান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার নেতৃত্বাধীন দল আওয়ামী লীগের।
একটি দেশের উন্নয়নের অন্যতম পূর্বশর্ত স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ, যা বাংলাদেশে বিরাজ করছে। বাংলাদেশ এখন বিশ্ব বিনোয়োগেরও অন্যতম কেন্দ্র। এখানে রয়েছে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল।
রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষার ক্ষেত্রেও রয়েছে আওয়ামী লীগের অবদান। এ ক্ষেত্রে সংগ্রাম ও ঐতিহ্যের অধিকারী রাজনৈতিক দলটির ভূমিকা প্রশংসনীয়। জাতি যখনই কোনো ক্রান্তিকালে পতিত হয়েছে, তখনই মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে আওয়ামী লীগ। ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ–এর মাঝে ’৫৪-র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ছয় দফাসহ সব সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক আন্দোলনে সামনের কাতারে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে আওয়ামী লীগ।
মহান মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে অর্জিত হয় স্বাধীনতা। পাকিস্তানের জেল থেকে মুক্তি পেয়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি নবীন দেশকে পুনর্গঠনের কাজে হাত দেন বঙ্গবন্ধু। মাত্র সাড়ে তিন বছরেই তার নেতৃত্বাধীন সরকার সময়োপযোগী বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে শুরু করে। প্রথম ভাগে পুনর্বাসন ও পুনর্গঠন এবং দ্বিতীয় ভাগে আর্থসামাজিক উন্নয়নের দিকে নজর দেন বঙ্গবন্ধু। এরইমধ্যে বাংলায় সোনার ফসল ফলতে শুরু করে, কারখানার চাকা ঘুরতে শুরু করে। ঠিক তখনই স্বাধীনতাবিরোধী ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে, যা ছিল দেশ-জাতি ও মানুষের জন্য চরম দুর্ভাগ্যের। ওই সময় তার দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বিদেশে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান। এরপর শুরু হয় দেশে আওয়ামী লীগ কর্মীদের ওপর জুলুম-নির্যাতন। এর মাঝে দলে দেখা দেয় কোন্দল; নেতৃত্বশূন্যের কারণে তৃণমূল থেকে শুরু করে কেন্দ্র পর্যন্ত কর্মীদের মাঝে হতাশা ছড়িয়ে পড়ে। আর দলটির বিরুদ্ধে প্রচার-প্রচারণাও ছিল বেশি।
১৯৮০ সাল পর্যন্ত প্রকাশ্যে আওয়ামী লীগ বা বঙ্গবন্ধুর নাম নেয়া অলিখিতভাবে নিষিদ্ধই ছিল। ফলে এসব বাধা প্রতিহত করে রাজনীতির মাঠে ঘুরে দাঁড়ানো মোটেও সহজ ছিল না দলটির জন্য।
এমন প্রেক্ষাপটে ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফেরেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। তিনি দলের হাল ধরলেন। ঘাতকরা মনে করেছিল, বঙ্গবন্ধু পরিবারের সব সদস্যকে হত্যার মাধ্যমে আওয়ামী লীগ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। পরে প্রবাসে প্রাচীন সংগঠনটির সভাপতির দায়িত্ব নিয়ে শেখ হাসিনা যেন আওয়ামী লীগের নবজন্ম দেন।
দলীয় সভাপতি হিসেবে দেশে ফিরে কয়েক ভাগে বিভক্ত আওয়ামী লীগকে ঐক্যবদ্ধ করেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। তার ধীশক্তি, দৃঢ়তা, লক্ষ্য স্থিরে বিচক্ষণতা, সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক দূরদর্শিতা আওয়ামী লীগকে বর্তমান অবস্থায় নিয়ে এসেছে। আশির দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে আওয়ামী লীগের ঐতিহাসিক ভূমিকা এ দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের একটি মাইলফলক।
নানা সংকটের পর ১৯৯৬ সালে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। এরপর ২০০৮ সালের নির্বাচনেও বিপুল ভোটে জয়ী হয় মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দলটি। এটি সম্ভব হয় জাতির প্রতি আওয়ামী লীগের অঙ্গীকার আর দায়বদ্ধতার কারণে। এরপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে বাংলাদেশকে বিশ্বে মর্যাদার আসনে আসীন করেন। তার উদ্যোগের ফলেই অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের রোল মডেল।
লেখকঃ তন্ময় আহমেদ, কোর্ডিনেটর, আওয়ামী লীগ ওয়েব টিম, সাবেক সাধারণ সম্পাদক, বুয়েট ছাত্রলীগ