579
Published on মে 3, 2024কভিড-১৯ আমাদের শিখিয়েছিল কেন বাংলাদেশে সশরীরে পাঠদানের সঙ্গে সঙ্গে অনলাইন শিক্ষার একটি দৃঢ় পরিকাঠামো গড়ে তোলা প্রয়োজন। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর শিক্ষাব্যবস্থা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কভিড-১৯-এর বিধ্বংসী প্রভাবে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত হলেও উন্নত দেশগুলো শিক্ষার সমস্ত স্তরে অনলাইনভিত্তিক শিক্ষণ পরিচালনার জন্য একটি শক্তিশালী পরিকাঠামো থাকায় এর প্রভাব কাটিয়ে উঠতে সমর্থ হয়েছিল। বর্তমানে বাংলাদেশে চলমান ক্রমাগত দাবদাহ আমাদের আবারও দ্বিধায় ফেলেছে এই জন্য যে শিক্ষার্থীদের তাপপ্রবাহের হাত থেকে বাঁচাতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর অনলাইনে শিক্ষাদান করা উচিত কি না?
চলমান তাপপ্রবাহের নেতিবাচক প্রভাব বিবেচনা করে বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইনে তাদের শিক্ষাদান কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অন্যদিকে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় সশরীরে পাঠদানের পাশাপাশি অনলাইনে পাঠদান চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে এক সপ্তাহের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে শিক্ষার্থীরা যে ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে, তা বিবেচনা করে মন্ত্রণালয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খোলার এবং শারীরিক ক্লাস পুনরায় শুরু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যথাযথ পরিকাঠামোর অভাব, অ্যানড্রয়েড ফোন ও ল্যাপটপের অভাব, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট সেবার ঘাটতি এবং অভিভাবকদের ইন্টারনেটের ব্যয় বহন করার সামর্থ্য না থাকায় প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে অনলাইনে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা মন্ত্রণালয়ের জন্য কঠিন। বাংলাদেশের মতো দেশের প্রেক্ষাপটে এই সমস্যাগুলো নিষ্ঠুর বাস্তবতা।
ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় সরকারের প্রচেষ্টা সত্ত্বেও বাস্তবতা হলো, আমরা এখনো ডিজিটাল বাংলাদেশের সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে পিছিয়ে রয়েছি। এরই মধ্যে বাংলাদেশ সরকার বেশির ভাগ পরিষেবা বিতরণ ব্যবস্থায় ই-গভর্ন্যান্স চালু করেছে এবং স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। তবে পরিষেবা প্রদানকারী এবং পরিষেবা গ্রহণকারীদের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে আমরা পিছিয়ে রয়েছি। অতএব নীতিনির্ধারকদের পক্ষে অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতিতে অনলাইনে শিক্ষার রূপান্তর করার সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে।
আমাদের মনে রাখতে হবে যে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বিশ্বের প্রায় সব দেশকে প্রভাবিত করেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অগ্রিম পূর্বাভাস ছাড়াই আমরা শীত ও গ্রীষ্মে চরম ঠাণ্ডা এবং গরম অনুভব করছি। এই বাস্তবতায় চরম আবহাওয়ার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য নিজেদের প্রস্তুত করতে হবে। আবহাওয়ার চরম অবস্থা থেকে শারীরিকভাবে নিরাপদ রাখাই যথেষ্ট নয়, আমাদের দৈনন্দিন জীবন এবং শিক্ষা ব্যবস্থা অব্যাহত রাখতে হবে। তা না হলে আমরা অন্যদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারব না।
আমাদের মনে রাখতে হবে যে আগামী দিনে আমাদের আরো কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে। তাই পরিবর্তিত পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে হাইব্রিড শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করার দিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অবিলম্বে নজর দেওয়া উচিত। হাইব্রিড শিক্ষাপদ্ধতি হলো এমন একটি শিক্ষাপদ্ধতি, যেখানে সরাসরি শিক্ষা কার্যক্রমের সঙ্গে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা। আমরা জানি যে বাংলাদেশে প্রায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সশরীরে পাঠদান করা হয়। ফলে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার রূপান্তরের জন্য প্রথমে অনলাইন শিক্ষার উপযোগী পরিকাঠামো তৈরি করতে হবে এবং তারপর শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের নতুন পরিবর্তিত পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করার ক্ষেত্রে মোবাইল ফোন বা ল্যাপটপ ও ইন্টারনেটের খরচ বহন করতে না পারা দরিদ্র শিক্ষার্থীদের বিষয়টি অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে বিবেচনা করা দরকার। কভিড-১৯-এর সময় সরকারের পক্ষ থেকে দরিদ্র শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন ধরনের সহায়তা প্রদান করা হয়েছিল। সেই সহায়তার পরিমাণ বাড়াতে হবে।
পরিকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষকদের একটি বড় অংশ রয়েছে, যাদের কম্পিউটার সাক্ষরতা নেই। তাই তারা অনলাইন ক্লাস পছন্দ করে না। অন্যদিকে দুর্বল ইন্টারনেট সংযোগ এবং নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ না থাকার কারণে অনেক শিক্ষার্থী অনলাইন ক্লাস চালিয়ে যেতে পারে না। সুতরাং ইন্টার্যাক্টিভ শিক্ষাদান নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে পড়েছে। তা ছাড়া অনলাইনে তত্ত্বীয় কোর্সের পাঠদান করা সম্ভব হলেও প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষার ক্ষেত্রে সশরীরে উপস্থিত হয়ে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করার সুযোগ রাখা আবশ্যক।
কভিডের সময়ের অনলাইন পাঠদানের অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, গ্রামে অবস্থান করা শিক্ষার্থীদের জন্য অনলাইনে ক্লাসে অংশগ্রহণ করা বেশ কষ্টকর ছিল। অনেক শিক্ষার্থীর অ্যানড্রয়েড ফোন বা ল্যাপটপ নেই। আবার অনেক ক্ষেত্রে শুধু অংশগ্রহণের জন্যই অনেকে অনলাইন ক্লাসে অংশগ্রহণ করত। এই বিষয়গুলোর অভিজ্ঞতাকে মাথায় রেখে শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে স্বল্প মূল্যে ইন্টারনেট সেবা প্রদান করা এবং যাদের অ্যানড্রয়েড ফোন বা ল্যাপটপ কেনার সামর্থ্য নেই, তাদের আর্থিক সহায়তা প্রদান করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
আমাদের মনে রাখতে হবে যে কভিড-১৯-এর সময় বেশির ভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় যথাযথভাবে অনলাইনে শিক্ষাদান করতে সক্ষম হয়েছিল বিধায় তারা শিক্ষার্থীদের সেশন জ্যাম থেকে বাঁচাতে সক্ষম হয়েছিল। কভিড-১৯-পরবর্তী পরিস্থিতিতে অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সশরীরে এবং অনলাইন ক্লাসের সংমিশ্রণে হাইব্রিড শিক্ষা ব্যবস্থা চালিয়ে গেছে, যার ফলে তাদের শিক্ষার্থীরা নির্বিঘ্নে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। আমাদের মনে রাখতে হবে যে যেহেতু অনলাইনে পাঠদান আমাদের দেশের ক্ষেত্রে নতুন একটি অভিজ্ঞতা, সেহেতু এই পদ্ধতিতে পাঠদান করার মাধ্যমে সম্পূর্ণ পরিতৃপ্তি পেতে কিছুটা হলেও সময় লাগবে। ফলে আমাদের চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।
পরিশেষে আবহাওয়ার বৈরিতা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বিবেচনা করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে স্বাভাবিক দিনগুলোতেও সশরীরে এবং অনলাইনে পাঠদানের বিষয়টিকে একত্র করে হাইব্রিড শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তনের গুরুত্ব বুঝতে হবে। কভিড-পরবর্তী সময়ে পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশ এই পদ্ধতিতে শিক্ষা কার্যক্রম এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এই ধরনের রূপান্তর আমাদের শিক্ষাকে কেবল তার গতি বজায় রাখতে সহায়তা করবে না, বরং যেকোনো পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে এবং অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতির মোকাবেলা করতেও সহায়তা করবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একার পক্ষে এই রূপান্তর নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না। শিক্ষাক্ষেত্রে জড়িত স্টেকহোল্ডারদের কাছ থেকে আন্তরিক সমর্থন প্রয়োজন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের। আমাদের মনে রাখতে হবে, বিভিন্ন ধরনের পরিবর্তিত পরিস্থিতিকে মোকাবেলা করে এগিয়ে যেতে হলে হাইব্রিড শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করা ছাড়া আমাদের কাছে আর কোনো বিকল্প নেই।
লেখক: ড. প্রণব কুমার পাণ্ডে; রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক
সৌজন্যেঃ কালের কণ্ঠ