379
Published on এপ্রিল 17, 2024বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে একটি অবিস্মরণীয় দিন ১৭ এপ্রিল। ১৯৭১ সালের এই দিনে বর্তমান মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথতলায় বাংলাদেশের প্রথম সরকার শপথ গ্রহণ করে। সংক্ষিপ্ত এই অনুষ্ঠানে দেশি-বিদেশি অর্ধশতাধিক সাংবাদিক উপস্থিত ছিলেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবর্তমানে যুদ্ধকালীন এই সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবে সৈয়দ নজরুল ইসলাম গার্ড অব অনার গ্রহণ করেন।
বৈদ্যনাথতলাকে মুজিবনগর নামকরণ করেন তাজউদ্দীন আহমদ। এই ঐতিহাসিক কর্মকাণ্ডে সহায়তা করেছিলেন স্থানীয় একটি গির্জার কর্মীরা। যেখানে দর্শকরা বসেছিলেন, বসার সেই টুলও গির্জা থেকে আনা হয়েছিল। সেদিন শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান শেষ হয়েছিল ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে।
শপথবাক্য পাঠের সময় উড়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। সংক্ষিপ্ত অথচ এই ঐতিহাসিক কর্মসূচি চলাকালে অনুষ্ঠানস্থলের নিরাপত্তার বিধান করেছিল স্থানীয় জনগণ ও গোলক মজুমদারের নির্দেশে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী।
মুজিবনগরের আম্রকাননে উপস্থিত অনেকের স্মৃতিকথা থেকে জানা যায়, সেদিন সকাল ১১টা ১০ মিনিটে শীর্ষ নেতারা দৃপ্ত পদক্ষেপে মঞ্চের দিকে এলে দেশ স্বাধীন করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ সমবেত সংগ্রামী জনতা ‘জয় বাংলা’ জয়ধ্বনি দেয়। মুজিবনগরে শপথ অনুষ্ঠানস্থলে একটি ছোট্ট মঞ্চ স্থাপন করা হয়েছিল।
ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রথমে মঞ্চে ওঠেন। ঝিনাইদহের তৎকালীন এসডিপিও মাহবুব উদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি সশস্ত্র দল ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপ্রধানকে ‘গার্ড অব অনার’ প্রদান করে। এরপর মঞ্চে আসেন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরা এবং প্রধান সেনাপতি কর্নেল ওসমানী। উপস্থিত স্বেচ্ছাসেবকরা ফুলের পাপড়ি ছিটিয়ে নেতাদের বরণ করে নেন।
সরকারের মুখপত্র জয় বাংলা পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি আবদুল মান্নান এমসিএর উপস্থাপনায় শপথ অনুষ্ঠান শুরু হয়।
প্রথমেই নতুন রাষ্ট্রের ঐতিহাসিক দলিল ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ পাঠ করেন চিফ হুইপ অধ্যাপক ইউসুফ আলী। অনুষ্ঠানের সূচনায় পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরআন তিলাওয়াত, গীতা ও বাইবেল পাঠ করা হয়।
অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ দিনস্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের সঙ্গে সঙ্গে বাংলা মায়ের চার বীর সন্তান প্রাণ ঢেলে গাইলেন জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’। উপস্থিত সবাই তাঁদের সঙ্গে কণ্ঠ মেলালেন। অপূর্ব এক ভাবগম্ভীর পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছিল তখন। ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিপরিষদের সদস্যদের পরিচয় করিয়ে দেন। তারপর ঘোষণা করেন প্রধান সেনাপতি পদে কর্নেল ওসমানী এবং সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ পদে কর্নেল আবদুর রবের নাম।
ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম তাঁর আবেগময় ভাষণের শেষে দৃপ্তকণ্ঠে আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, ‘আমাদের রাষ্ট্রপতি জনগণনন্দিত ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ নির্যাতিত মানুষের মূর্ত প্রতীক শেখ মুজিব বাংলার মানুষের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারের জন্য সংগ্রাম করে আজ বন্দি। তাঁর নেতৃত্বে আমাদের স্বাধীনতাসংগ্রাম জয়ী হবেই।’ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথগ্রহণের পর তাজউদ্দীন আহমদ অভূতপূর্ব ও অবিস্মরণীয় বক্তৃতায় বলেন, ‘পাকিস্তান আজ মৃত এবং অসংখ্য আদম সন্তানের লাশের তলায় তার কবর রচিত হয়েছে। পূর্বপরিকল্পিত গণহত্যায় মত্ত হয়ে ওঠার আগে ইয়াহিয়ার ভাবা উচিত ছিল তিনি নিজেই পাকিস্তানের কবর রচনা করছেন।’ মুক্তিযুদ্ধের সার্বিক পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে বক্তৃতার শেষে তিনি বলেন, ‘আমাদের এই অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে আমরা কামনা করি বিশ্বের প্রতিটি ছোট-বড় জাতির বন্ধুত্ব। বিশ্ববাসীর কাছে আমরা আমাদের বক্তব্য পেশ করলাম। বিশ্বের আর কোনো জাতি আমাদের চেয়ে স্বীকৃতির বেশি দাবিদার হতে পারে না। কেননা আর কোনো জাতি আমাদের চেয়ে কঠোরতর সংগ্রাম করেনি, অধিকতর সংগ্রাম করেনি। জয় বাংলা।’
একটি সরকার সম্পূর্ণ বৈধতা পায়, যখন সেই সরকার সংবিধান অনুযায়ী শপথ গ্রহণ করে। ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপ্রধান ও প্রধানমন্ত্রী উভয়েই তৎকালীন বাস্তবতায় যা বলার প্রয়োজন ছিল, তা-ই তাঁরা বলেন। শীর্ষ দুই নেতার এই দিকনির্দেশনামূলক ভাষণ ছিল ঐতিহাসিক এবং অনন্য। পাবনার জেলা প্রশাসক নুরুল কাদের খান, মেহেরপুরের মহকুমা প্রশাসক তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী, রাজনৈতিক নেতা, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সাংবাদিকসহ আরো অনেকেই সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের এই শপথ অনুষ্ঠান ছিল এক অনন্যসাধারণ ঘটনা। শপথ অনুষ্ঠানের বিবরণ পাওয়া যায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখায়। তাঁর ‘পূর্ব-পশ্চিম’ গ্রন্থের ৮৫ থেকে ৮৭ পৃষ্ঠায় সেদিনের বিবরণ আছে এভাবে, “...গাড়িগুলি শেষ পর্যন্ত এসে থামল একটি বিশাল আম বাগানের মধ্যে। এই গ্রামটির নাম বৈদ্যনাথতলা, জেলা কুষ্টিয়া, মহকুমা মেহেরপুর। কিছু লোক সেখানে দৌড়াদৌড়ি করে চেয়ার সাজাচ্ছে, অধিকাংশই হাতল-ভাঙা চেয়ার, কাছাকাছি গ্রামের বাড়িগুলো থেকে জোগাড় করে আনা হয়। জায়গাটিকে ঘিরে রাইফেল-এলএমজি হাতে পজিশন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বিশ-পঁচিশজন সৈন্য, তাদের ঠিক মুক্তিবাহিনীর ছেলে বলে মনে হয় না, খুব সম্ভবত প্রাক্তন ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলের একটি বিদ্রোহী-বাহিনী।
আশপাশের গ্রাম থেকে ধেয়ে এসেছে বিপুল জনতা। অস্ত্রধারী সেনাদের বৃত্ত ভেদ করে তারা হুড়মুড় করে ভেতরে ঢুকে পড়তে পারছে না বলে অনেকেই আম গাছগুলোতে চড়তে শুরু করেছে।
অনুষ্ঠান শুরু হল এগারটার পর। সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ সবাই এসে গেছেন। তবে যার উপস্থিতি সবচেয়ে বেশি প্রয়োজনীয় ছিল তিনি নেই, তিনি আসবেন না। শেখ মুজিব যে কোথায় আছেন তা এখনো জানা যায়নি। তবু অনুপস্থিত শেখ মুজিবুর রহমানের নাম ঘোষণা করা হলো রাষ্ট্রপতি হিসেবে। সৈয়দ নজরুল ইসলাম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ। মন্ত্রিসভার অন্য তিনজন সদস্য হলেন খোন্দকার মোশতাক আহমদ, এইচ এম কামরুজ্জামান এবং এম মনসুর আলী। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কমান্ডার ইন চীফ নিযুক্ত হলেন অবসরপ্রাপ্ত কর্ণেল ওসমানী।
এর সাতদিন আগেই কলকাতার থিয়েটার রোডের অস্থায়ী ‘মুজিবনগর’ সরকার থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সনদ ঘোষণা করা হয়েছিল। আজ ১৭ এপ্রিল (১৯৭১) বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হলো স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার। ঐতিহাসিক দলিলটি পাঠ করলেন চীফ হুইপ ইউসুফ আলী।”
মুজিবনগর সরকারের যোগ্য নেতৃত্ব, সঠিক দিকনির্দেশনা ও রণকৌশল মুক্তিযুদ্ধকে সফল পরিসমাপ্তির দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। মহান মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাসহ বিশ্বদরবারে সদ্যঃস্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে জনমত সৃষ্টি, শরণার্থীদের ব্যবস্থাপনা, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশবাসীর পাশে দাঁড়ানোসহ মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকার পরিচালনায় এই সরকার সার্বিক দায়িত্ব পালন করে।
এর আগে ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল সমবেত জনপ্রতিনিধিরা সর্বসম্মতিক্রমে মুক্তিযুদ্ধ ও সরকার পরিচালনার জন্য একটি মন্ত্রিসভা গঠন করেন।
তখন বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিক্ষিপ্তভাবে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করে যাচ্ছিলেন। কিন্তু তাঁদের কোনো কমান্ডকাঠামো না থাকায় যুদ্ধ চালাতে বেশ অসুবিধাই হচ্ছিল। বিশ্ববাসীর কাছে এটি প্রমাণ করার প্রয়োজন ছিল যে বাংলাদেশে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা একটি বৈধ সরকার গঠন করেছেন; কারণ সেই সময় নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ছাড়া অন্য কারো সরকার গঠন করার সুযোগ ছিল না।
জনপ্রতিনিধিদের ইচ্ছার শতভাগ প্রতিফলন ঘটিয়ে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ন রেখে, রাজনৈতিক বৈধতা অর্জন করে সেদিন ‘প্রবাসী সরকার’ শপথ নিয়েছিল। আর এসব কিছুর বৈধ ভিত্তি ছিল ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’। পরে ৩০ লাখ মানুষের রক্তস্নাত আত্মদান ও চার লক্ষাধিক মা-বোনের আত্মত্যাগে জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের সার্বিক সাফল্য নিশ্চিত হয়েছিল এই দিনটিতেই। মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নে তথা ১৯৭১ সালের এপ্রিলের ১০ ও ১৭ তারিখে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র ও সরকারের প্রধানতম লক্ষ্য ছিল সাংবিধানিকভাবে রাজনৈতিক বৈধতা নিশ্চিত করে মুক্তিযুদ্ধ তথা জনযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশকে শত্রুমুক্ত করে সুমহান বিজয় ছিনিয়ে আনা। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এই দিনের গুরুত্ব অপরিসীম।
লেখক : এম নজরুল ইসলাম, সর্ব-ইউরোপিয়ান আওয়ামী লীগের সভাপতি
সৌজন্যেঃ কালের কণ্ঠ