394
Published on মার্চ 17, 2024বাংলাদেশের জনগণ যখন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন পালন করছে তখন সকলের উচিত তাঁর দর্শনকে আমাদের বাস্তব জীবনে মেনে চলা। তাঁর অদম্য চেতনা, স্বাধীনতার প্রতি অটল প্রতিশ্রুতি এবং দূরদর্শী নেতৃত্ব কেবল বাংলাদেশের জন্মই দেয় নি, দেশের শাসন ব্যবস্থার দর্শনের ভিত্তিও স্থাপন করেছিল।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কেবল একজন রাজনৈতিক নেতা ছিলেন না; তিনি স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের জন্য বাংলাদেশের জনগণের আকাঙ্ক্ষার মূর্ত প্রতীক ছিলেন। ১৯২০ সালের ১৭ই মার্চ অবিভক্ত বাংলার গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া নামে একটি ছোট গ্রামে জন্মগ্রহণ করা বঙ্গবন্ধু নিপীড়ন ও শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রামে এক মহান ব্যক্তিত্ব হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন।
একটি দেশের জাতির পিতা হওয়ার কাজ খুব সহজ নয়। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জাতির পিতা হওয়ার পথে তাঁর যাত্রা সহনশীলতা, ত্যাগ এবং দেশবাসীর কল্যাণে তাঁর অটল নিবেদনের দ্বারা চিহ্নিত হয়েছিল। খেলাফত আন্দোলনে তাঁর প্রাথমিক অংশগ্রহণ থেকে শুরু করে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্বের ভূমিকা পর্যন্ত গণতন্ত্র ও সমতার নীতির প্রতি তাঁর অঙ্গীকার অটুট ছিল।
তবে, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের দিকে অগ্রসর হওয়া অশান্ত সময়েই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সত্যিকার অর্থে তাঁর অসাধারণ নেতৃত্বের গুণাবলী প্রদর্শন করেছিলেন। পাকিস্তানি শাসনের নৃশংস দমন-পীড়ন ও ব্যাপক নৃশংসতার মুখে তিনি বাঙালি জনগণের কণ্ঠস্বর হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন, এবং স্বায়ত্তশাসন ও মর্যাদার জন্য তাদের দাবি তুলে ধরেন।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু যে ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন, তা লক্ষ লক্ষ বাংলাদেশিকে দেশের স্বাধীনতার জন্য যে কোন যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য অনুপ্রাণিত করেছিল। তাঁর আবেগপূর্ণ ভাষণে তিনি ঘোষণা করেছিলেন, "এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম"।
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত হিসেবে স্বীকৃত, যেটিকে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের আনুষ্ঠানিক সূচনা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। রেডিওতে সম্প্রচারিত এক আলোড়ন সৃষ্টিকারী বার্তায় বঙ্গবন্ধু সার্বভৌম ও স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মের কথা ঘোষণা করেন এবং পাকিস্তানি শাসনের নিপীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানান।
তাঁর কথাগুলি, তৎপরতা ও দৃঢ় সংকল্পের অনুভূতিতে অনুপ্রাণিত হয়ে, লক্ষ লক্ষ বাংলাদেশিকে স্বাধীনতার পক্ষে একত্রিত করে, তাদের অধিকার ও মর্যাদার লড়াইয়ে যোগ দিতে অনুপ্রাণিত করে। গুরুতর ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তার মুখে দেওয়া এই ঘোষণাপত্রে গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার ও আত্মনিয়ন্ত্রণের আদর্শের প্রতি বঙ্গবন্ধুর অটল অঙ্গীকারের প্রতিফলন ঘটে, যা নয় মাসব্যাপী স্বাধীনতা যুদ্ধের মঞ্চ তৈরি করেছিল যা শেষ পর্যন্ত স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মের দিকে নিয়ে যায়।
গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের নীতির উপর ভিত্তি করে একটি স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি সর্বস্তরের মানুষকে স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দিতে অনুপ্রাণিত করেছিল। কারাবাস ও নিপীড়নের সম্মুখীন হওয়া সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু তাঁর সংকল্পে অটল ছিলেন। স্বাধীনতার প্রতি তাঁর প্রতিশ্রুতি থেকে তিনি কখনও বিচ্যুত হন নি।
তাঁর অক্লান্ত প্রচেষ্টার সমাপ্তি ঘটে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর, যখন নয় মাসব্যাপী সশস্ত্র যুদ্ধের পর বাংলাদেশ বিশ্ব মানচিত্রে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে অগণিত বাংলাদেশিদের আত্মত্যাগের ফল অবশেষে পাওয়া যায়।
তবে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের মধ্য দিয়ে তাঁর অবদান শেষ হয় নি। বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি এবং পরে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে তিনি যুদ্ধবিধ্বস্ত জাতিকে পুনর্নির্মাণ এবং একটি প্রগতিশীল ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজের ভিত্তি স্থাপনের লক্ষ্যে একটি মিশন নিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন।
জনগণের ক্ষমতার প্রতি অটল বিশ্বাস ছিল বঙ্গবন্ধুর শাসন দর্শনের কেন্দ্রবিন্দু। তিনি শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং অর্থনৈতিক সুযোগের মাধ্যমে জনসাধারণের ক্ষমতায়ন করতে চেয়েছিলেন। তিনি মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন যে যে সত্যিকারের অগ্রগতি কেবলমাত্র সমাজের সবচেয়ে প্রান্তিক অংশের উন্নতির মাধ্যমেই অর্জন করা যেতে পারে।
স্বাধীনতার পরে দেশের ফিরে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে বাংলাদেশের জন্য তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছিলেন বঙ্গবন্ধু, যেখানে তিনি নতুন স্বাধীন জাতির অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন কর্মসূচির রূপরেখা দিয়েছিলেন। তিনি বৃহত্তর বিকেন্দ্রীকরণ, সম্পদের ন্যায়সঙ্গত বন্টন এবং মৌলিক অধিকার সুরক্ষার মাধ্যমে বাংলাদেশের উন্নয়নের গতিপথের ভিত্তি স্থাপন করেছিল।
তাছাড়া, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শিশুদের অধিকারের জন্য একজন দৃঢ় প্রবক্তা ছিলেন। তিনি শিশুদের জাতির ভবিষ্যতের রক্ষক হিসাবে দেখতেন। তাঁর সরকার শিশুদের অন্তর্নিহিত সম্ভাবনা এবং এটিকে লালনপালনের প্রয়োজনীয়তাকে স্বীকৃতি দিয়ে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং সমাজকল্যাণ কর্মসূচিগুলিকে অগ্রাধিকার দেওয়ার জন্য উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নিয়েছিল।
এভাবে, শিশুদের প্রতি বঙ্গবন্ধুর ভালোবাসার কথা বিবেচনা করে শেখ হাসিনা সরকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিনকে বাংলাদেশের ‘জাতীয় শিশু দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা দেয়। এই সিদ্ধান্তটি বঙ্গবন্ধুর চিরস্থায়ী উত্তরাধিকার, বিশেষত দেশের শিশুদের কল্যাণ ও ভবিষ্যতের প্রতি তাঁর অটল নিবেদনের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও প্রশংসার ইঙ্গিত দেয়। এইভাবে তাঁর জন্মদিন উদযাপন করে সরকার কেবল জাতির পিতার প্রতি শ্রদ্ধাই জানায় না, বাংলাদেশের ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি ও সম্ভাবনার প্রতিনিধিত্বকারী যুবকদের লালন-পালন ও ক্ষমতায়নের প্রতিশ্রুতিও পুনর্ব্যক্ত করে। এই উদ্যোগটি শেখ হাসিনার একটি সমৃদ্ধ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনের দৃষ্টিভঙ্গির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ যেখানে প্রতিটি শিশুর উন্নতি ও জাতির অগ্রগতিতে অবদান রাখার সুযোগ রয়েছে।
জাতীয় শিশু দিবসে আমাদের সকলের উচিত বঙ্গবন্ধুর চিরস্থায়ী উত্তরাধিকার এবং নীতিগুলি স্মরণ করা। তাঁর জীবন দর্শন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আশা ও অনুপ্রেরণার আলোকবর্তিকা হিসাবে কাজ করে, যা আমাদের সাহস, সহনশীলতা এবং স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচারের আদর্শের প্রতি অটল প্রতিশ্রুতির কথা মনে করিয়ে দেয়।
যেহেতু বাংলাদেশ অগ্রগতি ও উন্নয়নের যাত্রা অব্যাহত রেখেছে, আসুন আমরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে শক্তি অর্জন করি এবং এমন একটি জাতি গঠনে নিজেকে পুনরায় উৎসর্গ করি যা দেশের সকল নাগরিক, বিশেষত শিশুদে, মর্যাদা ও অধিকারকে সমর্থন করে। তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আমরা বাংলাদেশের জনগণ তাঁর অদম্য চেতনার প্রতি শ্রদ্ধা জানাই এবং যে আদর্শের জন্য তিনি জীবন উৎসর্গ করেছিলেন তার প্রতি আমাদের সম্মিলিত প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করি।
লেখক : ড. প্রণব কুমার পান্ডে; রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের প্রফেসর