614
Published on ফেব্রুয়ারি 8, 2024বাংলাদেশে রাজনৈতিক গুজব নতুন কিছু নয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন প্রথম বাংলাদেশ পরিচালনা শুরু করে তখনও যেমন মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী শক্তির গুজব ছিলো, তা আজও একইভাবে রয়ে গেছে। তবে ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সেই গুজব নতুন এক মাত্রা পেয়েছে। আর এই গুজব লাগাম ছাড়া অবস্থায় পৌঁছে গেছে বিশ্বের জনপ্রিয় ভিডিও প্লাটফর্ম ইউটিউবে।
গত ৭ জানুয়ারি হয়ে হয়ে যাওয়া দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিগত মাসগুলোতে এর মাত্র আরও বেড়েছে। নির্বাচনের পরও তা থামেনি। এই ভিডিওগুলোর প্রধান টার্গেট নবগঠিত আওয়ামী লীগ সরকার, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যরা। জনপ্রিয় ভিডিও শেয়ারিং প্ল্যাটফর্ম ইউটিউবে শতাধিক এমন গুজব নির্ভর চ্যানেল দেখা গেছে। যদিও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এবং তার চরমপন্থী মিত্র জামায়াত-ই-ইসলামির (জেআই) মতো বিরোধী দলগুলির সাথে এই ভিডিওগুলিকে সরাসরি সম্পর্ক উদ্ধার করা যাবে না। তবে ভিডিওগুলোর বিষয়বস্তু, লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্যগুলো দেখে বোঝাই যায়, আসলে এই ধরনের অপতৎপরতার উৎস কোথায়।
সম্প্রতি আওয়াপন্থী অ্যাক্টিভিস্ট শাহ আলী ফরহাদ এ ধরনের গুজবের ভিডিওর বেশ কয়েকটি পোস্টের স্ক্রিনশট সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে পোস্ট করেছেন। এসব ভিডিও বিশ্লেষণ করে দেখা যায় ভিডিওগুলো সবগুলোই সরকার ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বেকায়দায় ফেলতে তৈরি করা হয়েছে।
এসব ভিডিওর মূল বিষয়গুলোকে মোটা দাগে ভাগ করলে যা মেলে তা হলো- বাংলাদেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা, সহিংসতার বিভ্রান্তিকর তথ্য, সামরিক অভ্যত্থান বা ক্যু, সরকার পতন, খালেদা জিয়ার মৃত্যু এবং বিএনপি নেতাদের মুক্তি। তবে প্রতিটি ভিডিওতেও আক্রমণ করা হয়েছে আওয়ামী লীগ ও তার সভপতি শেখ হাসিনাকে। মূলত বর্ণনামূলক এই ভিডিওতে দেখা যায় কোন এক ব্যক্তি বা একাধিক ব্যক্তি কোন একটা সত্য ঘটনাকে অবলম্বন করে তার মতো করে মিথ্যার ডানা মেলতে থাকে এবং নিজের মন গড়া বিভিন্ন যুক্তি উপস্থাপন করতে থাকে। তবে উপস্থাপন করা ব্যক্তিদের বাচনভঙ্গি থাকে বেশ আকর্ষণীয়। অনেকটা ফুটপাথে পণ্য বিক্রির জন্য ক্রেতাকে আকৃষ্ট করা জন্য। প্রতিটি ভিডিওতে থাকা ব্যক্তিদের নাম ও পরিচয় সাধারণ মানুষ না জানলেও তারা প্রত্যেকেই নিজেদের বিশেষজ্ঞ, সাংবাদিক বা মানবাধিকার কর্মী হিসেবে পরিচয় দিতে পছন্দ করেন। এই ভিডিওগুলোর প্রতিটিতেই উদ্ভোট এবং আকর্ষণীয় মিথ্যায় ভরা থাম্বনিল ব্যবহার করা হয়। যা দেখে মানুষ আকৃষ্ট হয়ে ভিডিওগুলোতে ক্লিক করেন।
ইউটিউব ঘুরে এমন বেশ কিছু ভিডিও আমরা দেখেছি যা এক নজরে পাঠকদের সামনে তুলে ধরা হলো-
'বাংলাদেশের ওপর আসছে নিষেধাজ্ঞা'
এ ধরণের ভিডিওগুলোতে বলা হচ্ছে শিগগিরই নবগঠিত আওয়ামী লীগ সরকারের ওপর বা বাংলাদেশের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা আসছে। কখনও এ ধরণের ভিডিওগুলোতে ভিসা নিষেধাজ্ঞার কথা বলা হয়, কখনও বা অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা। ভিডিওগুলোতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার পশ্চিমা মিত্র দেশগুলোর নাম ব্যবহার করা হচ্ছে। আর বেশিরভাগ ভিডিওর থাম্বনেইল ব্যবহার করা হচ্ছে ঢাকাস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের ছবি। হেডিংয়েও তাঁর নাম ব্যবহার করা হচ্ছে। যদিও এই ধরণের প্রোপাগান্ডার বিরুদ্ধে কখনই মন্তব্য করেনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা তার ঢাকাস্থ দূতাবাস। এমন সব ভিডিওর শিরোনাম হিসেবে থাকে 'নিষেধাজ্ঞা আসছে, প্রধানমন্ত্রী ভীত, সেনাপ্রধান পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন' (https://youtu.be/OjYAx6agV54), 'প্রধানমন্ত্রীর পালানোর গোপন পরিকল্পনা ফাঁস, নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা শুরু' ( https://youtu.be/8vONDjyPUbQ ), 'ভিসা নিষেধাজ্ঞার চিঠি পিটার হাসের হাতে: ক্ষুব্ধ ওবায়দুল কাদের' (https://www.youtube.com/watch?v=xJXy5cbqnZk ), 'পাপ বাপকেও ছাড়ে না: ক্ষমতার দাপট শেষ' ( https://youtu.be/cgEJZYY3m_I ), 'অবশেষে শেখ হাসিনাকে চিঠি দিল বাইডেন, বড় দুঃসংবাদ পেল আওয়ামী লীগ' ( https://youtu.be/jX3zUobdYeQ?si=C1ltJQCKfzpDhZef ), 'নিষেধাজ্ঞা নিয়ে পিটার হাস এ কি বললেন' ( https://youtu.be/xG5eRT7dpj8?si=Qpd4mKYjzr8Vljzj )
মূলত বর্তমান সরকারের সঙ্গে একত্রে কাজ করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করে প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে লেখা মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের চিঠিকে কেন্দ্র করে এই গুজব ছড়ানো হয়।
সহিংসতার বিভ্রান্তিকর তথ্য
নির্বাচনের আগে ও পরে সরকার বিরোধী গুজবের ভিডিও কনটেন্টের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সহিংসতা বিভ্রান্তিকর সব তথ্য ছড়িয়ে দেয়া। এগুলোতে বলা হয়, বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামীর মতো দলগুলো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সদস্যদের মারধর করে সফল আন্দোলনের মাধ্যমে বাংলাদেশের রাজপথের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। ভিডিওগুলোতে আরও বলা হয়, আওয়ামী লীগ রাজপথ দখলে ব্যাকফুটে রয়েছে। 'পুলিশকে ব্যাপক পেটাল বিএনপি জামায়াত' ( www.youtube.com/watch?v=gJDnNV_PJPg)
সামরিক অভ্যত্থান বা ক্যু
২০২১ সাল থেকেই বারবার সামরিক অভ্যুত্থানের কথা প্রচার করে এসেছে এই গুজবকারীরা। নির্বাচন পরবর্তী সময়ে গুজবের ভিডিওতে সেনা অভ্যুত্থানের বিষয়টিকেও বার বার তুলে ধরা হচ্ছে। অনেকেই বলেছেন শান্তিরক্ষা মিশনের ওপর নিষেধাজ্ঞার হুমকির কথা। আর এ কারণেই সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করে নিয়েছেন বলে বর্ণনা করা হয় ভীডিওতে। এমনই দুটি ভিডিও হলো 'ক্ষমতা দখলে সেনাবাহিনী' ( https://youtu.be/9rbIlx4P1oo ), ব্রেকিংনিউজ।২মাসের মধ্যেই বিদাই নিবে ডামি সরকার। সেনাবাহীনির নেতৃত্বে হবে গনঅভ্যুত্থান ( https://www.youtube.com/watch?v=Zjgw6BAYGfo )
সরকার পতন
গুজব সংশ্লিষ্ট ভিডিওতে যে আরেকটি বিষয় দেখানো হচ্ছে তা হলো সরকারের পতন হয়ে গেছে বা কয়েক সপ্তাহের মধ্যে হয়ে যাবে এমন সব বক্তব্য দিয়ে ভিডিও। ভিডিওগুলোতে বলা হচ্ছে, আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটতে চলেছে। বিএনপি-জামায়াত ও জোটের কঠোর আন্দোলনের মুখে সংসদ ভেঙে দিয়ে সরকার তা করতে বাধ্য হচ্ছে। 'হঠাৎ দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাবে সরকার' ( https://youtu.be/75vijSK5VyI?si=qawnFXvOny8RUBNU), মন্ত্রী-এমপিরা দেশের বাহিরে যেতে ছুটছে ভিসার জন্য ( https://www.youtube.com/watch?v=JfcSTtcMAwo ) এমন আরও অনেকগুলো ভিডিও ঘুরে বেড়াচ্ছে ইউটিউবে। যেখানে কোন তথ্যসূত্র নেই, কিন্তু আছে সরকারের পদত্যাগের নিশ্চয়তা। যেই নিশ্চয়তা বিএনপি ও সমমনা দলগুলো ২০০৯ সাল থেকে দিয়ে আসলেও এবারের নির্বাচন শেষেও বাংলাদেশের ক্ষমতায় রয়েছে আওয়ামী লীগ।
খালেদা জিয়ার মৃত্যু
এই গুজব নির্ভর ইউটিউব চ্যানেলগুলো দেখলে আরও একবার স্পষ্ট বোঝা যায়, খালেদা জিয়ার মৃত্যু বিরোধী দলগুলো বিশেষত বিএনপির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দলটির অনেক নেতাকর্মী মনে করেন খালেদা জিয়ার মৃত্যুর মাধ্যমে দলটি ক্ষমতায় আসবে গণ আন্দোলনের মাধ্যমে। যদিও পরিসংখ্যান তেমনটি বলছে না। তারপরও গুজব নির্ভর এই ইউটিউব চ্যানেলগুলো থেকে প্রায়ই খালেদা জিয়া মারা যাওয়ার গুজব প্রচার করা হয়েছে। এখনও হচ্ছে। তেমনি একটি ভিডিওতে সম্প্রতি খালেদা জিয়ার মৃত্যুর গুজব ছড়ানো হয় ( https://youtu.be/hOP3zvMCeu8?si=nEPqjYwHg_2DNSg_)
বিএনপির নেতাদের মুক্তির খবর
নির্বাচনের আগে প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলা সহ, রেল লাইন ও রেলের বগিতে সহিংসতা এবং দেশ জুড়ে অসংখ্য সহিংস তাণ্ডব চালিয়ে গ্রেফতার হওয়া বিএনপি নেতাদের মুক্তি হওয়ার বিষয়েও গুজব ছড়ানো হচ্ছে ইউটিউবের বিভিন্ন ভিডিওতে ( https://youtu.be/6qy7XGgHAbE?si=Xq3FZx-rmnxl4Unz )
যারা বাংলাদেশের রাজনীতিকে ঘনিষ্ঠভাবে অনুসরণ করেন তাদের কাছে এই ভিডিওগুলোর উদ্দেশ্য পরিষ্কার। প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর সরকারকে পদত্যাগ করতে এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে বাধ্য করার জন্য বিএনপি-জামায়াত সহিংসতা করেও ব্যর্থ। সেইসঙ্গে নতুন সরকার স্থিতিশীলতার সঙ্গে বিশ্বকে মোকাবেলা করতে শুরু করেছে। এতে বিএনপি-জামায়াতের কর্মীরা এবং মিত্ররা বেশ হতাশ। তারা তাদের আন্দোলনের কোনো ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছেন না। বিএনপির দণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক নেতা তারেক রহমান যুক্তরাজ্যে স্বেচ্ছায় নির্বাসনে জীবনযাপন করছেন। তাদের সিনিয়র নেতারা সহিংসতার মামলায় কারাগারে রয়েছেন। সেইসঙ্গে আওয়ামী লীগ সরকার স্থিতিশীল অবস্থায় রয়েছেন।
সুতরাং এটা পরিষ্কার যে, মিথ্যা ও অপতৎপরতায় ভরা এই ভিডিওগুলোর মূল উদ্দেশ্য বিএনপি-জামায়াত ও তাদের শরিক দলগুলোর কর্মী ও নেতাদের মনোবল বাড়ানো। মজার ব্যাপার হলো, যদিও স্বাধীন ফ্যাক্ট-চেকারদের ভূমিকা এখানে দেখা যাচ্ছে না। একটিও স্বনামধন্য ফ্যাক্ট-চেকার অথবা ফ্যাক্ট-চেকিং সংস্থা ইউটিউবের এইসব বিভ্রান্তিকর ভিডিওগুলির বিষয় নিয়ে কোনো কাজ করেনি। বাংলাদেশ প্রসঙ্গে বিদেশি গণমাধ্যম বা সংস্থাগুলোর ভুল বা ফ্যাক্ট চেক করতে সক্ষম হলেও ইউটিউবে হাজার হাজার ভিউ হওয়া বিভ্রান্তিকর এ সব তথ্যের ফেক্ট চেক করার জন্য এগিয়ে আসেনি দেশের কোন ফ্যাক্ট চেকিং প্রতিষ্ঠান।