735
Published on জানুয়ারি 1, 2024হীরেন পণ্ডিতঃ
২৭ ডিসেম্বর দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ : উন্নয়ন দৃশ্যমান, বাড়বে এবার কর্মসংস্থান’ স্লোগানে নিজেদের নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেছে আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের ঘোষিত ইশতেহারে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দ্রব্যমূল্য ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে নিয়ে আসা, গণতান্ত্রিক চর্চার প্রসার, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা, আর্থিক খাতে দক্ষতা বৃদ্ধি, স্বাস্থ্যসেবা সুলভ করা, আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলাসহ মোট ১১টি বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
ইশতেহারে মুদ্রা সরবরাহ ও ব্যাংকিং ব্যবস্থা নিয়ে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, মুদ্রা সরবরাহ ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের প্রধান উপায়-উপকরণ হবে নীতি সুদহার ব্যবহার। কর্মোপযোগী প্রশিক্ষিত যুবকদের আত্মকর্মসংস্থানের জন্য ঋণ সরবরাহ সম্প্রসারণ করা হবে। আমদানি ও রফতানি বাণিজ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা হবে, যা বৈদেশিক মুদ্রা সরবরাহে অনিশ্চয়তা লাঘব করবে। খেলাপি ঋণ আদায়ে কঠোর আইন প্রয়োগ এবং এক্ষেত্রে ব্যাংক যাতে বিধি নির্ধারিত সঞ্চিতি রাখে তা নিশ্চিত করা হবে।
অর্থনৈতিক উন্নয়ন বেসরকারি খাতের গুরুত্ব অব্যাহত রাখবে এবং যুক্তিসংগত ক্ষেত্রে সরকারি ও বেসরকারি খাতের যৌথ বিনিয়োগের সুযোগ ব্যবহার করবে আওয়ামী লীগ। পাশাপাশি অর্থ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ; রাষ্ট্র ও সমাজের সব স্তরে ঘুষ-দুর্নীতি উচ্ছেদ, অনুপার্জিত আয় রোধ, ঋণ-কর-বিল খেলাপি ও দুর্নীতিবাজদের বিচার ব্যবস্থার মাধ্যমে শাস্তি এবং তাদের অবৈধ অর্থ ও সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে।
দারিদ্র্য বিমোচন ও বৈষম্য হ্রাসের মাধ্যমে ২০৪১ সাল নাগাদ দারিদ্র্যের হার ৩ শতাংশে নামিয়ে আনার অঙ্গীকার করেছে আওয়ামী লীগ। আমার গ্রাম-আমার শহর কর্মসূচির আওতায় প্রতিটি গ্রামে আধুনিক নগর সুবিধা সম্প্রসারণ করার কথাও বলা হয়েছে ইশতেহারে। নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করলে আগের ধারাবাহিকতায় উন্নত রাস্তাঘাট, যোগাযোগ, সুপেয় পানি, আধুনিক স্বাস্থ্যসেবা ও সুচিকিৎসা, মানসম্পন্ন শিক্ষা, উন্নত পয়োনিষ্কাশন ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহ, কম্পিউটার ও দ্রুতগতিসম্পন্ন ইন্টারনেট সুবিধা, বৈদ্যুতিক সরঞ্জামসহ মানসম্পন্ন ভোগ্যপণ্যের বাজার সম্প্রসারণের মাধ্যমে প্রতিটি গ্রামকে আধুনিক শহরের সব সুবিধা দেয়ার ব্যবস্থা নিশ্চিত অব্যাহত রাখা; গ্রামের যুবসমাজের শহরমুখী হওয়ার প্রবণতা কমাতে গ্রামেই আত্মকর্মসংস্থানের ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও জানিয়েছে আওয়ামী লীগ। একই সঙ্গে দেশের রূপান্তর ও উন্নয়ন তরুণ ও যুবসমাজকে সম্পৃক্ত রাখার কথাও বলা হয়েছে। কর্মক্ষম, যোগ্য তরুণ ও যুবকদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সম্প্রসারণ, জেলা ও উপজেলায় ৩১ লাখ লোকের প্রশিক্ষণ দেয়া এবং তাদের আত্মকর্মসংস্থানের জন্য সহায়তা কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে।
আওয়ামী লীগ স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার স্লোগানকে সামনে নিয়ে আসে গত বছরের ডিসেম্বরের সম্মেলনে। জনগণকে স্মার্ট বাংলাদেশের পক্ষে নিয়ে আসা এবং জনমত নিজেদের পক্ষে নেওয়ার কাজ শুরু করে। নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণার মধ্য দিয়ে এই পরিকল্পনা পূর্ণতা পেল। খাতভিত্তিক যে অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়েছে গত ১৫ বছরে, আগামী ৫ বছরে এই ধারাবাহিকতা রক্ষা করে অর্থনৈতিক উন্নয়নক টেকসই রূপ দেওয়াই এবারের ইশতেহারের লক্ষ্য। এর সুফল যাতে দেশের মানুষ পায় এবং বাংলাদেশকে একটা কল্যাণমূখী রাষ্ট্রে পরিণত করা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাঙালির মুক্তির জন্য যে লক্ষ্য ছিল, আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিকসহ সব ক্ষেত্রে সেটিকে গুরুত্ব সহকারে, চেতনা হিসেবে তা গ্রহণ করতে সবাইকে।
নির্বাচনী ইশতেহারের কয়েকটি লক্ষ্য রয়েছে তা হলো ২০৪১ সালের স্মার্ট বাংলাদেশের লক্ষ্য। ডেলটা পরিকল্পনা বা ১০০ বছরের বদ্বীপ পরিকল্পনা। আরও আছে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার প্রস্তুতি নেয়ার পরিকল্পনা। আওয়ামী লীগ এর ভিশন হলো আবার যদি সরকার গঠন করতে পারে ২০৪১ সালের মধ্যে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ে তোলা। স্মার্ট বাংলাদেশ হবে স্মার্ট নাগরিক, স্মার্ট অর্থনীতি, স্মার্ট সরকার এবং স্মার্ট সোসাইটির ওপর ভিত্তি করে। পাশাপাশি প্রতিটি গ্রামকে একটি শহরে রূপান্তর করা।
দক্ষ নাগরিক তৈরির পাশাপাশি স্মার্ট অথনীতি, স্মার্ট শিক্ষা, স্মার্ট শিল্পনীতিসহ দেশবাসীর স্মার্ট সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা। ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের মাধ্যমে স্মার্ট বাংলাদেশের এগিয়ে যাচ্ছে দেশ।
আওয়ামী লীগের গত ১৫ বছরের শাসনামলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অত্যন্ত প্রশংসনীয় গতিশীলতা সৃষ্টি হয়। কিন্তু কিছু অনিয়ম, দুর্নীতি, পুঁজি লুণ্ঠন ও পুঁজি পাচারের অভিযোগ সেসব অর্জনকে অনেকটাই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। জনগণের বিবেচনায় ১৫ বছরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ বিশ্বের কাছে উন্নয়নের ‘রোল মডেল’ হয়েছে, নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে উত্তরণ করোনার কারণে ২০২৬ সাল পর্যন্ত এলডিসির সুবিধাগুলো বজায় রাখার জন্যই বাংলাদেশ এ অনুরোধ করে। অনেক মেগা প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে, পদ্মা বহুমুখী সেতু, ঢাকা মেট্রোরেল, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল চালু করা, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, কর্ণফুলী টানেল, মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর, মাতারবাড়ী ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্প, পায়রা বন্দর, পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্প, রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প, বাঁশখালী বিদ্যুৎ প্রকল্প।
যুব সমাজকে দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তর, কর্মসংস্থান নিশ্চিত করার পাশাপাশি সমৃদ্ধি ও ২০৪১ সারের স্মার্ট বাংলাদেশের অগ্রযাত্রাকে বেগবান করার জন্য উদ্যোগ রয়েছে। বিগত সময়ের অঙ্গীকার বাস্তবায়ন ও ১৫ বছরের উন্নয়ন চিত্রও তুলে ধরা হয় প্রধানমন্ত্রীর ইশতেহার উপস্থাপন সভায় ২৭ ডিসেম্বর। আওয়ামী লীগের ২০০৮ সালের ইশতেহারের শিরোনাম ছিলো ‘দিন বদলের সনদ’, ২০১৪ সালের ‘এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ’, ২০১৮ সালের ইশতেহারের শিরোনাম ছিলো ‘সমৃদ্ধি ও অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ’। ২১টি বিশেষ অঙ্গীকারে ছিলো এটিতে।
ইশতেহারে আরো বলা হয়েছে, সরকার কৃষির জন্য সহায়তা ও ভর্তুকি তথা কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে কৃষি উপকরণে বিনিয়োগ সহায়তা প্রদান অব্যাহত রাখবে। ব্যবহারযোগ্য কৃষি যন্ত্রপাতি সহজলভ্য ও সহজপ্রাপ্য করা হবে। কৃষি যন্ত্রপাতিতে ভর্তুকি প্রদান অব্যাহত রাখা হবে। বাণিজ্যিক কৃষি, জৈবপ্রযুক্তি, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং রোবোটিকস, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, ন্যানো-টেকনোলজিসহ গ্রামীণ অকৃষিজ খাতের উন্নয়ন ও বিশ্বায়ন মোকাবেলায় উপযুক্ত কর্মকৌশল গ্রহণ করা হবে। কৃষির আধুনিকায় প্রযুক্তি উদ্ভাবন এবং কৃষি গবেষণার সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ অব্যাহত থাকবে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতে ২০২৮ সালের মধ্যে গবাদিপশুর উৎপাদনশীলতা ১ দশমিক ৫ গুণ বৃদ্ধি করা হবে। বাণিজ্যিক দুগ্ধ, পোলট্রি ও মৎস্য খামার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আত্মকর্মসংস্থান বৃদ্ধি এবং দারিদ্র্য দূরীকরণে সহজ শর্তে ঋণ, প্রয়োজনীয় ভর্তুকি, প্রযুক্তিগত পরামর্শ ও নীতিগত সহায়তা দেয়ার কথাও বলা হয়েছে।
শিল্প উন্নয়নের লক্ষ্যে দেশের শ্রমশক্তিতে প্রতি বছর নতুন যুক্ত হওয়া ২০ লাখেরও বেশি মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা অওয়ামী লীগের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। এটি অর্জনে ১৫০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা হচ্ছে। নতুন নতুন শিল্প স্থাপন করে শিল্প খাতের বিকাশ ঘটানো হবে। উদ্যোক্তা শ্রেণীকে আকৃষ্ট করতে যথোপযুক্ত নীতি প্রণয়ন ও কর্মসূচি হাতে নেয়া হবে। কর্মসংস্থান সম্প্রসারণের জন্য ক্ষুদ্র, মাঝারি ও কুটির শিল্প, তাঁত ও রেশম শিল্পকে সংরক্ষণ এবং প্রতিযোগিতা সক্ষম করা হবে। বেনারসি ও জামদানিকে উৎসাহিত করা হবে। চামড়া ও পাটপণ্যে বৈচিত্র্য আনা হবে এবং এ শিল্পগুলোকে লাভজনক করার উদ্যোগ অব্যাহত থাকবে। পাটশিল্পে বেকারি খাতের উদ্যোগ উৎসাহিত করা হবে। কামার, কুমার ও মৃৎশিল্পীদের উন্নয়নের জন্য বিশেষ উদ্যোগ অব্যাহত থাকবে। প্রয়োজন অনুসারে এ খাতে দেয়া হবে প্রণোদনা।
বিদ্যুৎ খাতে গত ১৫ বছরের উন্নয়নের কথা ইশতেহারে তুলে এনেছে আওয়ামী লীগ। নিরবচ্ছিন্ন ও মানসম্মত বিদ্যুৎ এবং জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত ও বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২০৩০ সালের মধ্যে ৪০ হাজার ও ২০৪১ সালের মধ্যে ৬০ হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত করার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণের কথা জানানো হয়েছে। পরিবেশবান্ধব জ্বালানি থেকে ১০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে।
আওয়ামী লীগ আরো জানিয়েছে, নবায়নযোগ্য ও পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদিত বিদ্যুৎ সঞ্চালনের জন্য গ্রিড যুগোপযোগী করার কার্যক্রম শুরু ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করা হবে। দেশের উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলে গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ব্যাপকভাবে গ্যাস ও এলপিজির সরবরাহ বাড়ানো হবে।
রূপকল্প-২০৪১ অর্জনে আওয়ামী লীগ সরকার নিরাপদ যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে বিগত ১৫ বছরে ব্যাপক কর্মসূচি বাস্তবায়নের কথা জানিয়েছে। নৌপথ, সড়কপথ, রেলপথ ও বিমানের উন্নয়ন অব্যাহত থাকবে এবং নিরাপদ যোগাযোগ ব্যবস্থা রাজধানী থেকে গ্রাম পর্যন্ত উন্নত করার অঙ্গীকার করেছে। সড়কে নিরাপদ যাত্রা নিশ্চিত করার জন্য নিরাপদ সড়ক আইন প্রণয়নের পদক্ষেপের কথা বলা হয়েছে। ইশতেহারে বলা হয়, আওয়ামী লীগ সরকার তিন মেয়াদে বিভিন্ন মেগা প্রজেক্ট গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করেছে। আশা করা যায়, জাতির অহংকার ও গর্বের প্রতীক পদ্মা সেতুসহ এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুফল বয়ে আনছে। সমুদ্র সম্পদ আর্থসামাজিক উনয়নে যথাযথভাবে কাজে লাগানোর উদ্দেশ্যে সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। সমুদ্র সম্পদ তেল, গ্যাস, খনিজ, মৎস্য সম্পদ আহরণ করার ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। সমুদ্রবন্দর ও গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করা হয়েছে; যা ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণে সুযোগ সৃষ্টি করেছে।
এমডিজি অর্জন এবং এসডিজি বাস্তবায়ন কৌশলের (২০১৬-৩০) অংশ হিসেবে এমডিজি অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে বাস্তবায়ন করা হয়েছে। টেকসই উন্নয়ন বাস্তবায়ন অর্থাৎ এসডিজি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বাসস্থান, খাদ্যনিরাপত্তা, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, সুপেয় পানি, স্যানিটেশন সুবিধা, শিশু ও মাতমৃত্যু হার হ্রাস, সমতা নিশ্চিতকরণসহ প্রয়োজনীয় সব ক্ষেত্রে সাফল্যের সঙ্গে বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। আর্থসামাজিক উনয়নের ক্ষেত্রে বৈশ্বিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে নতুন কৌশল উদ্ভাবন ও বাস্তবায়নের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে বলেও ইশতেহার ঘোষণার সময় জানানো হয়।
আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে উন্নত-সমৃদ্ধ ও স্মার্ট সোনার বাংলা গড়ার অঙ্গীকার কওে নৌকায় ভোট দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দেশবাসীর উদ্দেশে তিনি বলেছেন, ‘বিগত ১৫ বছরের সরকার পরিচালনার পথপরিক্রমায় যা কিছু ভুলত্রুটি তার দায়ভার নিজের এবং সকল অর্জনের জন্য জনগণকে সাফল্যের কৃতিত্ব দিয়েছেন। তিনি অতীতের ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার আহবান জানিয়েছেন। তিনি অতীতের ভুলভ্রান্তি থেকে শিক্ষা নিয়ে জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী ভবিষ্যৎ কর্মকাÐ পরিচালনা করার অঙ্গীকার করেছেন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ইশতেহার ঘোষণা অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনা এগুলো উল্লেখ করেন।
আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা উল্লেখ করেন আন্তরিকতা ও নিষ্ঠা থাকা সত্তে¡ও সরকার পরিচালনা করতে গিয়ে সবসময়ই যে আমরা শতভাগ সফল হয়েছেন, এমন দাবি তিনি করেন না। তবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কথামালার রাজনীতিতে বিশ্বাসী নয়। আওয়ামী লীগ যা বলে তা বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করেন। ২০০৮, ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়ন তার প্রমাণ। তবে মাঝে-মধ্যে মনুষ্য-সৃষ্ট, প্রাকৃতিক এবং বৈশ্বিক বাধাবিপত্তি আমাদের চলার গতিপথকে মন্থর করে দেয়।
২০১৩ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াতের অগ্নিসন্ত্রাস এবং জঙ্গিবাদ বিস্তারের চেষ্টা মোকাবেলা করে আমাদের এগিয়ে যেতে হয়েছে। ২০০৯ সালের পর থেকে বেশ কয়েকটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করতে হয়েছে। সবচেয়ে বড় আঘাত এসেছে ২০২০ সালে যখন বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস মহামারী ছড়িয়ে পড়ে। এ মহামারী গোটা বিশ্বের অর্থনীতি এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে তছনছ করে দিয়েছিল।
পর্যালোচনা করে বলা যায়, আওয়ামী লীগ দলটির এ নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবানুগ। কারণ এতে সাম্প্রতিক সময়ে জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকেই প্রাধান্য পেয়েছে। আওয়ামী লীগ নতুন ইশতেহারে বাজারমূল্য ও আয়ের মধ্যে সংগতি প্রতিষ্ঠা করার প্রতিশ্রুতি রয়েছে । এ ছাড়া ২০৩১ সালের মধ্যে দেশকে উচ্চ-মধ্যম আয়ের কাতারে নিয়ে যাওয়া এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত-সমৃদ্ধ ও স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছে। আনুষ্ঠানিকভাবে ইশতেহার ঘোষণার সময় আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে প্রত্যয় ঘোষণা করেছেন। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য তিনি মুদ্রানীতির বিষয়েও ব্যাপক জোর দিয়েছেন। মুদ্রানীতির সফল বাস্তবায়ন করা গেলে অভ্যন্তরীণ বাজারে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে বলে তিনি প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছেন। পাশাপাশি নিত্যপণ্যের দাম সহনীয় পর্যায়ে আনতে যা যা করা প্রয়োজন তার সবকিছুই করা হবে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
নিম্নবিত্ত ও নিম্ন আয়ের মানুষদের জন্য নিত্যপণ্যের দামবৃদ্ধি গুরুতর সমস্যা। তাদের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে নানা সময়োপযোগী পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়েও আভাস দেওয়া হয়েছে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে। মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত ও স্বল্প আয়ের মানুষদের সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করার বিষয়ে অনেক কথা বলা হয়েছে। নিত্যপণ্যের দাম ক্রমেই বাড়ছে। অভ্যন্তরীণ বাজারে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে শুধু দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণই যথেষ্ট নয়। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে নিম্ন আয়ের প্রান্তিক, সুবিধাবঞ্চিত মানুষের কথাই বারবার ঘুরেফিরে এসেছে। সুবিধাবঞ্চিত মানুষের অধিকার, সুযোগ-সুবিধার কথা উঠে এসেছে। প্রবীণ, সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষ এমনকি সংখ্যালঘু জাতিসত্তার ক্ষমতায়নের প্রসঙ্গও উঠে এসেছে। বিশেষত সংখ্যালঘু জাতিসত্তার মানুষের জন্য আলাদা কমিশন গঠন করার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। দেশের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর ক্ষমতায়নে এই প্রতিশ্রুতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে কৃষি খাতকে বাড়তি গুরুত্ব দেওয়ার বিষয়টিও একটি উল্লেখযোগ্য দিক। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানিয়েছেন, ক্ষমতায় এলে কৃষি ভর্তুকি বৃদ্ধি এবং কৃষকের উৎপাদন সক্ষমতা বাড়াতে নানা উদ্যোগ নেওয়া হবে। দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি কৃষি। কৃষির উন্নয়নের মাধ্যমে অর্থনীতির চাকা আরও গতিশীল হবে। তবে অন্যান্য শিল্পের উন্নয়নের জন্যও পরিকল্পনার কথা বলা হয়েছে ইশতেহারে।
সবকিছু ছাপিয়ে প্রান্তিক ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি ও আর্থসামাজিক উন্নয়নের প্রসঙ্গটিই উঠে এসেছে ঘুরেফিরে। মানুষের অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে প্রযুক্তির দক্ষ ব্যবহার ও সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষের উন্নয়নের অঙ্গীকার-প্রতিশ্রুতি রয়েছে ইশতেহারে।
শিল্পের বিকাশ ও প্রসারের জন্য শ্রমিকের অধিকার নিশ্চিতকরণ, সবুজ কারখানা স্থাপন, কর্মক্ষেত্রে অধিকার ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা, শিল্প খাতের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান বৃদ্ধির প্রসঙ্গ উঠে এসেছে। শিল্পের প্রসারের ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির বিষয়টি পেয়েছে বাড়তি গুরুত্ব। দেশে মূল্যস্ফীতির সঙ্গে বেকারত্বের হারও একটি বড় সমস্যা। তরুণরা কর্মসংস্থানের অভাবে সামাজিক বিভিন্ন স্তরে যে নানাবিধ সমস্যার মুখোমুখি হন সে কথা ভেবেই নির্বাচনী ইশতেহারে কর্মসংস্থানের প্রসঙ্গটি উঠে এসেছে। তরুণদের কর্মসংস্থান বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণ ও অর্থায়নের ব্যবস্থা নেওয়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে। এক্ষেত্রে এসএমই ও এমএসএমই খাতের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। কর্মসংস্থান তৈরি ও এর প্রসারের জন্য এই দুই খাতে বাড়তি মনোযোগ ইতিবাচক অবশ্যই।
দেশে নারীর ক্ষমতায়নে বর্তমান সরকার নানা উদ্যোগ নিয়েছে। তবে নারী শ্রমিকদের এখনও নানা প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়তে হয়। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে নারী শ্রমিকদের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। গ্রামীণ নারীর জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন, সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং তাদের প্রযুক্তিগত দক্ষতা বৃদ্ধির পরিকল্পনার আভাস দেওয়া হয়েছে। সার্বিকভাবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনী ইশতেহারের ঘোষণা দিয়েছে।
নির্বাচনী ইশতেহারের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন দল সাধারণ মানুষের চাহিদাকেই প্রাধান্য দিয়েছে। মূল্যস্ফীতি সাধারণ মানুষের জীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণকে প্রাধান্য দিয়েই নির্বাচনী ইশতেহার সাজানো হয়েছে। দেশের মানুষ সমাধানের জন্য রাজনীতিকদের কাছেই প্রত্যাশা রাখেন। আওয়ামী লীগ মানুষের আকাক্সক্ষার বিষয়টি অনুধাবন করতে পেরেছে। সুবিধাবঞ্চিত ও নিম্ন আয়ের মানুষদের অন্তর্ভুক্ত করার জন্য তাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সুদূরপ্রসারী এবং বাস্তবসম্মত ও সময়োপযোগী। দেশের মূল চালিকাশক্তি কৃষি খাতে যেমন গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, তেমনি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে শিল্পের অন্যান্য খাতেও। শুধু তাই নয়, জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে সবুজ কারখানা স্থাপনের বিষয়ে জোর দেওয়া হয়েছে। বলা হয়, দুর্নীতি ও সুশাসনের অভাব দেশের অর্থনীতির দুই বিষফোঁড়া। দুর্নীতি দমনে সরকারের আগে থেকেই জিরো টলারেন্সের কথা এবং অবস্থানের অঙ্গীকার রয়েছে। এবার সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য আরও যুগোপযোগী পদক্ষেপ নেওয়ার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়েছে ইশতেহারে।
অর্থনীতির জন্য মূল্যস্ফীতি একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য আর্থিক খাতে অনিয়ম রোধ এবং ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে সুসংহত ও সুগঠিত করার আশাবাদ ব্যক্ত হয়েছে। যদি তা করা সম্ভব হয়, তাহলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ দুরূহ কিছু হবে না। এই ইশতেহারে সাধারণ মানুষের চাহিদা ও আকাক্সক্ষার কথাই ব্যক্ত হয়েছে। মূল্যস্ফীতি ও অর্থনীতির নানা প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা বড় চ্যালেঞ্জ অবশ্যই। কিন্তু নির্বাচনের পর আরও সময়োপযোগী উন্নয়ন ও পদক্ষেপের আভাস এই ইশতেহারে মিলেছে। সাধারণ মানুষ এই ইশতেহারে আওয়ামী লীগের উন্নয়ন দর্শনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে পারবে।
‘নির্বাচন এলেই মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশ এবং উন্নয়নবিরোধী একটি চক্র ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করে সক্রিয় হয়ে ওঠে। নির্বাচনে কূটকৌশল অবলম্বন বা কারচুপির মাধ্যমে কিংবা পেছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতায় যেতে তারা আটঘাট বেঁধে মাঠে নামে। সফল না হলে জনগণের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রতিশোধস্পৃহায়। অগ্নি-সন্ত্রাস, যানবাহন পোড়ানো, বোমাবাজি, নাশকতা বা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সাধারণ জনগণকে ভীতসন্ত্রস্ত করে ঘরবন্দি করতে চায়। এবারো তার ব্যতিক্রম হয়নি। তার ওপর এবার তারা বিদেশ থেকেও কলকাঠি নাড়ছে।
এ মুহূর্তে বাংলাদেশ এক ক্রান্তিকালে দাঁড়িয়ে। স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে শামিল হতে যাচ্ছে দেশ। এ উত্তরণ যেমন একদিকে সম্মানের, অন্যদিকে বিশাল চ্যালেঞ্জেরও। ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকারকে এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার সক্ষমতা থাকতে হবে। একমাত্র আওয়ামী লীগই পারবে এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে দেশকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক-বাহক বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের হাত ধরেই ২০৩১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ উচ্চ-মধ্যম আয়ের এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত-সমৃদ্ধ স্মার্ট সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠিত হবে। তিনি আরো একবার বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতীক নৌকা মার্কায় ভোট দিয়ে আমাদের জয়যুক্ত করে আপনাদের সেবা করার সুযোগ দেওয়ার আহবান জানান। তিনি উল্লেখ করেন আপনারা আমাদের ভোট দিন, আমরা আপনাদের উন্নয়ন, শান্তি ও সমৃদ্ধি দিব।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও গবেষক