জুলিও কুরি পদক ; বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির ৫০ বছর পূর্তি

1375

Published on মে 23, 2023
  • Details Image

মানিক লাল ঘোষঃ

রাজনৈতিক জীবনে কখনো সংঘাত চাননি তিনি। কখনো সহ্য করেননি মানবতার অবমাননা। নিজের জন্য না ভেবে আমৃত্যু লড়াই সংগ্রাম করে গেছেন গণমানুষের অধিকার আদায়ের জন্য। তিন আমাদের অহংকার, বিশ্বমানবতার পরম বন্ধু জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বিশ্বের মুক্তিকামী নিপীড়িত মেহনতী মানুষের অবিসংবাদিত নেতা ছিলেন তিনি। নিপীড়িত মানুষের মুক্তির এই দিশারী আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন সাম্য, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য। বাঙালির মুক্তি সংগ্রাম, তাদের অধিকার আদায়ে সহ্য করেছেন জেল, জুলুম, অত্যাচার, নির্যাতনের স্টিম রোলার। শুধু বাংলাদেশের নয়, বিশ্বের সকল নিপীড়িত মানুষের পক্ষে সোচ্চার ছিলেন তিনি। গণমানুষের পক্ষে তার এই সাহসী অবস্থান ও বিশ্ব মানবতার পক্ষে সবসময় সোচ্চার থাকার স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৭৩ সালের ২৩ মে বিশ্বশান্তি পরিষদ ‘জুলিও কুরি’ শান্তি পদকে ভূষিত করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার মহান স্থপতি ও বাঙালি জাতিরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে।

এই ২৩ মে দিনটি ছিলো বাংলাদেশের জন্য গৌরবোজ্জ্বল মহান দিন। বঙ্গবন্ধুর এই পদক লাভে স্বাধীনতার পর আন্তর্জাতিক বিশ্বে দ্বিতীয়বারের মতো মর্যাদায় উচ্চারিত হয় বাংলাদেশের নাম। বিশ্বশান্তি পরিষদের শান্তিপদক বঙ্গবন্ধুর কর্মের স্বীকৃতি। এটি ছিল বাংলাদেশের প্রথম আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি, আন্তর্জাতিক সম্মান। জাতির পিতার এই পদকপ্রাপ্তি অন্যান্য রাষ্ট্রের কাছ থেকে সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশের স্বীকৃতি আদায় ও জাতিসংঘসহ বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার সদস্যপদ লাভকে ত্বরান্বিত করেছিল।

বিশ্ববিখ্যাত নোবেল বিজয়ী দম্পতি মেরি কুরি ও পিয়েরে কুরি ছিলেন বিশিষ্ট পদার্থবিজ্ঞানী। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় এক্সরে’র সংকট দেখা দিলে নিজেদের প্রচেষ্টায় প্রায় ১০ লাখ মানুষকে এক্সরে সেবা দিয়েছিলেন এই দম্পতি। বিশ্বশান্তির সংগ্রামে এই বিজ্ঞানী দম্পতির অবদান অপরিসীম। এই অবদানকে যুগ থেকে যুগান্তর চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্য তাদের নামে ১৯৫০ সাল থেকে ফ্যাসিবাদ, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামে ও মানবতার কল্যাণে শান্তির স্বপক্ষে বিশেষ অবদানের জন্য ব্যক্তি ও সংগঠনকে ‘জুলিও কুরি’ পদক প্রদানের সিদ্ধান্ত নেয় বিশ্বশান্তি পরিষদ।

পাকিস্তান রাষ্ট্রটি গঠন হওয়ার শুরু থেকেই পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্য, সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালিদের ওপর অন্যায়, নির্যাতন-নিপীড়ন প্রথম থেকেই মেনে নিতে পারেননি বঙ্গবন্ধু। বাঙালির ওপর প্রথম আঘাত যখন আসে ভাষার ওপর। তখনই বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার দাবিতে ১৯৪৮ সালেই পাকিস্তানি শাসকদের বিরূদ্ধে প্রথম রুখে দাঁড়ান বাঙালির এই অবিসংবাদিত নেতা। ৫২’এর ভাষা আন্দোলন, ৬৬’র ছয়-দফা, ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান এবং ৭০ এর নির্বাচনে বিজয়। এভাবেই চলতে থাকে মুক্তিকামী বাঙালির ধারাবাহিক আন্দোলন।

১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় পাকিস্তানের বিরূদ্ধে স্বাধীনতার ডাক দেন বঙ্গবন্ধু। ঘোষণা দেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম’। ৭ মার্চের ভাষণই মূলত স্বাধীনতার ঘোষণা। বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণে উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশমাতাকে স্বাধীন করতে পাকিস্তানি হায়েনাদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে বীর বাঙালি। দীর্ঘ নয় মাস মুক্তিযুদ্ধ শেষে লাল সবুজের পতাকায় অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন বাংলাদেশের ।

১৯৭২ সালের ১০ অক্টোবর পৃথিবীর ১৪০টি দেশের শান্তি পরিষদের ২০০ প্রতিনিধির উপস্থিতিতে বিশ্ব শান্তি পরিষদ বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টাকে ‘জুলিও কুরি’ শান্তিপদক দেওয়ার সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নেয়

১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে ১০ জানুয়ারি স্বদেশের মাটিতে ফিরে আসেন বঙ্গবন্ধু। দেশে ফিরে এসেই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার শান্তি প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন তিনি। সবার প্রতি বন্ধুত্ব, কারও প্রতি বৈরিতা নয়- এই মতবাদে পররাষ্ট্রনীতি ঘোষণা করেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পররাষ্ট্রনীতি ঘোষণা করে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘পৃথিবীর বৃহত্তম শক্তি যে অর্থ ব্যয় করে মানুষ মারার অস্ত্র তৈরি করছে, সেই অর্থ গরিব দেশগুলোকে সাহায্য দিলে পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা হতে পারে।’

আঞ্চলিক ও বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর অবদান ছিলো স্পষ্ট। বিভিন্ন সময় বঙ্গবন্ধু তার দিক-নির্দেশনামূলক বক্তব্যে বলেছিলেন, ‘আমরা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াকে শান্তি, স্বাধীন এবং নিরপেক্ষ এলাকায় পরিণত করার পক্ষে সমর্থন জানাই’। বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর এ দিক-নির্দেশনা এখনও সবার মুখে মুখে। মানবজাতির অস্তিত্ব রক্ষায় শান্তিই আজ সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।

১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি বাংলার অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে ছাত্র-জনতা কৃতজ্ঞচিত্তে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। ১৯৭২ সালের ১০ অক্টোবর পৃথিবীর ১৪০টি দেশের শান্তি পরিষদের ২০০ প্রতিনিধির উপস্থিতিতে বিশ্ব শান্তি পরিষদ বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টাকে ‘জুলিও কুরি’ শান্তিপদক দেওয়ার সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নেয়।

১৯৭৩ সালের ২৩ মে ঢাকায় আয়োজিত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে বিশ্বশান্তি পরিষদের প্রতিনিধিরা যোগদান করেন। বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের উন্মুক্ত প্লাজায় অনুষ্ঠিত হয় এই সম্মেলন। বিশ্বশান্তি পরিষদ আয়োজিত অনুষ্ঠানে আন্তর্জাতিক কূটনীতিকদের বিশাল সমাবেশে বিশ্বশান্তি পরিষদের তৎকালীন মহাসচিব রমেশ চন্দ্র মুক্তি আন্দোলনের মহানায়ক বঙ্গবন্ধুকে জুলিও কুরি পদক প্রদান করেন। এসময় তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শুধু বঙ্গবন্ধু নন, আজ থেকে তিনি বিশ্ববন্ধুও বটে।’ সেদিন থেকেই বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে স্বীকৃত বিশ্ববন্ধু শেখ মুজিব হিসেবে।

অনুষ্ঠানে বিশ্ববন্ধুর সম্মান পেয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘এ সম্মান কোনো ব্যক্তি বিশেষের জন্য নয়। এ সম্মান বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে আত্মদানকারী শহীদদের, স্বাধীনতা সংগ্রামের বীর সেনানীদের। জুলিও কুরি শান্তি পদক সমগ্র বাঙালি জাতির।’

বিশ্বের শান্তি প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সর্বোচ্চ স্বীকৃতি ‘জুলিও কুরি’ পদক। বঙ্গবন্ধু ছাড়াও এ বিরল সম্মান অর্জন করেছেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা প্রথম প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরু, কিউবার ফিদেল কাস্ট্রো, চিলির সার্ভে আলেন্দে, ফিলিস্তিনের ইয়াসির আরাফাত, ভিয়েতনামের হো চি মিন, দক্ষিণ আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলা, ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী, কবি ও রাজনীতিবিদ পাবলো নেরুদা, মার্টিন লুথার কিংসহ বিশ্বের বরেণ্য ব্যক্তিবর্গ।

পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে বিশ্ব মানবতার পথেই হাঁটছেন উত্তরাধিকারী জননেত্রী শেখ হাসিনা। বাংলাদেশসহ বিশ্বের শান্তি প্রতিষ্ঠায় নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। নিজ দেশের অর্থনৈতিক, ভৌগোলিক নানাবিধ সমস্যার কথা না ভেবে শুধু মানবিক কারণে নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে বিশ্বে আজ ‘মাদার অব হিউম্যানিটি’র স্বীকৃতি পেয়েছেন শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত ও আদর্শিক পথেই হাঁটছেন তিনি।

পিতার দেখানো পথে জননেত্রী শেখ হাসিনার এই অগ্রযাত্রায় শুভকামনা আর ‘জুলিও কুরি’ শান্তি পুরস্কার প্রাপ্তির ৫০তম বার্ষিকীতে বিনম্র শ্রদ্ধা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি। যার কাছে শুধু বাঙালির নয়, আজন্ম ঋণ বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের। অধিকার আদায়ের সংগ্রামে বঙ্গবন্ধু হোক দেশ-দেশান্তরে যুগ-যুগান্তরে আজন্মের প্রেরণা।

লেখকঃ সহ-সভাপতি, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন,- ডিইউজে ও বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির কার্যনির্বাহী সদস্য

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত