1067
Published on মে 16, 2023ড. প্রণব কুমার পান্ডেঃ
নারীর ক্ষমতায়ন টেকসই উন্নয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান এবং যে কোনো দেশের সার্বিক অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির জন্য অপরিহার্য। নারীরা বিশ্বব্যাপী জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক হলেও দারিদ্র্য, বৈষম্য এবং সামাজিক বর্জন দ্বারা প্রায়ই অসামঞ্জস্যপূর্ণভাবে প্রভাবিত হয়। তাই নারীর ক্ষমতায়ন ও লিঙ্গ সমতা উন্নীত করা শুধু মানবাধিকারের বিষয় নয় বরং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, সামাজিক উন্নয়ন এবং পরিবেশগত টেকসইতার মূল চালিকাশক্তি।
নারীর ক্ষমতায়ন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের দিকে নিয়ে যেতে পারে। নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন পরিবারের আয় বাড়াতে পারে, দারিদ্র্য হ্রাস এবং টেকসই উন্নয়ন উৎসাহিত করতে পারে। বিশ্বব্যাংকের মতে, যেসব দেশে শ্রমশক্তিতে নারীদের অংশগ্রহণের হার বেশি, সেসব দেশের অর্থনীতির আরও শক্তিশালী হওয়ার প্রবণতা রয়েছে। এর কারণ হলো যখন নারীদের শিক্ষা, প্রশিক্ষণ এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ প্রদান করা হয় তখন তারা অর্থনীতিতে আরও সম্পূর্ণভাবে অবদান রাখতে পারে, যা উৎপাদনশীলতা, উদ্ভাবন এবং প্রতিযোগিতা বৃদ্ধির দিকে পরিচালিত করে। নারীর ক্ষমতায়ন ও লিঙ্গ সমতা উন্নীত করার মাধ্যমে আমরা তাদের পূর্ণ সম্ভাবনা কাজে লাগাতে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখতে পারি। গবেষণায় দেখা গেছে, শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি একটি দেশের জিডিপিতে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাব ফেলতে পারে। নারীর ক্ষমতায়ন স্বাস্থ্যের ফলাফল উন্নত করতে এবং স্বাস্থ্যসেবার খরচ কমাতে পারে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নারীরা পরিবার ও সম্প্রদায়ের প্রাথমিক পরিচর্যাকারী হওয়ায় তারা তাদের স্বাস্থ্যের অবস্থা, পরিবারের স্বাস্থ্য এবং সুস্থতার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। যখন নারীদের স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা ও তথ্যের প্রবেশাধিকার থাকে, তখন তারা তাদের স্বাস্থ্য এবং পরিবারের স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এটি উন্নত স্বাস্থ্যসেবার ব্যয় হ্রাস এবং আরও উৎপাদনশীল কর্মী বাহিনী তৈরিতে সহায়তা করতে পারে।
নারীর ক্ষমতায়ন সামাজিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করে সমাজে বৈষম্য কমাতে পারে। যখন নারীদের শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের সমান সুযোগ থাকে, তখন তারা সমাজের বিভিন্ন কার্যক্রমে আরও সম্পূর্ণভাবে অংশগ্রহণ করতে এবং সম্প্রদায়ের উন্নয়নে অবদান রাখতে পারে। এটি বৃহত্তর সামাজিক সংহতি, বৈষম্য হ্রাস এবং আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টাকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে পারে। ব্যক্তি ও সমাজের উন্নয়নের জন্য শিক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নারীরা প্রায়ই শিক্ষার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য বাধার সম্মুখীন হয়। নারীর ক্ষমতায়ন ও শিক্ষায় তাদের সমান প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা হলে দেশের সার্বিক সাক্ষরতার হার উন্নত, দারিদ্র্য হ্রাস এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি উন্নীত করতে পারে। নারী স্বাস্থ্য উন্নয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। নারীর ক্ষমতায়ন এবং লিঙ্গ সমতার প্রচার মা ও শিশু স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটাতে পারে, এইচআইভি/এইডস এবং অন্যান্য রোগের বিস্তার কমাতে ও স্বাস্থ্যকর জীবনধারা উন্নীত করতে পারে। অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং কার্যকর শাসনের জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় নারীদের অংশগ্রহণ অপরিহার্য। নারীর ক্ষমতায়ন ও লিঙ্গ সমতা প্রচারের মাধ্যমে আমরা নিশ্চিত করতে পারি যে, নারীদের কণ্ঠস্বর শোনা হচ্ছে এবং রাজনৈতিক অঙ্গনে তাদের স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা হচ্ছে। সামাজিক নেটওয়ার্ক এবং সম্প্রদায় নির্মাণ ও বজায় রাখার ক্ষেত্রে নারীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নারীর ক্ষমতায়ন ও লিঙ্গ সমতা প্রচারের মাধ্যমে আমরা সামাজিক সংহতি প্রচার, লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা হ্রাস এবং আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠন করতে পারি।
উন্নয়নের জন্য নারীর ক্ষমতায়ন অপরিহার্য। এটি একটি মৌলিক মানবাধিকার এবং টেকসই উন্নয়ন অর্জনের পূর্বশর্ত। নারীর ক্ষমতায়ন ও লিঙ্গ সমতা উন্নীত করার মাধ্যমে আমরা সবার জন্য আরও ন্যায্য, ন্যায়সংগত এবং সমৃদ্ধ বিশ্ব তৈরি করতে পারি। এমনকি পরিবেশগত টেকসইতার জন্য নারীর ক্ষমতায়ন অপরিহার্য। প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা এবং পরিবেশ রক্ষায় নারীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নারীরা যখন প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় জড়িত থাকে, তখন তারা টেকসই অনুশীলনের প্রচার এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য পরিবেশ রক্ষা করার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
দেশের উন্নয়নে নারীর ক্ষমতায়নের গুরুত্ব বিবেচনা করে বাংলাদেশ সরকার নারীর ক্ষমতায়নের জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, যিনি নারীর ক্ষমতায়ন ও লিঙ্গ সমতার জন্য একজন দৃঢ় প্রবক্তা, তিনি সবসময় বাংলাদেশে নারীর অবস্থার উন্নতির জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থেকেছেন এবং সবসময় স্বীকার করেছেন যে, সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য লিঙ্গ সমতা অপরিহার্য। এখন একটি প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন হচ্ছে, শেখ হাসিনা সরকার বাংলাদেশি নারীদের ক্ষমতায়নে কী উদ্যোগ নিয়েছে। তার সরকার বিভিন্ন স্তরে নারীর ক্ষমতায়নের জন্য অনেক উদ্যোগ নিয়েছে। নারীদের শিক্ষার সুযোগ বাড়ানোর জন্য সরকার বেশ কিছু কর্মসূচি চালু করেছে। এর মধ্যে রয়েছে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে মেয়েদের উপবৃত্তি, মহিলা শিক্ষকদের জন্য প্রণোদনা এবং মহিলা কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন। ফলে বাংলাদেশ প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় লিঙ্গ সমতা অর্জন করেছে এবং স্কুলে যাওয়া মেয়েদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
সরকার নারীদের স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছে, যার মধ্যে রয়েছে শুধু নারী-স্বাস্থ্যকেন্দ্র স্থাপন, বিনামূল্যে মাতৃস্বাস্থ্য সেবা প্রদান এবং গর্ভনিরোধক ও পরিবার পরিকল্পনা সেবা বিতরণ। তা ছাড়া প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদে একটি করে কমিউনিটি হেলথ ক্লিনিক প্রতিষ্ঠা শেখ হাসিনার স্বপ্নের প্রকল্প নারী ও পুরুষদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
সরকার নারীদের কর্মসংস্থানের উন্নয়নে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে শুধু নারীদের জন্য শিল্পপার্ক স্থাপন, নারীদের জন্য বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ প্রদান এবং সরকারি চাকরিতে নারীদের জন্য কোটা প্রবর্তন। সরকার স্থানীয় সরকার সংস্থায় নারীদের জন্য এক-তৃতীয়াংশ আসন সংরক্ষণ এবং জাতীয় সংসদে নারীদের জন্য কোটা ব্যবস্থা বাড়িয়ে নারীদের রাজনৈতিক অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করেছে।
সরকার নারী উদ্যোক্তাদের উন্নীত করার জন্য তহবিল প্রতিষ্ঠা, তাদের জন্য ঋণ ও প্রশিক্ষণ প্রদান এবং নারী-নেতৃত্বাধীন ক্ষুদ্র ও মাঝারি আকারের উদ্যোগের উন্নয়নসহ বেশ কিছু উদ্যোগ চালু করেছে। সরকার নারীদের অধিকার রক্ষার জন্য বেশ কিছু আইনি সংস্কার করেছে, যার মধ্যে রয়েছে গার্হস্থ্য সহিংসতা, যৌন হয়রানি এবং অ্যাসিড হামলা প্রতিরোধে আইন প্রবর্তন। নারীর প্রতি সহিংসতা-সংক্রান্ত মামলার দ্রুত বিচারের জন্য সরকার একটি বিশেষ ট্রাইব্যুনালও গঠন করেছে।
সরকার নারীদের ক্ষমতায়নের জন্য বিভিন্ন ডিজিটাল উদ্যোগ চালু করেছে, যার মধ্যে রয়েছে শুধু নারীদের জন্য কল সেন্টার স্থাপন, নারীদের জন্য ডিজিটাল প্রশিক্ষণ প্রদান এবং নারী উদ্যোক্তাদের জন্য ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম চালু করা। নারীদের জন্য ডিজিটাল বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান সুবিধা হলো শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের সুযোগ বৃদ্ধি করা। শিক্ষায় আইসিটির ব্যবহার গ্রামীণ ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের নারীদের মানসম্পন্ন শিক্ষা ও প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করতে সক্ষম করেছে, যা তাদের সাক্ষরতার হার বৃদ্ধি, তাদের দক্ষতা ও জ্ঞান বাড়াতে এবং তাদের কর্মসংস্থানের উন্নতিতে সাহায্য করেছে। নারীরা এখন অনলাইন কোর্স, ই-বুক এবং শিক্ষামূলক ভিডিও অ্যাক্সেস করতে পারে, যা আগে তাদের কাছে উপলব্ধ ছিল না। শেখ হাসিনার সরকার বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়নের জন্য একটি বিস্তৃত পন্থা গ্রহণ করেছে, যা সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য, তা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।
সামগ্রিকভাবে, গত এক দশকে বাংলাদেশি নারীদের অবস্থার উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়েছে। তবে কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা এখন বাকি আছে, যেমন লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা, বাল্যবিবাহ এবং স্বাস্থ্যসেবায় প্রবেশাধিকার। সরকার ও সুশীল সমাজ সংস্থাগুলোকে অবশ্যই এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে এবং নারীদের সমান অধিকার ও সুযোগ নিশ্চিত করতে একসঙ্গে কাজ চালিয়ে যেতে হবে। নারীর ক্ষমতায়ন সামাজিক ন্যায়বিচারের একটি বিষয় এবং টেকসই উন্নয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। নারীরা যখন ক্ষমতায়িত হয়, তখন তারা তাদের পরিবার, সম্প্রদায় এবং সমাজের উন্নয়নে অবদান রাখতে পারে। এ বাস্তবতা শেখ হাসিনা ভালোভাবেই উপলব্ধি করেছেন বিধায় নারীদের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতায়নের জন্য তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। নারীর ক্ষমতায়নের প্রতি তার অঙ্গীকার জাতীয় সংসদের স্পিকার এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী পদে নারীদের স্থান দেওয়ার সিদ্ধান্তের মাধ্যমে প্রতিফলিত হয়েছে। আমরা আশা করি তার নেতৃত্বে বাংলাদেশের নারীরা সামনের দিকে এগিয়ে যাবে এবং তাদের অবস্থার আমূল পরিবর্তন হবে।
লেখক : অধ্যাপক, লোকপ্রশাসন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়