787
Published on মে 16, 2023সাদিকুর রহমান পরাগ:
‘পথিক, তুমি পথ হারাইয়াছ?’ বঙ্কিম চন্দ্রের ‘কপালকুণ্ডলা’ উপন্যাসে নবকুমারকে এ প্রশ্নটি করা হয়েছিল। পরবর্তীকালে এ কথাটি এতই জনপ্রিয় হয় যে ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে সমাজ ও রাজনীতিতে ব্যাপকভাবে এর ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। যদিও বঙ্কিম সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করা আজকের এ লেখার উদ্দেশ্য নয়।
‘কপালকুণ্ডলা’ উপন্যাসের সেই সংলাপের সঙ্গে মিল রেখে এ প্রশ্নটি রাখতে চাই- ‘বিএনপি, তুমি পথ হারাইয়াছ?’
কেন বিএনপির পথ হারানোর কথা উঠছে? উঠছে এ কারণে দলটি বিএনপি বলেই।
বিদেশে বসে তারেক রহমান হাজার হাজার ডলার খরচ করে তার গুজব স্কোয়াডের মাধ্যমে দেশবিরোধী মিথ্যা তথ্য ও অপপ্রচার চালিয়েছে। তারা ভেবেছিল পশ্চিমা দেশগুলোকে বিভ্রান্ত করে স্যাংশন আরোপের মাধ্যমে দেশের অভ্যন্তরে একটি অস্থিরতা তৈরি করতে সক্ষম হবে। তারা ভেবেছিল পশ্চিমা শক্তি বিএনপিকে ক্ষমতায় বসিয়ে দেবে- এ ধরনের একটি ধারণা সুকৌশলে তাদের নেতাকর্মীদের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়ে দলটিকে উজ্জীবিত করতে পারবে। কিন্তু তাদের সেই চেষ্টাও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। ঘটা করে হাঁকডাক দিয়ে বিভাগীয় মহাসমাবেশ করে এবং ১০ ডিসেম্বর সরকার ফেলে দেওয়ার মতো কর্মসূচি দিয়েও ‘যেই লাউ সেই কদু’।
১০ ডিসেম্বরের পর খালেদা জিয়ার কথায় দেশ চলবে- এই মর্মে ঘোষণা দিয়ে বিএনপি প্রকারান্তরে তার নেতাকর্মীদের সঙ্গেই প্রতারণা করেছে। দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকতে থাকতে ক্লান্ত হতাশ কর্মীরা এ ঘোষণাকে সত্য বলে বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল। কিন্তু এটিও ছিল তারেক রহমানের আরেকটি ধাপ্পাবাজি।
এমনই প্রেক্ষাপটে তারা রাষ্ট্র মেরামতের ২৭-দফা ঘোষণা করে। এই ২৭-দফাও আসলে এক ধরনের আইওয়াশ। ১০ ডিসেম্বরের ব্যর্থতা ঢাকতে, নিজেদের এই প্রতারণা আড়াল করতে এবং দলীয় নেতাকর্মীদের ক্ষোভ ও হতাশা প্রশমিত করতে তারা এই তথাকথিত ২৭-দফার ঘোষণা দেয়। কেউ কেউ রসিকতা করে বলে- রাষ্ট্র নয়, এখন প্রয়োজন বিএনপি মেরামতের ২৭-দফা।
বিএনপি রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের যে ২৭-দফা ঘোষণা করেছে, তার ১৩নং দফায় বলেছে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে কোনো আপস করা হবে না। এ কথাটি যে কতটা হাস্যকর ও অযৌক্তিক, তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হচ্ছে বিএনপির গঠনতন্ত্র সংশোধন। বিএনপির গঠনতন্ত্রে ছিল যে দুর্নীতির দায়ে সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তি বিএনপি করতে পারবে না; কিন্তু দুর্নীতির দায়ে পলাতক তারেক রহমানের নেতৃত্ব রক্ষার জন্য গঠনতন্ত্র থেকে সেই ধারাটি বিলোপ করে দিয়েছে। দুর্নীতির দায়ে সাজাপ্রাপ্ত খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের নেতৃত্বে বিএনপি দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করবে!
এই ২৭-দফার ২নং দফায় ‘ন্যাশনাল রিকনসিলিয়েশন কমিশন’ গঠনের মাধ্যমে প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের রাজনীতির বিপরীতে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, বৈষম্যহীন ও সম্প্রীতিমূলক ‘রেইনবো নেশন’ প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে। তারেক রহমানের নীলনকশায় বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে পরিচালিত ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা, সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া, আইভি রহমান, সাবেক সংসদ সদস্য আহসানউল্লাহ মাস্টার, মঞ্জুরুল ইমাম, মমতাজ ফকির-সহ হাজার হাজার আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীকে হত্যা, হাওয়া ভবনের পৃষ্ঠপোষকতায় জঙ্গিগোষ্ঠীর উত্থান ঘটিয়ে সারাদেশে জঙ্গি হামলা পরিচালনা করেছে যারা তারাই বলছে রেইনবো নেশনের কথা। এর চেয়ে বড় পরিহাস আর কী হতে পারে।
দক্ষিণ আফ্রিকা বর্ণবৈষম্য বিলোপে ‘ন্যাশনাল রিকনসিলিয়েশন কমিশন’ গঠনের মাধ্যমে একটি রেইনবো নেশন গড়ে তুলেছে। কিন্তু আমাদের দেশে বিএনপি আর জামাতের রাজনীতি হচ্ছে একই মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ। আদতে জামাত-শিবিরকে গ্রহণযোগ্যতা দিতে রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের নামে বিএনপি যে ‘রেইনবো নেশন’ প্রতিষ্ঠার কথা বলেছে সে-ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।
এমনই অবস্থায় যতই দিন যাচ্ছে বিএনপি যেন আরও বেপথু হয়ে পড়ছে। দলের অভ্যন্তরে বেজে উঠেছে বেসুরো আওয়াজ। প্রকাশ্যে না বললেও আকারে-ইঙ্গিতে বিএনপির সিনিয়র নেতারা প্রশ্ন তুলছেন যে তারেক রহমানের ফাঁদে পা দিয়ে বিএনপি কি আবারও রাজনীতির চোরাবালিতে পথ হারিয়েছে?
বিএনপির জন্য সবচেয়ে বড় ক্রাইসিস হচ্ছে আগামী জাতীয় নির্বাচন। নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে, বিএনপির জন্য এ সংকট ততই জটিলতর হচ্ছে। কূটনৈতিকপাড়ায় দৌড়াদৌড়ি করে, নালিশ দিয়ে আদৌ কতটা ফায়দা হবে সেটিও তারা নিশ্চিত নয়। সেক্ষেত্রে কী করবে তারা, নির্বাচনে অংশ নেবে না-কি নেবে না। যদি অংশ নেয় তাহলে কীভাবে নেবে। যদি না নেয় তাহলে কী করবে- নির্বাচন প্রতিহত করবে? যেখানে এতদিনেও আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে কোনো গণ-আন্দোলন তৈরি করতে তারা ব্যর্থ হয়েছে, সেখানে নির্বাচন প্রতিহত করার মতো তীব্র আন্দোলন কি তারা তৈরি করতে পারবে? সেই সাংগঠনিক শক্তি এবং জনসমর্থন কি বিএনপির রয়েছে? এ-রকম হাজারো প্রশ্নের ঘূর্ণাবর্তের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে বিএনপি।
এদিকে পশ্চিমা শক্তি বাংলাদেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেখতে চায়। বিভিন্ন সময় তারা সরকারের কাছে তাদের এই মত জানিয়েছে। তাতে অনেকে উল্লসিত হয়ে উঠেছে এই ভেবে যে, এবার বোধহয় পশ্চিমা শক্তি বিএনপিকে ক্ষমতায় বসাতে তৎপর রয়েছে। কিন্তু সে নিয়েও বিএনপির মধ্যে হতাশা, কারণ পশ্চিমা শক্তি যে বিএনপিকে ক্ষমতায় দেখতে চায়, সে-ধরনের কোনো বার্তাও তাদের দেয়নি। বরং সম্প্রতি মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক সাক্ষাৎকারে বলেছে, ‘নির্বাচন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়।’
স্বাভাবিকভাবে বিএনপি নেতৃত্বের মধ্যে এ প্রশ্নও তৈরি হয়েছে যে আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে বিএনপিকে সামনে রেখে পশ্চিমা শক্তি কি তাহলে তাদের নিজস্ব কোনো এজেন্ডা বাস্তবায়নে দেন-দরবার করছে?
এদিকে মিত্র রাজনৈতিক দলগুলোও যে বিএনপির খুব একটা আস্থায় আছে সেটিও নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। মিত্রদের আস্থায় রাখাও একটা বড় চ্যালেঞ্জ তাদের জন্য। ক্ষমতায় গেলে তাদের নিয়ে জাতীয় সরকার তৈরি করবে সে-রকম একটি মুলাও ঝুলিয়ে রেখেছে। কিন্তু তাতেও খুব একটা কাজ হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। চলতি বছরের ১৭ মার্চ বিএনপি অনুগত বুদ্ধিজীবী ফরহাদ মাজহার এবং বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শওকত মাহমুদের নেতৃত্বে ‘জাতীয় ইনসাফ কায়েম কমিটি’র আত্মপ্রকাশ ঘটে। সেখানে তারা নির্বাচনের পূর্বেই অন্তর্বর্তীকালীন জাতীয় সরকার গঠন করার দাবি তুলেছে। যদিও পরবর্তীতে শওকত মাহমুদকে বিএনপি থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে; কিন্তু এ-সময় ইনসাফ কমিটির পক্ষ থেকে জাতীয় সরকারের গঠন নিয়ে প্রশ্ন তোলাটাও পর্দার আড়ালে অন্য রাজনীতিরই আভাস দেয়।
বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া অসুস্থ এবং দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমান লন্ডনে পলাতক। দেশের বাইরে বসেই তার যত হম্বিতম্বি। তার এই হম্বিতম্বি বিএনপির নেতৃত্বকেও অস্বস্তিতে ফেলে দেয়। বিদেশে বসে তারেক রহমান দলের মধ্যে তার নিজস্ব অনুগতদের নিয়ে একটি বলয় সৃষ্টি করেছে, যাতে তারেক রহমানের সিদ্ধান্ত নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলতে না পারে। বিএনপির সিনিয়র নেতৃবৃন্দকে উপেক্ষা করে এই অনুগত বাহিনী দিয়ে তারেক রহমান দল পরিচালনা করছে। এতে বিএনপির সিনিয়র নেতৃবৃন্দের মধ্যেও একটা অস্বস্তি এবং ক্ষোভ বিরাজ করছে। তারেক রহমান কোনোদিন ক্ষমতা পেলে যে তাদের একবারেই ঝেঁটে বিদায় করে দেবে- এ আশঙ্কাটিও সিনিয়র নেতৃবৃন্দের মধ্যে প্রবলভাবে বিরাজ করছে।
তারেক রহমান চায় না সে বিদেশে থাকা অবস্থায় বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করুক। কিন্তু বিএনপির নতুন জেনারেশন নির্বাচনে যেতে আগ্রহী বলে মনে করা হয়। দীর্ঘদিন ধরে যথাযথভাবে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ না করার কারণে নির্বাচনী রাজনীতিতে নতুন নেতৃত্ব সামনে আসতে পারছে না। জনগণের কাছে তারা নিজেদের উপস্থাপন করতে পারছে না। ফলে মাঠপর্যায়ে নেতাদের গ্রহণযোগ্যতাও তৈরি হচ্ছে না। কিন্তু জিয়া পরিবারের অনাগ্রহের কারণে তাদের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারও হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়েছে।
ইতোমধ্যে গাজীপুর, খুলনা, বরিশাল, রাজশাহী ও সিলেট সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হয়েছে। বিএনপি বলছে যে তারা নির্বাচনে অংশ নেবে না। কিন্তু এই পাঁচ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে মেয়র ও কাউন্সিলর পদে বিএনপি-দলীয় প্রার্থীরা স্বতন্ত্রভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে বলে শোনা যাচ্ছে। এ আশঙ্কা থেকে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব মিডিয়ার মাধ্যমে দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে নির্বাচনে অংশ নিলে বহিষ্কার করা হবে বলে ক্রমাগত হুমকি প্রদান করে যাচ্ছে। এ থেকেই বোঝা যায় যে নির্বাচনকে ঘিরে বিএনপির অভ্যন্তরীণ রাজনীতি কতটা বেসুরো হয়ে বাজছে।
আগামীতে দেখার বিষয় হচ্ছে যে বিএনপি কীভাবে তার এই গৃহদাহ সামাল দেবে। তবে লেখাটি শেষ করতে চাই আবার শুরুর সেই কথা দিয়েই, ‘বিএনপি, তুমি পথ হারাইয়াছ?’
সৌজন্যেঃ উত্তরণ, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মুখপত্র