শেখ জামাল : স্যান্ডহার্স্ট একাডেমি থেকে রেজিমেন্ট জীবনে

559

Published on এপ্রিল 28, 2023
  • Details Image

এম নজরুল ইসলামঃ

স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে যে বাড়িটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, তিনি সেই বাড়ির সন্তান। যে পরিবারটি দেশের স্বাধীনতার জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত ছিল, তিনি সেই বাড়ির সদস্য। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা মুজিবের দ্বিতীয় পুত্র শেখ জামালের জন্ম ১৯৫৪ সালের ২৮ এপ্রিল গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায়। বাবা একটি রাজনৈতিক দলের কর্ণধার হলেও পরিবারটি মধ্যবিত্ত। খুব সাধারণ পরিবেশেই তাঁর বেড়ে ওঠা। লেখাপড়া করেছেন ঢাকার রেসিডেনসিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজে। এখান থেকে এসএসসি উত্তীর্ণ হওয়ার পর ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি। মুক্তিযুদ্ধের সময় পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে গৃহবন্দি হন তিনি। তাঁর বড় ভাই শেখ কামাল বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে যোগ দিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে। একদিন সেই পথ ধরলেন শেখ জামালও। পালিয়ে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন তিনি। কতই বা বয়স তখন তাঁর। কিশোরই বলতে হবে তাঁকে। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য কিশোর শেখ জামাল ১৯৭১ সালের ৫ আগস্ট ধানমণ্ডির তারকাঁটার বেড়া দেওয়া পাকিস্তানি বাহিনীর বন্দিশিবির থেকে পালিয়ে ভারতে যান। ধানমণ্ডি থেকে পালিয়ে ভারতের আগরতলা পৌঁছানো ছিল রীতিমতো ঝুঁকিপূর্ণ। দেশের স্বাধীনতার জন্য সেই ঝুঁকি নিয়েছিলেন তিনি। আগরতলা থেকে কলকাতা হয়ে ভারতের উত্তর প্রদেশের কালশীতে মুজিব বাহিনীর (বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স) ৮০ জন নির্বাচিত তরুণের সঙ্গে শেখ জামাল ২১ দিনের বিশেষ প্রশিক্ষণ শেষে যোগ দেন ৯ নম্বর সেক্টরে। যুদ্ধ শেষে ১৯৭১ সালের ১৮ ডিসেম্বর স্বাধীন দেশে ফিরে আসেন। ওই দিনই বিকেলে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে কাদের সিদ্দিকী বীর-উত্তম আয়োজিত স্বাধীন বাংলায় ঢাকার পল্টনে প্রথম জনসভায় উপস্থিত ছিলেন তিনি।

বঙ্গবন্ধু শেখ জামালকে সেনা অফিসার হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। ১৯৭৪ সালের ২৯ জানুয়ারি ঢাকায় রাষ্ট্রীয় সফরে এসেছেন যুগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটো। তিনি শেখ জামালকে যুুগোস্লাভ মিলিটারি একাডেমিতে সামরিক প্রশিক্ষণের প্রস্তাব দেন। ১৯৭৪ সালের বসন্তে ঢাকা কলেজের ছাত্র জামাল যুগোস্লাভিয়ার মিলিটারি একাডেমিতে ক্যাডেট হিসেবে যোগদান করেন। কিন্তু একেবারে ভিন্ন পরিবেশ, প্রতিকূল আবহাওয়া আর ভাষার অসুবিধার কারণে সেখানকার প্রশিক্ষণের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো শেখ জামালের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে। মার্শাল টিটো তাঁকে ব্রিটেনের স্যান্ডহার্স্টে প্রশিক্ষণ গ্রহণের পরামর্শ দেন। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. বায়েজিদ সরোয়ার (অব.) লিখেছেন, ১৯৭৪ সালের শরতে স্যান্ডহার্স্টে সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণের লক্ষ্যে শেখ জামাল লন্ডনে এসে পৌঁছেন। তবে স্যান্ডহার্স্টের পূর্বশর্ত হিসেবে তাঁর ব্রিটেনের আর্মি স্কুল অব ল্যাঙ্গুয়েজ, বেকনসফিল্ড থেকে প্রয়োজনীয় পূর্ব-প্রশিক্ষণ গ্রহণের প্রয়োজন পড়ে। বিশ্বের সেরা সামরিক একাডেমিগুলোর মধ্যে স্যান্ডহার্স্ট অন্যতম। এখানে দ্বিতীয়বারের মতো বাংলাদেশের তিনজন তরুণ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে আসেন।

উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধুর বিশেষ উদ্যোগে ১৯৭৪ সালে সর্বপ্রথম বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর দুজন ক্যাডেট শফি মো. মেহবুব ও লুেফ কামাল স্যান্ডহার্স্ট থেকে কমিশন লাভ করেন। স্যান্ডহার্স্টের শর্ট সার্ভিস কমিশনের সুকঠিন গ্র্যাজুয়েট কোর্সটির মেয়াদ ছিল প্রায় ছয় মাস—৩ জানুয়ারি থেকে ২৭ জুন ১৯৭৫। ৪০০ ক্যাডেটের মধ্যে বিদেশি ক্যাডেটের সংখ্যা ছিল ৩০। ১৯৭৫ সালের মে মাসের শেষের দিকে স্যান্ডহার্স্ট থেকে ক্যাডেটরা রণকৌশলগত চূড়ান্ত অনুশীলন এক্সারসাইজ ডাইনামিক ভিক্টোরিতে অংশগ্রহণ করতে পশ্চিম জার্মানিতে ব্রিটিশ আর্মি অন রাইন যান। এ অনুশীলনকে রীতিমতো যুদ্ধই বলা যায়। গায়ে কমব্যাট ইউনিফর্ম, হাতে রাইফেল, পিঠে হ্যাভারস্যাক পরে জামাল পুরোপুরি যোদ্ধা। কখনো পাহাড়ি এলাকা, কখনো অরণ্য, কখনো খোলা প্রান্তরে চলে দুঃসাহসিক অনুশীলন। সারা দিন প্রতিরক্ষায় ট্রেঞ্চে বসে থাকা। ভোররাতে পরিচালিত হলো গোর্খা ব্যাটালিয়নের আক্রমণ। আকাশে শত্রুর বিমান। ট্রেঞ্চের কিছু দূরে আর্টিলারি শেল পড়ে। চলে লাইভ ফায়ারিং। শত্রুদের হটিয়ে এবার এগিয়ে যেতে হয়। পাইন বৃক্ষশোভিত অরণ্যময় এলাকায় হেলিকপ্টার থেকে র‌্যাপলিং করে নামতে হতো কয়েক শ ফুট।

স্যান্ডহার্স্ট একাডেমি থেকে প্রশিক্ষণ শেষে দেশে ফিরে এলে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট শেখ জামালের পোস্টিং হয় ঢাকা সেনানিবাসের দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। সেখানে বীরপ্রতীক ক্যাপ্টেন নজরুলের অধীনে ‘কম্পানি অফিসার’ হিসেবে শেখ জামালের রেজিমেন্ট জীবনের হাতে খড়ি। দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গলে জামালের চাকরিকাল ছিল প্রায় দেড় মাস। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. বায়েজিদ সরোয়ার (অব.) লিখেছেন, এই স্বল্প সময়ে অফিসার ও সৈনিকদের মধ্যে তিনি অসাধারণ পেশাগত দক্ষতা ও আন্তরিকতার ছাপ রেখেছিলেন। কয়েক সপ্তাহেই জামাল অফিসার ও সৈনিকদের মধ্যে তাঁদেরই একজন হয়ে যান। ট্রেনিং গ্রাউন্ডে, রণকৌশলের ক্লাসে, অবস্ট্যাকল ক্রসিংয়ে অংশ নিয়ে সৈনিকদের মুগ্ধ করেন। ব্যাটালিয়ন বক্সিং টিমের সদস্যদের প্রশিক্ষণ দেন। বিকেলে খেলার মাঠে ইউনিটের সদস্যদের সঙ্গে বাস্কেট বল খেলেন।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে নিহত হন তিনি। বিপথগামী কয়েকজন সহকর্মীই তাঁর ঘাতক। আজ তাঁর জন্মদিনে স্মরণ করি সেই কিশোর মুক্তিযোদ্ধাকে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যিনি যুদ্ধে গিয়েছিলেন, নিজেকে চৌকস সামরিক অফিসার হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন।

লেখক : সর্ব ইউরোপিয়ান আওয়ামী লীগের সভাপতি

সৌজন্যেঃ কালের কণ্ঠ

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত