800
Published on জানুয়ারি 15, 2023শেখর দত্ত
ছোটবেলা থেকেই দেখে এসেছি, বাঙালি সমাজে শিক্ষিত-অশিক্ষিত মানুষ মাত্রই ব্যতিক্রমী বা আশ্চর্যজনক কোনো কিছু জানলে বা শুনলে প্রবাদ উচ্চারণ করে। প্রবাদ হচ্ছে লোকসমাজের স্বতঃস্ফূর্ত সংক্ষিপ্ত উক্তি, সমাজের দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতালব্ধ জীবনসত্যের প্রকাশ, যা সাধারণভাবে বিদ্রুপাত্মক।
সম্প্রতি প্রতিষ্ঠিত পুরানা পল্টনের মণি সিংহ-ফরহাদ স্মৃতি ট্রাস্ট ভবনের একতলায় সমাজ বিকাশ পাঠাগারে বসে বিজয়ের মাসের ২০ তারিখে কেউ বই আবার কেউ পত্রিকা পড়ছিলেন। হঠাৎই পত্রিকা পাঠরত একজন নিস্তব্ধতা ভেঙে বলে উঠলেন- ‘কয়লা ধুলেও ময়লা যায় না।’ সবাই তার দিকে তাকালেন। তিনি দ্বিতীয় প্রবাদ বিদ্রুপাত্মক স্বরে উচ্চারণ করলেন- ‘উঠন্ত মুলো পত্তনেই চেনা যায়।’ সেখানে উপস্থিত সবাই পরে জানতে পারলেন, বিএনপি দলটির ‘রাষ্ট্র মেরামত’ করার ২৭-দফা কর্মসূচি পড়ে তিনি ওই প্রবাদ দুটো উচ্চারণ করেছেন।
‘রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের রূপরেখা’ পড়লে এমন প্রবাদ কম-বেশি সকলেই উচ্চারণ করবেন। পাঠকরা চলুন না, রূপরেখার আদ্যোপান্ত বিবেচনার মধ্যে নেই। রূপরেখার সূচনায় বলা হয়েছে : “বাংলাদেশের জনগণ গণতন্ত্র, সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন নিয়া এক সাগর রক্তের বিনিময়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে রাষ্ট্র গড়িয়া তুলিয়াছিল, সেই রাষ্ট্রের মালিকানা আজ তাহাদের হাতে নাই।” এমন কথা বিএনপির মুখে যেন ভূতের মুখে রাম নাম! সপরিবারে বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার হত্যার পটভূমিতে সামরিক শাসনের মধ্যে ক্ষমতায় থেকে ক্যান্টনমেন্টে বসে যে দল জন্মলগ্নেই হয় ক্ষমতাসীন দল, সেই দল যদি গণতন্ত্রের কথা বলে, তবে বোধ করি ‘মরা মানুষ হাসবে।’ জনগণের স্মৃতিতে এখনও ১৯৯৬-এর ফেব্রুয়ারির নির্বাচন, ২০০১ সালের শা-ল-সা সরকারের নির্বাচন এবং ২০০৬ সালের নির্বাচনের আগে ‘পুতুল সরকার’ ড. ইয়াজউদ্দিনের ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং চিত্র গেঁথে আছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে হাওয়া ভবনের নীলনকশায় পেরেকের পর পেরেক মেরে কীভাবে বাক্সবন্দি করা হয়েছিল, তা দেশবাসীর জানার মধ্যেই আছে। তাই ওই দলের মুখে গণতন্ত্র শোভা পায় না।
‘মানবিক মর্যাদা’র কথা বিএনপির মুখে শুনলে বোকারাও তিন হাসি হাসবে। বিএনপির নেতারা বলুন তো হত্যা-ক্যু-পাল্টা ক্যুর ভেতর দিয়ে কতজনকে হত্যা করেছিল বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান! পরিত্রাতা কর্নেল তাহেরকে যখন বিশ্বাসঘাতকতা করে ‘হুকুমের বিচারে’ ফাঁসিতে ঝোলানো হয় কিংবা ২০০১ সালে ভোট ডাকাতির নির্বাচনে তথাকথিত জয় পেয়ে নিরীহ ভোটারদের ওপর হত্যা-খুন-সন্ত্রাস এবং সংখ্যালঘুদের ওপর যখন ‘এথেনিক ক্লিনজিং’ চালানো হয়, তখন কোথায় ছিল মানবতা! ২০০৪ সালে বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড বিস্ফোরিত করার ঘটনাকে কী বলা যায়! কিবরিয়া, আহসানউল্লাহ মাস্টার, মঞ্জুরুল ইমাম, মমতাজউদ্দিন প্রমুখের হত্যাকাণ্ডকে!
যে-দল ‘মানি ইজ নো প্রবলেম’ বলে দেশে লুটেরা অর্থনীতি চালু করেছিল, সে-দলের মুখে ‘সাম্য’, ‘সামাজিক ন্যায়বিচার’ কথাটা একেবারেই খাপ খায় না। তাই বিএনপির রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের ২৭-দফা রূপরেখার সূচনাতেই হয়েছে ‘বিসমিল্লায় গলদ’! এখানে বলে রাখি, রূপরেখার সূচনায় ‘রাষ্ট্রের মালিকানা’ প্রসঙ্গটি দফাগুলো পর্যালোচনা করে না বলা যাবে না। তাই বিষয়টি থাকবে বক্ষ্যমাণ লেখার শেষ পর্যায়ে। এখন পাঠকরা চলুন, বিএনপির রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের দাবিগুলো বিবেচনায় নেই।
এক নম্বর দফায় মূলত রয়েছে দুটো বিষয়। প্রথমত; আওয়ামী লীগ সরকার সংবিধানে অযৌক্তিক ও মৌলিক সংশোধনী এনেছে। তা ‘রহিত/সংশোধন’ করা হবে। দ্বিতীয়ত; সংবিধান সংশোধনে গণভোট ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হবে। এ-কথাগুলো যখন বিএনপি বলে তখন কী মনে রাখে? বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা নেতা প্রেসিডেন্ট জিয়া যখন সংসদ বা জনমতকে উপেক্ষা করে সামরিক ফরমানবলে সংবিধানের খোল নলচে পাল্টে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপরীত সাম্প্রদায়িক ধারা আমদানি করেছিলেন! তখন বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়া মৌলিক বলতে বুঝত পাকিস্তানি চেতনা। নিয়মনীতি ও যুক্তির ধারপাশে তিনি যাননি। কারণ তার ছিল আর্মির অস্ত্রবল। বিএনপি সংবিধান সংশোধনে গণভোটের দাবি তুলেছে। গণভোট, আস্থাভোটের রূপ-পদ্ধতি-ফলাফল কতটা হাস্যোস্পদ হয়, তা বিএনপির বর্তমান নেতৃত্বেরও মনে থাকার কথা। বিএনপি দলটি আসলে ভূতের মতো সবসময় পিছনে হাঁটে, বাংলাদেশকে বিপরীতমুখী করতে চায়। এজন্যই সংবিধান সংশোধনে আগ্রহী।
দুই নম্বর দফায় বিএনপি প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের রাজনীতির বিপরীতে সকল মত ও পথের সমন্বয়ে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে ‘রেইনবো নেশন’ প্রতিষ্ঠা করার কথা বলেছে। বাকচাতুর্যের সাত রঙে ভরা খুবই সুন্দর কথা! বলুন তো বিএনপির নেতারা, পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট কিংবা ৩ নভেম্বরের হিংসাত্মক ঘটনার প্রকৃত বেনিফিসিয়ারি কে বা কোন দল! পঁচাত্তরের আগে-পরে ইতিহাসের দারস্থ হলে কিন্তু কে কীভাবে কোন্ ঘুঁটি চালিয়ে প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের রাজনীতি বাংলাদেশে আমদানি করেছিলেন, তার সবটা দিবালোকের মতো সুস্পষ্ট হয়ে যাবে।
স্বঘোষিত খুনি ফারুক-রশীদ-ডালিম চক্রকে বিদেশে চাকরি দিয়ে বা চাকরি বহাল রেখে প্রেসিডেন্ট জিয়া যে স্বঘোষিত খুনিদের সপক্ষে ছিলেন, তার প্রমাণ রেখেছেন। বিএনপির প্রতিষ্ঠা, ভোটে জেতা কিংবা শাসনের সবকিছুর মূলে রয়েছে, একাত্তরের পরাজয়ের প্রতিহিংসা চরিতার্থ করা। আর দল-মত-পথ সবাই নিয়ে রেইনবো নেশন করা মানে তো হচ্ছে ঘাতক-দালাল জামাত আর তালেবানিদের রাষ্ট্রক্ষমতার অংশী করা। বাস্তবে রেইনবো থাকে আকাশে, ধরা-ছোঁয়া যায় না, একসময় মিলিয়ে যায়। বিএনপির রেইনবো নেশনও তেমনি।
বলুন তো বাংলাভাই বলে কেউ নেই বলেছিলেন কোন্ সরকারের মন্ত্রীরা! পৃথিবী বিখ্যাত ভারতীয় সন্ত্রাসী ডন ইব্রাহীমের সঙ্গে দুবাইয়ের এক হোটেলে দেখা করেছিলেন তারেক জিয়া। প্রবাদ বলে সোনার পাথরবাটি। দেশের সর্বোচ্চ আদালত জিয়া আমলের সব কর্মকাণ্ডকে অবৈধ ঘোষণা করা এবং হাওয়া ভবনের অবৈধ কর্মকাণ্ডের ভেতর দিয়ে বিএনপি আসলে হয়ে গেছে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ের পাথর, তা দিয়ে সোনার পাথরবাটি তথা রেইনবো নেশন হওয়ার নয়। অতীতের মতো বিএনপি অবশ্য ‘ব্যর্থ রাষ্ট্র’, ‘সন্ত্রাসী রাষ্ট্র’ বানাতে পারে।
তিন নম্বর দফায় গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠায় নির্বাচনকালীন দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে। আসলে নির্বাচনকালীন নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠার দাবি ছিল আমাদের জাতির গণতন্ত্রের সংগ্রামের অভিজ্ঞতালব্ধ ফসল, যা সংবিধান তথা রাষ্ট্রের মালিকানা জনগণের নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক হলেও তাতে জাতীয় ঐকমত্যের মহান আদর্শ প্রতিফলিত হওয়ায় জনগণ সংগ্রাম করেছিল। কিন্তু বলুন তো বিএনপির নেতারা! এখন ফাটা বাঁশের চিপায় পড়ে ‘দলনিরপেক্ষ’ শব্দটি দাবি হিসেবে সামনে আনছেন; কিন্তু তখন তখন ‘পাগল ও শিশু’ ছাড়া কেউ নিরপেক্ষ নেই বলেছিলেন কে! কার নেতৃত্বে আপনাদের সরকার জনগণের দাবিকে ছেঁটে দিয়ে অর্থাৎ ‘নিরপেক্ষ’ শব্দটি বাদ দিয়ে কেবল ‘নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ব্যবস্থা সংবিধানে যোগ করেছিলেন। তিনি হচ্ছেন খালেদা জিয়া। এতিমদের ট্রাস্টের টাকা আত্মসাতের মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে তিনি এখন আর বিএনপির চেয়ারপারসন নেই। আওয়ামী লীগ সরকারের বদান্যতায় তিনি জেলের বাইরে, কৃতকর্মের সাজা ভোগ করছেন। তিনি বলেছিলেন বিএনপির নেতারা ‘আঙ্গুল চোষা’, সেই নেতারাই এখন আদালতের রায়ে লাশ দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি তুলে ধরছেন।
দলনিরপেক্ষ সরকার বিএনপি মেনে নেয়নি। এমন কী নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার-ব্যবস্থারও বারোটা বাজিয়েছিল। বিচারপতিদের বয়স বাড়ানোর নাটক করে হাসানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান করতে চেয়েছিল কারা! বিএনপির প্রজেকটেড তথা ভাবী প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী, ক্ষমতার প্যারালাল কেন্দ্র হাওয়া ভবন আর রঙ্গরসের খোয়াব ভবনের নেতা তারেক রহমানই কিন্তু ‘টু ইন ওয়ান’, অর্থাৎ রাষ্ট্রপতি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান ড. ইয়াজউদ্দিনকে দিয়ে ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং করতে গিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার-ব্যবস্থায় শেষ পেরেকটি ঠুকে দিয়েছিলেন।
২০০৭ সালের ১০ মে জরুরি আইনের সরকার থাকাকালীন সময়ে মহানগর বিএনপি নেতা সাদেক হোসেন খোকা বলেছিলেন, ‘বিচারপতিদের চাকরির বয়স বাড়ানো, ইয়াজউদ্দিনকে সরকারপ্রধান করা, ২২ জানুয়ারি একদলীয় নির্বাচনের পথে এগোনো প্রভৃতির জন্য দেশে আজ এ অবস্থা।’ মহাসচিব মান্নান ভূঁইয়াসহ অনেক নেতাই তখন এই সত্য উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। আসলে লতিফুর রহমান ও ড. ইয়াজউদ্দিনের মেরে যাওয়া পেরেকগুলো ‘সুযোগ্য পুত্র’ বা ‘ভাইয়া’ তারেক রহমানকে দেশে এনে খুলতে বলা এখন বিএনপি নেতাদের কর্তব্য। কৃতকর্মের প্রায়শ্চিত্ত ছাড়া রেহাই কেউ পেতে পারেন না, ইতিহাসের এই শিক্ষা যে বা যারা নিতে পারেন না, তাদের দিয়ে জাতির মঙ্গলের জন্য দাবিনামা প্রণয়ন শোভা পায় না।
চার নম্বর দফায় রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভার নির্বাহী ক্ষমতার ভারসাম্য আনা এবং নির্বাহী বিভাগ, আইন ও বিচার বিভাগের ক্ষমতা, দায়িত্ব ও কর্তব্য সুসমন্বয় করার কথা বলা হয়েছে। ফৌজদারি মামলার দণ্ডপ্রাপ্ত হাওয়া ভবনের নেতা দিয়ে রাষ্ট্রের তিন অঙ্গের সুসমন্বয় করা যাবে, এমন ভাবাটা আকাশ-কুসুম কল্পনা করারই নামান্তর। বেশি ব্যাখ্যায় না গিয়ে বলি, বিএনপি নির্বাচিত পরে বাতিলকৃত রাষ্ট্রপতি ডা. বদরুদোজ্জা চৌধুরী মহাখালীর রেললাইন দিয়ে দৌড়ে পালাচ্ছেন, এমন চিত্রটি স্মরণে আনুন। যে দল বা দলের নেতা তারেক রহমান এমনটা করতে পারেন, তিনি বা তার দল রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন, এমনটা মনে করা আর বোকার স্বর্গে বাস করা অর্থ একই।
পাঁচ নম্বর দফায় দুই টার্মের অতিরিক্ত কেউ রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করবে না বিষয়টি উত্থাপন করা হয়েছে। বর্তমান বাংলাদেশে এই প্রস্তাব কার্যকর হবে, এমনটা যারা ভাবতে পারেন তারা আসলে দিবাস্বপ্ন দেখেন। দলীয় কাউন্সিলের টার্ম যারা রক্ষা করতে পারেন না, তাদের মুখে এ-কথা মানায় না। বিএনপি গণতন্ত্রের কথা বলে কিন্তু তাদের কাউন্সিল হয় না। ফৌজদারি মামলার দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি বিদেশে পালিয়ে থেকেও দলের প্রধান হয়ে যেতে পারে। তারা বাস্তবায়ন করবে রাষ্ট্রক্ষমতায় দুই টার্ম নীতি! এই দাবি তোলা তো ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দেওয়ার নামান্তর। আমেরিকা এই নীতি কার্যকর করতে পেরেছে। রাশিয়া কিন্তু পারেনি। পুতিন রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর পদ দিয়ে এক্কা-দোক্কা খেলছেন। বাংলাদেশে কোনো দলকে এমন খেলা খেলতে দেওয়া হবে আত্মহননেরই শামিল। তবে বিএনপির গলায় কলসি বেঁধে পানিতে মরতে যেতে হবে না। কারণ অঙ্গীকার রক্ষা করার দল নয় বিএনপি।
ছয় নম্বর দফায় বিশেষজ্ঞ জ্ঞানের সমন্বয়ে রাষ্ট্র পরিচালনায় উচ্চ কক্ষবিশিষ্ট আইনসভার কথা বলা হয়েছে। এমন দাবি কখনোবা নিরপেক্ষ দাবিদার সুশীল সমাজের কারও কারও কাছ থেকে শোনা যায়। প্রবাদ বলে, এক রামে পারে না সুগ্রীব দোসর! এক পার্লামেন্টই বয়কট, পদত্যাগে চলে না। তারপর আবার বোঝার ওপর শাকের আঁটি। বিএনপি নেতাদের বোধকরি মনে নেই, সংসদ থাকতেও অধ্যাদেশ দিয়ে দেশ পরিচালনা কিংবা সংসদীয় কমিটিকে অকার্যকর করে রাখার কথা।
সাত নম্বর দফায় আস্থা ভোট, অর্থবিল, সংবিধান সংশোধনী বিল এবং রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন জড়িত- এমনসব বিষয় ব্যতীত সংসদ সদস্যদের স্বাধীনভাবে মতামত প্রকাশের সুযোগের কথা বলা হয়েছে। প্রবাদ বলে- কথায় বৃহস্পতি। বিএনপি আসলে কথায় পটু। কাজে অষ্টরম্ভাই কেবল নয়, প্রতিহিংসাকে পুঁজি করে কথায় জনগণকে ধোঁকা দিতে চায়। বলুন তো বিএনপির নেতারা! এবারে যে সংসদ সদস্যরা সংসদ থেকে পদত্যাগ করলেন, তাতে কী তাদের মতামত নেওয়া হয়েছে। দেশবাসী জানে না কোনো মতামত নেওয়া হয়েছিল কী না! যদি নেওয়া হতো, তবে অন্তত পদত্যাগের আগে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পদত্যাগী এমপি, যিনি বাই ইলেকশন করছেন, তার বিরুদ্ধকণ্ঠ দেশবাসী শুনতে পারত। কবে, কখন, কোথায় বিএনপি নেতারা দলে গণতন্ত্রের চর্চা করেছে। দলে না করে সংসদে করবে, এমনটা ভাবা যায় না। প্রবাদ বলে- আপনি আচারি ধর্ম পরকে শেখাও।
পরবর্তী কতক দফায় নির্বাচন কমিশন, সাংবিধানিক সব প্রতিষ্ঠান পুনর্র্গঠন, বিচার বিভাগ, আইনের শাসন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা, প্রতিরক্ষা বাহিনী, স্থানীয় সরকারব্যবস্থা, প্রশাসনিক সংস্কার, মিডিয়ার স্বাধীনতা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নারীর ক্ষমতায়ন, শ্রমজীবীদের ন্যায্য মজুরি, মুক্তিযুদ্ধের শহিদদের তালিকা, যুবসমাজ, কৃষি, জ্বালানি, জ্ঞানভিত্তিক সমাজ নির্মাণ প্রভৃতি নিয়ে যা বলা হয়েছে, তা গতানুগতিক। তাই সেসব দফা নিয়ে আলোচনা করা হলো না। তবে দুনীতি, ধর্মপালনের স্বাধীনতা ও বৈদেশিক নীতি সম্পর্কে যা বলা হয়েছে, তা আলোচনার দাবি রাখে।
বারো নম্বর দাবিনামায় বলা হয়েছে, দুর্নীতির ক্ষেত্রে কোনো আপস করা হবে না। অর্থপাচার ও দুর্নীতির অনুসন্ধান করে একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করা হবে। সংবিধান অনুযায়ী ন্যায়পাল গঠন করা হবে। এটা বোধকরি কারোরই অস্বীকার করার উপায় নেই যে, দুর্নীতি ও অর্থপাচার কালপরিক্রমায় ক্যানসার হিসেবে সমাজদেহে ছড়িয়ে পড়েছে। প্রবাদ স্মরণে এনে বলা যায়- সর্বাঙ্গে ব্যথা ওষুধ দেবো কোথা। এ অবস্থা থেকে এক ধাক্কায় উত্তরণের বোধকরি কোনো পথ নেই। আর্মির শাসন শুরু হয়েছিল দুর্নীতি, কালো টাকা ও অর্থপাচার রোধ করার কথা বলে। কিন্তু ক্ষমতা এসে ‘মানি ইজ নো প্রবলম’ নীতি গ্রহণ করে দুর্নীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া হয়েছে। রাজনীতি রাজনীতিকদের জন্য ডিফিক্যাল্ট করা হয়েছে। আর্মি ব্যাকড সুশীল সমাজের সরকার জরুরি আইনের ১/১১-র সরকার এসে দুর্নীতি নির্মূল দূরে থাক; বরং দুর্নীতিকে সর্বংসহা করে তুলেছে।
দুর্নীতিকে দমনের পন্থা হচ্ছে, ক্রমে রাষ্ট্র ও সমাজের সব প্রতিষ্ঠানকে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার আওতায় আনা, দেশকে ডিজিটাইজ করা, সামাজিক আন্দোলন-প্রতিরোধ দাঁড় করানো প্রভৃতি। এসবই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারায় জাতীয় পুনর্জাগরণের সঙ্গে যুক্ত। প্রয়াত নেতা প্রেসিডেন্ট জিয়ার ছিল ‘ছেঁড়া গেঞ্জি’ আর ‘ভাঙা সুটকেস’। তার স্ত্রী বিধবা ভাতা আর পুত্ররা এতিম ভাতা পেতেন। বাড়ি-গাড়ি সব ছিল রাষ্ট্রের দেওয়া। এমন অবস্থা থেকে নিমিষের মধ্যে ডান্ডি ডাইং, রহমান গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ ও নেভিগেশন ব্যবসার বিশাল অর্থনৈতিক সাম্রাজ্য গড়ে ওঠা রূপকথার গল্পকেও হার মানায়। নয়-ছয় কিংবা বাম হাতের কারবার ছাড়া এমনটা হতে পারে না। বাস্তবে দুর্নীতির সঙ্গে আপস করব না ধরনের মুখরোচক কথা বিএনপির মুখে মানায় না। বিদ্যুৎ খুঁটির ‘খাম্বা’ হওয়া কিংবা পেট্রোল কেরাসিন হওয়ার পেছনে হাওয়া ভবনের উল্টোসিধে কারবারের কথা জনগণ কোনোদিন ভুলতে পারবে না। আর ন্যায়পাল! ১৯৮০ সালে জিয়ার আমলে ন্যায়পাল নিয়োগ ও তার দায়িত্ব নির্ধারণ করে আইন প্রণয়ন করা হয়েছিল। কিন্তু ন্যায়পাল পদটিতে কোনো নিয়োগই দেয়নি জিয়া সরকার। তখন হাওয়া ভবন ছিল না। তবে ওই প্রতিশ্রুতি বা আইন হাওয়ায় উড়ে গেছে!
ষোলো নম্বর দফায় বলা হয়েছে, ‘ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার- এ মূলনীতির ভিত্তিতে প্রত্যেক ধর্মাবলম্বী নিজ নিজ ধর্ম পালনের পূর্ণ অধিকার ভোগ করবেন। এ প্রতিশ্রুতি দেওয়ায় বিএনপি ধন্যবাদ পেতে পারে। তবে তাতে বিএনপিকে বলতে হবে, প্রেসিডেন্ট জিয়ার সংবিধান সংশোধন বাতিল করে দল চার মূলনীতি সংবলিত বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যেতে চায়। কারণ ‘ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার’- এ নীতি কার্যকর করতে গেলে বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি কার্যকর করতে হবে। সর্বোপরি বিএনপির ঘোষণাপত্রও সংশোধন করতে হবে। ওটা তো তাদের হাতেই আছে। পরিবর্তন করার আগে কথায় ফানুস উড়িয়ে লাভ কী!
উনিশ নম্বর দফা আরও আগ্রহোদ্দীপক। তাতে বৈদেশিক নীতির বয়ান রয়েছে। বিএনপি বলছে, ‘বাংলাদেশের ভূখণ্ডের মধ্যে কোনোরকম সন্ত্রাসী তৎপরতা বরদাশত করা হবে না এবং কোনো সন্ত্রাসবাদী আশ্রয়-প্রশ্রয় পাবে না।’ হায় রে বিএনপি! ঠাকুর ঘরে কে রে, আমি কলা খাই না প্রবাদটা এ দলটির জন্য খুব খাটে। আইএসআই-র সহায়তায় উলফাসহ ভারতের সেভেন সিস্টারের উগ্রবাদী ও বিচ্ছিন্নতাবাদীদের জন্য কারা বাংলাদেশকে অভয়ারণ্য করে দিয়েছিল। উলফা নেতা রাজখোর আর পরেশ বড়ুয়া বাংলাদেশে ছিলেন কীভাবে! বিএনপির আমলে ভারত বাংলাদেশে ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের অস্ত্র প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের তালিকা দিয়েছিল। এসব প্রশ্নে সদুত্তর ছাড়া এসব ওয়াদা দেওয়া কেবল ধূর্ততা নয়, কাপুরুষতার লক্ষণ।
সবশেষে আবারও ফিরে যাওয়া যাক রাষ্ট্রকাঠামো সংস্কার রূপরেখার সূচনায়। বিএনপি ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে রাষ্ট্র গড়িয়া তুলিয়াছিল, সেই রাষ্ট্রের মালিকানা আজ জনগণের হাতে নাই’ কথাটা বলেছে। এটা ঠিক বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়া মুক্তিযোদ্ধা ভাবমূর্তি বিএনপি দল গঠন ও রাষ্ট্র পরিচালনার সময়ে ব্যবহার করেছিলেন। পরবর্তীতে বিএনপি জিয়াকে স্বাধীনতার ঘোষক বলেও ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রচার করেছে। যদিও এখন এ নিয়ে তেমন আর ঢাকঢোল পেটায় না। কেমন যেন গেছে চুপসে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ‘গ্রিন সিগন্যাল’ পেয়ে যিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন, তিনি কীভাবে স্বাধীনতার ঘোষক হন, তার উত্তর কখনও বিএনপি দিতে পারেনি। যেমন উত্তর দিতে পারেনি, তিনি চট্টগ্রাম গিয়েছিলেন কেন? জাহাজ থেকে হানাদার বাহিনীর অস্ত্র নামাতে কি?
বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে, ২৬ মার্চের উষালগ্নে। আওয়ামী লীগ নেতা এমএ মান্নান ২৬ মার্চ সন্ধ্যে ৭টা ৪৫ মিনিটে আর মেজর জিয়া পরদিন চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেছিলেন। বিএনপি কখনও এ প্রশ্নের উত্তর দেয়নি, স্বাধীনতা দিবসের পরের দিন ২৭ মার্চ কীভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়া যায়? স্বাধীনতাবিরোধী ঘাতক-দালাল দল জামাত, যে দল কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চায়নি, সেই দলকে স্বাধীন বাংলাদেশে দল করার অধিকার দিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট জিয়া। পরে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া তাদের মন্ত্রী বানিয়ে গাড়িতে-বাড়িতে পতাকা উড়ানোর সুযোগ করে দেন। আর বিএনপি কথিত হবু প্রধানমন্ত্রী তারেক রহমান জনসভায় বুকে জড়িয়ে ধরে তাদের বলে ‘আত্মার আত্মীয়’। সর্বোপরি খালেদা জিয়া মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বামী মেজর জিয়ার পাশে না দাঁড়িয়ে ঢাকায় ফিরে এসে হানাদার বাহিনীর ক্যান্টনমেন্টে ছিলেন। বিএনপি এখনও ছাতা হয়ে জামাতকে মাঠে নামার সুযোগ করে দিচ্ছে। এই দলের মুখে কি ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে মুক্তিযুদ্ধে’ বিজয়ের কথাটা মানায়?
আর রাষ্ট্রের মালিকানা জনগণের কথাটাও বিএনপির মুখে একদম শোভা পায় না। পঁচাত্তরের খুনি মোশতাকের ক্ষমতার উৎস ছিল ক্যান্টনমেন্টের বাইরে, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের খুনি মেজরদের ট্যাংকের ছাউনিতে। কিন্তু জিয়া ক্ষমতাকে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যান। দেশ পড়ে ক্যু-পাল্টা ক্যু ও প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সামরিক শাসনের ঘোরপ্যাঁচে। তা থেকে মুক্ত হতেই আওয়ামী লীগ সংবিধান সংশোধন করে অবৈধ শক্তির ক্ষমতায় আসার পথ রুদ্ধ করেছে। বিএনপির কাছে কি ওই সংশোধনী অযৌক্তিক কিংবা মৌলিক, যা বিএনপি রাষ্ট্র মেরামতের জন্য সংশোধন করতে চায়! সব স্পষ্ট করে বলুন। অস্পষ্টতা ও কথার মারপ্যাঁচ হচ্ছে জনগণকে ধোঁকা দেওয়ার ফন্দি, তা শাক দিয়ে মাছ ঢাকার নামান্তর। জন্মলগ্ন থেকেই বিএনপি তা করে এসেছে।
লেখক : সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য, উত্তরণ