রাজনীতিতে ১০ ডিসেম্বর গুরুত্ব হারিয়েছে

877

Published on ডিসেম্বর 26, 2022
  • Details Image

ড. প্রণব কুমার পান্ডে:

গত প্রায় দুই মাসের ওপর সময়কালে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ১০ ডিসেম্বর কেন্দ্রিক উৎকণ্ঠা বিরাজমান ছিল জনসাধারণের মনে। মাস দুয়েক আগে ঢাকার একটি জনসভায় বিএনপি নেতা আমান উল্লাহ আমান বলেছিলেন যে, ১০ ডিসেম্বর থেকে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার নির্দেশনা অনুযায়ী বাংলাদেশ পরিচালিত হবে। সেই ঘোষণাকে সরকারের তরফ থেকে উড়িয়ে দেওয়া হলেও জনগণের মধ্যে এক ধরনের চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছিল এই ভেবে যে, ১০ ডিসেম্বর দেশে কী ঘটতে চলেছে। ১০ ডিসেম্বর কেন্দ্রিক যে বক্তব্য বিএনপির তরফ থেকে উপস্থাপন করা হয়েছিল, তাতে যুক্তি ছিল না।

কিন্তু তারপরও দেশবাসী এ বিষয়টি নিয়ে বেশ দুশ্চিন্তার মধ্যে দিনাতিপাত করেছে। অবশেষে ১০ ডিসেম্বর অতিবাহিত হয়েছে অন্য যে কোনো দিনের মতো। অনেক নাটকীয়তার পর বিএনপি ঢাকায় তাদের জনসমাবেশ করেছে এই দিনে। একই রকমভাবে সরকার এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে জনসভার স্থান নিয়ে বিভিন্ন ধরনের দরকষাকষি করা হলেও অবশেষে কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ছাড়াই বিএনপি তাদের ঢাকার সমাবেশ সম্পন্ন করেছে, যদিও নাশকতার আশঙ্কায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যথেষ্ট সজাগ ছিল।

১০ ডিসেম্বর নিয়ে দেশবাসীর উৎকণ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশে অবস্থিত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের মধ্যেও উৎকণ্ঠা প্রকাশ পেয়েছে। বিশেষত যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের তরফ থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে ১০ ডিসেম্বর বিএনপির নেতাকর্মীদের সংঘর্ষের আশঙ্কায় বাংলাদেশে অবস্থানরত তাদের নাগরিকদের সাবধানে চলাচল করার পরামর্শ প্রদান করা হয়েছিল। একই সঙ্গে বাংলাদেশ ভ্রমণে ইচ্ছুক সেই দেশের নাগরিকদের সতর্কতা অবলম্বন করতে বলা হয়েছিল।

একটি দেশের সরকার এবং তাদের কূটনীতিকদের প্রধান উদ্দেশ্য হলো, সেই দেশের জনগণের নিরাপত্তা বিধান করা। এটি যেমন একটি বাস্তবতা, ঠিক তেমনি একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে আগে থেকেই যদি বিভিন্ন ধরনের সংঘর্ষের আশঙ্কা করা হয়, তাহলে সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে দেশে এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের রাজনীতি সম্পর্কে একটি ভুল বার্তা যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মতো দেশের কূটনীতিকরা যখন এ ধরনের আশঙ্কা করেন এবং সেটি আন্তর্জাতিক মিডিয়াতে প্রচারিত হয়, তখন এ ধরনের ঘটনার বাস্তবে গুরুত্ব না থাকলেও, এক ধরনের বায়বীয় গুরুত্ব তৈরি হতে পারে। অতএব ভবিষ্যতেও বাংলাদেশে অবস্থিত বিভিন্ন দেশের দূতাবাসের কূটনীতিকদের এ ধরনের মন্তব্য করার আগে বা যে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করার আগে, সেই বিষয়টিকে কেন্দ্র করে আদৌ কোনো ধরনের বিপদের আশঙ্কা রয়েছে কিনা—সেটি ভালোভাবে বিশ্লেষণ করে তারপর পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ১০ ডিসেম্বর বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য কী বার্তা প্রদান করল? সাধারণ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিচার করলে বিএনপির বিভিন্ন বিভাগীয় শহরের জনসভার মতো ঢাকার জনসভাটিও একই রকম একটি জনসভা হিসেবেই বিবেচিত হয়েছে জনগণের কাছে। এ জনসভায় বিএনপির পক্ষ থেকে ১০ দফা দাবি উত্থাপন করা হয়েছে। এ দাবিগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ দাবি হচ্ছে বর্তমান সরকারের পদত্যাগ, ১৯৯৬ সালের আদলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন এবং বর্তমান নির্বাচন কমিশন বাতিল ও নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের মাধ্যমে দেশে একটি সুষ্ঠু, অবাধ এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজনের দাবি। এ দাবিগুলোর সঙ্গে বর্তমানে অভ্যন্তরীণ বাজারে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণসহ অন্যান্য দাবি রয়েছে। তবে এ দাবিগুলোর মধ্যে নতুনত্ব কিছু খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না কারণ এগুলো বিএনপির পক্ষ থেকে বেশ কিছুদিন ধরেই তাদের জনসভায় উপস্থাপন করা হয়েছে। বিএনপির পক্ষ থেকে দাবিগুলোকে আগামী দিনের আন্দোলনের একটি রূপরেখা হিসেবে উপস্থাপন করার একটি প্রয়াস লক্ষ করা গেছে। তবে সরকারি দলের পক্ষ থেকে বিএনপির এ জনসভাকে একটি বিফল জনসভা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াস লক্ষ করা গেছে। সরকারি দলের নেতারা যে কথাগুলো বলার চেষ্টা করেছেন তা হলো, এ জনসভাটি আলাদাভাবে কোনো গুরুত্ব বহন করে না বাংলাদেশের রাজনীতিতে। বিএনপি যে কথাগুলো গত বেশ কয়েক মাস ধরে বলে আসছে, সেই কথাগুলোর পুনরাবৃত্তি হয়েছে এ জনসভায়। তবে জনসভাকে কেন্দ্র করে বিএনপির সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মতদ্বৈততা তৈরি হয়েছিল।

পুলিশের ভাষ্যমতে, গত ৭ ডিসেম্বর পল্টনে বিএনপির অফিসের সামনে দলটির নেতাকর্মীরা পুলিশের ওপর চড়াও হয়েছিল। আবার বিএনপি নেতাকর্মীদের ভাষ্য অনুযায়ী, পুলিশ ইচ্ছাকৃতভাবে তাদের ওপর চড়াও হয়েছিল। এরই ধারাবাহিকতায় পুলিশ বিএনপির কেন্দ্রীয় অফিসে রেইড করে সেখান থেকে বেশ কিছু বোমা পেয়েছে মর্মে গণমাধ্যমকে জানায়। পরবর্তীকালে, সেই ঘটনার জেরে পুলিশ মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও মির্জা আব্বাসকে আটক করে এবং নাশকতার মামলায় আটক দেখানো হয়েছে। যদিও বিএনপির পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে যে, জনসভার সফলতাকে বাধাগ্রস্ত করতেই আটক করা হয়েছে তাদের শীর্ষ নেতাদের।

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ২০১৪ সালে বিএনপির ডাকা মাসাধিকালের অধিক হরতালের সময় দেশে ব্যাপক অগ্নিসন্ত্রাসের ঘটনা ঘটেছিল। ফলে আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিএনপির যে কোনো কর্মসূচিকে সরকার একটু অতিরিক্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে। কিন্তু এ ধরনের জনসভাকে সরকার যত গুরুত্ব প্রদান করবে, তা আখেরে বিএনপির জন্য ইতিবাচক হবে বলে দেশের বেশিরভাগ মানুষ মনে করে। সরকারের তরফ থেকে বেশ কিছুদিন ধরে বিএনপির সব ধরনের সভা-সমাবেশ অনুষ্ঠানের ব্যাপারে বাধা না দেওয়ার বার্তা প্রদান করা হয়েছে। যার ধারাবাহিকতায় বিএনপি দেশব্যাপী বেশ কিছু জনসভা করেছে। সরকারের পক্ষ থেকে এ ধরনের বার্তা প্রদান ইঙ্গিত করে যে, তারা আগামীতে সবাইকে নিয়ে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজনের ব্যাপ্যারে আগ্রহী। যদিও বিএনপির পক্ষ থেকে সরকার পতনের আন্দোলনের কথা বলা হচ্ছে, কিন্তু সরকার পতনের জন্য সাংগঠনিকভাবে যে শক্তি প্রয়োজন তা তাদের নেই যা ইতিমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে। ফলে সরকারের তরফ থেকে যখন এ ধরনের কর্মসূচিকে অধিক গুরুত্ব প্রদান করা হয়, তখন জনগণের মধ্যে যে ধরনের চিন্তার জন্ম নেয় তা হলো, কেনই-বা সরকার বিএনপিকে এত ভয় পাচ্ছে?

গত এক দশকের ওপরে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বাংলাদেশে অভূতপূর্ব উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। অতএব সরকার ও আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সেই উন্নয়নের অভিজ্ঞতাগুলোকে জনগণের সামনে উপস্থাপনের মাধ্যমে তাদের মন জয় করার বিষয়টি বেশি প্রাধান্য দেওয়া উচিত। তাছাড়া ইউক্রেন ও রাশিয়ায় যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাবে দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীসহ অন্যান্য দ্রব্যের ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে। সেই মূল্য কীভাবে কমানো যায় সে বিষয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। এটি করা সম্ভব হলে জনগণ আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষেই থাকবে বলে দেশের বেশিরভাগ মানুষ মনে করে।

তবে এটি করতে ব্যর্থ হলে সেটি সরকারের জন্য নেতিবাচক ফল নিয়ে আসতে পারে কারণ এরই মধ্যে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি মানুষের জীবন-জীবিকাকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে। আর মানুষের পিঠ যখন দেয়ালে ঠেকে যায় তখন কিন্তু মানুষ ঘুরে দাঁড়ায়। অতএব এ অবস্থা চলতে থাকলে আন্দোলনের জন্য বিএনপির সাংগঠনিক শক্তি না থাকলেও জনগণ সরকারের বিপক্ষে চলে যেতে পারে। ফলে সরকারের তরফ থেকে বিএনপির আন্দোলনকে বেশি প্রাধান্য না দিয়ে অভ্যন্তরীণ বাজারে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ এবং কীভাবে বৈশ্বিক মন্দা মোকাবিলা করা যায় সে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা দরকার। আমরা এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রীকে এ বিষয়ে বিভিন্ন ধরনের বক্তব্য উপস্থাপন করতে দেখেছি। রাজনীতিতে ১০ ডিসেম্বরের মতো ঘটনা ঘটবে, এটিই বাস্তবতা। এ বিষয়গুলোকে যেমন গুরুত্ব দিতে হবে, ঠিক তেমনিভাবে জনগণের জীবন ও জীবিকা স্বাভাবিক রাখার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।

লেখক : প্রফেসর, লোকপ্রশাসন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত