16351
Published on আগস্ট 15, 2022সাজ্জাদুল হাসানঃ
১৫ আগস্ট জাতির কালিমালিপ্ত বেদনাবিধুর শোকের দিন, জাতীয় শোক দিবস। মানুষের কথা বলতে গিয়ে, দেশের কথা বলতে গিয়ে, একটা জাতির মুক্তির জন্য, একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজীবন সংগ্রাম করেছেন। কিন্তু এ দেশের কতিপয় ষড়যন্ত্রকারী ও আন্তর্জাতিক চক্রান্তে ঘাতকদের বুলেটের আঘাতে বঙ্গবন্ধু তার পরিবারের সদস্যসহ নির্মমভাবে নিহত হন। খুনিরা ভেবেছিল, তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, তার রাজনীতির দর্শন ধ্বংস করা যাবে কিন্তু তা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক ‘মুছে ফ্যালো মিছে অশ্রু তোমার’ কবিতায় তাই লিখেছেন:
‘মুজিব মরে না, মরেনি মুজিব কোনো বুলেটের ঘায়।/বুলেটে পতিত দেহই কেবল, অমর সে আত্মায়।/মুছে ফ্যালো মিছে অশ্রু তোমার, আজো এই বাংলায়/কুটিরে পাথারে নগরে ও গ্রামে পায়ে পায়ে হেঁটে যায়/অবিরাম হেঁটে চলেছে মুজিব রক্তচাদর গায়।/মুজিব! মুজিব! জনকের নাম এত সহজেই মোছা যায়!’
বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের যে ব্যাপকতা তা লিখে শেষ করা যাবে না। তবুও বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক চেতনা নিয়ে আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস। বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির সাধনার অন্যতম আদর্শ ছিল অসাম্প্রদায়িকতা ও মানবতাবাদ। এ আদর্শের ওপর ভিত্তি করেই তিনি বাঙালির মুক্তির জন্য সারা জীবন সংগ্রাম করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় জাগরিত হয়ে মুক্তিযুদ্ধে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষ যুদ্ধ করেছিল একটি ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণে বাঙালি জাতির প্রতি সশস্ত্র সংগ্রামের যে আহ্বান জানিয়েছিলেন তা ছিল ধর্ম-বর্ণ, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবার প্রতি। এ আহ্বানে সাড়া দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষ।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সুমহান চেতনায় সাম্প্রদায়িকতা বা ধর্মের কোনো সংঘাতের ঠাঁই ছিল না। জীবন দর্শনে অসাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মনিরপেক্ষ হওয়ায় শেখ মুজিব বাংলার ৪টি প্রধান সম্প্রদায় হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সবাইকেই সমদৃষ্টিতে দেখতেন। তার ৬ দফা হিন্দু-মুসলমান, বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সবাইকে ধর্মীয় বিরোধ উপেক্ষা করে ’৭০-এর নির্বাচনে এক অবিশ্বাস্য ফলাফল নিয়ে আসে এবং সেখানেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রকৃত পটভূমি রচিত হয়। ধর্মীয় বিরোধের কারণে যে সাম্প্রদায়িকতার উদ্ভব হয় তা রোধকল্পে তিনি সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্রীয় মূল চার নীতির অন্তর্ভুক্ত করেন। বঙ্গবন্ধু মূলত ইসলামের সঙ্গে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় বিধানে অন্য সব ধর্মের সহাবস্থান নিশ্চিত করেছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক চেতনার উৎসে আছে পারিবারিক শিক্ষা। বঙ্গবন্ধুর পারিবারিক শিক্ষা ছিল, যিনি প্রকৃত ধার্মিক তিনি কখনো সাম্প্রদায়িক হতে পারেন না। অন্য ধর্ম ও মানুষের প্রতি সহনশীলতা ও ভালোবাসা প্রদর্শন তার পারিবারিক ঐতিহ্য। পারিবারিকভাবে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী ছিলেন বলেই ধর্মীয় সংকীর্ণতা যেমন বঙ্গবন্ধুকে স্পর্শ করতে পারেনি, তেমনি তার রাজনৈতিক জীবনেও কখনো ধর্মীয় গোঁড়ামি স্থান পায়নি। ধর্মের ব্যবহার যেন রাজনীতিকে কলুষিত না করে সেজন্যই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ধর্মকে রাজনীতি হতে দূরে রেখে অসাম্প্রদায়িক চেতনা প্রতিষ্ঠা করেছেন।
বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী থেকে জানতে পারি কিশোর বয়সেই নেতাজি সুভাষ বোসের ভক্ত হয়ে তিনি স্বদেশি আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৩৮ সালে হিন্দু-মুসলিম উত্তেজনা চলাকালে শেরেবাংলা একে ফজলুল হক ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী গোপালগঞ্জ সফরে আসার প্রাক্কালে বঙ্গবন্ধু স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর নেতৃত্বে থাকা অবস্থায় হিন্দু ছাত্রদের স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে অন্তর্ভুক্তির অনাগ্রহ দেখে আশ্চর্য হন। তার ভাষায়, ‘আমার কাছে তখন হিন্দু-মুসলমান বলে কোনো জিনিস ছিল না। হিন্দু ছেলেদের সঙ্গে আমার খুব বন্ধুত্ব ছিল। একসঙ্গে গানবাজনা, খেলাধুলা, বেড়ানো সবই চলত।’ ১৯৪৬ সালের আগস্ট মাসে সংগঠিত হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গায় তিনি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে দাঙ্গাবিরোধী তৎপরতায় নিয়োজিত ছিলেন এবং হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের লোককে নিরাপদে রাখার চেষ্টা করেছিলেন। (অসমাপ্ত আত্মজীবনী)
১৯৭২ সালের নভেম্বর মাসে ঢাকায় বাংলাদেশের আইনসভায় নবীন সংবিধান গ্রহণের সময় তিনি বলেছিলেন :
‘আমরা ধর্মাচরণ বন্ধ করব না... মুসলমানরা তাদের ধর্ম পালন করবেন... হিন্দুরা তাদের ধর্ম পালন করবেন... বৌদ্ধরা তাদের ধর্ম পালন করবেন... খ্রিস্টানরা তাদের ধর্ম পালন করবেন... আমাদের আপত্তি শুধু ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারে।’
ইংল্যাল্ডে বাংলাদেশ হাইকমিশন এবং লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস (এলএসই) দক্ষিণ এশিয়া কেন্দ্র কর্তৃক আয়োজিত এক বক্তৃতায় নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক অমর্ত্য সেন বলেন, “আক্ষরিক অর্থে বঙ্গবন্ধু শব্দটির মানে হলো বাংলার বন্ধু। কিন্তু তিনি ছিলেন এর চেয়েও বেশি। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের মহান রাজনীতিবিদ, বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি এবং বাংলাদেশের মানুষের জীবনে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলা ব্যক্তিত্ব। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুকে মানুষ ভালোবাসে মন থেকে।.”
১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দ্বিবার্ষিক কাউন্সিল অধিবেশনের উদ্বোধনী ভাষণে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘রাজনীতিতে যারা সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টি করে, যারা সাম্প্রদায়িক তারা হীন, নীচ, তাদের অন্তর ছোট। যে মানুষকে ভালোবাসে সে কোনোদিন সাম্প্রদায়িক হতে পারে না। যারা এই বাংলার মাটিতে সাম্প্রদায়িকতা করতে চায়, তাদের সম্পর্কে সাবধান হয়ে যাও। আওয়ামী লীগের কর্মীরা, তোমরা কোনোদিন সাম্প্রদায়িকতাকে পছন্দ করো নাই। তোমরা জীবনভর তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছ। তোমাদের জীবন থাকতে যেন বাংলার মাটিতে আর কেউ সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপন না করতে পারে।’ ওপরের আলোচনা থেকে আমরা বঙ্গবন্ধুর জীবনে অসাম্প্রদায়িক কর্মকা- ও মানবিকতার নানা উদাহরণ দেখতে পাই। প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক ও জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী ‘কেন তিনি জাতির পিতা’ বিশেষ প্রবন্ধে উল্লেখ করেন, ‘১৯৪৮ থেকে ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পূর্বপর্যন্ত, প্রথমে স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধিকার এবং শেষে স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে পরিচালিত বাঙালির সংগ্রামী সব তৎপরতায় শেখ মুজিবের ভূমিকা ক্রমান্বয়ে উজ্জ্বলতর হয়ে উঠতে থাকে। তিনি ধর্মনিরপেক্ষতা, অসাম্প্রদায়িকতা, গণতন্ত্র, বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও সমাজতান্ত্রিক মূল্যবোধের সঙ্গে নিজেকে একাত্ম করলেন। তার এই বিকাশ অন্য সব নেতা থেকে পৃথক করে তাকে এক অভূতপূর্ব মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্যে ভূষিত করে। বিশেষ করে তার অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ, মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির উল্লেখ করতে হয়।’
অসাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মনিরপেক্ষ হওয়ায় বাংলার জনগণ বঙ্গবন্ধুর ওপর আস্থা স্থাপন করেছিল এবং দেশ স্বাধীন হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর ধর্মনিরপেক্ষতা মানে সমাজে শান্তি বজায় রেখে সবার নিজ নিজ ধর্ম পালন করা, ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি না করা, ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার না করা। বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িকতা ও মানবিকতা বিভিন্ন বক্তব্য বা বিবৃতিতে শুধু প্রকাশ করতেন তা নয়। তার জীবনাচরণে তিনি তা ধারণ ও লালন করতেন। অনেক ঘটনার মধ্যেই তা প্রমাণিত হয়। যার মধ্যে মাত্র দুটি ঘটনা এখানে উল্লেখ করা হলো :
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে লিখেছেন : ‘একদিনের একটা ঘটনা আমার মনে দাগ কেটে দিয়েছিল, আজও সেটা ভুলি নাই। আমার এক বন্ধু ছিল ননীকুমার দাস। একসঙ্গে পড়তাম, কাছাকাছি বাসা ছিল, দিনভরই আমাদের বাসায় কাটাত এবং গোপনে আমার সঙ্গে খেত। ও ওর কাকার বাড়িতে থাকত। একদিন ওদের বাড়িতে যাই। ও আমাকে ওদের থাকার ঘরে নিয়ে বসায়। ওর কাকিমাও আমাকে খুব ভালোবাসত। আমি চলে আসার কিছু সময় পর ননী কাঁদো কাঁদো অবস্থায় আমার বাসায় এসে হাজির। আমি বললাম, ‘ননী কী হয়েছে?’ ননী আমাকে বলল, ‘তুই আর আমার বাসায় যাস না। কারণ তুই চলে আসার পর কাকিমা আমাকে খুব বকেছে তোকে ঘরে আনার জন্য এবং পুরো ঘর আবার পরিষ্কার করেছে পানি দিয়ে ও আমাকেও ঘর ধুতে বাধ্য করেছে।’ আমি বললাম, ‘যাব না, তুই আসিস।’
গোপালগঞ্জের ত্যাগী সমাজকর্মী চন্দ্র ঘোষের সঙ্গে জেলখানায় দেখা হয় বঙ্গবন্ধুর। গুরুতর অসুস্থ চন্দ্র ঘোষকে অপারেশনের জন্য বাইরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তিনি তখন তাকে দেখতে চাইলেন। বঙ্গবন্ধুও তাকে দেখতে গেলেন। চন্দ্র ঘোষ কেঁদে ফেললেন এবং বললেন, ‘ভাই, এরা আমাকে ‘সাম্প্রদায়িক’ বলে বদনাম দিল; শুধু এই আমার দুঃখ মরার সময়। কোনোদিন হিন্দু-মুসলমানকে দুই চোখে দেখি নাই।’ কথাগুলো শুনে সবার মতো বঙ্গবন্ধুর চোখেও পানি এসে গিয়েছিল। তখন তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছিলেন, ‘চিন্তা করবেন না, আমি মানুষকে মানুষ হিসেবেই দেখি। রাজনীতিতে আমার কাছে মুসলমান, হিন্দু ও খ্রিস্টান বলে কিছু নাই। সকলেই মানুষ। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিপিবদ্ধ এমন ঘটনার মাধ্যমেই বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রমাণ পাওয়া যায়।
ধর্মনিরপেক্ষতাকে ভিত্তি করে যে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের গোড়াপত্তন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ক্ষমতার পালা বদলে বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী মহলের ক্ষমতায় টিকে থাকার অভিপ্রায়ে তা বিভিন্ন সময়ে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। যদিও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ সর্বস্তরের মানুষ এসব অপশক্তির বিরুদ্ধে বারবার কঠোরভাবে রুখে দাঁড়িয়েছে। আমরা আশাবাদী এজন্য যে, তার সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর সে আদর্শকে বাস্তবায়নে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। বঙ্গবন্ধুর মতো তার কন্যাও অসাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শে বিশ্বাসী। পরিশেষে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে বাংলাদেশের বিশিষ্ট কবি নির্মলেন্দু গুনের ‘কোথায় তুমি নেই’ কবিতার কয়েকটি লাইন উদ্ধৃত করে শেষ করতে চাইÑ
‘কোথায় তুমি নেই?/তোমার ছবি প্রেমের মতো/মুক্ত ভুবনেই।/তোমার ছবি মৃত্যুহীন ঐ/
কালের ইতিহাসে;/সাগর জলে, নদীর জলে,/চোখের জলে ভাসে।’
লেখকঃ সাবেক সিনিয়র সচিব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও চেয়ারম্যান, পরিচালনা পর্ষদ বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স
সৌজন্যেঃ আমাদের সময়