জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি এবং বৈশ্বিক পরিস্থিতি

1254

Published on আগস্ট 8, 2022
  • Details Image

ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়াঃ 

জ্বালানি তেলের মূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে দেশে এক ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে। এটা স্বাভাবিক। এর আগে যখনই তেল-গ্যাসের দাম বেড়েছে, তখনই একই অবস্থা আমরা লক্ষ করেছি। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি সব সময় একটি অজনপ্রিয় কাজ।

এ ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে বড় ধরনের রাজনৈতিক ঝুঁকি নিতে হয়। এর পরও বিরূপ পরিস্থিতিতে দেশের অর্থনীতি সচল রাখার জন্য বাস্তবতার নিরিখে এ ধরনের দুঃসাহসী সিদ্ধান্ত গ্রহণের কোনো বিকল্প থাকে না। আমরা এর আগেও দেখেছি বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়ে জ্বালানি তেলের দাম ওঠানামা করতে। সবার নিশ্চয়ই মনে আছে, ২০১৬ সালে বাংলাদেশে জ্বালানি তেলের দাম কমানো হয়েছিল। আবার ২০২১ সালে বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে তা বাড়াতে হয়েছে। জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি বা হ্রাস কোনো সরকার নিয়ন্ত্রণ করে না, সবটাই আন্তর্জাতিক বাজার পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে। কিন্তু গতকাল রাতে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্তটি নিয়ে অনেকেই বিরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছেন।

আমাদের মনে রাখতে হবে, রাশিয়া-ইউক্রেনের চলমান যুদ্ধের কারণে বিশ্বজুড়ে খাদ্য ও জ্বালানির তীব্র সংকট সৃষ্টি হয়েছে। উন্নত রাষ্ট্রগুলোও এই পরিস্থিতির সঙ্গে সমন্বয় রাখতে হিমশিম খাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া গোটা পৃথিবীর জ্বালানি বাজারের সাপ্লাই চেইন ভেঙে পড়েছে। এই নিদারুণ বাস্তবতায় আইএমএফ সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশসহ প্রায় ৯৩টি রাষ্ট্র আইএমএফের কাছে আর্থিক ঋণের জন্য আবেদন করেছে। রাশিয়া পৃথিবীর তৃতীয় বৃহৎ জ্বালানি তেল উৎপাদনকারী দেশ। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র তাদের জ্বালানি তেল রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। বলা যায়, এই চলমান যুদ্ধে জ্বালানিকে একটি বিধঢ়ড়হ ড়ভ ধিৎ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। যার কারণে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল ও গ্যাসের অভূতপূর্ব কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি হয়েছে। কেউ কেউ বলছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মানবসভ্যতা এমন সংকটময় পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়নি। আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ এবং অর্থ দিয়েও ধনী ও উন্নত রাষ্ট্রগুলো গ্যাস মজুদ করতে পারছে না। ইউরোপের গ্যাস ব্যবহারের ৪০ শতাংশ রাশিয়া থেকে সরবরাহ করা হতো। গ্যাসসংকটের কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থাও উল্লেখযোগ্যভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে।

উল্লেখ্য, বিশ্বের এই সংকটময় পরিস্থিতির সঙ্গে বাংলাদেশকেও পৃথিবীর অন্যান্য রাষ্ট্রের মতো মূল্য সমন্বয় করতে হচ্ছে। বাংলাদেশে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি এই সমন্বয়েরই একটি অংশ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশরত্ন জননেত্রী শেখ হাসিনা টানা তৃতীয়বার সরকার পরিচালনার সুযোগ পাওয়ায় বাংলাদেশকে একটি শক্তিশালী অর্থনৈতিক কাঠামোর ওপর দাঁড় করিয়েছেন, যা বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার সরকারের আমলেই দেশের আর্থিক উন্নয়নের সূচকের ঊর্ধ্বগতি অতীতের সব রেকর্ড অতিক্রম করেছে। যেমন—মাথাপিছু আয়ের প্রবৃদ্ধিতে আমরা প্রতিবেশী দেশ ভারতকে পেছনে ফেলেছি। রপ্তানি আয় ৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অতিক্রম করেছে। দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক সক্ষমতা বৃদ্ধির কারণেই করোনা মহামারির সময় বিপুল পরিমাণ অর্থ প্রণোদনা দিয়ে বৈশ্বিক সংকটময় মুহূর্তেও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা সম্ভব হয়েছে। দেশের প্রতিটি সেবা খাতেই, বিশেষত কৃষি ও জ্বালানি খাতে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার সরকার হাজার হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়ে যাচ্ছে, যাতে বিশ্ববাজারে মূল্যবৃদ্ধির চাপ জনগণকে সম্পূর্ণভাবে স্পর্শ না করে। উল্লেখ্য, বর্তমান সরকার ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে মোট ৬৬ হাজার ৮২৫ কোটি টাকা (জিডিপির ১.৭০ শতাংশ) ভর্তুকি দিয়েছে। তার পরও জনগণ ও দেশের ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক কাঠামো বিবেচনায় রেখে বৈশ্বিক বাস্তবতা ও পরিস্থিতির কারণেই অনেক সময় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়। ইউরোপের যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) প্রতিদিনের লোকসানের পরিমাণ ছিল শতাধিক কোটি টাকা। গত ফেব্রুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত বিপিসি প্রায় ৮,০১৪ কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়েছে। পৃথিবীর অন্য কোনো রাষ্ট্র এভাবে বিপুল পরিমাণ অর্থ ভর্তুকি দিয়ে জ্বালানি তেল বিক্রি করেনি। এমনকি পশ্চিমবঙ্গে যখন (১২ জুলাই ২০২২) লিটারপ্রতি ডিজেলের দাম ছিল ৯২.৭৬ রুপি (১ রুপি সমান ১.২৩ টাকা হিসাবে বাংলাদেশি মুদ্রায় ১১৪.০৯ টাকা) তখন বাংলাদেশে প্রতি লিটার ডিজেল প্রায় ৩৪.০৯ টাকা কমে ৮০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে যখন পেট্রল ১০৬.০৩ রুপি (বাংলাদেশি মুদ্রায় ১৩০.৪২ টাকা) দরে বিক্রি হয়েছে তখন বাংলাদেশে পেট্রলের দাম ছিল তাদের চেয়ে ৪৪.৪২ টাকা কম, অর্থাৎ ৮৬ টাকা। উল্লেখ্য, শুধু ভারতই নয়, এই সময়ে চীন, আরব আমিরাত, নেপাল, ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুর, হংকংসহ অনেক দেশেই জ্বালানি তেলের দাম আমাদের চেয়ে অনেক বেশি ছিল।

বিশ্ববাজারে ব্যারেলপ্রতি ডিজেলের দাম ৭৪.০৪ মার্কিন ডলার এবং অকটেন প্রতি ব্যারেল ৮৪.৮৪ মার্কিন ডলারে থাকলেই কেবল ডিজেল ও অকটেন প্রতি লিটার বাংলাদেশে যথাক্রমে ৮০ ও ৮৯ টাকা বা বিদ্যমান মূল্যে বিক্রি সম্ভব হতো। কিন্তু গত ফেব্রুয়ারি মাস থেকে আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য বৃদ্ধি পেয়ে ডিজেল প্রথমে ব্যারেলপ্রতি ১০৮.৫৫ মার্কিন ডলার এবং ক্রমাগতভাবে তা বেড়ে জুলাই ২০২২-এ দাঁড়িয়েছে ব্যারেলপ্রতি ১৩৯.৪৩ মার্কিন ডলার। একইভাবে অকটেনের দামও গত ফেব্রুয়ারি মাসে বেড়ে দাঁড়ায় ব্যারেলপ্রতি ১০৮.০৪ মার্কিন ডলার এবং ক্রমাগতভাবে তা বৃদ্ধি পেয়ে জুলাই ২০২২-এ দাঁড়িয়েছে ১১৪.৯৬ মার্কিন ডলারে। বর্তমানে বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ তেল উৎপাদনকারী দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি লিটার জ্বালানি তেলের দাম বাংলাদেশি মুদ্রায় ১৩৫ টাকা, যা গত মে মাসে ছিল ৫৫ টাকা। ফ্রান্সে প্রতি লিটার অকটেন বাংলাদেশি মুদ্রায় ২২০ টাকা, পেট্রল ২৩২ টাকা ও ডিজেল ২২৪ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আয়ারল্যান্ডে দুই মাস আগে যেখানে পেট্রল ছিল বাংলাদেশি মুদ্রায় ১৩০ টাকা, তা এখন বিক্রি হচ্ছে ২০০ টাকায়। দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রতি লিটার ডিজেল বিক্রি হচ্ছে বাংলাদেশি মুদ্রায় ১৪৪ টাকায়। অস্ট্রেলিয়ায় দফায় দফায় বাড়ছে তেলের দাম, সেখানে প্রতি লিটার পেট্রল বিক্রি হচ্ছে বাংলাদেশি মুদ্রায় ১৫০ টাকা আর ডিজেল ১৬০ টাকায়। জার্মানিতে ডিজেলের বর্তমান দাম লিটারপ্রতি ১৮৯ টাকা এবং পেট্রল ১৭৫ টাকা। মালদ্বীপে পেট্রলের দাম লিটারপ্রতি ১০২.৬১ টাকা এবং ডিজেল ১০৩.৯৮ টাকা। নেপালে লিটারপ্রতি পেট্রলের দাম ১৩৫.৩৬ টাকা, ডিজেল ১২৮.৬৩ টাকা এবং কেরোসিন ১২৮.৬৩ টাকা। ভোক্তা পর্যায়ে ইউরোপ, আমেরিকাসহ উন্নত দেশে ৫০ থেকে ৫৫ শতাংশ পর্যন্ত জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার ২০১৬ সাল থেকে গত ছয় বছরে পেট্রল ও অকটেনের দাম এক টাকাও বাড়ায়নি। বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির এই প্রেক্ষাপটে সর্বশেষ জুলাই মাসে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের ব্যয় দাঁড়িয়েছে ১০৩১২.৭৬ কোটি টাকা। অন্যদিকে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে জ্বালানি তেলের আমদানি মূল্য আরো বেড়েছে। এমন বৈশ্বিক সংকট উত্তরণে পৃথিবীর অন্যান্য রাষ্ট্রের মতো আমাদের দেশের অর্থনীতি স্থিতিশীল রাখার জন্য বাংলাদেশ সরকারের জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি করা ছাড়া অন্য কোনো উপায় ছিল না।

এই মূল্যবৃদ্ধির ফলে বাজারের অন্যান্য খাতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। মানুষের কষ্ট হতে পারে। তা জেনেও দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো, বিশেষত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য সার্বিক বিবেচনায় মূল্যবৃদ্ধির বিকল্প কোনো পথ নেই। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের বাজার হ্রাস পেলে এবং মুদ্রাবাজার স্থিতিশীল হলে সরকার অবশ্যই সঙ্গে সঙ্গে জ্বালানি তেলের মূল্য আবার সমন্বয় করবে। বাংলাদেশে তেলের সরবরাহের কোনো ঘাটতি নেই। এ নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। ভবিষ্যতে যাতে কোনো প্রকার ভয়াবহ সংকট সৃষ্টি না হয় তাই এ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।

কেউ কেউ বলছেন, পেট্রল ও অকটেন দেশে উৎপাদিত হলে তার দাম বাড়ার কারণ কী? হ্যাঁ, বাংলাদেশ চাহিদার শতভাগ পেট্রল এবং বেশির ভাগ অকটেন উৎপাদন করে। তবে উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় অনেক কাঁচামাল আমদানি করতে হয়। এ ছাড়া প্রতিবেশী দেশ ভারতে লিটারপ্রতি পেট্রল ও অকটেনের দাম বাংলাদেশের বিদ্যমান দামের চেয়ে অনেক বেশি ছিল। এই পার্থক্যের কারণে পাচার রোধ বিবেচনায় এবং আন্তর্জাতিক নীতি অনুসারে মূল্য সমন্বয় করা হয়েছে। আমাদের বুঝতে হবে, পরিস্থিতি এমনই যে পৃথিবীর ধনী রাষ্ট্রগুলোও জ্বালানি তেলের মূল্য ক্রমাগত হারে বৃদ্ধি করতে বাধ্য হচ্ছে। তাই বৈশ্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় আমাদের সবাইকে জ্বালানি ব্যবহারে সাশ্রয়ী হতে হবে এবং ধৈর্যের সঙ্গে বৈশ্বিক সংকট মোকাবেলায় সবাইকে দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে। পৃথিবীর উন্নত রাষ্ট্রগুলো জ্বালানি সংযম মেনে চলার জন্য সে দেশের নাগরিকদের অনুরোধ জানিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত রাষ্ট্রগুলো ১৫ শতাংশ গ্যাস ব্যবহার হ্রাস করেছে। এমনকি এরই মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের জিডিপি ১.৫ শতাংশ কমে গেছে। কেউ গুজবে কান দেবেন না, অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হবেন না। সফল রাষ্ট্রনায়ক বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার প্রতি আস্থা রাখুন। অতীতের মতো বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সব সংকট মোকাবেলা করে বাঙালি জাতি যেভাবে আমাদের জাতিগত অগ্রগতির ধারা অব্যাহত রাখতে সক্ষম হয়েছে, ঠিক তেমনি বঙ্গবন্ধুকন্যার নেতৃত্বেই আমরা এই সংকট মোকাবেলা করতেও সক্ষম হব। পরম করুণাময় আমাদের সহায় হোন।

লেখক : দপ্তর সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত