বিশ্ব আর্থিক সংকটের মূল্য দিতে হচ্ছে বাংলাদেশকেও

639

Published on আগস্ট 4, 2022
  • Details Image

ড. আতিউর রহমান : 

কোভিড ১৯-এর প্রভাবে বৈশ্বিক সরবরাহ চেইন এমনিতেই ভঙ্গুর হয়ে গিয়েছিল। তাই সংক্রমণ কমতে শুরু করার পর বাংলাদেশসহ বেশিরভাগ দেশের অর্থনীতি গা ঝাড়া দিয়ে উঠতে শুরু করে। কিন্তু চাহিদার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারছিল না জাহাজ পরিবহনসহ পুরো দুনিয়ার সরবরাহ সেবা। আর কোভিডকালে সব দেশের অর্থনীতিতে দেদার কম সুদে (উন্নত বিশ্বে শূন্য অথবা তারও নিচে) তারল্য পাম্প করা হয়। সে কারণে অর্থনীতি ঝিমিয়ে পড়েনি। মানুষ খেয়ে-পরে বেঁচে থাকতে পেরেছে। তাছাড়া পৃথিবীর পয়লা নম্বরের অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্রে তারল্য সম্প্রসারণের পরিমাণ ছিল সবার চেয়ে বেশি।

অবশ্যি, ২০০৮-৯-এর বিশ্ব আর্থিক সংকট মোকাবিলার অন্যতম অস্ত্রই ছিল সম্প্রসারণমূলক মুদ্রানীতি। তাকে দেখে জাপান, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এবং যুক্তরাজ্য প্রায় শূন্যের কাছাকাছি মৌলিক সুদের হার বজায় রাখে। কোভিডকালে এই ধারা আরও শক্তিশালী হয়। বাইডেন প্রশাসন কোভিডের কারণে বিপর্যস্ত অর্থনীতিকে জাগিয়ে তুলতে প্রত্যেক নাগরিকের ব্যাংক হিসাবেও অর্থ পাঠিয়ে দিতে কসুর করেনি। আমাদের মতো দেশেও সম্প্রসারণমূলক মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতি পরিচালনা করতে হয়েছে কোভিড থেকে সমাজ ও অর্থনীতিকে বাঁচানোর জন্য। সারা বিশ্বকেই এই পথে হাঁটতে হয়েছে। তখন কেউই জানতেন না এই মহামারীর চাপ আরও কত দিন থাকবে। তাই তারল্য বাড়িয়ে অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখার পথকেই যথার্থ মনে হয়েছিল বিশ্বজুড়ে নীতিনির্ধারকদের। এতে দোষের কিছু ছিল না। কিন্তু এই অবস্থা থেকে উত্তরণের পথটি যে এত চ্যালেঞ্জিং হবে তা অনেকেরই জানা ছিল বলে মনে হয় না। একদিকে সরবরাহ চেইনে ঘাটতি, অন্যদিকে তারল্যের অস্বাভাবিক ব্যাপ্তি- দুইয়ে মিলে বিশ্ব মূল্যস্ফীতিকে দারুণভাবে উসকে দেয়। এখন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ এবং এশিয়ার কোনো কোনো দেশে নয় শতাংশের ওপরে উঠে গেছে মূল্যস্ফীতি। খুব স্বাভাবিক নিয়মেই যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেড বিরাজমান অস্বাভাবিক তারল্যকে শুষে নেওয়ার জন্য দীর্ঘদিন পর আক্রমণাত্মক হারে বেসিক রেট বাড়াতে শুরু করেছে।

একমাত্র জাপান ছাড়া পৃথিবীর সকল বড় বড় কেন্দ্রীয় ব্যাংকই তারল্য কমানোর কৌশল গ্রহণ করে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতিকে সচল করেছে। ফেড জুন মাসের পর থেকে একের পর এক রেট বাড়াচ্ছে। সর্বশেষ বাড়িয়েছে গত বুধবার। সব মিলে এই কদিনেই আড়াই শতাংশের মতো মৌলিক সুদ বাড়িয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। খুব স্বাভাবিকভাবেই এর ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বন্ড মার্কেট খুব আকর্ষণীয় হতে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বন্ড কেনার জন্য সারা বিশ্বের বিনিয়োগকারীরা হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন। তাই আগে বিনিয়োগ করা ডলার বিকাশমান অর্থনীতি এবং ইউরোপীয় বাজার থেকে মার্কিন ম–লুকে চলে যাচ্ছে। ফলে ডলার আরও শক্তিশালী হচ্ছে। প্রায় সব দেশেরই মুদ্রামান শক্তিশালী ডলারের সামনে দাঁড়াতে পারছে না। দ্রুতই তাদের মুদ্রার অবমূল্যায়ন করতে হচ্ছে। না করলে তাদের বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে যাচ্ছে। বাড়ছে চলতি হিসাবের ঘাটতি। আর এর চাপ আরও বেশি করে পড়ছে তাদের মুদ্রার ওপর। তাই যে ইউরোপ ২০১১ সালের পর একবারও তার রেট বাড়ায়নি তাকেও গত সপ্তাহে তা বাড়াতে হয়েছে। কেননা তার ইউরোর দাম ডলারের চেয়েও কমে গেছে। অথচ এক সময় ইউরো ডলারের চেয়ে প্রায় দেড়গুণ শক্তিশালী ছিল। ইতোমধ্যে ইউরো ডলারের বিপরীতে দশ শতাংশের বেশি অবমূল্যায়িত হয়ে গেছে। এখন হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড ও কেন্দ্রীয় ইউরোপের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোও রেট বাড়াচ্ছে। কেননা তাদের মুদ্রার মূল্যমানও দ্রুত কমে যাচ্ছে।

ওয়াল স্ট্রিটে মুদ্রা বেচা-কেনা যারা করে থাকেন তারা বলছেন বৈদেশিক মুদ্রা বাজারে এই টালমাটাল অবস্থা এ বছরের বাকি দিনগুলোতেও চলবে। ফেড যখন মূল্যস্ফীতিকে দৃশ্যমানভাবে বাগে আনতে সক্ষম হবে তখনই হয়তো তারল্য শুষে নেওয়ার কৌশল বদলাবে। রেট কমতে শুরু করবে। উল্লেখ্য, ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল ডলার ইনডেস্ক (যা পৃথিবীর ১৬ দেশের মুদ্রার মূল্যমান মাপার মাধ্যমে নির্ধারিত হয়) গত এক বছরে ১৩ শতাংশ বেড়েছে। বাড়ন্ত মূল্যস্ফীতি, বৈশ্বিক মন্দার ভীতি (যা সর্বশেষ আইএমএফ আউটলুকে ধরা পড়েছে) এবং ফেডের আক্রমণাত্মক মুদ্রানীতি কৌশলের প্রেক্ষাপটে এই সূচকের এমন ঊর্ধ্বগতি লক্ষ করা যাচ্ছে বলে পর্যবেক্ষকরা বলছেন।

এতক্ষণ ধরে সারা বিশ্বের আর্থিক সংকটের একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিলাম। এর প্রভাব ইমাজিং মার্কেট তথা উন্নয়নশীল বিশ্বে যে পড়েছে তা তো অস্বীকার করার উপায় নেই। যে সব দেশের মৌলিক ম্যাক্রো-অর্থনীতি শক্তিশালী পাটাতনের ওপর দাঁড়িয়ে তারা মোটামুটিভাবে রিজার্ভ ছেড়ে দিয়ে এবং মুদ্রামানের অবমূল্যায়ন করে পরিস্থিতির সামাল দিচ্ছে। যেমন ভারত। তার রিজার্ভ ছিল ৭৫০ বিলিয়ন ডলারের ওপর। তাই এই জুলাই মাসেই সাড়ে সাত বিলিয়ন ডলার বাজারে ছেড়ে দিতে সাহস করেছে। গত এক বছরে প্রায় আশি ডলার ছাড়তে দ্বিধা করেনি। তবু ভারতীয় রুপি প্রায় দশ শতাংশ তার মূল্যমান ছাড়িয়েছে।

ভারতের অর্থনীতি বড়। তার বৈদেশিক মুদ্রার মজুদও বেশি। তাই তারা পেরেছে। সেই তুলনায় আমাদের অর্থনীতি অনেকটাই ছোট। তবে আপেক্ষিক বিচারে আমাদের রিজার্ভও ছিল চল্লিশের ওপরে। আমরাও তাই এ বছরে আট বিলিয়ন ডলারের বেশি বাজারে ছেড়েছি। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমাদের টাকার মান ভারতের মতোই প্রায় এক-দশমাংশ কমেছে। এ নিয়ে মন খারাপ করার দরকার নেই। যারা বিশ্ব বাস্তবতা বুঝেও এ নিয়ে ভয় দেখাচ্ছেন, আতঙ্ক ছড়াচ্ছেন তারা সংকটকালে খুবই অবিবেচকতার পরিচয় দিচ্ছে। কথায় কথায় শ্রীলংকার সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা করে বাংলাদেশের অসামান্য অর্থনৈতিক অর্জনকে খাটো করে দেখাচ্ছেন।

শ্রীলংকার বৈদেশিক ঋণ জিডিপির ১০৪ শতাংশ (মোট ঋণ জিডিপির ১১৯ শতাংশ)। শ্রীলংকার রিজার্ভ নেই বললেই চলে। অথচ এ বছরই তাকে ৭ বিলিয়ন ডলার ফেরত দিতে হতো। নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করে কোনোমতে টিকে আছে। তার বেশিরভাগ ঋণই বাণিজ্যিক ঋণ। বেশি সুদের। কম সময়ে শোধযোগ্য। সার আমদানি বন্ধ করে খাদ্য সংকট তীব্র করেছে। তেল ও গ্যাস আমদানি করার বিদেশি অর্থ নেই। বিদ্যুৎ প্ল্যান্টগুলো চলছে না। মূল্যস্ফীতি ১৭ শতাংশেরও বেশি। এসব সূচকের সঙ্গে বাংলাদেশকে কোথায় মেলানো যায়? বাংলাদেশের বিদেশি ঋণ জিডিপির ১৯.৫ শতাংশ। এসব ঋণের ৯০ শতাংশেরও বেশি দীর্ঘমেয়াদি। কম সুদের। আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে নেওয়া। তবে গত কয়েক বছরে ব্যক্তি খাত বিদেশি ঋণ বেশ বেড়েছে। টাকার অবমূল্যায়নের পর তাদের সেই ঋণের সুদ শোধ করা বেশ মুশকিল হবে। তারা এর বিপরীতে ‘হেজ’ও করেছে বলে মনে হয় না। এক্ষুনি এ নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সরকারকে ভাবতে হবে। আগে এই ধারা বন্ধ করতে হবে। পরে এর শোধের নয়া পথ বেছে নিতে হবে।

বাংলাদেশের রিজার্ভ এখন চল্লিশ বিলিয়ন ডলারের আশেপাশেই। দ্রুত বিলাস পণ্য ও অপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি কমিয়ে আনার যে উদ্যোগ বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকার নিয়েছে রাজস্বনীতিতে যে সব সাশ্রয়ী উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে সেসবের প্রভাব আমদানির ওপর পড়তে শুরু করেছে। আগে প্রায় আট বিলিয়ন ডলার আমদানি হচ্ছিল। জুনে তা সাত বিলিয়নে নেমে এসেছে। জুলাইতে ছয় বিলিয়নের কাছাকাছি নেমে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে। আর বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার খানিকটা নমনীয় করায় আমদানি করা বিলাস পণ্যের দামও বেড়ে গেছে। তাই এই ধারা অক্ষুণ্ন্ন থাকবে। মনে হয় আগামী ছয় মাসের জন্য গাড়ি ও বিলাস পণ্য আমদানি নন-ট্যারিফ বাধা দিয়ে বন্ধ করলেও দোষের কিছু হবে না। সংকটকালে এমন কড়া নীতি নেওয়াই যায়। তাই যে রিজার্ভ আছে তা দিয়ে পাঁচ মাসের বেশি প্রয়োজনীয় আমদানি করা সম্ভব। আর আমাদের বিদ্যুতের জন্য জ্বালানি জোগানের জন্য যথেষ্ট ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তবে মনে হয় টেকসই জ্বালানি নীতিতে সোলার ইরিগেশন পাম্প, বায়ু বিদ্যুৎ, ইনসেনটিভসহ নেট মিটারিং ব্যবস্থা আরও কার্যকরীভাবে চালু করা খুবই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। ইডকলের সহায়তায় এরই মধ্যে প্রায় চার হাজার সোলার ইরিগেশন পাম্প চলছে। এগুলোর খরচ ডিজেলচালিত পাম্পের অর্ধেক। ১৩ লাখ সেচ পাম্পের অর্ধেকও যদি এই সংকটকালে সোলারে রূপান্তর করা যেত তাহলে একদিকে আমদানি করা জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমত, অন্যদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমাদের সমর্থন বাড়ত। সোলার প্যানেল থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ ২০ শতাংশ প্রিমিয়ামে জাতীয় গ্রিডে দিতে পারলে প্রতিটি বাড়ির ছাদে এমন প্যানেল দেখা যেত। জলবায়ু বিনাশী জ্বালানির বদলে সবুজ জ্বালানির জন্য এমন করে ভর্তুকি দিলে টেকসই উন্নয়নে বাংলাদেশ আরও সামর্থ্য ও সুনাম অর্জন করতে পারত। শুনছি আগামীতে প্রচলিত জ্বালানির দাম আরও বাড়বে। তাই এখন থেকেই টেকসই উন্নয়নের কথা ভাবতে পারি।

এবার আমরা ফের চলমান ডলার সম্পর্কিত অস্থিতিশীলতা কী করে ঠেকানো যায় সে বিষয়ে কিছু নীতি উদ্যোগের কথা বলতে পারি। ডলার নিয়ে অনেক আলাপ করেছি। বেশ কিছু উদ্যোগ এরই মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকার নিয়েছে। আরও কী কী করা যায় সেসব প্রস্তাবের কয়েকটি খুবই সংক্ষেপে নিচে তুলে ধরছি।

১. মূল্যস্ফীতি কমাতে হলে শুধু বিদেশি মুদ্রার বিনিময় হার নমনীয় করাই যথেষ্ট নয়, তাকে বাজারে বিরাজমান হারের কাছাকাছি নিয়ে যেতে হবে। সেজন্য বাংলাদেশ ব্যাংক, বাফেদা ও এবিবি মিলে একটি গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি খুঁজে বের করতে হবে যাতে একটি সর্বজন গৃহীত বেঞ্চমার্ক হার খুঁজে পাওয়া যায়। ইন্টার-ব্যাংক বিনিময় হারকে বাজারধর্মী করলে সেটিই হতে পারে এই বেঞ্চমার্ক হার। সকল ব্যাংক, এক্সচেঞ্জ হাউস, বাংলাদেশ ব্যাংক এই হারের আশেপাশে থাকবে তেমন একটি সহায়ক বৈদেশিক মুদ্রাবাজার নিশ্চিত করা খুবই জরুরি। বৈদেশিক মুদ্রাবাজার আগের চেয়ে অনেকটাই বাজারধর্মী হয়েছে। তাকে আরও কয়েক কদম সামনে যেতে দিতে হবে। বাজারের ধর্মকে অস্বীকার করে এই সংকটকালে পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণে আনা সহজ হবে বলে মনে হয় না। তাই দ্রুত অংশীজনকে সঙ্গে নিয়ে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। অস্বীকার করার উপায় নেই যে আমাদের টাকার মান উল্লেখযোগ্য হার ‘ওভারভ্যালু’ ছিল। এই হারকে যতটা সম্ভব বাজার ভিত্তিক করার উদ্যোগ নিতে হবে।

২. শুধু বিদেশি মুদ্রার বিনিময় হার ঠিকঠাক করলেই পুরো বাজারে স্বস্তি আসবে বলে মনে হয় না। আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মৌলিক রেট আরও বাড়াতে হবে। আর সেই রেটের প্রতিফলন যাতে পুরো আর্থিক বাজারেও পড়ে সেজন্য দেশের ভেতরেও ঋণের হারকে বাজারনির্ভর করার উদ্যোগ নিতে হবে। কৃষি, রপ্তানি তথা বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে নির্দেশিত হার বজায় আগেও ছিল। ভারতেও আছে। তবে অন্যান্য ক্ষেত্রে সুদের হার অবশ্যই চাহিদা ও জোগানের আলোকে বাজারভিত্তিক ও আরও নমনীয় করতে হবে। আমরা দুই পায়েই হাঁটি। তাই বিদেশি মুদ্রার বাজার নমনীয় এবং দেশের আর্থিক বাজারকে একই সঙ্গে অনমনীয় রাখতে পারি না। এক পায়ে হাঁটতে গেলে হোঁচট খাওয়ার আশঙ্কা থেকেই যাবে। এ নিয়ে অংশীজনদের সঙ্গে দ্রুত আলাপ সেরে নিতে পারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। মূল্যস্ফীতি বাগে আনতে সারা বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কৌশল বাংলাদেশ ব্যাংক সর্বক্ষণ অস্বীকার করতে গেলে নানা ধরনের অসংগতি দেখা দেবে। পাশের দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক কীভাবে হাঁটছে তা একটু দেখলে ক্ষতি কী?

৩. সরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে বাজারের চেয়ে কম বিনিময় হারে বৈদেশিক মুদ্রা বেচা হচ্ছে। আন্তঃব্যাংক বাজারকে সক্রিয় করে ওই হারেই বাজার কিংবা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে তারা কিনতে পারে। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো দক্ষ নয় বলেই তারা এই ভর্তুকি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে আদায় করছে। সরকার চাইলে তাদের আলাদা করে ভর্তুকি দিতেই পারে। তবে বৈদেশিক মুদ্রার বাজারকে সুস্থির ও বাজারভিত্তিক চলতে দেওয়াটাও খুব জরুরি।

৪. আন্তঃব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রা বাজারকে মুখে মুখে ডিকটেট না করে স্বকীয়ভাবেই বিকশিত হতে সাহায্য করুক বাংলাদেশ ব্যাংক।

৫. বিদেশি মুদ্রার বাজারে ফরওয়ার্ড এক্সচেঞ্জ রেট মার্কেট চালু করতে উৎসাহ দেওয়া যেতে পারে। যাদের এলসি মার্জিন বিদেশি মুদ্রায় দেওয়ার সক্ষমতা আছে তারা বাজার থেকে সেই মুদ্রা কিনলে সুদের হার খানিকটা প্রণোদনা দেওয়ার কথা ভাবা যেতে পারে।

৬. এফসি হিসেবে আসা বিদেশি মুদ্রার ব্যবহার আরও ভালোভাবে করার জন্য ব্যাংকের ট্রেজারি ব্যবস্থাপনাকে উৎসাহী করা যেতে পারে।

৭. সম্প্রতি রপ্তানি রিটেনশন কোটা কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই বিদেশি মুদ্রা দেশের ভেতরেই থাকে। তাই এই বিষয়টিতে অংশীজনদের সমস্যা কী হচ্ছে তা বিবেচনায় নিয়ে খানিকটা পরিবর্তন করা যায় কিনা কেন্দ্রীয় ব্যাংক ভেবে দেখতে পারে। বলা হচ্ছে এখান থেকে আমদানি মূল্য পরিশোধ, বিদেশে ব্যবসা উন্নয়নে খানিকটা সমস্যা হচ্ছে।

৮. প্রবাসী আয় নিয়েও নতুন করে ভাবা যেতে পারে। ‘এক্সচেঞ্জ হাউসগুলো’র সঙ্গে টাকা অ্যারেঞ্জমেন্টের বদলে ডলার অ্যারেঞ্জমেন্ট করা যায় কিনা ভেবে দেখা যেতে পারে। এতে করে ডলার বিক্রির অসুস্থ প্রতিযোগিতা কমে আসবে বলে মনে হয়।

৯. এক্সচেঞ্জ হাউসগুলোকে দূতাবাসের রিপোর্ট নিয়ে ‘ড্রয়িং অ্যারেঞ্জমেন্ট’ করতে হয় বলে জানা যাচ্ছে, যদি তাই হয় তা উঠিয়ে দিয়ে ব্যাংকগুলোর ওপরই পুরো দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ ব্যবস্থা শুধু মনিটর করবে।

১০. প্রবাসীদের সুদ আহরণ করা যায় এমন নন-রেসিডেন্ট টাকা হিসেব খুলতে উৎসাহিত করা যেতে পরে। তারা ঐ অর্জিত সুদ বাংলাদেশে ব্যবহার করতে পারবেন এবং মূল অর্থ বিদেশি মুদ্রায় বিদেশে নিতে পারবেন এমন নীতি সহজীকরণে বাংলাদেশ ব্যাংক মনোযোগী হতে পারে।

১১. ফেডের সুদ বাড়ানোর উদ্যোগে তাদের দীর্ঘমেয়াদি ট্রেজারি বন্ডের সুদ বা লভ্যাংশ বেড়ে গেছে। এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের ডলার বন্ডগুলোর হারও নমনীয় করে প্রণোদনাসহ বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। আর এসব বন্ড কেনা খুবই সহজে ডিজিটালি করা যেতে পারে।

অনেকগুলো স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি প্রস্তাব রাখলাম। সময়টা খুবই চঞ্চল। তাই নীতিনির্ধারকদের চোখ কান খোলা রাখতে হবে। চারদিকে কী হচ্ছে তা খেয়াল রাখতে হবে। মাঝপথে নিয়মনীতি বদলে আরও জনবান্ধব হওয়ার মতো মনবদল তাদের ঘটাতে হবে। সারা বিশ্বেই চলছে সংকট। বাংলাদেশ কৃষি, প্রবাসী আয়, রপ্তানি এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে জোর দিয়ে অনেকটাই ভালো আছে। তাই আইএমএফ ও মুডিস বলছে বাংলাদেশে বিনিয়োগ ঝুঁকি নেই। অন্যান্য সংস্থাও একই মত পোষণ করে। তাই দীর্ঘমেয়াদি ঋণ নিয়ে তারা এগিয়ে আসছে। এই সময়টায় সমাজকে সাহস দেওয়ার। আতঙ্ক ছড়ায় এমন কিছু বলা থেকে আসুন সবাই বিরত থাকি। সকলের চেষ্টায় আমরা এ সংকট কাটিয়ে উঠতে পারব।

লেখকঃ উন্নয়ন সমন্বয়ের সভাপতি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত