১৬ই জুলাই বাংলাদেশের একটি কালো আধ্যায়

739

Published on জুলাই 16, 2022
  • Details Image

ড. প্রণব কুমার পান্ডে: 

১/১১ বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি 'কালো দিবস' হিসেবে বিবেচিত হয় কারণ অসাংবিধানিক একটি সরকার এই দিন ক্ষমতা দখল করে প্রায় দুই বছর ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকে। তাদের এই দুই বছর ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকার সময় কালে তারা বিরাজনীতিকরণ পরিকল্পনা গ্রহণ করে তা বাস্তবায়ন করতে চেয়েছিল মাইনাস টু ফর্মুলার মাধ্যমে। অর্থাৎ দুই প্রধান দলের নেত্রীকে দলের নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে তাদের পছন্দের মানুষকে নেতৃত্বে নিয়ে আসার মাধ্যমে একটি পুতুল সরকার পরিচালনা করার নীল নকশা বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করেছিল তৎকালীন সরকার। কিন্তু বাংলার মানুষ তাদের সেই বিরাজনীতিকরণের হীন প্রচেষ্টা খুব দ্রুত উপলব্ধি করতে পারে বিধায় তারা পিছু হটতে বাধ্য হয়।

আমরা সকলেই জানি যে ২০০৭ সালের ১৬ই জুলাই তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে গ্রেফতার করেছিল। তার ঠিক ৫ দিন আগে অর্থাৎ ১১ই জুলাই তার সাথে দেখা করে এক ঘন্টার উপরে সময় কাটানোর সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। আমি তখন হংকংয়ের সিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি গবেষণার অধ্যয়নরত ছিলাম। দেশে এসেছিলাম আমার গবেষণার তথ্য উপাত্ত সংগ্রহের জন্য। আমার গবেষণার মূল বিষয় ছিল "বাংলাদেশে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন"। আমি দেখতে চেয়েছিলাম বাংলাদেশের স্থানীয় পর্যায়ে নারীদের প্রক্রিয়াকে যে বিষয়গুলো প্রভাবিত করেছিল সেই বিষয়গুলোর চিহ্নিত করে তাদের ভূমিকা আলোচনার মাধ্যমে স্থানীয় পর্যায়ে নারীর ক্ষমতায়নের অবস্থা তুলে ধরা।

আমরা সকলেই জানি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার নারী বান্ধব সরকার। দেশের রাজনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণের যে ব্যাপক উন্নতি হয়েছে তার একটি বড় সহায়ক শক্তি হচ্ছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। গবেষণার তথ্য সংগ্রহের জন্য বিভিন্ন শ্রেণীর উত্তরদাতার কাছে আমাকে যেতে হয়েছিল। তাদের মধ্যে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ গুরুত্বপূর্ণ উত্তরদাতা ছিলেন। যেহেতু আমার গবেষণার মূল বিষয়বস্তু ছিল স্থানীয় সরকারে নারীদের ক্ষমতায়ন, আমি চেষ্টা করেছিলাম শেখ হাসিনার সাক্ষাৎকার গ্রহণ করতে কারণ ১৯৯৭ সালে যখন ইউনিয়ন পরিষদে নারীদের সরাসরি নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয় তখন তিনি প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। ফলে তাঁর সাথে কথা বলে ভেতরের বিষয়গুলো জানা আমার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

কিন্তু ২০০৭ সালের সেই সময় বাংলাদেশে এক ধরনের অচলাবস্থা বিরাজমান ছিল বিধায় শেখ হাসিনার কাছে সরাসরি পৌঁছানো অনেকটাই দুরূহ কাজ ছিল। তাছাড়া আমি পেশায় একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হলেও তখন বয়সে অনেক তরুণ। আমার সেই রকম যোগাযোগ ছিল না। আর আমি দ্বিধান্বিত ছিলাম কারণ মিডিয়ার মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে গ্রেফতার করার কথা জানা যাচ্ছিল। আমি সেই সময়ই যোগাযোগ করি আমাদের সর্বজন শ্রদ্ধেয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এম সাইদুর রহমান খান স্যারের সাথে। স্যার আমাকে সেই সময় ছাত্রলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ চৌধুরীর -যিনি বর্তমানে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী- সাথে যোগাযোগ করিয়ে দেন। তিনি ওই সময় বেশিরভাগ সময় সুধাসদনে অর্থাৎ নেত্রীর বাসভবনে থাকতেন। আমি জনাব চৌধুরীর সাথে যোগাযোগ করে তাকে বিষয়টি বুঝিয়ে বলি এবং উনি আমাকে ১১ই জুলাই সকালে সুধাসদনে যেতে বলেন। ১১ জুলাই সকালে যখন সুধাসদনের সামনে পৌঁছায় তখন তিনস্তর বিশিষ্ট নিরাপত্তা চৌকি দেখতে পায়।

সেই দিনের অবস্থা অত্যন্ত ভয়ানক ছিল। সুধাসদনে সবাইকে ঢুকতে দেয়া হচ্ছিল না। আমি অনেকক্ষণ অপেক্ষা করলাম সেখানে। দেখলাম মোহাম্মদ নাসিমসহ কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ অনেকেই নেত্রীর সঙ্গে দেখা করে বের হয়ে আসছেন। তারপরে জনাব চৌধুরীর সাথে মোবাইলে যোগাযোগ করেও ভেতরে প্রবেশ করাটা অনেক কঠিন হচ্ছিল। পরবর্তীতে জনাব চৌধুরী নিরাপত্তা বাহিনীর একজন কর্মকর্তার সহায়তায় আমাকে সুধাসদনের নিচতলায় নিয়ে গেলেন। আমি যখন সেখানে প্রবেশ করি সেখানে মহিলা আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।

কিছুক্ষণ পরে নেত্রী নিচে আসলেন। আমার সাথে কথা বলা শুরু করার পূর্বে তিনি মহিলা আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দের সাথে কিছুক্ষণ কথা বললেন। আমি পুরো সময়টাই তাঁকে পর্যবেক্ষণ করেছিলাম এই জন্য যে কতটা মানসিক শক্তি সম্পন্ন একজন নেতা হলে নিজে এতো বিপদে থেকেও নেতাকর্মীদের উজ্জীবিত রাখতে সক্ষম হন। গোটা দেশ তখন উদ্বিগ্ন ছিল এই ভেবে যে সরকার শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তার করতে পারে। তিনি সেটি নিজেও জানতেন। এতকিছুর পরেও উনি নেতৃবৃন্দেকে উদ্দীপ্ত করে চলেছিলেন যে বলে যে তারা যেন যার যার জায়গা থেকে জনগণকে সংগঠিত করে। সেটি আমি খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন যা আজও আমার স্পষ্ট মনে আছে।

মহিলা আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দকে বিদায় করে দিয়ে নেত্রী আমাকে প্রায় এক ঘণ্টা সময় দিয়েছিলেন আমার গবেষণা সংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তর দেবার জন্য। আমি সে দিন খুব কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করেছিলাম উনার জ্ঞানের পরিধি। সবচেয়ে বড় কথা হল নারীর ক্ষমতায়ন সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকে তিনি খুব সহজভাবে আমার সামনে উপস্থাপন করেছিলেন যা আমার গবেষণা পরিচালনার ক্ষেত্রে অত্যন্ত সহায়ক হয়েছিল। আমি আমার গবেষণায় তাঁর অনেক বক্তব্য উপস্থাপন করেছি। আমি সেদিন একজন গবেষক হিসেবে উপলব্ধি করেছিলার নারীদের প্রতি একজন রাজনৈতিক নেতার অনুরক্ততা। তিনি নারীর ক্ষমতায়ন বিষয়টাকে অন্তরে লালন করেন এবং সেই কারণেই ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে স্থানীয় সরকারের নারীর ক্ষমতায়নের জন্য সরাসরি নির্বাচনের ব্যবস্থা করেছিলেন। এমনকি সামরিক বাহিনীতে নারীদের অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন।

তার চেয়েও বড় কথা হল এতো খারাপ সময়েও তিনি আমাকে প্রায় এক ঘন্টার উপরে সময় দিয়ে আমার গবেষণা পরিচালনার ক্ষেত্রে সহায়তা করেছিলেন- যা আজও আমার মনে আছে। আমি জানিনা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ২০০৭ সালের সেই ঘটনাটি কথা এখনো মনে আছে কিনা? না থাকারই কথা। কিন্তু সেই দিনটি এখনো আমার জীবনে স্মরণীয় হয়ে আছে কারণ দেশের খুব খারাপ সময়ে একজন রাজনৈতিক নেতা একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককে সময় দিয়ে গবেষণায় সাহায্য করেছিলেন। এই মহানুভবতা সকলের মধ্যে থাকে না। হয়তো আমি নিজেও ওই পরিস্থিতিতে থাকলে এ ধরনের সাক্ষাৎকারে অংশগ্রহণ করার ক্ষেত্রে দ্বিমত পোষণ করতাম। কিন্তু উনি সেটি করেননি। এর মাধমে তাঁর শিক্ষা, গবেষণা এবং নারীদের প্রতি অনুরক্ততার বিষয়টি প্রকাশিত হয়েছিল।

২০০৭ সালের ১৬ জুলাই বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গ্রেপ্তার করার পর থেকে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তন হতে শুরু করেছিল। তারা সুপরিকল্পিতভাবে ১/১১ এর কুশীলবদের সহায়তায় বিরাজনীতিকরণের যে প্রক্রিয়া শুরু করেছিলে সেই প্রক্রিয়ায় একটি বড় আঘাত ছিল শেখ হাসিনাকে গ্রেফতার করা। কারণ তাঁর গ্রেফতারের সাথে সাথে বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল। আওয়ামী লীগের সকল স্তরের নেতৃবৃন্দ এবং কর্মীরা সঙ্গবদ্ধ হয়েছিল এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে। পাশাপাশি আওয়ামী লীগের মধ্যে এক শ্রেণীর নেতারা-যাদেরকে আমরা সংস্কারপন্থী হিসেবে চিনি- সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাথে হাত মিলিয়ে বিরাজনীতিকরণ প্রক্রিয়াকে সফল করার জন্য চেষ্টা করেছিলেন। যদিও তাদের সে চেষ্টা সফল হয়নি।

শেখ হাসিনার দৃঢ় মনোবল ১/১১ এর কুশীলবদের এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে বাধ্য করেছিল দেশে বিরাজনীতিকরণ প্রক্রিয়ার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে নির্বাচন দিয়ে জনগণের সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে। আর এই কারনেই ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই বাংলাদেশের ইতিহাসে কালো দিবস হিসেবে বিবেচিত হবে অনাদিকাল। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় ১/১১ এর মতো হস্তক্ষেপ কখনোই কাম্য হতে পারে না। এই ব্যবস্থাকে প্রতিষ্ঠিত করতে যারা সহায়তা করেছিল তারা চেষ্টা করেছিল বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলের শাসন ব্যবস্থাকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে। তারা চেষ্টা করেছিল তাদের কুশীলবদের মাধ্যমে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে। কিন্তু তারা ইতিহাস থেকে শিক্ষা না নিয়েই এই বিরাজনীতিকরণ প্রক্রিয়া সফল করতে চেয়েছিল। তারা ভুলে গিয়েছিলে যে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে আওয়ামী লীগকে শেষ করা যায়নি। বঙ্গবন্ধুর কন্যা-যিনি সৌভাগ্যক্রমে বিদেশে থাকায় বেঁচে গিয়েছিলেন- ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে রুগ্ন আওয়ামী লীগের হাত ধরেছিলেন। তাঁর যোগ্য নেতৃত্বের জন্যই ১৯৯৬-২০০১ পর্যন্ত এবং ২০০৮ থেকে অদ্যাবধি আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে।

পরিশেষে বাংলাদেশের ইতিহাসে ১৬ই জুলাই এর গুরুত্ব অপরিসীম। সেই দিন বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গ্রেফতার করে যে ভুল করেছিল সে ভুলের মাশুল তারা দিয়েছে। জনগণ এতটা সংগঠিত হয়েছিল যে ২০০৮ সালের নির্বাচনে দেশের জনগণ আওয়ামী লীগকে সমর্থন দিয়ে দেশ শাসনের ভার শেখ হাসিনার উপর অর্পণ করে। ২০০৮ সালে ক্ষমতায় এসে অদ্যাবধি শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে উন্নয়নের অন্যন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছেন। বাংলাদেশ আজ পৃথিবীর বুকে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। যারা এক সময় বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি হিসেবে আখ্যা দিয়েছিল তারাই আজ বাংলাদেশকে এশিয়ার বাঘ কিংবা উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে বিবেচনা করছে। শেকহ হাসিনা দেশকে অর্থনৈতিকভাবে এতটা শক্তির ওপর দাঁড় করাতে সক্ষম হয়েছেন যে করোনা অতিমারির সময় যখন পৃথিবীর অন্যান্য দেশ স্বাস্থ্য এবং অর্থনৈতিক ঝুঁকি সালাম দিতে হিমশিম খাচ্ছে তখন বাংলাদেশ যথেষ্ট সাফল্যের সাথে অতিমারি মোকাবেলা করেছে। বাংলাদেশের জনগণ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় ১৬ জুলাই এর পুনরাবৃত্তি প্রত্যাশা করে না। তবে এটিও ঠিক এখনো অনেক কুশীলব আছে যারা দেশে ১৬ জুলাই এর মত ঘটনা ঘটাতে চায়। জনগণের উচিত এই গোষ্ঠীকে ঐক্যবদ্ধ ভাবে প্রতিহত করা- এটাই হোক ২০২২ সালের ১৬ জুলাই এর অঙ্গীকার।

লেখকঃ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের প্রফেসর
সৌজন্যেঃ bahannonews.com

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত