বিএনপির নিরপেক্ষ ও জাতীয় সরকার!

2184

Published on এপ্রিল 7, 2022
  • Details Image

অজয় দাশগুপ্ত: 

বিএনপি ও খালেদা  জিয়াকে নিয়ে পুলিশ কমিশনারের বক্তব্যে প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়েছেন কয়েকজন বিএনপি নেতা, যে দলে এই দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামও রয়েছেন। মার্চ মাসের শেষ ও এপ্রিলের শুরুর দিকে একাধিক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, পুলিশ বাহিনীতে থেকে কেউ রাজনৈতিক বক্তব্য দিতে পারেন না। 

খুব ভাল কথা, যুক্তির কথা। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ২৪ অগাস্টের থেকে পরের কয়েকটি বছর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান পদে অধিষ্ঠিত থেকে জিয়াউর রহমান প্রকাশ্যে যে সব রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়েছেন (গোপন তৎপরতা, ষড়যন্ত্র না-ই বা বললাম) সে বিষয়ে বিএনপি নেতারা কী বলবেন? জিয়াউর রহমান ৭ নভেম্বর সকালে  ঢাকা বেতার কেন্দ্রে ভাষণ দিয়ে নিজেকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিলেন। এটা ছিল সংবিধানের সুস্পষ্ট লংঘন। একদিন যেতে না যেতেই তিনি প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পদ ছেড়ে উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পদ গ্রহণ করেন। তবে সমুদয় ক্ষমতা রাখেন নিজের হাতে। ১১ নভেম্বর তিনি ভাষণ দেন বেতার ও টেলিভিশনে। তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগের শাসনামলে সামরিক বাহিনীকে অবহেলা করা হয়েছে।’ [বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-: প্রতিবাদের প্রথম বছর, পৃষ্ঠা ১১৭] 

২৩ নভেম্বর (১৯৭৫) গভীর রাতে ফের জিয়াউর রহমান ভাষণ দেন বেতারে। বেতারে দীর্ঘ সময় ধরে ঘোষণা হতে থাকে- উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও সেনাবাহিনী প্রধান অল্প সময়ের মধ্যে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবেন। শেষ পর্যন্ত তাঁর কণ্ঠ শোনা যায় রাত পৌনে একটায়। তিনি বলেন, “বিদেশি চক্রান্ত চলছে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে।” এ চক্রান্ত নস্যাৎ করতে জনগণের সমর্থন চেয়েছেন তিনি। 

সেনাবাহিনীর প্রধান পদে থেকেই জিয়াউর রহমান রাজনীতি করেছেন। তাকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান পদে নিয়োগ দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের প্রধান হোতাদের অন্যতম খন্দকার মোশতাক আহমদ। ১৫ অগাস্ট স্বাধীনতা সংগ্রামের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের সপ্তাহ যেতে না যেতেই তিনি সেনাবাহিনী প্রধান পদে সবচেয়ে বিশ্বস্ত ব্যক্তি হিসেবে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে বেছে নিয়েছিলেন। জিয়াউর রহমান প্রতিদান দিয়েছিলেন যথাসময়ে। ১৯৭৯ সালের এপ্রিল মাসে তার নিয়ন্ত্রিত জাতীয় সংসদে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বিল পাস হয়, যাতে ১৫ অগাস্টের হত্যাকাণ্ডকে বৈধতা দেওয়া হয়। আরও কিছুদিন পর সংসদে তিনি পাস করিয়ে দেন বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের বিচার থেকে অব্যাহতি প্রদানের কুখ্যাত আইন।

বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম ‘বঙ্গভবনের শেষ দিনগুলি’ গ্রন্থে লিখেছেন, ১৯৭৬ সালের ২৯ নভেম্বর  মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান আমার কাছ থেকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পদ নিয়ে নেন। এভাবে তিনি সংবিধান সংশোধন, ঘোষণা ও আদেশ প্রদান- সব ক্ষমতা নিয়ে নেন। পরের বছর ২১ এপ্রিল আমাকে বলা হয় জিয়াউর রহমানের হাতে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব হস্তান্তর করার জন্য। সেটাই করা হয়। [পৃষ্ঠা ৩৫]

তিনি আরও লিখেছেন, ‘দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়ার আগমুহূর্তে আমি জিয়াকে বলি, যেহেতু আমি রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করতে পারলাম না, আমি তাকে অনুরোধ করব যেন তিনি নির্বাচন দেন। তিনি আমাকে নিশ্চয়তা দিয়ে বলেন, তিনি নির্বাচন অনুষ্ঠান করবেন। কিন্তু আমি ভাবতে পারিনি যে নির্বাচনে তিনিই অংশ নেবেন। সে রকম ক্ষেত্রে সেনাপ্রধান থাকা অবস্থাতেই এবং সামরিক আইনের অধীনে প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবেও অর্থাৎ ক্ষমতাসীন হয়েই তিনি নির্বাচন করবেন এবং সেই নির্বাচনে তিনি অংশগ্রহণ করবেন এমন চিন্তা আমার মাথায় আসেনি।’ [পৃষ্ঠা ৩৬]

মির্জা ফখরুল ইসলাম এবং বিএনপির অন্য নেতারা এ বিষয় সব নিশ্চয়ই জানেন, কিন্তু স্বীকার করবেন না। সেনাবাহিনী প্রধান হিসেবে জিয়াউর রহমান রাজনীতি করতে পারেন, কিন্তু পুলিশ বাহিনীর কোন কর্মকর্তা মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম নিয়ে বক্তব্য দিলে সেটা ‘রাজনীতি’ হয়ে যায়?  

বিএনপি দাবি তুলছে পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনের (দ্বাদশ জাতীয় সংসদ) আগে ‘নিরপেক্ষ সরকার’ গঠন করতে হবে। বিএনপির ভাইস- চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, জাতীয় সরকার গঠিত হবে নির্বাচনের পর। অন্যদিকে বিএনপির ঘনিষ্ঠ মিত্র আসম আবদুর রব বলেছেন, ‘ধ্বংসপ্রাপ্ত রাষ্ট্র ব্যবস্থার মাধ্যমে যে গভীরতম জাতীয় সংকটের সৃষ্টি হয়েছে তাকে পুনরুদ্ধার করার অন্যতম পন্থা হচ্ছে ‘‘জাতীয় সরকার’’। জাতীয় জীবনে গভীর শাসনতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংকট উত্তরণে জাতীয় সরকারের পন্থাই অনুসরণ করতে হয়। গণবিচ্ছিন্ন অবৈধ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারী বিজয়ী শক্তির নেতৃত্বেই ‘‘জাতীয় সরকার’’ গঠিত হবে।’

মির্জা ফকরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবিতে একমত সরকারবিরোধী সব রাজনৈতিক দল। এখন এ ইস্যুতে আমরা বৃহত্তর ঐক্য গড়ব। দাবি পূরণ না হলে আমরা নির্বাচনে যাব না। কোনো নির্বাচন হতেও দেব না। জনগণকে নিয়ে আমরা প্রতিহত করব।’

আসম আবদুর রব বলেছেন, বৃহত্তর ঐক্যের মূল সূত্র নির্বাচনকালে দলীয় সরকার, নাকি জাতীয় সরকার তা নিয়ে মতভিন্নতা আছে। জাতীয় ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে যারাই আন্দোলনে সরকার পতনের জন্য কাজ করবে, তারা সবাই মিলে একটা জাতীয় ঐকমত্যের সরকার গঠন করবে অন্তর্বর্তী সময়ের জন্য।

বিএনপির ভাইসচেয়ারম্যান তারেক রহমান ২৮ মার্চ লন্ডনে এক আলোচনা সভায় ‘জাতীয় সরকারের’ রূপরেখা তুলে ধরেছেন। দলের সিনিয়র যুগ্মমহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, বিএনপি নির্বাচন চায় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে, কোনো জাতীয় সরকারের অধীনে নয়। সেই নির্বাচনে বিএনপি জয়ী হলে সব গণতান্ত্রিক দল, শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, কৃষিবিদসহ সব পেশাজীবীকে নিয়ে জাতীয় সরকার গঠন করবে। যারা নির্বাচনে জিতবে, যারা জিতবে না কিন্তু গণতন্ত্র ও জনগণের পক্ষের প্লাটফরমে এসে দাঁড়াবে, সবাইকে একসঙ্গে নিয়ে আমরা জাতীয় সরকার গঠন করব। কারণ বিএনপি বিশ্বাস করে, নির্বাচনের পর দলমত নির্বিশেষে সবার সমন্বয়ের ভিত্তিতে একটি জাতীয় সরকার গঠন করা প্রয়োজন।’

জাতীয় সরকার নির্বাচনের আগে না পরে? আসম আবদুর রব স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগ সমর্থক ছাত্রলীগের বিপুল সংখ্যক নেতা-কর্মী নিয়ে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল গঠন করেন। জাসদ গঠনের পর দলের সভাপতি মেজর (অব.) জলিল পল্টনের জনসভায় বলেছিলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় যে সব বাঙালি আর্মি পাকিস্তান ছিলেন তারা ফিরে আসছে এবং তারা জাসদের পতাকাতলে সংঘটিত হবে। 

১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর ‘বিপ্লব’ সংঘটন এবং জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করেছে জাসদ এবং তাদের নিয়ন্ত্রিত গণবাহিনী, এ দাবি এখনও আসম আবদুর রব এবং তার অনুগামীরা করে থাকেন। কেউ কেউ তো এমন উদ্ভট দাবিও করেন যে, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ সিরাজুল আলম খান লিখে দিয়েছেন। আসম রবের তরফে দাবি করা হয় যে ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানের মঞ্চে তাকে এমন স্থানে বসানো হয়েছিল যেন তিনি সহজেই বঙ্গবন্ধুর পাঞ্জাবীর পকেট স্পর্শ করতে পারেন। কেন এমন আসন ব্যবস্থা? কারণ সিরাজুল আলম খান মনে করেছিলেন বঙ্গবন্ধু ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’- এ কথাটি যদি না বলেন তাহলে আসম আবদুর রব তার পাঞ্জাবীর পকেট ধরে টান দেবেন এবং তিনি বুঝে যাবেন যে স্বাধীনতার কথা বলতে হবে।

যিনি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বাঙালির অধিকারের দাবিতে সোচ্চার ছিলেন, যিনি ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বরের নির্বাচনে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে পশ্চিম পাকিস্তানের কোনো আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী দেননি, নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভের পরও  একবারের জন্য পশ্চিম পাকিস্তান যাননি, বরং পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে তার সঙ্গে আলোচনার জন্য ঢাকায় আসতে বাধ্য করেন- তিনি বাংলাদেশের জনগণ কী চায় এবং তিনি নিজে কী চান সেটা বলতে ভুলে যাবেন! 

বঙ্গবন্ধু অসমাপ্ত আত্মজীবনী, কারাগারের রোজনামচা ও আমার দেখা নয়াচীন- এ তিনটি গ্রন্থ রচনা করেছেন কারাগারে থাকার সময়। প্রথম দুটি গ্রন্থ রচনার সময় ঝুলছিল ‘ফাঁসির দণ্ডের হুমকি’। কিন্তু বাঙালি জাতির মহান নেতা ছিলেন নির্ভীক, ধীরস্থির। এ সব গ্রন্থ বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের অমূল্য দলিল, সাহিত্য গুণমানে অনন্য। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা নিয়মিত লিখছেন, তার কয়েকটি গ্রন্থও বহুল প্রচারিত। সিরাজুল আলম খান বা আসম আবদুর রব বই লেখাতো দূরের কথা, কোনো নিবন্ধ লিখেছেন- এমন তথ্য তাদের ঘনিষ্ঠজনেরাও জানেন কি?

তবে ১৯৭৫ সালের ১৫ নভেম্বর মেজর (অব.) আবদুল জলিল এবং আসম আবদুর রব জাসদের নামে একটি লিফলেট প্রচার করেছিলেন। এতে তারা প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম ও উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের কাছে দাবি করেছিলেন- ‘বাকশাল ব্যতীত সকল প্রকাশ্য ও গোপন দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন গণতান্ত্রিক জাতীয় সরকার গঠন করা হোক। নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের তত্ত্বাবধানে নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা হোক এবং নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হোক।’

৪৭ বছর পরও আসম আবদুর রবের ‘জাতীয় সরকারের’ ধারণা পাল্টায়নি। তিনি মনে করেন- নির্বাচন হতে হবে আওয়ামী লীগকে বাইরে রেখে।

তারেক রহমান বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ২০১৮ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছেন, ‘আমরা বিএনপির গঠনতন্ত্রে একটি মাইনর চেঞ্জ করেছি। বিএনপির গঠনতন্ত্রের ৭ ধারায় ছিল- নিন্মোক্ত ব্যক্তিগণ জাতীয় কাউন্সিল, জাতীয় নির্বাহী কমিটি, জাতীয় স্থায়ী কমিটি বা যে কোনো পর্যায়ের নির্বাহী কমিটির সদস্য পদের কিংবা জাতীয় সংসদের নির্বাচনে দলের প্রার্থীপদের অযোগ্য বিবেচিত হবেন- ক. ১৯৭২ সালের রাষ্ট্রপতির আদেশ নং-৮ এর বলে দণ্ডিত, খ. দেউলিয়া, গ. উন্মাদ, ঘ. সমাজে দুর্নীতিপরায়ন বা কুখ্যাত বলে পরিচিত ব্যক্তি।’

দুর্নীতিপরায়ন ব্যক্তি বিএনপির কোনো কমিটিতে থাকতে পারবে না- বিএনপি তাদের গঠনতন্ত্র থেকে এই ধারাটি বাদ দিয়েছে। দলের মহাসচিবের কাছে এ পরিবর্তন মাইনর, তবে সকলের জানা যে এই পরিবর্তনের কারণে তারেক রহমান বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পেয়েছেন। তবে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতের দৃষ্টিতে এ ধরনের পরিবর্তন কোনো দল তাদের গঠনতন্ত্রে আনতে পারে না। গত ২৮ মার্চ (২০২২) তারেক রহমান লন্ডনের এক সমাবেশে বলেছেন, ‘নির্বাচনের আগে নিরপেক্ষ সরকার গঠন করতে হবে। এবং নির্বাচনে বিএনপি জয়ী হয়ে তাদের নেতৃত্বে গঠন করবে “জাতীয় সরকার”।’

কোথায় বাংলাদেশে নিয়ে যেতে চায় বিএনপি, বুঝে নিন। 

লেখকঃ একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত