লবিস্ট নিয়োগ করে বিএনপির কি স্বার্থ সিদ্ধি হবে?

1030

Published on ফেব্রুয়ারি 16, 2022
  • Details Image

ড. প্রণব কুমার পান্ডেঃ

সাম্প্রতিক সময়ে করোনার তৃতীয় ঢেউয়ের পরে যে বিষয়টি বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে তা হলো, বাংলাদেশ সরকার এবং রাষ্ট্রকে বহির্বিশ্বের কাছে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপনের জন্য বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) লবিস্ট নিয়োগের ঘটনা। অনেক সময় হলেও বিএনপির লবিস্ট নিয়োগের বিষয়টি ধামাচাপা পড়ে ছিল। পরে কয়েক দিন আগে এই বিষয়টি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আসে যখন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিমন্ত্রী জনাব শাহরিয়ার আলম এমপি সংসদ অধিবেশনে রাষ্ট্রপতির বক্তব্যের ওপর ধন্যবাদ জ্ঞাপন করার সময় তথ্য-উপাত্তের মাধ্যমে বিএনপির লবিস্ট নিয়োগের ঘটনাটি জাতির সামনে উপস্থাপন করেন।

লোক নীতির অ্যাকাডেমিক আলোচনায় আমরা দেখেছি, নীতি প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন অনুঘটক সব সময় চেষ্টা করে সরকারের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করতে। এই ক্ষেত্রে লবিস্টরা একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুঘটক হিসেবে স্বীকৃত অনেককাল ধরে। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় লবিং করা হয় সরকারের তরফ থেকে বিভিন্ন রাষ্ট্র বা আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কোনও সিদ্ধান্তে ঐকমত্যে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে। আবার অনেক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন দল, যাদের সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গের কাছে পৌঁছাবার ক্ষমতা নেই, তারা লবিস্ট নিয়োগের মাধ্যমে তাদের পক্ষে নীতি প্রণয়ন করার চেষ্টা করেন। কিন্তু সরকার এবং রাষ্ট্রকে বহির্বিশ্বের কাছে ছোট করে স্বার্থ হাসিলের ঘটনাটি সচরাচর দেখা যায় না, যা অতি সম্প্রতি বিএনপি'র কার্যকলাপের মাধ্যমে উপস্থাপিত হয়েছে।

এই বিষয়টি নিয়ে যেহেতু বেশ কিছু দিন ধরেই যুক্তিতর্ক উপস্থাপিত হচ্ছে, ফলে আমি ধরেই নিয়েছিলাম এই বিষয়ে কোনও লেখা লিখবো না। তবে সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত বেশ কিছু তথ্য আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে এই বিষয়ে আজকের লেখাটির প্রস্তুত করার ক্ষেত্রে। প্রথম বিষয়টি হলো সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রীদের মাধ্যমে উপস্থাপিত তথ্যের পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে বিএনপি এখন পর্যন্ত প্রায় ৩১ কোটি টাকা প্রদান করেছে লবিস্ট ফার্মকে। এই টাকার উৎস কী? ২০১১-২০২০ সাল পর্যন্ত সময়ে যে রাজনৈতিক দলের আয় ৩৪ কোটি ৬৬ লাখ ৭৯ হাজার ২৯৯ টাকা এবং ব্যয় ২৮ কোটি ৪২ লাখ ২ হাজার ৬৮২ টাকা, সেই দল কীভাবে এবং কোন প্রক্রিয়ায় এত টাকা লবিস্ট ফার্মকে প্রদান করলো তা জাতি জানতে চায়। সরকারের উচিত এ বিষয়টির গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা।

তাছাড়া এই বিপুল অংকের টাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের নজরদারি ফাঁকি দিয়ে কীভাবে দেশের বাইরে পাঠানো হলো সে বিষয়টিও গুরুত্ব সহকারে বিবেচনার দাবি রাখে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্ট নিয়োগের মাধ্যমে মার্কিন সরকারের কাছে বাংলাদেশকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করার মাধ্যমে দেশের এবং সরকারের সুনাম নষ্ট করায় তাদের অভিপ্রায় কিছুটা হলেও সফল হয়েছে। কারণ, আমরা ইতোমধ্যে জেনেছি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। এটিকে যদিও বিএনপি তাদের জয় হিসেবে দেখছে, তবে আমি এই বিষয়টিকে এতটা গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে চাই না।

তবে এটি ঠিক যে এই দলটি তাদের লবিস্টের মাধ্যমে মার্কিন সরকারকে বাংলাদেশবিরোধী কিছু বিষয় বোঝাতে সক্ষম হয়েছে, যদিও এটি বাংলাদেশের জন্য তেমন কোনও বিষয় নয়। আমরা সকলেই জানি যে ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালে মার্কিন সরকার তাঁর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। আবার তিনি যখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী হলেন সেই মার্কিন সরকার তাদের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে তাঁকে লালগালিচা সংবর্ধনা প্রদান করেছে। অতএব, শান্তি-শৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক এবং অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে খুব বড় ফ্যাক্টর বলে আমি মনে করি না।
আমরা ইতোমধ্যে জেনেছি একটি সংঘবদ্ধ চক্র দেশের বাইরে অবস্থান করে বেশ কিছু দিন ধরে বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন নেতিবাচক প্রচারণা চালাচ্ছে। এর সঙ্গে জড়িত রয়েছেন বেশ কিছু স্বনাম ধন্য ব্যক্তি এবং বিএনপি, যাদের মূল টার্গেট যেকোনও উপায়ে বাংলাদেশকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপনের মাধ্যমে বর্তমান সরকারকে গদি থেকে সরিয়ে ক্ষমতার মসনদে বসা। তবে, তাদের এই হীন প্রচেষ্টা খুব সহসায় সফল হবে বলে আমি মনে করি না। তবে এখানে আমাদের যে বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে ভাবা দরকার সেটি হচ্ছে আমাদের রাষ্ট্রের এবং সরকারের বিভিন্ন মেকানিজম রয়েছে এই বিষয়গুলো পর্যবেক্ষণ করার।

মূলত এই বিষয়গুলো দেখাশোনা করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। বিএনপি এতদিন ধরে তাদের লবিস্টের মাধ্যমে যেভাবে সরকারকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করার প্রক্রিয়া পরিচালনা করেছে, সেই তথ্য জনসমক্ষে আসতে বা সরকারের নজরে আসতে এত সময় লাগলো কেন সে বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে ভেবে দেখার অবকাশ রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের মিশনে কর্মরত কর্মকর্তারা কি তাদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে, সেই বিষয়টিও খতিয়ে দেখা দরকার। বর্তমানে পরিস্থিতি এমন একটা জায়গায় পৌঁছেছে যে বিএনপি এবং বেশ কয়েকজন বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতারা সবসময় মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আসছে- এই মর্মে জুজুর ভয় দেখাতে ব্যস্ত রয়েছেন। কিন্তু তাদের মাথায় রাখা উচিত যে বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই ধরনের ভয়ে ভীত নন। তিনি গত ১৩ বছরে শক্তহাতে যেভাবে দেশের হাল ধরেছেন এই বিষয়গুলোও ঠিক একইভাবে তিনি যথাসময়ে সমাধান করবেন। বিএনপি প্রথম দিকে লবিস্ট নিয়োগের বিষয়টি অস্বীকার করলেও পরবর্তী সময়ে বিএনপির সেক্রেটারি জেনারেল সাংবাদিকদের সামনে স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন যে বিএনপি লবিস্ট নিয়োগ করেছে। অতএব, সরকারের উচিত অতি দ্রুত এই অর্থের উৎস অনুসন্ধান করে যারা এই প্রক্রিয়ায় দেশের বাইরে অর্থ প্রেরণ করেছে তাদের দেশদ্রোহিতার অভিযোগের মামলায় বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর।

রাজনীতির ক্ষেত্রে বিরোধিতা থাকবেই -এটাই স্বাভাবিক। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার মূল সৌন্দর্য হচ্ছে বিরোধিতা। কিন্তু নিজের স্বার্থ হাসিলের জন্য অর্থের বিনিময়ে দেশকে বিদেশে এবং আন্তর্জাতিক মহলে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করার অধিকার সংবিধান কোনও ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে প্রদান করেননি। বাংলাদেশে অবস্থান করে যারা এ ধরনের কাজ করছেন তাদের অবশ্যই শাস্তির আওতায় নিয়ে আসতে হবে।

বিএনপি এবং অন্যান্য বিরোধী নেতৃবৃন্দ আরও মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আসছে বলে তথ্য প্রচার করলেও ইতোমধ্যে মার্কিন কংগ্রেসম্যান এবং পররাষ্ট্র বিষয়ক হাউজ কমিটির চেয়ারম্যান গ্রেগরি ডব্লিউ মিকস স্পষ্ট করে বলেছেন, আপাতত বাংলাদেশের ওপর কোনও নিষেধাজ্ঞা আরোপের পরিকল্পনা মার্কিন সরকারের নেই। এটি যেমন একটি স্বস্তির খবর, ঠিক তেমনিভাবে সরকারের উচিত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি সুরাহা করা। যদিও র‍্যাব কর্মকর্তাদের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার বিষয়টিতে বাংলাদেশ সরকারের এমন কিছু যায় আসে না, তারপরও যেহেতু বাংলাদেশ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দুটি বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র, তাদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি বেশি দিন ধরে রাখা ঠিক হবে না।
একথা অস্বীকার করবার উপায় নেই যে এই গোষ্ঠী তাদের লবিস্ট ফার্মের মাধ্যমে বাংলাদেশ সম্পর্কে কিছু কিছু ক্ষেত্রে নেতিবাচক তথ্য প্রদান করতে সক্ষম হয়েছে মার্কিন প্রশাসনের কাছে। তাছাড়া বর্তমান মার্কিন প্রশাসনের বিভিন্ন পদে বেশ কিছু বাংলাদেশি মার্কিনী রয়েছেন, যাদের সঙ্গে বিএনপির অনেক নেতার পারিবারিক সম্পর্ক ও ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। তারাও চেষ্টা করবেন মার্কিন প্রশাসনকে বাংলাদেশ সম্পর্কে ভুল পথে পরিচালিত করতে। এটা স্বাভাবিক হলেও সরকারের উচিত এই বিষয়গুলো গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যে প্রক্রিয়ায় এই বিষয়টি মোকাবিলা করা যায় সেই বিষয়ে সব বিকল্প প্রস্তাবনা নিয়ে কাজ করছে। তবে যত দ্রুত সম্ভব এ বিষয়টির সুরাহা হলে যারা ইতোমধ্যে নিজেদের সফল হিসেবে দাবি করে খুশিতে রয়েছেন তাদের সেই খুশি মলিন হয়ে যাবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশকে যেভাবে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন বিশ্ব দরবারে, তার পক্ষেই সম্ভব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশের (যেখানে বাংলাদেশকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করবার কাজ করছে দেশ বিরোধী চক্র) সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের মাধ্যমে দেশের অগ্রগতি এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। আমাদের এ কথা ভুললে চলবে না যে বিভিন্ন গোষ্ঠীর বৈরিতা এবং কোভিড-১৯-এর মতো অতিমারির প্রভাব মোকাবিলা করে বাংলাদেশের অর্থনীতি দুর্দান্ত গতিতে এগিয়ে চলেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্ট নিয়োগের মাধ্যমে বাংলাদেশের অবস্থান পৃথিবীর মানচিত্রে খাটো করা যাবে না। সরকারের উচিত অতিসত্বর এই গোষ্ঠীকে খুঁজে বের করে শাস্তির আওতায় নিয়ে আসা।

লেখক: অধ্যাপক, লোক-প্রশাসন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

সৌজন্যেঃ বাংলা ট্রিবিউন

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত