448
Published on জানুয়ারি 8, 2022এম. নজরুল ইসলাম:
০৭ জানুয়ারি ২০১৯, সোমবার টানা তৃতীয়বারের মতো শপথ নিল সরকার। আগের দিন রবিবারই জানা গিয়েছিল ৪৭ সদস্যের মন্ত্রিসভার সদস্যদের নাম। সেটা সবার জন্য চমকই ছিল। প্রশ্ন ছিল অনেক। প্রশ্ন থাকাটাই তো স্বাভাবিক। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নতুন সরকার যখন দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেয়, তিন বছর আগের সেই সময়টিতে বিশ্ব এক নতুন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে যাচ্ছিল। মন্ত্রিসভার সদস্যদের নাম ঘোষণার পর দেখা গেল, তাতে পুরনো মন্ত্রিসভার হেভিওয়েট বিশেষ কেউ নেই। বিষয়টি শুধু চমকে ওঠার মতো ছিল না। বলা যেতে পারে সিদ্ধান্তটি ছিল দুঃসাহসী। এতে ঝুঁকি ছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগের ঘোর সমালোচকদের অনেকেই অবশ্য তখন প্রশংসামুখর হয়ে বলেছিলেন অপেক্ষাকৃত তরুণদের বেছে নেওয়াটা নতুন দৃষ্টিভঙ্গির পরিচায়ক। তাঁদের অনেকের মনে হয়েছিল, এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হতে যাচ্ছে। আবার চ্যালেঞ্জও যে ছিল না, তা তো নয়। রাজনীতিগতভাবে সিদ্ধান্তটি কঠোর ছিল। নতুনদের নিয়ে গঠিত মন্ত্রিসভা ভুল করলে জনগণ সরকারের প্রতি আস্থাও হারাতে পারে, এমন আশংকাও ব্যক্ত করেছিলেন কেউ কেউ। জাতীয় কিংবা বৈশ্বিক সংকটে নতুন মন্ত্রিসভা কতটা দক্ষতার পরিচয় দিতে পারবে, এমন প্রশ্নও ছিল। সংশয়ও ব্যক্ত করেছিলেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলের অনেকে। ঠিক এক বছর পার না হতেই বড় পরীক্ষার মুখে পড়তে হলো সরকারকে, ২০২০ সালে।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণে টালমাটাল হয়ে পড়ল বিশ্ব অর্থনীতি। বাংলাদেশও তো এর বাইরে ছিল না। এই চরম দুঃসময়েও সবাইকে অবাক করে দিলো এশিয়ার এই উদীয়মান অর্থনীতির দেশটি। বিশ্ব অর্থনীতি নিয়ে চারদিকে যখন নেতিবাচক খবর, তখন প্রবৃদ্ধিতে আশা জাগিয়েছে বাংলাদেশ। করোনা মহামারির ধাক্কা কাটিয়ে সামষ্টিক অর্থনীতির সূচকগুলোতে উন্নতি করে প্রবৃদ্ধিতে পেছনে ফেলে দেয় প্রতিবেশী দেশগুলোকে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বলছে, মহামারির মধ্যেই চলতি অর্থবছরে মাথাপিছু জিডিপিতে ভারতকে ছাড়িয়ে যাবে বাংলাদেশ। শুধু ভারতই নয়, চলতি অর্থবছরে মাথাপিছু জিডিপির হিসাবে দক্ষিণ এশিয়ায় শীর্ষ এবং এশিয়ার মধ্যে চতুর্থ হতে চলেছে বাংলাদেশ। অর্থনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রবৃদ্ধিতে ভারতের মতো বৃহৎ অর্থনীতির দেশকে ছাড়িয়ে যাওয়া অবশ্যই একটি বড় অর্জন। তবে এ নিয়ে আত্মতৃপ্তিতে না ভুগে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ সামাল দেওয়ার প্রস্তুতি নেওয়ার পাশাপাশি অর্থনীতি পুনরুদ্ধার কার্যক্রম আরো জোরদার করার বিষয়ে জোর দিয়েছেন অর্থনীতি বিশ্লেষকরা। ভারতীয় অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসু, যিনি ২০১৬ সাল পর্যন্ত বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ হিসেবে কাজ করেছেন, তিনি বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্ধারণ করা সুনির্দিষ্ট অগ্রাধিকারের কারণেই বাংলাদেশের এই অগ্রগতি।
এক দশক ধরেই দ্রুত প্রবৃদ্ধিশীল দেশগুলোর অন্যতম বাংলাদেশ। করোনা মহামারিতেও ঘুরে দাঁড়ানোর সক্ষমতা দেখিয়েছে। অর্থনীতিতে এই ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে আগামী ২০৩৬ সালের মধ্যেই বিশ্বের ২৪তম অর্থনীতি হবে বাংলাদেশ। যুক্তরাজ্যভিত্তিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর ইকোনমিকস অ্যান্ড বিজনেস রিসার্চ (সিইবিআর) তাদের সর্বশেষ প্রতিবেদনে এমন দাবি করেছে।
বাংলাদেশের জন্য ২০২১ সালটি শুরু হয়েছিল স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় নাম লেখানোর মধ্য দিয়ে। ২৬ ফেব্রুয়ারি জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি বা ইউএন-সিডিপির বৈঠক থেকে আসে কাঙ্খিত এ ঘোষণা।
বছরের শেষভাগে গত ২৪ নভেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে রাখার প্রস্তাব চূড়ান্ত অনুমোদন পায়। আগামী ২০২৬ সাল পর্যন্ত উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে পর্যবেক্ষণে থাকবে বাংলাদেশ, এর ভেতরে চলতে থাকবে উন্নয়নের বড় প্রস্তুতিগুলো।
আগের বছরের তুলনায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়েছে। এরমধ্যেই গত বছরের শেষ দিকে এসে রেমিটেন্স প্রবাহ কমেছে। ডলারের দাম বেড়ে যাওয়া ও আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে আমদানি ব্যয় মেটাতে হয়েছে অন্য বছরের তুলনায় বেশি। এরপরও ২০২০ সালের তুলনায় কিছুটা প্রবৃদ্ধি ধরে রেখেছে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ। বাংলাদেশে ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের নভেম্বর শেষে ৪১ দশমিক ২৬ বিলিয়ন এবং ডিসেম্বর শেষে রিজার্ভের মজুদ ছিল ৪৩ দশমিক ১৬ বিলিয়ন ডলার। অপরদিকে ২০২১ সালের নভেম্বরে এসে রিজার্ভের পরিমান বেড়ে হয়েছে ৪৪ দশমিক ৮৮ বিলিয়ন ডলাল। আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ। গত বছরের আগস্ট শেষে রিজার্ভের সংগ্রহ ৪৮ বিলিয়নের রেকর্ড ছুঁয়েছিল। ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত এর পরিমাণ ছির ৪৫ দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলার, যা বছরে শেষে ৪৬ বিলিয়নের ঘর ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনার কথাও বলছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা।
করোনাভাইরাস সংক্রমণের একাধিক ঢেউ নাড়িয়ে দিয়ে গেলেও সরকারের দ্রুত ও সময়োচিত পদক্ষেপে বাংলাদেশের অর্থনীতি প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় দ্রæত ঘুরে দাঁড়াচ্ছে বলে মনে করছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফ।
আন্তর্জাতিক এই ঋণদাতা সংস্থা বলছে, সংক্রমণের হার কমে আসায় এবং সরকারের অনুকূল নীতি সহায়তা অব্যাহত থাকায় চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ৬ দশমিক ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি পেতে পারে।
মহামারীর মধ্যে গত দুই বছরে সরকারের ধার বেড়ে গেলেও আন্তর্জাতিক বাজার পরিস্থিতি এবং দেশে টিকাদান পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় ঋণের বোঝা নিয়ে দীর্ঘমেয়াদে খুব বেশি ঝুঁকি দেখছে না আইএমএফ।
অর্থনীতি এই গতিপথ ধরে রাখতে পারলে ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ ৭ দশমিক ১ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি পেতে পারে বলে আভাস দেওয়া হয়েছে আইএমএফ এর এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে।
এক দশক ধরেই দ্রুত প্রবৃদ্ধিশীল দেশগুলোর অন্যতম বাংলাদেশ। করোনা মহামারিতেও ঘুরে দাঁড়ানোর সক্ষমতা দেখিয়েছে। অর্থনীতিতে এই ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে আগামী ২০৩৬ সালের মধ্যেই বিশ্বের ২৪তম অর্থনীতি হবে বাংলাদেশ। যুক্তরাজ্যভিত্তিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর ইকোনমিকস অ্যান্ড বিজনেস রিসার্চ (সিইবিআর) তাদের সর্বশেষ প্রতিবেদনে এমন দাবি করেছে।
সম্প্রতি প্রকাশিত বার্ষিক ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক লীগ টেবিল’ (ওয়েল্ট ২০২২) প্রতিবেদনে বলা হয়, বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের ক্ষমতা, ক্রমবর্ধমান তৈরি পোশাকের চাহিদা ও সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার কারণে ১৯১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ এই অবস্থান অর্জন করবে। বর্তমানে বাংলাদেশের অবস্থান ৪২তম; ২০২২ সালে ৪১তম স্থানে থাকার পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে, যা ২০২৬ সাল নাগাদ গিয়ে পৌঁছাবে ৩৪তম স্থানে এবং ২০৩৬ সালে পৌঁছাবে ২৪তম অবস্থানে। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া এবং এটি পরবর্তী দশকে ব্যাপক অর্থনৈতিক বিকাশের ইঙ্গিত দেয়।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, কভিড-১৯ মহামারির ধাক্কায় বিশ্বব্যাপী বেশির ভাগ দেশের তুলনায় বাংলাদেশে মৃত্যুর হার কম দেখা গেছে। এ ছাড়া ২০২১ সালের ডিসেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত দেশের অর্ধেকেরও বেশি মানুষ অন্তত এক ডোজ করে টিকা পেয়েছে। এতে আরো বলা হয়, দেশের টিকাদান অভিযান বিশ্বমানের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ ছিল।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশ বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ এবং স্থির মূল্যে জিডিপির আকার ৮৮৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার নিয়ে ২০৩৬ সাল পর্যন্ত উন্নতির এই ধারা বজায় থাকবে দেশে। বর্তমানে বাংলাদেশের জিডিপির পরিমাণ ৩২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
করোনার আগের ১০ বছরে ১৮৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করে বাংলাদেশ সারা বিশ্বে প্রবৃদ্ধি অর্জনে প্রথম স্থান অধিকার করেছে। এমনকি করোনায় যখন সারা বিশ্বের অর্থনীতি ৩ দশমিক ১ শতাংশ সঙ্কুচিত হয়েছে, সে সময়ও বাংলাদেশের অর্থনীতির সকল সূচক ছিল ঊর্ধ্বমুখী। অর্থনৈতিক এই সাফল্যে আজ আমাদের উন্নয়নশীল দেশের কাতারে সামিল করছে।
বাংলাদেশের মানুষের উন্নয়নের যে আকাক্সক্ষা রয়েছে, তা অন্য অনেক দেশে নেই বলে মনে করেন দেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। সম্প্রতি এক আলোচনায় তিনি বলেছেন, ‘আমাদের দেশের খুব গরিব মানুষরাও মনে করেন যে দারিদ্র্য তাদের ভাগ্য নয়। এটি উন্নয়নের আকাঙ্ক্ষা, এটা একটা বড় শক্তি। মানুষের এই আকাক্সক্ষা বোধহয় মুক্তিযুদ্ধ থেকেই এসেছে এবং এখন পর্যন্ত আছে।’
তিনি মনে করেন, ‘এত দিন আমরা যে উন্নয়নের সাফল্য পেয়েছি, সেখানে সাধারণ মানুষ, কৃষক, ক্ষুদ্র, মাঝারি, বড় শিল্প উদ্যোক্তাদের একটা বৈশিষ্ট্য ছিল, যখন যেই সুযোগ এসেছে তার পূর্ণ ব্যবহার করেছেন। যতটুকু তাদের সাধ্যের মধ্যে ছিল, এমনকি ক্ষুদ্র কৃষক। আর সরকার সেখানে প্রয়োজনীয় নীতি সমর্থন দিয়েছেন এবং সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। এটাই হলো বাংলাদেশের সাফল্যের মূল কথা।’
তিনি একইসঙ্গে বলেছেন, বাংলাদেশের অর্থনীতির উন্নয়ন কাউকে অনুকরণ করে হয়নি, হয়েছে ‘নিজস্ব মডেলে’।
আর এভাবেই গত ১২ বছরে অর্থনীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এগিয়েছে অনেক দূর। নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় প্রযুক্তিগত উন্নয়ন, উপযুক্ত শিক্ষা দিয়ে মানব সম্পদ তৈরি এবং প্রশাসনের দক্ষতা ও জবাবদিহিতা বাড়াতে পারলে বাংলাদেশকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হবে না।
অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের ভাষায়, শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্ব আর সাধারণ মানুষের মধ্যে উন্নয়নের আকাক্সক্ষা এ দুইয়ের সম্মিলনে উন্নয়নের গল্প লিখছে বাংলাদেশ।
টানা এক যুগ ধরেই চলছে এই উন্নয়নের গল্প লেখা। তার ধারাবাহিকতায় তৃতীয়বারের মতো সরকার পরিচলনায় শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকারের তৃতীয় বর্ষ পূরণ হচ্ছে আজ। করোনা সংক্রমণ বাড়ছে। অর্থনীতির ওপর চাপ আসবে। কিন্তু নেতৃত্ব যেখানে জনকল্যাণে ব্রতী, সেখানে কোনো কালোছায়া বিস্তার লাভ করতে পারবে না, এটা আমাদের বিশ্বাস। চতুর্থ বর্ষে পদার্পনের এই শুভক্ষণে সরকারের জন্য শুভকামনা।
লেখক: সর্ব ইউরোপিয়ান আওয়ামী লীগের সভাপতি