1777
Published on নভেম্বর 15, 2021হীরেন পণ্ডিতঃ
বাংলাদেশের অর্থনীতি অনেক আশাব্যঞ্জক মাইলফলক ছুঁয়েছে। নানা প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। সরকার বেশকিছু মেগা প্রকল্প হাতে নিয়ছে। পদ্মা বহুমুখী সেতুর কাজ প্রায় শেষের দিকে। সর্বশেষ স্প্যানটি বসানো হয় গত ডিসেম্বরে। আগামী বছরের মাঝামাঝি সেতুটি যান চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হবে।
এতে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থায় বিপ্লব ঘটবে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ সব নাগরিককে বিস্তৃত টেলিযোগাযোগ সেবা (সরাসরি ঘরে ঘরে টিভি, রেডিও, টেলিমেডিসিন, শিক্ষা ও ইন্টারনেট ব্যবহার), রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, ঢাকা মেট্রোরেল প্রকল্প, মাতারবাড়ি প্রকল্প দেশের অর্থনীতিকে চাঙা করতে অবদান রাখছে।
গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ প্রকল্প, রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, বঙ্গবন্ধু টানেল নির্মাণ প্রকল্প, ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, তিন ডজনেরও বেশি হাইটেক পার্ক এবং আইটি গ্রাম নির্মাণ করা হচ্ছে। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা গৃহীত হয়েছে। গ্রামগুলো সব ধরনের নাগরিক সুবিধা দিয়ে সজ্জিত করা হচ্ছে। আজ দেশ এমন একটি অবস্থায় পৌঁছেছে, যেখানে মাথা উঁচু করে বিশ্বের কাছে দেশের পরিচয় দেয়া যায়।
সরকার ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা, এমডিজি এবং প্রথম পরিপ্রেক্ষিত পরিকল্পনা বাস্তবায়নে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছে। আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে এখন পর্যন্ত ৩ লাখ ২০ হাজার ৭২টি পরিবারকে আশ্রয় দিয়েছে। মুজিব জন্মশতবর্ষে সরকার বছরের উপহার হিসেবে ৬৬ হাজার ১৮৯টি পরিবারকে একটি করে বাড়ি উপহার দিয়েছে।
জনগণের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের জন্য প্রায় ১৪ হাজার ৫০০ কমিউনিটি ক্লিনিক তৈরি করা হয়েছে। ৩ কোটির বেশি শিক্ষার্থীকে বৃত্তি-উপবৃত্তি, ৬ লাখ মানুষকে বিভিন্ন ভাতা, ৫০ লাখ পরিবারকে ১০ লাখ টাকার চাল, কৃষি খাতে কৃষকদের ভর্তুকি প্রদান করে। কোভিড-১৯ মহামারি চলাকালে সরকার ১ লাখ ২১ হাজার কোটি টাকার বিভিন্ন প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে, যা দারিদ্র্য বিমোচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
বর্তমানে বাংলাদেশ বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম ধান উৎপাদনকারী দেশ এবং মাছ-মাংস, ডিম ও শাকসবজিতেও স্বয়ংসম্পূর্ণ। অভ্যন্তরীণ জলসীমায় মাছ উৎপাদন বৃদ্ধির হারের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। আজ ডিজিটাল বাংলাদেশের সুফল শহর থেকে গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ছে।
জাতিসংঘ ২০১৮ সালে বাংলাদেশকে এলডিসি থেকে একটি উন্নয়নশীল দেশে রূপান্তরের ঘোষণা দেয়। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে, জাতিসংঘ বাংলাদেশকে একটি উন্নয়শীল দেশে পরিণত করার জন্য চূড়ান্ত সুপারিশ করে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের মতে, ২০৩০-এর মধ্যে বাংলাদেশ হবে বিশ্বের ২৪তম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ। দ্বিতীয় পরিপ্রেক্ষিতে পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০৩১ সালে বাংলাদেশে এমন কেউ থাকবে না, যাকে অত্যন্ত দরিদ্র বলা যাবে।
মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা- এই তিনটি সূচক উন্নয়নশীল দেশগুলোর যোগ্যতা নির্ধারণ করে। এই তিন সূচকে বাংলাদেশ প্রায় কাঙ্ক্ষিত যোগ্যতা অর্জন করেছে। কোভিড-১৯-এর মধ্যেও বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ২ হাজার ৫৫৪ এর অর্থনৈতিক ধারাবাহিকতা বজায় রেখে সারা বিশ্বকে স্তম্ভিত করেছে।
নারী শিক্ষা-ক্ষমতায়ন, স্বাস্থ্যসেবা, মা ও শিশুমৃত্যুর ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। নারীরা এখন সামাজিক-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকসহ সব স্তরে অবদান রাখছে। প্রযুক্তির ছোঁয়ায় গ্রামাঞ্চলের নারীও পিছিয়ে নেই। এগিয়ে চলেছেন পুরুষের সঙ্গে সমানতালে। এতে বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার পথে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে।
আজকের তরুণরাই আগামীর কর্ণধার। তরুণ প্রজন্মকে মানবসম্পদে পরিণত করতে বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, প্রকৌশল, কলা ও গণিত (স্টিম) শিক্ষা ব্যাপকভাবে চালু করা হচ্ছে। সমসাময়িক বিশ্বে ক্যারিয়ারভিত্তিক শিক্ষা অপরিহার্য। রাষ্ট্রকে অবশ্যই তরুণদের জ্ঞান-দক্ষতা, অভিজ্ঞতা-আকাঙ্ক্ষা এবং মতামতের যথাযথ মূল্য দিতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী দেশের জন্য অর্জনের জন্য চারটি মাইলফলক নির্ধারণ করেছেন। প্রথমটি ২০২১-এ ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপকল্প, ২০৩০-এ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জন, ২০৪১-এ উন্নত বাংলাদেশ গড়ে তোলা এবং চতুর্থটি ২১০০-এর ডেল্টা প্ল্যান। সব নাগরিককে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত (এসডিজি-১ দারিদ্র্য অবসান এবং এসডিজি-২, জিরো হাঙ্গার অর্জন) করতে একটি উন্নত বাংলাদেশের জন্য কাজ করতে হবে এবং বঙ্গবন্ধু যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, সেই মুক্তিযুদ্ধ ও ধর্মনিরপেক্ষতার চেতনাকে সমুন্নত রাখতে হবে। বাংলাদেশের সম্পদ সীমিত। ভূমির তুলনায় জনসংখ্যা বেশি। তা সত্ত্বেও বাংলাদেশ আজ বিশ্বের কাছে উন্নয়নের রোল মডেল।
কোভিড-১৯ মহামারির কারণে বিশ্বের বেশির ভাগ অর্থনীতি গত বছরে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি দেখেছে। এর মানে এই দেশগুলোর মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) আগের বছরের তুলনায় কম। এমনকি প্রতিবেশী ভারতের মতো উচ্চ-বৃদ্ধির দেশগুলোতেও জিডিপির আকার প্রায় ৮ শতাংশ কমেছে। বাংলাদেশ এই ধারার অন্যতম ব্যতিক্রম ছিল। অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, কিন্তু আগের বছরের তুলনায় আকারে সংকুচিত হয়নি। ২০১৯-২০ সালে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা সত্ত্বেও বাংলাদেশের অর্থনীতি পিছিয়ে যায়নি।
আগামী অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি আরও বেশি হবে বলে মনে করছে বিশ্বব্যাংক। ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য সংস্থাটির পূর্বাভাস ৭.৯ শতাংশ। রপ্তানি ও ভোগে ধারাবাহিকতা থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে। অর্থনীতির পুনরুদ্ধার অব্যাহত থাকা ও দারিদ্র্য হ্রাস পাওয়া নির্ভর করবে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার এবং ব্যবসায়ীদের সাহায্য করে অর্থনীতির ক্ষতি মোকাবিলার ওপর।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) সম্প্রতি জন্ম-মৃত্যু, স্বাস্থ্য ও শিক্ষাসহ ২০২০-এর ‘ভাইটাল স্ট্যাটিস্টিকস’ প্রকাশ করেছে। দেখা যায় বাংলাদেশের গড় আয়ু এখন ৭২.৮ বছর। ত্রিশ বছর আগে-১৯৯০ সালে গড় আয়ু ছিল মাত্র ৫৬ বছর। পাকিস্তানি দুঃশাসনের কারণে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশের গড় আয়ু গত ৩০ বছরে ১৫ বছর বেড়েছে।
ভারতের গড় আয়ু বাংলাদেশের তুলনায় কম। ২০২০ সালে এটি ৬৮.৩ বছর ছিল। বাংলাদেশে গত বছর পাঁচ বছরের কম বয়সী প্রতি এক হাজার শিশুর মধ্যে ৩১ শিশু মারা যায়। ১৯৯০ সালে এই সংখ্যা ছিল ১৪৪। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার্থীদের ভর্তি হারেও অনেক উন্নতি হয়েছে। মাধ্যমিক স্তরের বয়স বিবেচনায় এখন ৬৩ শতাংশ শিশু স্কুলে যায়।
বিশ্বব্যাংকের মতে, ১৯৯০-এ বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ছিল ৩২০ মার্কিন ডলার। ২০২০ সালে এটি ২ হাজার ১৩৯ ডলারে দাড়িয়েছে। ১৯৯০ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতি বা জিডিপির আকার ছিল মাত্র ৩২ বিলিয়ন ডলার। ২০২০-এ জিডিপি ৩২৪ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। গত এক দশকে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বিশ্ব অর্থনীতির গতিশীলতার ওপর এর সর্বশেষ বিশ্ব অর্থনৈতিক আউটলুকে বলেছে যে, বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি এ বছরও ভারতকে ছাড়িয়ে যাবে।
দারিদ্র্যবিমোচনে বাংলাদেশের সাফল্য বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭৩-৭৪ সালে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ৭২ শতাংশ। সর্বশেষ প্রকাশিত পারিবারিক আয়-ব্যয় জরিপ অনুযায়ী-২০১৬ সালে দারিদ্র্যের হার ছিল ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ। এর ভিত্তিতে ২০১৯ সালে আনুমানিক দারিদ্র্যের হার ২০.৫ শতাংশ। গত বছর কোভিড-১৯ মহামারির কারণে দারিদ্র্য পরিস্থিতির অবনতি হয়।
সাম্প্রতিক বিভিন্ন জরিপ অনুসারে, এর অনেকটাই এখন উদ্ধার করা হয়েছে। বিশ্বব্যাংক সম্প্রতি দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে হালনাগাদ প্রতিবেদনে বলেছে, কোভিড-১৯-এর কারণে বাংলাদেশে দারিদ্র্য পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে, কিন্তু বর্তমানে পরিস্থিতি উল্টে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ উন্নয়নের পথে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে। সঠিক নীতি ও পরিকল্পনার মাধ্যমে এসব সমস্যার সমাধান করতে হবে। ২০২৬ সালে বাংলাদেশ এলডিসি স্ট্যাটাস থেকে বেরিয়ে গেলে, বর্তমান শুল্ক এবং কোটামুক্ত সুবিধা শুধু ২০২৯ সাল পর্যন্ত ইইউ বাজারে পাওয়া যাবে। এ কারণে আগামী পাঁচ বছরের প্রস্তুতি বাংলাদেশের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ।
অর্থনীতিবিদরা এসডিজি, অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ও টেকসই ট্রানজিটের জন্য পরিপ্রেক্ষিত পরিকল্পনার সঙ্গে সমন্বয় করে শক্তিশালী ট্রানজিট কৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের পরামর্শ দিচ্ছেন। আগামীতে অগ্রগতির জন্য স্থানীয় বাজার ও জনগণের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি, রপ্তানি বহুমুখীকরণ, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, অবকাঠামোর উন্নয়ন, দুর্নীতি হ্রাস, মানসম্মত শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা সম্প্রসারণে বিশেষ মনোযোগ দেয়ার সুপারিশ করা হয়।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও রিসার্চ ফেলো, বিএনএনআরসি
সৌজন্যেঃ নিউজবাংলা২৪
(মতামত লেখকের নিজস্ব। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ-এর অফিসিয়াল ওয়েবসাইটের সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)