বঙ্গবন্ধুর শক্তি, সাহস ও প্রেরণার নাম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব

1948

Published on আগস্ট 8, 2021
  • Details Image

সাইফুল্লাহ্ আল মামুনঃ

পৃথিবীর ইতিহাসের সফলতম ব্যক্তিদের সফলতা বা অর্জনের নেপথ্যে থাকে কিছু অনুঘটনা, থাকে বিশেষ কারো কাছ থেকে পাওয়া সাহস ও প্রেরণা। যে সাহস ও প্রেরণায় ভর করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি দুর্বার গতিতে এগিয়ে যায় দূর বহুদূর। আর সাহস ও প্রেরণা জাগানো সেই ব্যক্তিটি যদি হয় জীবনের বিশেষ কেউ তাহলে সৃষ্টি হয় প্রচন্ড আত্মবিশ্বাস ও দৃঢ়তা। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যেকোন বৃহৎ অর্জন বা সৃষ্টিশীলতার মূল ভিত্তি প্রচন্ড আত্মবিশ্বাস ও দৃঢ়তা থেকে প্রাপ্ত দুর্বার জীবনীশক্তি। আমাদের স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আজন্ম শক্তি, সাহস ও প্রেরণার উৎস ছিলেন বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব।

‘আপনি শুধু আমার স্বামী হওয়ার জন্য জন্ম নেননি, দেশের কাজ করার জন্যও জন্ম নিয়েছেন। দেশের কাজই আপনার সবচাইতে বড় কাজ। আপনি নিশ্চিন্ত মনে আপনার কাজে যান। আমার জন্য চিন্তা করবেন না। আল্লাহর উপরে আমার ভার ছেড়ে দিন।’- একজন স্বামীর কাছে লেখা অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীর চিঠির ভাষা এটা। এমন অনুপ্রেরণাদানকারী স্ত্রীর স্বামীরাই তো কালে কালে স্মরণীয় বরণীয় হতে পেরেছে, পেরেছে দেশ ও জাতিকে বড় কোন অর্জন এনে দিতে। ১৯৪৭ সালের দেশ বিভক্তির চূড়ান্ত সময়ের প্রাক্কালে ও অব্যবহিত পরে যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা চলছিল সেই দাঙ্গার সময়ে যুক্তবাংলার প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছাত্রলীগ ও মুসলিম লীগ ন্যাশনাল গার্ডের একটা ভলান্টিয়ার কোর গঠন করে বর্ডারে গিয়ে শরনার্থীদের আসা-যাওয়ার বিষয়টি তদারকি করার দায়িত্ব দেন শেখ মুজিবকে। কিন্তু সেই সময় আমাদের প্রিয় নেত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা মাতৃগর্ভে। যে সময় স্বামী মুজিবকে স্ত্রী রেণুর (বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের ডাক নাম) পাশে থাকা উচিৎ এবং যে সময় প্রত্যেক স্ত্রীই তার স্বামীকে পাশে দেখতে চায় সব চেয়ে বেশি ঠিক সেই সময়ই শেখ মুজিব স্ত্রীর কাছে কলকাতার বিরাজমান পরিস্থিতি বর্ণনা করে চিঠি লিখলেন। স্বামীর চিঠির প্রত্যুত্তরে বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব উপরোক্ত উত্তর পাঠিয়েছিলেন।

"কোন কালে একা হয়নি ক’ জয়ী পুরুষের তরবারি,/প্রেরণা দিয়াছে, শক্তি দিয়াছে বিজয়-লক্ষ্মী নারী।" (কাজী নজরুল ইসলামের 'নারী' কবিতা )। আমরা বাঙালীরা সৌভাগ্যবান। আমাদের শত সহস্র বছরের স্বাধীনতার স্বপ্নসাধ পূরণে আমরা আমাদের ইতিহাসের মহানায়কের পাশে তেমনই একজন নারী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবকে পেয়েছিলাম। দেশত্ববোধ ও জনকল্যাণকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে ১৯৪৭ সালে তিনি যখন তাঁর স্বামীকে চিঠিটি লিখেছিলেন তখন তার বয়স কতো? মাত্র ১৭! এই বয়সের একজন গৃহবধু কত্তোটা উদার এবং স্বামীর আদর্শ ও কাজের প্রতি কত্তোটা আস্থাশীল কিংবা দেশ ও জনগণের প্রতি নিজের কমিটমেন্ট থাকলেই কেবল কথাগুলো লিখতে পারে?

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও ফজিলাতুন্নেছা দম্পতির বড় সন্তান বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার মায়ের প্রসঙ্গ এলে একটি গল্প প্রায়ই বলেন। সেটি বঙ্গবন্ধুর সাত মার্চের ভাষণ দিতে বাসা থেকে রওনা দেয়ার প্রাক্কালের ঘটনা। তিনি বলেন, ‘বড় বড় বুদ্ধিজীবীরা লিখে দিয়েছেন, এটা বলতে হবে, ওটা বলতে হবে। কেউ কেউ বলছেন, এটাই বলতে হবে, না বললে সর্বনাশ হয়ে যাবে। এ রকম বস্তা বস্তা কাগজ আর পরামর্শ! গুরুত্বপূর্ণ কিছুতে যেতে হলে আমার মা কিন্তু আব্বাকে বলতেন, কিছুক্ষণ তুমি নিজের ঘরে থাক। তাকে ঘরে নিয়ে তিনি একটা কথা বললেন, তোমার মনে যে কথা আসবে তুমি সে কথা বলবা। কারণ লাখো মানুষ সারা বাংলাদেশ থেকে ছুটে এসেছে, হাতে বাঁশের লাঠি, নৌকার বৈঠা নিয়ে। আর এদিকে পাকিস্তানি শাসকরাও অস্ত্র-টস্ত্র নিয়ে বসে আছে এই বলে যে, বঙ্গবন্ধু কী নির্দেশ দেন। তারপর মানুষগুলোকে আর ঘরে ফিরতে দেবে না, নিঃশেষ করে দেবে, স্বাধীনতার স্বাদ বুঝিয়ে দেবে। এটাই ছিল পাকিস্তানের সিদ্ধান্ত! আর সেখানে আমাদের কোনো কোনো নেতা বলে দিলেন যে, এখানেই বলে দিতে হবে, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। কেউ বলে, এটা বলতে হবে, ওটা বলতে হবে। মা বাবাকে বললেন, সারা জীবন তুমি সংগ্রাম করেছ, তুমি জেল-জুলুম খেটেছ, দেশের মানুষকে নিয়ে তোমার যে স্বপ্ন, বাংলার মানুষকে তোমার চেয়ে কেউ বেশি ভালোবাসে না, তোমার মনে যা আসে তুমি তাই বলবা।’

দেশ ও মানুষের জন্য তাঁর মায়ের অবদানের কথা তিনি তুলে ধরেছেন আরেকটি ঘটনা বর্ণনায়। সেটা আগরতলা মামলার সময় বঙ্গবন্ধুকে প্যারোলে মুক্তি দেওয়ার বিষয় নিয়ে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের নেতারা আবারও উঠেপড়ে লাগলেন, আইয়ুব খান গোলটেবিল বৈঠক ডাকলেন, সেখানে যেতে হবে, না গেলে সর্বনাশ হবে। মা খবর পেলেন। আমাকে পাঠালেন। বললেন, আমার সঙ্গে কথা না বলে কোনো সিদ্ধান্ত যেন উনি (বঙ্গবন্ধু) না দেন।’ আমাদের বড় বড় নেতারা সবাই ছিলেন, তারা নিয়ে যাবেন। আমার আব্বা জানতেন, আমার উপস্থিতি দেখেই বুঝে যেতেন যে, মা কিছু বলে পাঠিয়েছেন। মা খালি বলে দিয়েছিলেন, আব্বা কখনও প্যারোলে যাবেন না, যদি মুক্তি দেন তখন যাবেন। সে বার্তাটাই আমি পৌঁছে দিয়ে এসেছিলাম। আর তার জন্য আমাদের নেতারা বাসায় এসে বকাঝকা, ‘তুমি কেমন মেয়ে, তুমি চাও না তোমার বাবা বের হোক জেল থেকে?  মাকে বলতেন, ‘আপনি তো বিধবা হবেন।’ মা শুধু বলেছিলেন, ‘আমি তো একা না, এখানে তো ৩৪ জন আসামি। তারা যে বিধবা হবে এটা আপনারা চিন্তা করেন না?  আমার একার কথা চিন্তা করলে চলবে?  আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় ৩৫ জনের মধ্যে ৩৪ জনই তো বিবাহিত। মামলা না তুললে উনি যাবেন না।’

এ ঘটনায় বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের আরেকটি সাহসী পদক্ষেপের কথা জানা য়ায় মহিউদ্দিন আহমেদ'র ‘আওয়ামী লীগ : উত্থান পর্ব ১৯৪৮ থেকে ১৯৭০’ গ্রন্থে। এই গ্রন্থে ওই মামলার আসামি লেফটেন্যান্ট আবদুর রউফের উদ্ধৃতি দিয়ে ১৯০ নম্বর পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ... বঙ্গবন্ধুর প্যারোলে মুক্তির বিষয়ে আলোচনা চলছিল। এ সময় একদিন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বসে আছেন। একটি গাড়ি এসে থামল, যেটা থেকে নামলেন বেগম মুজিব। বঙ্গবন্ধু তাকে ভেতরে ডাকলে তিনি সেখানে দাঁড়িয়েই বললেন, শুনলাম, তুমি প্যারোলে যাচ্ছো? যদি এমন কিছু হয় তাহলে আমার নেতৃত্বেই এর প্রতিবাদী মিছিল বের হবে, যে মিছিলে থাকবে তোমার ছেলে-মেয়েরাও।’ এই একটি ঘটনাই গণতন্ত্র এবং স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য বঙ্গবন্ধুর আজন্ম লালিত যে স্বপ্ন সেটার প্রতি বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের আস্থা ও দৃঢ়তা সুস্পষ্টভাবে  জানান দেয়। আর  জীবনসঙ্গীনীর নিকট থেকে পাওয়া এমন জীবনীশক্তিই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন পূরণের পাথেয় হয়ে কাজ করেছে।

বঙ্গবন্ধু তাঁর আত্মজীবনীর প্রথম পাতা শুরু করেছিলেন সঙ্গী সহধর্মিণীর কথা দিয়ে। কেননা বেগম মুজিবের তাগিদেই আজ বহুভাষায় বিশ্ববাসীর কাছে উন্মুক্ত বঙ্গবন্ধুর নিজ হাতে লেখা ঐতিহাসিক গ্রন্থটি। বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবনের কাহিনি রচনার পেছনে স্ত্রীর যে উদ্যোগ ও উৎসাহ পেয়েছেন তাঁর বর্ণনায় লিখেছেন,-  " আমার সহধর্মিনী একদিন জেলগেটে বসে বলল, ‘বসেই তো আছ, লেখ তোমার জীবনের কাহিনি।’ বললাম, লিখতে যে পারি না; আর এমন কী করেছি যা লেখা যায়! আমার জীবনের ঘটনাগুলো জেনে জনসাধারণের কি কোনো কাজে লাগবে? কিছুই তো করতে পারলাম না। শুধু এইটুকু বলতে পারি, নীতি ও আদর্শের জন্য সামান্য একটু ত্যাগ স্বীকার করতে চেষ্টা করেছি।”

বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব শুধু লেখার কথা বলেই তার দায়িত্ব শেষ করেননি। তিনি রীতিমতো উদ্যোগ নিয়ে লেখার ব্যবস্থাও করে দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু তার আত্মজীবনীতে আরও উল্লেখ করেন, “আমার স্ত্রী যার ডাকনাম রেণু- আমাকে কয়েকটা খাতাও কিনে জেলগেটে জমা দিয়ে গিয়েছিল। জেল কর্তৃপক্ষ যথারীতি পরীক্ষা করে খাতা কয়টা আমাকে দিয়েছেন। রেণু আরও একদিন জেলগেটে বসে আমাকে অনুরোধ করেছিল, তাই আজ লিখতে শুরু করলাম।” বঙ্গবন্ধুকে লেখার অনুরোধ, লেখার ব্যবস্থার পাশাপাশি কঠিন পরিস্থিতিতেও তিনি এগুলো সংরক্ষণের জন্য যথাযথ পদক্ষেপ অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গেই গ্রহন করেছিলেন।

মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক বর্বররা বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বরের বাড়ী তছনছ করলেও কিভাবে সেখান থেকে বঙ্গবন্ধুর লেখা খাতাগুলো উদ্ধার করা হয়েছিলো সে প্রসঙ্গে ‘কারাগারের রোজনামচা’ বইয়ের ভূমিকায় বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার জবানি থেকে জানা যায়, ড. ওয়াজেদ সাহেব আণবিক কমিশনের অফিসার হওয়ায় অফিসে নিয়মিত আসা-যাওয়া করতেন, কিন্তু নজরদারি ছিল খুব। এদিকে বাচ্চারা স্কুলে যাবে, সঙ্গে ছিল না কোনো বই পুস্তক। পাকিস্তানি জওয়ানরা জানতে চেয়েছিল বই পুস্তক কোথায়? উত্তর দেওয়া হয়েছিল ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের বাসায়, আর যেটি ছিল পাকিস্তানি আর্মিদের দখলে। প্রসঙ্গক্রমে ৩২ নম্বর প্রবেশের অনুমতি পাওয়া গেল এবং সঙ্গে ছিলেন শেখ হাসিনা। সেই কঠিন থেকে কঠিনতম সময়ে বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব তার প্রিয় কন্যা শেখ হাসিনাকে বলেছিলেন, “একবার যেতে পারলে আর কিছু না হোক, তোর আব্বার লেখা খাতাগুলো যেভাবে পারিস নিয়ে আসিস।” এবং খাতাগুলো কোথায় পাবে বা কোথায় রাখা আছে সেটিও সুনির্দিষ্টভাবে বলেছিলেন। শেখ হাসিনা তার লেখায় আরও উল্লেখ করেছেন, “বঙ্গবন্ধু যেদিন জেল থেকে মুক্তি পেতেন, জেলগেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতেন ফজিলাতুন্নেছা মুজিব এবং বঙ্গবন্ধুর লেখা খাতাগুলো যেন ঠিকভাবে ফেরত আসে সে-বিষয়ে তিনি নজর রাখতেন।”

ফজিলাতুন্নেছা সম্বন্ধে একান্ত সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু বলেন, “আমার স্ত্রীর মতো সাহসী মেয়ে খুব কমই দেখা যায়। আমাকে যখন পিন্ডির ফৌজ বা পুলিশ এসে জেলে নিয়ে যায়, আমার ওপর নানা অত্যাচার করে, আমি কবে ছাড়া পাব বা কবে ফিরে আসব ঠিক থাকে না, তখন কিন্তু সে কখনো ভেঙে পড়েনি। আমার জীবনে দুটি বৃহৎ অবলম্বন। প্রথমটা হলো আত্মবিশ্বাস, দ্বিতীয়টা হলো আমার স্ত্রী আকৈশোর গৃহিণী।”

১৯৩০ সালের ৮ আগস্ট ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের (ডাক নাম রেণু) জন্ম। পিতা শেখ জহুরুল হক ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমানের জ্ঞাতি সম্পর্কের চাচা এবং গ্রামের বর্ধিষ্ণু কৃষক পরিবার।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর আত্মজীবনীতে উল্লেখ করেছেন, ‘একটা ঘটনা লেখা দরকার, নিশ্চয়ই অনেকে আশ্চর্য হবেন। আমার যখন বিবাহ হয় তখন আমার বয়স বারো-তেরো বছর হতে পারে। রেণুর বাবা মারা যাবার পরে ওর দাদা আমার আব্বাকে ডেকে বললেন যে আমার সাথে তার এক নাতনির বিবাহ দিতে হবে। কারণ তিনি তাঁর সমস্ত সম্পত্তি ওদের দুই বোনকে লিখে দিয়ে যাবেন। রেণুর দাদা আমার আব্বার চাচা। মুরব্বির হুকুম মানার জন্যই রেণুর সাথে আমার বিবাহ রেজিস্ট্রি করে ফেলা হলো। আমি শুনলাম আমার বিবাহ হয়েছে। তখন কিছুই বুঝতাম না, রেণুর বয়স তখন বোধ হয় তিন বছর হবে। রেণুর যখন পাঁচ বছর বয়স তখন তার মা হোসনে আরা বেগম মারা যান। একমাত্র রইল তার দাদা। রেণুর সাত বছর বয়সে দাদাও মারা যান। তারপর সে আমার মায়ের কাছে চলে আসে। রেণুদের ঘর আমার ঘর পাশাপাশি ছিল, মধ্যে মাত্র দুই হাত ব্যবধান।’

শেখ মুজিবের মা বেগম সায়রা খাতুন মাতৃহীন রেণুকে ঘরে তুলে নেন এবং নিজের ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে শিক্ষাদীক্ষা ও গৃহকর্মে বড় করে তোলেন। শৈশব থেকেই রেণু শেখ মুজিবসহ পরিবারের ছোট-বড় সব সদস্যের কাছে নিজেকে অতি আপন হিসেবে গড়ে তুলতে সচেষ্ট ছিলেন। বিশেষ করে বড় সন্তান খোকা (শেখ মুজিবের ছোটবেলার ডাকনাম), যার সঙ্গে তার বিশেষ সম্পর্ক, তাঁর চলাফেরা, কিশোর বয়স থেকেই নানা কর্মকাণ্ড, খানিকটা দুরন্তপনা, বেপরোয়া ও সাহসী মনোভঙ্গি কিশোরী ফজিলাতুন্নেছা রেণুর জন্যও বড় হওয়ার প্রেরণা ও মুগ্ধতার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।

প্রাথমিক জীবনে নিজের লেখাপড়া বেশিদূর না এগোলেও স্বামীর শিক্ষার ব্যাপারে তাঁর নজর ছিল অতন্দ্র।

বঙ্গবন্ধু লিখেছেন “কলকাতা যাব, পরীক্ষাও নিকটবর্তী। লেখাপড়া তো মোটেই করি না। ভাবলাম কিছুদিন লেখাপড়া করব। মাহিনা বাকি পড়েছিল, টাকা-পয়সার অভাবে। রেণুর কাছে আমার অবস্থা প্রথমে জানালাম। আব্বাকে বললে তিনি অসন্তুষ্ট হলেন মনে হলো। কিছুই বললেন না। টাকা দিয়ে আব্বা বললেন, ‘কোনো কিছুই শুনতে চাই না। বিএ পাস ভালোভাবে করতে হবে। অনেক সময় নষ্ট করেছ, ‘পাকিস্তানের আন্দোলন’ বলে কিছুই বলি নাই। এখন কিছুদিন লেখাপড়া কর।’ আব্বা-মা, ভাই-বোনদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রেণুর ঘরে এলাম বিদায় নিতে। দেখি কিছু টাকা হাতে করে দাঁড়িয়ে আছে। ‘অমঙ্গল অশ্রুজল’ বোধ হয় অনেক কষ্টে বন্ধ করে রেখেছে। বলল, ‘একবার কলকাতা গেলে আর আসতে চাও না। এবার কলেজ ছুটি হলেই বাড়ি এসো।’” প্রয়োজনে নিজের জমির ধান বিক্রির টাকা দিয়ে তিনি নিয়মিত স্বামীকে সহযোগিতা করে গেছেন। স্বামীর পাশে থেকে মানবতার জন্য কাজ করে গেছেন। জীবনে ঝুঁকি নিয়েছেন বহুবার। আড়াল থেকেই তিনি বাংলার মানুষের সেবা করে গেছেন আজীবন।

বেগম ফজিলাতুন্নেচ্ছা মুজিব অতিথি আপ্যায়নে অত্যন্ত যত্নশীল ছিলেন। তাঁদের বাড়িতে যে ই আসত, তাকেই খাবার টেবিলে বসানো হতো। সব সময়ই বেশি করে রান্নাবান্না করা হতো।  বঙ্গবন্ধুর বাড়ীতে রাজনৈতিক মিটিংগুলোতে উপস্থিত সকলকে নিজ হাতেই রান্না করে খাওয়াতেন তিনি।  নিত্যদিনের অপার স্নেহ মমতার মিশেলে অতিথি আপ্যায়ণের অনেক টুকরো টুকরো স্মৃতি বিভিন্ন সময় বিভিন্নজনের বক্তব্যে উঠে এসেছে। বঙ্গবন্ধুর একান্ত সচিব এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা  ড. মসিউর রহমানের কয়েকটি বক্তৃতায় তার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন এভাবে- “বেগম মুজিবের সাথে টুঙ্গিপাড়ায় গেলে বিশিষ্ট অতিথির আপ্যায়ন পাওয়া ছিল সাধারণ নিয়ম। সময়মতো খাওয়া হয়েছে কি না, খাওয়া ঠিক ছিল কি না, তিনি তার খবর নিতেন। আমি আমার এক বিব্রতকর অভিজ্ঞতার কথা বলছি। বঙ্গবন্ধু তখন বাইরে। বঙ্গবন্ধুর বাবার শরীর খারাপ। বেগম মুজিব বাড়িতে গেলেন। আমি যাবার ব্যবস্থা তদারকির জন্য সাথে। খাবারের সময় নিজে এলেন, হাতে পাখা।… আমি কয়েকবার জানাই আমার খাবার কোনো অসুবিধা হচ্ছে না, অন্যরা দেখাশোনা করছে, তার থাকার দরকার নাই। খাওয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত তিনি বসে থাকলেন। আমি প্রধানমন্ত্রীর কর্মকর্তা নই, তার বাড়ির অতিথি।”

বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ রেহানা স্মৃতিচারণ করেছেন, “তিনি বাবাকে শত দুঃখ-কষ্টেব মধ্যে অনুপ্রাণিত করেছেন। গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বিষয়ে মার ইতিবাচক সমর্থন ছিল।” (“আমার মা ফজিলাতুন্নেছা”, শেখ রেহানা, বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব স্মারক গ্রন্থ, সম্পাদনায় ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী, বৈশাখী প্রকাশনী, ১৯৯৮, পৃ-২৪”)

একটি দৈনিকে প্রকাশিত লেখায় শেখ রেহানা তাঁর মায়ের কথা বলতে যেয়ে লিখেছেন, ‘আর আমার মা! তাঁর কথা ভাবি। কত অল্প বয়সে বিয়ে হয়েছে। মাত্র ৪৪ বছর বয়সে তো তিনি আমাদের ছেড়ে চলেই গেলেন। কত অল্প বয়সে এতগুলো ছেলেমেয়ে নিয়ে তাঁকে জীবন-সংগ্রামে নেমে পড়তে হয়েছিল। আব্বা আগের দিন মন্ত্রী, পরের দিন জেলখানায়; বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে সরকারি বাসা ছেড়ে দিতে হয়েছে, কিন্তু কেউ মাকে বাসা ভাড়া দিচ্ছে না, আমার তখনো জন্ম হয়নি, কিন্তু এসব ঘটনা তো শুনেছি, পড়েছি, পরে নিজের চোখে দেখেছি। গ্রামে জন্ম হওয়া একজন সাধারণ নারী আমার মা, ক্লাস ফোর-ফাইভ পর্যন্ত পড়েছেন মিশনারি স্কুলে। কিন্তু কী যে প্রজ্ঞা, কী যে তাঁর ধৈর্য। আমার মায়ের কাছে আমাদের যে জিনিসটা সবার আগে শেখা উচিত, তা হলো ধৈর্য আর সাহস। সবাইকে এক করে রাখা। এতগুলো লোক বাড়িতে খাচ্ছে, দাচ্ছে, আমাদের গ্রামে কোন মেয়ে ম্যাট্রিক পাস করেছে, তাকে এনে ঢাকায় কলেজে ভর্তি করে দাও, কাকে বিয়ে দিতে হবে! সব সামলাচ্ছেন। এর মধ্যে আমাদের সকালে কোরআন শরিফ পড়া শেখাতে মৌলভি সাহেব আসছেন, তারপর নাচ শিখছি, সেতার শিখছি, বেহালা শিখছি- সব কিন্তু মায়ের সিদ্ধান্ত। কিন্তু তাঁর নিজের বয়স কত! আমার তো মনে হয়, আমার মা কি কোনো দিন তাঁর শৈশবে কিংবা কৈশোরে একটা ফিতা বা রঙিন চুড়ি চেয়েছেন কারও কাছে! মা-ই তো  সব থেকে বঞ্চিত ছিলেন। অথচ তিনি হাসিমুখে সব সামলাচ্ছেন।’

বেগম মুজিবের ধৈর্য ছিল। আন্তরিকতা ছিল। উদারতা ছিল। সংসারের হাত শক্ত করে ধরার ক্ষমতা আর দক্ষতা ছিল। ছিলেন রাজনীতি সচেতন বিচক্ষণ ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন। কামরুদ্দীন আহমদ তাঁর বইয়ে লিখেছিলেন, বঙ্গবন্ধু জাতির জনক হতে পেরেছিলেন বেগম মুজিবের সমর্থনের কারণে। বেগম মুজিব কখনো বলেননি, তুমি রাজনীতি কোরো না, তুমি জেলে গেলে আমাদের কী হবে। বরং বলেছেন উল্টোটা। তুমি দেশের জন্য কাজ করো, আমাদের কথা ভেবো না।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাষায়- “জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত পাশে ছিলেন। যখন ঘাতকরা আমার বাবাকে হত্যা করল, তিনি তো বাঁচার আকুতি করেননি। তিনি বলেছেন, “ওনাকে যখন মেরে ফেলেছ আমাকেও মেরে ফেল।”
এভাবে নিজের জীবনটা উনি দিয়ে গেছেন। সবাইকে নিয়ে চলে গেলেন” (“আমার মা: বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব”, শেখ হাসিনা, ৮ আগস্ট, ২০১৬, ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের ৮৬তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে মা’কে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ )

স্বামী-সংসার ভালোভাবে আগলে রেখেও এই বাঙালি নারী শোষিত-নিপীড়িত জনসাধারণকে মুক্তির চেতনায় জাগিয়ে তোলার সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর পাশে থাকা সহযোদ্ধা হিসেবে বিশ্বের কাছে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন বেগম মুজিব। বঙ্গমাতা তাঁর বুদ্ধি, দূরদর্শিতা এবং রাজনীতি সম্পর্কে বাস্তবচিত মূল্যায়ন এবং সুচিন্তিত সিদ্ধান্তের কারণে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র।

বঙ্গবন্ধুর বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠার পরতে পরতে রয়েছে বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের কাছ থেকে পাওয়া শক্তি, সাহস আর প্রেরণা। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিভিন্ন আন্দোলন, মহান মুক্তিযুদ্ধ কিংবা তার পরে দেশ পুনর্গঠনেও পাওয়া যায় বেগম মুজিবের মানবিকতা, বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতার সুস্পষ্ট পরিচয়। যদিও আজন্ম নিরবে নিভৃতিতেই কাজ করে গেছেন মহিয়সী নারী, সাহসী স্ত্রী,আদর্শ গৃহবধু এবং রত্নগর্ভা মা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব।

কবি নজরূলের কবিতার ভাষাই এক্ষেত্রে তাই যথার্থ-
“জগতের যত বড় বড় জয় বড় বড় অভিযান
মাতা ভগ্নী ও বধূদের ত্যাগে হইয়াছে মহীয়ান
কোন রণে কত খুন দিল নর, লেখা আছে ইতিহাসে,
কত নারী দিল সিঁথির সিঁদুর, লেখা নাই তার পাশে।
কত মাতা দিল হৃদয় উপাড়ি কত বোন দিল সেবা,
বীরের স্মৃতি-স্তম্ভের গায়ে লিখিয়া রেখেছে কেবা?

লেখক: সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় অর্থ ও পরিকল্পনা উপ-কমিটি

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত